ফিলিপের বিশাল বৈঠকখানা। রাত তখন ৯টা।
যিয়াদ বিন তারিকের সংগঠন ‘ব্রাদার্স ফর ক্রিসেন্ট’ এর উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের বৈঠক ডেকেছে আহমদ মুসা। ফিলিপের বাস্ক গেরিলা দলের মুসলিম নেতাদেরও ডাকা হয়েছে।
আহমদ মুসা আসার পর দুই গ্রুপের মুসলিম নেতারা এক সাথে স্পেনের মুসলমানদের জন্যে কাজ করছে।
মিটিং-এ অন্য সবাই হাজির।
যিয়াদ, ফিলিপ, যোয়ান, আবদুর রহমান, ডঃ আবদুর রহমান আন্দালুসী বৈঠকে হাজির নেই।
যোয়ান স্পেনেই হাজির নেই।
আহমদ মুসা ফরাসী রাষ্ট্রদূত মিঃ প্লাতিনির ওখান থেকে যে রাতে ফিরেছিল, সে রাত শেষে ভোরেই জোয়ান ও জেন মিঃ প্লাতিনি ও ডোনার সাথে রওয়ানা হয়ে যায় ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে।
সেদিন রাতে ফিরেই আহমদ মুসা জেন ও জোয়ানের বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেছিল। বিয়ে পড়িয়েছিল আহমদ মুসা।
এই তাড়াহুড়ায় আপত্তি করেছিল জোয়ান ও জেন দু’জনেই।
কিন্তু আহমদ মুসা দৃঢ়কন্ঠে বলেছিল যে, একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে একটা অনাত্মীয় পরিবেশে গিয়ে তারা পড়বে। এই যাত্রায় দু’জনকে দু’জনের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে হবে। বিয়ে না হলে তাদের এক পা এগুতে দিবেন না তিনি।’
আহমদ মুসার এই কথায় তারা নিরব হয়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসাই আবার বলেছিল, ‘তোমরা তাড়াহুড়ার কথা বলছ। যাত্রার আগে একটা রাত তোমাদের সামনে। আর আমি আমার বিমান ছাড়ার কিছু আগে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের আসন থেকে বিয়ের পোষাকে এসে আমি বিমানে চড়েছিলাম। তোমাদের ভাবিকে আমি দেখেছিলাম বিমান বন্দরে আসার পথে গাড়ীতে।’
জেন ও জোয়ান দু’জনের মুখই লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল। এক সাথেই বলেছিল, ‘মুসা ভাই আমাদের মাফ করুন। আমরা খুব ভেবে কথা বলিনি।’
‘ওটা আমি বুঝেছি। এক কথায় বিয়েতে রাজী হলে নাকি তাকে লোকে নির্লজ্জ বলে। তাই বিয়ের কথায় প্রথমে না না করাটা দোষের নয়। দোষ যখন নেই মাফের প্রশ্নও ওঠে না।’ হেসে বলেছিল আহমদ মুসা।
জোয়ান বসেছিল আহমদ মুসার পাশে দরজার কাছেই এক চেয়ারে। সে বলেছিল, ‘তাহলে আপনিও প্রথমে না না করেছিলেন?’
আহমদ মুসা হেসে বলেছিল, ‘হাঁ না না করেছিলাম। কিন্তু তোমাদের মত ‘ভেতরে ইচ্ছা, বাইরে না না’ এর মত নয়।’
জেন দাঁড়িয়েছিল দরজার আড়ালে। তার পাশে দাঁড়িয়েছিল ফিলিপের মা। আহমদ মুসার কথায় দু’হাতে মুখ ঢেকে ছুটে পালিয়েছিল জেন।
জোয়ানের মুখও লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল।
সে রাতে রাত ১২টার মধ্যেই জেন ও জোয়ানের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল।
ঠিক ভোর ৫টায় মিঃ প্লাতিনি ও ডোনা গাড়ী নিয়ে এসে গিয়েছিল। জেন ও জোয়ানের বিয়ের কেক তারাও খেয়েছিল। অল্প সময়েই আনন্দ উজ্জ্বল ডোনা হৈচৈ করে ফিলিপের বাড়ীটা বাজিয়ে তুলেছিল। কিন্তু তার আনন্দের মধ্যে একটা ফাঁক ছিল। গাড়ি থেকে নেমে ফিলিপের বাড়ীতে প্রবেশ করে সানন্দে সোচ্চার কন্ঠে ডেকে উঠেছিল, ভাইয়া কোথায় আপনি? যখন তাকে বলা হয়েছিল, আহমদ মুসা নেই, তখন তার হাস্যোজ্জ্বল মুখে বেদনার একটা কালো দাগ ফুটে উঠেছিল। শত আনন্দের মাঝেও সে কালো দাগ আর মুছে যায়নি।
জেন ও জোয়ানের বিয়ের পর পরই সে রাতে আহমদ মুসা, আবদুর রহমান ও যিয়াদ শিক্ষা শিবিরের একটা নির্ধারিত প্রোগ্রামে চলে গিয়েছিল।
ফিলিপ বিদায় জানিয়েছিল জেন, জোয়ান, মিঃ প্লাতিনি ও ডোনাকে।
ফিলিপ, যিয়াদ, আবদুর রহমান ও ডঃ আবদুর রহমান আন্দালুসী মিটিং-এ এখনও পৌঁছতে পারেনি। ওরা গেছে সরকারের সাথে গুরুত্বপূর্ণ এক বৈঠকে যোগ দিতে।
মুসলিম সংখ্যালঘুদের দাবীর ভিত্তিতে স্পেন সরকার মুসলিম নেতাদের ডেকেছে আলাপ করার জন্যে। মুসলিম নেতাদের সাথে স্পেন সরকারের এটাই প্রথম ফরমাল আলাপ। এদিক থেকে বলা যায় আলাপটা ঐতিহাসিক। অনেক চিন্তা ভাবনা ও আলাপ আলোচনার পর তাদেরকে পাঠিয়েছে আলোচনার টেবিলে আহমদ মুসা।
মিটিং শুরু হয়নি। অপেক্ষা করা হচ্ছে ফিলিপ ও যিয়াদের জন্যে। নানা আলাপ ও প্রশ্নোত্তর চলছে।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। বেলা ৯টা ১৫ মিনিট।
এল ফিলিপ, যিয়াদরা।
ঘরে ঢুকেই হৈ চৈ করে উঠল আবদুর রহমান। বলল, ‘জিতে গেছি মুসা ভাই, আমরা জিতে গেছি।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। বস বলত শুনি কি বিজয় এনেছ।’
বসল সবাই।
‘যিয়াদ তুমি বল মিটিং-এর বিবরণটা।’ বলল ফিলিপ।
‘শেখুল ইসলাম (ডঃ আবদুর রহমান আন্দালুসী) বলুন।’ বলল যিয়াদ।
‘ধন্যবাদ যিয়াদ এ দায়িত্ব তোমার। তোমাকেও বলতে হবে।’ বলল শেখুল ইসলাম আবদুর রহমান আনদালুসী।
শুরু করল যিয়াদ।
‘আমরা পাঁচটি দাবী নিয়ে গিয়েছিলাম। শিক্ষা ও চাকুরী বিষয়ক দাবী পুরোপুরিই মেনে নিয়েছে। উচ্চতর শিক্ষায় মুসলমানরা একটা কোটা পাবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি মুসলমানদের ইসলামী ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে এবং শিক্ষা সিলেবাস থেকে নগ্ন মুসলিম বিদ্বেষ মুলক বিষয় বাদ দেয়া হবে তালিকায় মুসলিম শিক্ষা বইও শামিল করা হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স তালিকায় মুসলিম শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাবিত বইও শামিল হবে চাকুরী ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য একটা কোটা থাকবে, তবে অতীতে মরিষ্ক হওয়ার অপরাধে যাদের চাকরি গেছে তাদের চাকুরী ফিরিয়ে দিতে তারা অস্বীকার করেছে। অনুরুপভাবে মরিষ্কদের বাড়ীঘর, সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবার দাবী তারা মেনে নেয়নি। তবে গত এক বছরের মধ্যে এ রকম হয়ে থাকলে সে বাড়ীঘর বা সম্পত্তি ফিরে পাবে। মুসলিম ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর ফেরত দেওয়ার আন্তর্জাতিক কমিটমেন্ট তারা রক্ষা করবে। আমাদের চতুর্থ দাবী, ইসলামী সংস্থা, সংগঠন, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইসলামী প্রচার মিশন গড়ার অনুমতি পাওয়া যাবে, তবে বাইরের কোনো লোক আনা যাবে না। বাইরের কোনো অর্থ নিতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। আমাদের পঞ্চম দাবী অর্থাৎ তেজষ্ক্রিয় ক্যাপসুল বিষয়ক ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের ওপর থেকে অভিযোগ প্রত্যাহার করার দাবী তারা মেনে নেয়নি। বলেছে, ওটা বর্তমান পরিবর্তন ও সরকারী প্রতিশ্রুতির আগের ঘটনা।’
থামল যিয়াদ বিন তারিক।
খুশিতে আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ‘যিয়াদ আমরা এই মুহূর্তে যা আশা করছিলাম, তার চেয়ে বেশি পেয়েছি। সত্যি আমার বিস্ময় লাগছে, ওরা এতটা নমনীয় হল কি করে?’
‘বোধ হয় বাইরের চাপ এবং কিছুটা লোভে পড়ে হয়েছে’ বলল ফিলিপ।
‘নতুন কিছু শুনেছ?’
‘হ্যাঁ, আমরা যখন আলোচনা শেষে প্রধানমন্ত্রীর আফিসের ওয়েটিং রুমে বসে ছিলাম। তখন যে অফিসারটির আমাদের সংগ দিচ্ছিল সে এক সমায় আমাকে ফিস ফিস করে বলল “ও আই সি”র তরফ থেকে সুস্পষ্ট দাবীনামা সম্বলিত একটা প্রস্তাব এসেছে। সেই সাথে এসেছে প্রলোভন ও হুমকি। বলেছে ন্যায্য দাবী গুলো মেনে নিলে মুসলিম দেশগুলোতে বাণিজ্য সুবিধা পাবে আর না নিলে তার বর্তমান লেন-দেন বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এতে ঘাবড়ে গেছে বর্তমান স্পেন সরকার। সৌদি আরবের তেলের দিকে তার এখন লোলুপ দৃষ্টি। এ কারণেই তড়িঘড়ি করে কিছু দাবী মেনে নিয়েছে। যাতে সে বলতে পারে মুসলমানদের সাথে তার সমঝোতা হয়ে গিয়েছে।’ থামল ফিলিপ।
‘বুঝলাম’ বলল, আহমেদ মুসা।
‘সৌদি আরবকে দিয়ে চাপ দিয়ে কি জেন ও জোয়ানদের উপর থেকে অভিযোগ তুলে নেওয়া যায় না?’ বলল যিয়াদ।
আহমেদ মুসা হেসে বলল ‘জেন ও জোয়ানদের বিরূদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ আছে স্পেন সরকার এটা স্বীকারই করবে না।’
‘স্বীকার না করলে তো ভাল, জেন ও জোয়ান চলে আসবে’ বলল যিয়াদ।
‘প্রকাশ্য সরকার কিছুই বলবেনা, কিন্তু সরকারের গুপ্ত ঘাতকদের হাত থেকে ওদের রক্ষা করবে কে?’
যিয়াদ কোনো কথা বলতে পারলনা। যিয়াদ, ফিলিপ, আবদুর রহমান সকলের মুখ কাল হয়ে গেল।
ফিলিপ বলল ‘এ কারনেই সরকার আমাদের বিরূদ্ধে এবং জেন জোয়ানের বিরূদ্ধে প্রকাশ্য কিছু বলছেনা, অভিযোগ আসছেনা।’
‘থাক এ প্রসংগ আমি যে জন্যে সবাইকে ডেকেছি, সেদিকে এবার যাই’ বলল, আহমদ মুসা।
এ সমায় গেটের সিকিউরিটি লোকটি রুমের দরজায় দাঁড়াল।
ফিলিপ তাকে ইংগিতে ডাকল।
সে এসে ফিলিপের হাতে একাটা ইনভেলপ তুলে দিল। ফিলিপ ইনভেলপটি দেখেই চিনতে পারল, এ ধরনের ইনভেলপ আগেই একদিন এসেছিল। ফিলিপ ইনভেলপটি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
ইনভেলপটি হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকালো আহমদ মুসা। মধ্য এশিয়া দুতাবাসের ইনভেলপ, ফিলিস্তিন দুতাবাসের নয়। তবে একই ধরনের সাদা ইনভেলপ। ভেবে পেলনা আহমদ মুসা। মধ্য এশিয়া দুতাবাস থেকে এই সময় কি জরুরী না হলে এভাবে মেসেজ আসার কথা নয়।
ইনভেলাপ খুলল আহমদ মুসা।
চারভাঁজ চিঠি খুলে দেখল মধ্য এশিয়ার প্রেসিডেণ্ট কর্নেল কুতাইবার চিঠি। পড়তে শুরু করল আহমেদ মুসা। চিঠি পড়তে পড়তে মুখের ভাব পরিবর্তিত হয়ে গেল আহমদ মুসার। অন্ধকার একটা ছায়া নামল তাঁর সারা মুখে। ঠোঁট শুকিয়ে গেল তাঁর। সিংহ হৃদয় আহমদ মুসার শুকনো ঠোঁট মনে হল একবার কেপে উঠল।
ফিলিপ, যিয়াদ, আবদুর রহমান সবাই অবাক বিস্ময়ে তকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। তাদের চোখে মুখেও উদ্বেগ। বুঝতে অসুবিধা হলনা তাদের, কি ধরনের খবর আহমেদ মুসার মত মানুষকে বিহবল করতে পারে। কিন্তু কি সে খবর? জেন ও জোয়ানের কোনো খারাপ খবর নয়তো!
আহমেদ মুসা চিঠি পড়া শেষ করে চোখ বুঝেছিল মুহূর্তের জন্য।
ফিলিপ আর থাকতে পারেনি। জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘কোনো খারাপ খবর মুসা ভাই?’
আহমেদ চোখ খুলল, হাসল। কিন্তু হাসিটা বড় শুষ্ক। বলল, ‘ভাল মন্দ মিলিয়ে তো জীবন। মন্দ খবর তো আসতেই পারে।’
‘কি খবর মুসা ভাই, বলুন। আমাদের অন্ধকারে রাখবেন না।’ বলল যিয়াদ।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল আহমেদ মুসা। বলল, ‘সিংকিয়াং-এ বিপর্যয় ঘটে গেছে যিয়াদ। এই চিঠিটা লিখেছেন মধ্য এশিয়ার মুসলিম প্রজাতেন্ত্রর প্রেসিডেণ্ট কর্নেল কুতাইবা। চিঠিটা পড়ছি তোমরা শুন: