গাড়ি চলতে শুরু করে। সুব্রত গাড়ি চালাচ্ছিল-স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে সামনের দিকে চেয়েছিল সে যেন একটু অন্যমনস্ক। মৃণাল সেন পাশেই বসেছিল।
জলধর বললেন, আমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবেন স্যার।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। সুব্রত মৃদুকণ্ঠে বলে।
থানায় জলধর চাটুজ্যেকে নামিয়ে দিয়ে ওরা বি. টি. রোড ধরে। বেলা তখন প্রায় সাড়ে বারোটা হবে।
এ সময়টা বি. টি. রোডে ট্রাফিকের একটু ভিড়ই থাকে। বিশেষ করে যুদ্ধের সময় মিলিটারি ট্রাকের ও জীপের চলাচলটা একটু বেশিই।
অনেকগুলো ইউনিট ও ক্যাম্প ব্যারাকপুরে-মিলিটারিদের যাতায়াতও তাই একটু বেশি বি. টি. রোডে।
ভদ্রলোককে কেমন মনে হল সুব্রতবাবু? মৃণাল সেন প্রশ্ন করে। তদন্তে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেল ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে।
কি?
ভদ্রলোক ঐ টাইপ করা চিঠিটা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। উনি কিছুই জনেন না ও সম্পর্কে।
কিন্তু আমার মনে হয় কথাটা উনি মিথ্যে বলেছেন।
মিঃ সেন, মিঃ গাঙ্গুলী মিথ্যে বলেননি। কারণ সত্যিই ওঁর মহেন্দ্র রায়কে আগরপাড়ায় ডেকে আনবার জন্য কোন চিঠি লেখবার প্রয়োজন ছিল না।
ছিল না বলতে চান!
হ্যাঁ। তা যদি থাকত তো উনি এত সহজে চিঠি দুটো আমাকে দিয়ে দিতেন না। তাছাড়া টাইপ করতে জানলেও এবং টাইপিং মেসিন থাকলেও বন্ধুকে একটা একান্ত। ব্যক্তিগত চিঠি টাইপ করে কেউ সাধারণত দেয় না। এক্ষেত্রে তাই মনে হচ্ছে, হত্যাকারী অত্যন্ত চালাক—সে জানত ঐ এক ঢিলেই হয়ত পাখি কাত হবে।
কি বলছেন?
ব্যাঙ্কের চিঠির ব্যাপার যখন ঐ চিঠির মধ্যে উল্লেখ করা ছিল তখন হত্যাকারী জানত সুনিশ্চিত ভাবেই যে মহেন্দ্রনাথ অমন একটা চিঠি পেয়ে রীতিমত ইন্টারেস্টেড হয়ে উঠবেন এবং যাবেনও বন্ধুর কাছে। তারপর সমস্ত ব্যাপারটা ভেবে দেখুন, কতখানি ভেবে কাজ করেছে হত্যাকারী। প্রথমত, শনিবারটা সে বেছে নিয়েছিল এবং সময়টা সন্ধ্যার দিকে। কারণ সে জানত শনিবারে ডেলি প্যাসেঞ্জারদের তিনটে সাড়ে তিনটের পর আর ভিড় থাকবে না। এই গেল এক নম্বর। দুই নম্বর, হত্যাকারী মহেন্দ্রনাথকে ভাল করেই চিনত এবং এও জানত তিনি সন্ধ্যার পর তার অন্ধপ্রায় ড্রাইভারকে নিয়ে বেরুবেন না—গেলে ট্রেনেই যাবেন। তারপর তৃতীয় নম্বর, মহেন্দ্রনাথ ট্রেনে গেলেও চারটার পর যাবেন। কারণ শনিবারেও তিনি বিকেল সাড়ে চারটা পাঁচটা পর্যন্ত অফিসের কাজ করতেন। অতএব যেতে যেতে যাঁর সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে।
শীতের ছোট বেলা, সাড়ে পাঁচটাতেই অন্ধকার হয়ে যায়। এবং শনিবার চারটের পর যে ট্রেনটা আগরপাড়া হয়ে যায় সেটা পৌনে আটটা নাগাদ আগরপাড়া পৌঁছায়। শনিবার ঐ সময়টা স্টেশনে তেমন ভিড়ও থাকে না। কাজেই–
কি?
কেউ যদি ঐ সময় স্টেশনে এসে মিঃ গাঙ্গুলীকে রিসিভ করে তবে তিনি সঙ্গে যাবেন এবং বড় একটা কারও সেটা নজরে পড়বে না। বুঝতে পারছেন বোধহয় মিঃ সেন, আমি কি বলতে চাইছি। হত্যাকারী মহেন্দ্রনাথকে স্টেশনে কাউকে দিয়ে রিসিভ করায়, তারপর তাকে বলে হয়ত, মিঃ গাঙ্গুলী পাঠিয়ে দিয়েছেন তাকে নিয়ে যেতে। ধরুন লোকটা যদি একটা সাইকেল-রিকশাওয়ালাই হয় মহেন্দ্র নিশ্চয়ই ঐ রিকশাওয়ালার সঙ্গে যাবেন, কারণ ইতিপূর্বে তিনি কখনও আগরপাড়ায় সলিটারি কর্নারে আসেননি, পথ চেনেন না। বরং খুশিই হবেন মিঃ গাঙ্গুলী লোক পাঠিয়েছেন দেখে, তারপর ব্যাপারটা ভেবে নিন—অন্ধকারে পথের মাঝখানে হত্যাকারী ওৎ পেতে ছিল-মহেন্দ্রনাথকে ক্লোজ রেঞ্জ থেকে গুলি করা এমন কিছু একটা শক্ত কাজ নয়।
কিন্তু—
ভাবছেন বোধ হয় গুলির শব্দটা, তাই না? কিন্তু তাও তো চাপা দেওয়া যেতে পারে। ধরুন যদি রিভলবারের সঙ্গে সাইলেন্সর লাগানো থাকে কিংবা রাস্তাটা নির্জন–হয়ত কারও কানে পৌঁছায়নি শব্দটা।
তা যেন হল কিন্তু মৃতের মুখটা অমন করে মিউটিলেট হল কি করে?
আমার অনুমান, সাধারণত শনিবার রাত্রে মিল থেকে যে সব ওয়াগান ভর্তি করে সেগুলো গুডস্ ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। তেমনি কোন ওয়াগনের ট্রাক্সন হুকের সঙ্গে হয়ত হত্যাকারী মৃতদেহটা আটকে দিয়েছিল বা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। ওয়াগন চলার সময় হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ঐভাবে মুখটা ও পরিধেয় জামা-কাপড় ক্ষতবিক্ষত ও ছিন্নভিন্ন হয়েছে যাতে করে মৃতদেহ দেখলে, পুলিসের মনে হয় ব্যাপারটা স্রেফ একটা আত্মহত্যা-মার্ডার নয় আদৌ।
তাহলে আপনি বলতে চান, হত্যাকারী মহেন্দ্রনাথকে বেশ ভালভাবেই চিনত—তার হ্যাবিটস্ পর্যন্ত জানত?
নিশ্চয়ই। এখন নিশ্চয়ই হত্যাকারীর একটা রূপ আপনি কল্পনা করতে পারছেন মিঃ সেন মনে মনে!
হ্যাঁ, কিছুটা আমার মনে হচ্ছে—
কি? মিঃ গাঙ্গুলীকেও এক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে না।
কেন?
মহেন্দ্রনাথের কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছিলেন। ধরুন সেই টাকা যাতে করে শোধ আর না দিতে হয় তাই–
না, যে বন্ধুকে অমন করে টাকা দিতে পারে তার ধারের ব্যাপারে চিন্তার কোন কারণ থাকতে পারে না। ভাল কথা, মহেন্দ্রনাথের বালিগঞ্জের বাড়িতে একবারও কি গিয়েছেন?
না।
সেখানে কিন্তু একবার আপনার যাওয়া উচিত ছিল।
যাব ভাবছি কাল।
হ্যাঁ চলুন, দুজনাই একসঙ্গে যাব—তার দুই পুত্র ও কন্যা সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার।