আম্মান থেকে ১২ মাইল উত্তরে জর্দান নদী থেকে ২০ মাইল পূর্বে একটি সংকীর্ণ পার্বত্য উপত্যকার পাশে পর্বত গাত্রের কয়েকটি গোপন প্রকোষ্ঠ আলোকিত হয়ে উঠেছে। পর্বত গুহার চতুর্দিকে মাইলের পর মাইল ধরে ‘সাইমুম’ মুক্তি সেনার ঘাঁটি ও পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ছড়িয়ে আছে। এখান থেকে পরিচালিত গেরিলাভিযান ইসরাইলের ইলাত থেকে গাজা, হাইফা থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত ইহুদী সম্রাজ্যবাদীদের সুখনিদ্রাকে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। রাতের অন্ধকারে রাইফেল নিয়ে পাহারায় বসতেও তাদের বুক আজ দুরু দুরু করে। যেন তার বুঝতে পারছে, হিসাবের দিন আসন্ন। প্যালেষ্টাইনী মুসলমানদের প্রতিটি ফোটা রক্তের শোধ আজ তাদের দিতে হবে।
উজ্জ্বল প্রকোষ্ঠগুলির একটিতে বিরাট এক গোল টেবিলের চারদিকে চেয়ার পাতা। ঘরের প্রতিটি চিনিস ঝকঝক তকতক করছে। টিবিল ঘিরে ১০ টি চেয়ার। ৮ জন লোক বসে আছে। এক পাশের দু’টি চেয়ার তখন ও খালি – একটি হাসান তারিকের অপরটি মেজর জেনারেল আলী এফেন্দির। হাসান তারিক নিখোঁজ। আর আলী এফেন্দী এখনো পৌঁছুতে পারেনি। সাইমুমের তিনজন সদস্য ছাড়াও যারা আজকের বৈঠকে এসছে, তারা হলো আফ্রিকার দু’ জন, তুরষ্ক থেকে একজন। UMLLA কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের পাঠানো রিপোর্ট পড়ছিলেন আফ্রিকার অন্যতম প্রতিনিধি আবদুর রহমান। এ শীতের রাতেও তার কপালে জমে উছেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আহমদ মুসার মুখ নিচু। তন্ময়তার কোন অতল গভীরে যেন হারিয়ে গেছে সে। আবদুর রহমান তাঁর রিপোর্টে বলছিলেনঃ -‘‘আফ্রিকার মোট ৩২২০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা হল ১৯৪ মিলিয়ন। আর বহিরাগত ঔপনিবেশিক খৃষ্টানদের নিয়ে মোট খৃষ্টান জনসংখ্যা হল ৪৭ মিলিয়ন। এ খৃষ্টানরা দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। এ অঞ্চলের কোন মুসলিম দেশেই এদের সংখ্যা ১৫% এর বেশী নয়। অথচ এ সামান্য সংখ্যক হয়েও তারা স্বগোত্রীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ইথিওপিয়া, চাঁদ, মালি, নাইজেরিয়া, তানজানিয়া, ঘানা, সিয়েরলিওন, ডাহোমী, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, আপার ভোল্টা, আইভরি কোষ্ট, সেগোল প্রভৃতি মুসলিম দেশে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ আর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশে শিক্ষার দ্বার মুসলমানদের জন্য প্রায় অবরুদ্ধ। অবশ্য কোন মুসলিম সন্তান যদি একান্তই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখনও ঢুকবার সুযোগ পায়, তাহলে তাকে মুসলমান নাম বদল করে খৃষ্টান নাম গ্রহণ করতে বাধ্য হন এবং অবশেষে খৃষ্টানই হয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক কায়কারবার ব্যাবসায় বাণিজ্যের সব সুযোগই খৃষ্টানদের কুক্ষিগত। রাজনীতি ক্ষেত্রে মুসলমানরাতো অস্পৃশ্য। এভাবে সর্বমুখী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়ে মুসলমানদের অস্তিত্ব আজ নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে, এসব কিছুর উপরে রয়েছে আবার রাজনৈতিক নির্যাতন। মাত্র কিছুদিন আগে চাদের লিবারেশন ফ্রন্টের সহস্র সহস্র কর্মীকে অমানুষিক যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ইথিওপিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদেরকে হত্যা করে গাছে গাছে লটকিয়ে রাখা হয়েছিল যা দেখে নিরপেক্ষ বিদেশীরাও চোখের পানি রোধ করতে পারেনি। জাঞ্জিবারের মুসলিম জননেতা কাশিম হাঙ্গা, আলি মহসিন, সালাম বাম্ব, ইবনে সালেহ্ আবদার জুমা, খাতির মুহাম্মদ সামত, জুমা আলই, আমিরাল আল্লারখিয় বছরের পর বছর ধরে কারাগারে যন্ত্রণা ভোগ করেছে। শুধু তাঞ্জানিয়ার কারাগারেই নয়, এমনই সহস্র সহস্র নরনারী আফ্রিকার বিভিন্ন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
আমরা ঠেকে ঠেকে বুঝেছি এবং একথা আমরা নিশ্চিতভাবে আজ বিশ্বাস করি যে, ভিক্ষা করে সুবিচার আদায় করা যাবে না কিংবা আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচারের মহড়াও এসব নির্যাতিত মানুষের কোন কাজে আসবে না। মজলুম মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ -সংগ্রাম। এ সংগ্রামকে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের আবেদন ৫ টিঃ
(১) দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সাহায্য।
(২) মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র – শস্ত্রের সরবরাহ।
(৩) আহত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা।
(৪) মুক্তিযোদ্ধাদের শিক্ষা ও ট্রেনিং এর জন্য উপদেষ্টা প্রেরণ।
(৫) সাইমুম কর্তৃক নির্যাতিত মানুষের মুক্তি আন্দোলন গুলোর নেতৃত্ব গ্রহণ।
সুদীর্ঘ দশ পৃষ্ঠাব্যাপী লিখিত রিপোর্ট শেষ করলেন আবদুর রহমান। কয়েক মুহূর্ত সবাই চুপচাপ। ধীরে ধীরে টেবিলে রাখা আফ্রিকার একটি বিশেষ মানচিত্র থেকে মুখ তুলল আহমদ মুসা। আর লিবিয়া ও চাদের পর্বতমালাকে আপনাদের প্রধান ও স্থায়ী ঘাঁটি হিসেবে মনোনীত করেছেন কোন কারণে? এর চেয়ে সমুদ্র কুলবর্তী কোন স্থানকে নির্বাচন করলে যুক্তিযুক্ত হতো না কি?
আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তর দিতে এগিয়ে এলেন আবু বকর সেনৌসি। তিনি বললেন এর কারণ তিনটি। প্রথম কারণ উভয় স্থানই অত্যন্ত দুর্গম এবং যে কোন বিরূপ মনোভাবাপন্ন শত্রু রাজধানী থেকে বহুদূরে। শুধু স্থান দুটি ভৌগলিক দিক দিয়ে দুর্গমই নয়, এর চারিদিকে হাজার হাজার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন পার্বত্য আর বেদুঈন গোত্র। তারা আমাদের বন্ধু এবং আমাদের সংগ্রামী শক্তির বিশিষ্ট অঙ্গ।