শফিক দ্রুত চলে গেল ওদের কাছে। পকেটে রিভলভার, সিগারেট কেস, লাইটার, হাত বোমা ছাড়া অন্য কোন কাগজ পত্র পেলনা।
গাড়ীতে একটি সাব মেশিনগার, একটি চামড়ার ছোট এটাচি কেস পড়ে ছিল। কোন তথ্য পাওয়া যেতে পারে মনে করে এটাচি কেসটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শফিক।
চলে যাবার আগে মোড়ে ডিউটিরত পুলিশকে দু’টি লাশের কথা জানিয়ে তাড়াতড়ি ওগুলোর ব্যবস্থা করার জন্য বলে গেল।
শফিককে পাঠিয়ে দেবার পর আহমদ মুসা অস্থিরভাবে কিছুক্ষণ পায়চারী করল। কি যেন সমাধান খুঁজছে সে মনে মনে। কোন কাজে হঠাৎ করে কোথাও চলে যাওয়াও হাসান তারিকের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাই বা কি করে হয়? এখন রাত ১২টা। তার এখানে পৌঁছবার কথা ছিল ১১ টায়। তাছাড়া সবচেয়ে আশ্চর্য তার অয়্যারলেসের নীরবতা। তাহলে……..ভাবতেই চোখ দু’টি জ্বলে উঠল মুসার। প্রতিশোধের আগুন যেন তাতে ঠিকরে পড়ছে। পরে ধীরে ধীরে সে চোখ নেমে এল অদ্ভুত এক তন্ময়তা। জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেল তার চোখ। অন্ধকার দিগন্তের কাল পর্দা ছাড়িয়ে তিবেক, হিন্দুকুশ, কারাকোরাম পর্বতমালা পেরিয়ে ছুটে গেল তার মন। পূর্ব্ব তুর্কিস্তানের কানশু এলাকার একটি সুন্দর জনপদে। কি হাসি -আনন্দ আর সমৃদ্ধি ভরা দিনগুলো। মরুভূমির একখন্ড দুরন্ত হাওয়ার মতই তারা ঘুরে বেড়াত চারিদিকে। কাঁটার ঝোঁপে সারাদিন চলত লুকোচুরি খেলা। রাতের বেলা বাবার উষ্ণ কোলে বসে আকাশের তারার দিকে চেয়ে কত গল্প শুনত। শুনতে শুনতে জগৎ পেরিয়ে মন চলে যেত আর এক জগতে। অন্ধকার গোটা পৃথিবী। একজন মহাপুরুষ এলেন আরব দেশে। তাঁর হাতে নেমে একখন্ড আলো। অনেক ঘৃর্ণাবর্ত আর ঝড়ের মাঝেও তা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। তার এক খন্ড এসে ছড়িয়ে পড়ল তুর্কিস্তানেও। অনেক সময় গল্প শেষ না করেই বাবাকে উঠকে হত। মসজিদ থেকে ভেসে আসতো বড় চাচাজনের এক পশলা মিষ্টি সুর। বুঝতো না সে এক বর্ণও কিন্তু ভাল লাগতো খুব। এমনি করে দিন চলে এসেছিল, চলতও এভাবেই কিন্তু সাজানো গোছানো এক জীবনে এল ঝড়। পিছনে অবশিষ্ট থাকল রক্ত, হাহাকার জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আহমদ মুসার মুখ কি এক অব্যক্ত বেদনায় আর দৃঢ়তায় শক্ত হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে সে বলল, ‘মধ্য এশিয়া সিংকিয়াংএ, ফিলিপাইনে, ফিলিস্তিনে, ইথিওপিয়ায়, চাদে মুসলমানদের উপর যে নির্যাতন তোমরা চালাচ্ছ তার হিসাব অবশ্যই দিতে হবে। তোমার ‘সিয়াটো’ সেন্টো, ন্যাটো’ গড়তে পারো, ‘ওয়ারস’ চুক্তি করতে পারো, কিন্তু আমরা কিছু করতে গেলেই তা হবে ‘ফ্যানাটিক’ আর ‘গোড়ামি’?
জানালার পাল্লা দু’টো টানতে গিয়ে নীচের চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। বাইরে প্রাচীরের পাশে বিড়ালের চোখের মত এক টুকরো ক্ষীণ আলো হঠাৎ জ্বলে উঠে নিভে গেল। পেন্সিল টর্চ নয়তো। সচকিত হয়ে উঠল আহমদ মুসা। অন্ধকারের জন্য বিশেষভাবে তৈরী বাইনোকুলার চোখে লাগাল দ্রুত। বাইরের অন্ধকার অনেকটা স্বচ্ছ হয়ে উঠল। দেখা গেল হুক লাগানো দড়ি বেড়ে একটি ছায়ামূর্তি প্রাচীরে উঠে বসেছে। কালো পোশাকে আবৃত সর্বাঙ্গ। ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে নামল নীচে। তারপর দেয়ালের পাশ ঘেঁষে শিকারী বিড়ালের মত এগিয়ে এল ধীরে নিঃশব্দ গতিতে।
প্রস্তুত হয়ে মুসা নেমে এল নীচে। সিঁড়ির মুখে সুইচ বোর্ডের পাশে একটি খামের আড়ালে দাঁড়াল সে।
নিঃশব্দ পায়ে ছায়ামূর্তিটি উঠে এল বারান্দায়। তাকে এক খন্ড জমাট অন্ধকার ছাড়া কিছু বুঝবার উপায় নেই। প্রায় দশ বারো হাতের মধ্যে সে চলে এসেছে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো ছায়ামূর্তি। আহমদ মুসা বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলের সুইচে চাপ দিয়ে ডানহাতে রিভলভার ধরে বের হয়ে এল আড়াল থেকে। ঘটনার আকস্মিকতায় ছাড়ামূর্তিটি মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ল। রিভলভারের নলটি স্থির লক্ষ্যে তুলে ধরে মুসা বলল, নিশানা আমার প্রায়ই ভুল হয় না, ফেলে দিন রিভলভার। বোম হাতের পেন্সিল হেডেড রিভলভারটিও ফেলে দিন।
ছায়ামূর্তিটি স্থির নিষ্কম্প চোখ দু’টি আহমদ মুসার চোখে কি যেন পাঠ করল। তারপর একটু দ্বিধা করে হাতের দু’টি অস্ত্র ছেড়ে দিল মেঝেয়।
পাশে মানুষের একটি ছায়া নড়ে উঠতে দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। প্রায় ছিটকে এক পাশে শুয়ে পড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে দুপ্ করে একটি শব্দ হল,তীব্র আর্তনাদ করে পড়ে গেল সামনের লোকটি। আহমদ মুসার রিভলভারও গর্জে উঠল। কিছু বুঝবার আগেই পিছনের লোকটির হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ে গেল। বাম হাতটি উপরে তুলতে চেষ্টা করল লোকটি। আহমদ মুসা গর্জে উঠল। হাত নামিয়ে নাও, নাহলে দ্বিতীয় গুলিটি এবার হাত নয় হৃদপিন্ড ভেদ করে বেরিয়ে যাবে।
আদেশ পালন করল লোকটি। তার ডান হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ছিল এ সময় বাইরের গেটে গাড়ী দাঁড়ানোর শব্দ হল। উৎকর্ণ হয়ে উঠল আহমদ মুসা। কিন্তু রিভলভারের নল তার একটুও নড়ল না। বাইরে থেকে একটি পরিচিত সংকেত এল, আহমদ মুসা তার উত্তর দিতেই কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে সেখানে হাজির হল ফারুক। এসেই বলল, ঠিক, আমার কান ভুল শোনেনি, যা ভেবেছিলাম তাই।
ওসব এ্যানালেসিস পরে করো ফারুক। আগে আমাদের এ মেহমানটির পকেট থেকে দ্বিতীয় রিভলবারটি বের করে নাও। সাবধানে হাত দিও পকেটে হয়তো আরো কিছু থাকতে পারে।