চারিদিকে চেয়ে দেখলাম, গতকাল যারা দুনিয়ার আলো বাতাসে বিচরণ করেছে, তাদেরই হাজার হাজার বিকৃত লাশে মরুভুমির বুক কালো হয়ে উঠেছে। শত শত পোড়া তাঁবুর খন্ড খন্ড অংশ ছিটিয়ে, ছড়িয়ে পড়ে আছে। শত শত এতিম শিশুর সব হারানোর কান্না চারিদিকে মাতম তুলেছে। আবার যখন আব্বার দিকে চাইলাম, চোখ দু’টি তাঁর বুজে গেছে। চোখ দু‘টি আর কোনদিন চাইবে না পৃথিবীর দিকে। একটি অবরুদ্ধ উচ্ছ্বাস যেন ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে চাইল আমার সমগ্র হৃদয়কে। চারিদিক থেকে অন্ধকার এসে সংকীর্ণ করে দিতে চাইল আমার পৃথিবীকে। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হতে চেষ্টা করলাম আমি।
কাঁধের উপর একটি কোমল স্পর্শে চমকে উঠলাম। ফিরে দেখলাম ‘ফারজানা’। শুভ্র গন্ড দু‘টি চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে তার। অশ্রু-ধোয়া কালো চোখ দু’টিতে কি নিঃসীম মায়া। এমন নিবিড়ভাবে ফারজানাকে কোনদিন আমি দেখিনি। ফারজানা সিংকিয়াং এর প্রধান বিচারপতি আমির হাসানের কন্যা।
আমি বললাম, ফারজানা কোন দুঃসংবাদ নেই তো? সে বলল, আমরা ভাল আছি। আব্বা আপানাকে আমাদের তাঁবুতে ডেকেছেন।
মরু সূর্য তখন আগুন বৃষ্টি করছে। আমি জানতাম, ফারজানাদের ছোট্ট একটি তাঁবু। আমি বললাম, চারিদিকে চেয়ে দেখো ফারজানা, তাঁবুর ছায়া আমরা কতজনকে দিতে পারব। যা হোক এদিকের একটা ব্যবস্থা করা যাবেই। তুমি যাও ফারজানা। আমি চাচাজানের সাথে পরে দেখা করব।
আমরা আমাদের দশ হাজার ভাই বোনকে মরু বালুর অনন্ত শয্যায় ঘুমিয়ে রেখে এগিয়ে চললাম সামনে। একদিন গোধূলী মুহুর্তে আমরা পৌঁছুলাম তিব্বত সীমান্তে। দেখলাম তিব্বত সরকার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। জানলাম সিংকিয়াং এর মাটি যাদেরকে আশ্রয় দিতে পারেনি তিব্বতের মাটিতেও তাদের পা রাখবার কোন জায়গা নেই। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ছিন্নমূল বনি আদমের কোন আবেদন নিবেদন কোন কাজে এল না। আশা ভঙ্গের চরম হতাশায় মৃত্যুর স্তব্ধতা নেমে এল কাফেলা ঘিরে।
এবার কোথায় যাব আমরা? উত্তরে মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকছে, দক্ষিণে তিব্বত সীমান্তের দুর্ভেদ্য দেয়াল। আশার একটি ক্ষীণ আলোক বর্তিকা তখন জ্বলছে-কাশ্মীর হয়ে আফগানিস্তান। পথ অত্যন্ত দুর্গম। কিন্তু উপায় নেই তবু।
হিমালয়ের ১৮ হাজার ফিট উঁচু বরফ মোড়া মৃত্যু-শীতল পথ ধরে আফগানিস্তানের দিকে যাত্রা শুরু হল আমাদের। দিন, মাস গড়িয়ে চলল। পার্বত্য পথের কষ্টকর আরোহণ অবরোহণ নিঃশেষ করে দিল মানুষের প্রত্যয়ের শেষ সঞ্চয়টুকু। তার উপর দুঃসহ শীত। প্রতিদিনই শত শত পরিশ্রান্ত মানুষের উপর নেমে আসতে লাগলো মৃত্যুর হিমশীতল পরশ। দুর্বল বৃদ্ধ, কোমল দেহ নারী, অসহায় শিশুরাই প্রধান শিকারে পরিণত হল এর। সবার মত ফারজানার বৃদ্ধ পিতাকেও একদিন হিমালয়ের এক অজ্ঞাত গুহায় সমাহিত করে আমরা এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। ফারজানার অবস্থাও হয়ে উঠেছে মর্মান্তিক। তার আব্বার মৃত্যুর পর সে পাষাণের মত মৌন হয়ে গেছে। বোবা দৃষ্টির শূন্য চাহনির মাঝে কোন ভাবান্তরই খুঁজে পাওয়া যায় না। ওর একটি হাত ধরে আমি পাশাপাশি চলছিলাম। কয়েকদিন পর হাত ধরে নিয়ে চলাও অসম্ভব হয়ে উঠতে লাগল। ভীষণ জ্বর উঠল ফারজানার। পা দু’টি আর উঠতে চায় না ওর।
সেদিন গভীর রাত। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয় সবাই। জ্বরের তীব্র ব্যাথায় ফারজানা কাতরাচ্ছে; একটু দূরে বসে অসহায়ভাবে সে দৃশ্য দেখছি আমি। হিমালয়ের নিঃসীম মৌনতার মাঝে ফারজানার অষ্ফুট কাতরানি তীব্র আর্ত বিলাপের মত আমরা সমগ্র হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে ওর মাথার পাশে বসলাম। ধীরে ধীরে হাত বুলালাম ওর আগুনের মত ললাটে। ওর দুর্বল দু’টি হাত উঠে এল। তুলে নিল আমার হাত ওর দু’হাতের মুঠোয়। তারপর হাত মুখে চেপে ধরে বাঁধ ভাঙা নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল ফারজানা। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, কেঁদোনা ফারজানা, কষ্ট এতে আরও বাড়বে।
ফারজানা বলল, আমাকে ভুলাতে চেষ্টা করো না। আমি জানি, আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তারপর একটু থেমে ধীরে ধীরে বলল, মুসা ভাই, সজ্ঞানে কখনও কোন পাপ করেছি বলে মনে পড়ে না। তুমি কি আমাকে আশ্বাস দিতে পার-অমর জীবনের সেই জগতে আবার আমি তোমাকে খুঁজে পাব। আব্বার কাছে বলেছিলাম, কাঁদব না। কিন্তু চোখের পাতা দু’টি সহসা ভারি হয়ে উঠল। আমি বললাম, একথা শুধু তিনিই জানেন ফারজানা। তবে বলতে পারি আমি- তিনি তাঁর বান্দার কোন একান্ত কামনাকেই অপূর্ণ রাখেন না।
ফরজানা যেন গভীর পরিতৃপ্তির সাথে চোখ বুজল। অষ্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, আল্লাহই তো আমাকে সবচেয়ে ভালো জানেন। চোখ দু’টি আর খুললো না ফারজানা। কোনদিনই তা আর খোলার নয়।
হিমালয়ের বুক চিরে দীর্ঘ পথ চলার পর আমরা যখন আফগান সীমান্তে পৌঁছলাম, ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে আমরা তখন বেঁচেআছি মাত্র ৮৫০ জন……।
খস্ খস্ শব্দ বন্ধ হল।
হঠাৎ থেমে গেল কলমটি!
টেবিলের একপাশে রাখা একটি ক্ষুদ্র যন্ত্রে হঠাৎ লালবাতি জ্বলে উঠল। আর সেই সাথে অয়্যারলেস গ্রাহকযন্ত্র থেকে ‘ব্লিৎস ব্লিৎস’ শব্দ ভেসে এল। আহমদ মুসা লেখা থামিয়ে ডাইরীটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। প্রায় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা লোকটি। মধ্য এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী তুর্কি স্বাস্থ্য দেহে। সকল প্রকারের কষ্ট এবং যে কোন প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলার যোগ্যতা দিয়ে যেন আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন একে। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। চোখ দু’টি উজ্জ্বল এবং দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ। শান্ত দর্শন মুখাবয়বে অনমনীয় ব্যক্তিত্বের সুস্পষ্ট ছাপ। এ লোকটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশী আলোচিত এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাথা ব্যথা। সাইমুমের মধ্যমনি। মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া এবং উত্তর ককেশিয়া থেকে তানজানিয়া পর্যন্ত সুবিস্তৃত মুসলিম সমাজের প্রতিটি মজলুম মানুষ তার নাম গর্বের সাথে স্মরণ করে এবং স্বাধীন দেশ আর স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখে। আহমদ মুসা উঠে গিয়ে অয়্যারলেসের কাছে বসল। বলল, আহমদ মুসা স্পিকিং।