পরের দিন সকালের দিকে সুব্রত ও মৃণাল সেন বালিগঞ্জে মহেন্দ্রনাথের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হল। মৃণাল সেন ইতিপূর্বে ঐ বাড়িতে আসেনি বটে তবে সুব্রত চিনত।
ধনী ব্যক্তি মহেন্দ্রনাথ।
বালিগঞ্জে লেকের কাছে গড়িয়াহাট অঞ্চল সেই যুদ্ধের সময়ে তেমন ডেভালাপড হয়নি।
অনেক নারকেল বাগান, জঙ্গল ও ধানজমি।
তারই মধ্যে এদিকে-ওদিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে লেককে কেন্দ্র করে কিছু কিছু পয়সাওয়ালা লোক বেশ কিছুটা করে জায়গা নিয়ে বড় বড় বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করেছেন।
মহেন্দ্রনাথ তাঁদেরই অন্যতম।
বুদ্ধিমান চতুর ব্যবসায়ী তিনি। জানতেন ও বুঝতে পেরেছিলেন ক্রমশ ঐ অঞ্চলটা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে—লেকের জৌলুসে বিশেষ একটি এলাকায় পরিণত হবে।
সুব্রতরা যখন মহেন্দ্রনাথের বালিগঞ্জের ভবনে এসে পৌঁছাল তখন বেলা আটটা হবে। দরোয়ান মৃণাল সেনের পুলিসের পোশাক দেখে তাকে আটকাল না। গেট খুলে দিল।
গেট দিয়ে ঢুকে সোজা ওরা এসে পোর্টিকোর সামনে গাড়ি থামাল। বাড়িটা অনেকখানি জায়গা নিয়ে। সামনে বেশ খানিকটা বাগান, তাছাড়া টেনিস লনও আছে।
বাড়িটা যেন অত্যন্ত নিস্তব্ধ। কোথাও কোন যেন সাড়াশব্দ নেই।
সুব্রত কলিংবেলটা টিপল।
একটু পরেই উর্দিপরা একজন বেয়ারা বের হয়ে এল।
কাকে চান?
সুরেনবাবু বাড়িতে আছেন? সুব্রতই প্রশ্ন করে।
আছেন।
একবার ডেকে দাও তো।
ভিতরে এসে বসুন।
মনে হল যেন মৃণাল সেনের, পুলিসের ইউনিফর্ম দেখে বেয়ারা একটু অবাকই হয়েছে। সে তাদের এনে ড্রইংরুমে বসাল।
ড্রইংরুমটি সুন্দরভাবে সাজানো।
দামী সোফা-পুরু কার্পেট মেঝেতে। দেওয়ালে দু-চারটি দামী ল্যান্ডস্কেপ।
সুব্রত ও মৃণালকে বেশিক্ষণ বসে থাকতে হল না।
একটু পরেই সুশ্রী, বেশ বলিষ্ঠগড়ন এক যুবক ঘরে এসে ঢুকল।
সুব্রতকেই লক্ষ্য করে যুবক বলে ওঠে, কতক্ষণ এসেছ?
এই আসছি। লেট মি ইনট্রোডিউস, ইনি মৃণাল সেন ইন্সপেক্টার, তোমার দাদার ব্যাপারটা ইনিই তদন্ত করছেন। মিঃ সেন—এই সুরেন, মহেন্দ্রনাথের ছোটভাই, আর্টিস্ট।
মৃণাল সেন দেখছিল। আদৌ আর্টিস্টের মত চেহারা নয় সুরেন্দ্রনাথের। বরং পালোয়ান বা অ্যাথলেটের মত চেহারাটা।
পরনে পায়জামা ও গরম পাঞ্জাবি। পায়ে চপ্পল।
মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা।
কঠিন চোয়াল, খাড়া নাক। হাতের কজি বেশ মোটা—আঙুলগুলো মোটা মোটা।
সুরেন, মিঃ সেন তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান। সুব্রত বলে।
বেশ তো-বলুন না—উনি কি জানতে চান। সুরেন্দ্র মৃদুকণ্ঠে বললে।
আপনি তো এই বাড়িতেই থাকেন?
মৃণাল সেনের প্রশ্নে তার মুখের দিকে তাকিয়ে সুরেন্দ্র মৃদুকণ্ঠে বলে, হ্যাঁ।
আচ্ছা মিঃ রায়, শনিবার দুর্ঘটনার দিন তার সঙ্গে শেষ কখন আপনার দেখা হয়েছিল?
বেলা তখন পৌনে পাঁচটা হবে-বেরুচ্ছিলেন তিনি। পোর্টিকোতে আমার সঙ্গে দেখা।
তাহলে সেদিন তিনি অফিস থেকে বাড়িতে এসে তারপর আগরপাড়া গিয়েছিলেন?
সেই রকমই মনে হয়।
আপনার সঙ্গে আপনার দাদার সে-সময় কোন কথা হয়েছিল?
না।
আচ্ছা মিঃ রায়, সেদিন যাবার সময় আপনার দাদার পরনে কী জামা-কাপড় ছিল মনে আছে নিশ্চয়?
আছে। গরম সুট পরনে ছিল। আর হাতে ছিল গ্রেট কোটটা।
কি রঙের?
কালো রঙের।
হাতে আর কিছু ছিল না?
হ্যাঁ, আর ফোলিও ব্যাগটা ছিল।
পায়ে কি জুতো ছিল?
কালো ডার্বি সু।
আচ্ছা সুরেন–
সুব্রতর ডাকে সুরেন্দ্র এবারে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।
তোমাকে সেদিন একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তোমার দাদার উইলের ব্যাপারটা কিছু জান–মানে উইলে কি ভাবে তিনি তার সম্পত্তি ভাগ করে গেছেন।
না।
ঐ একটি মাত্র শব্দের মধ্যে দিয়ে যেন সুব্রতর মনে হল বেশ একটা বিরক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল।
তুমি জান না কিছু?
না। হি ওয়াজ এ পিকিউলিয়ার সর্ট অফ ম্যান-বিচিত্র স্বভাবের এক লোক ছিলেন। আমাদের কারও পরে—এমন কি নিজের সন্তানদের পরেও তার কোন মায়ামমতা ছিল না। সেক্ষেত্রে যদি শুনি তিনি তার সব কিছু থেকে আমাদের সকলকেই বঞ্চিত করে গিয়েছেন-ওয়েল-ইট ওন্ট বী এ সারপ্রাইজ অ্যাট অল টু এনি অফ আস-আমরা কেউ এতটুকুও বিস্মিত হব না। আর হয়ত তাই কিছু করেছেন।
একথা তো তুমি আমায় বলনি সুরেন। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদেরও কি তেমন স্নেহের চোখে দেখতেন না?
তাই যদি হত তাহলে কি ছেলেমেয়েরা স্ত্রীর মৃত্যুর পর মামার বাড়িতে চলে যেত এবং কুন্তলা সেখানেই কি মানুষ হত। আসলে মানুষটা ছিল অত্যন্ত সেলফিশ-স্বার্থপর।
তার স্ত্রী কতদিন হল মারা গেছেন?
বৌদি?
হ্যাঁ।
কুন্তলার যখন আট বছর বয়স সেই সময়ে মারা যান বৌদি দীর্ঘদিন পরে আবার সন্তান হতে গিয়ে। সৌরীন-দাদার বড় ছেলের বয়স তখন ষোল ও ছোট ছেলে ভবেনের বয়স ছিল বোধ করি বারো-তেরো।
এমন তো হতে পারে সুরেন, তোমার দাদা তোমাদের বৌদিকে অত্যন্ত ভালবাসতেন, তাই তার মৃত্যুতে সংসার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে?
কে জানে? হয়ত ভালবাসতেন!
হুঁ। তোমার ভাইঝি বাড়িতে আছেন?
কে, কুন্তলা?
হ্যাঁ।
আছে। মিঃ সেন তার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চান।
বেশ তো–তোমরা বোস—আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি তাকে।
সুরেন্দ্র উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মৃণাল সেন সুরেন্দ্রর গমনপথের দিকে চেয়ে থাকে।
.
০৯.
কুন্তলা এল।
প্রায় নিঃশব্দেই এসে যেন কুন্তলা ঘরে প্রবেশ করল।