রাত দশটা।
পার্ল স্ট্রিটের বাইলেনের মুখে একটা জীপ এবং একটা কার এসে থামল।
গাড়ীদুটো থামতেই জীপ থেকে লাফ দিয়ে নামল যিয়াদ, ফিলিপ এবং আরও দুজন। ড্রাইভার গাড়ীতেই থাকল। যিয়াদ ও ফিলিপ এসে কারের সামনে জানালার কাছে দাঁড়ালো।
কারের ড্রাইভিং সিটে আবদুর রহমান। তার পাশের সিটে আহমদ মুসা। পেছনের সিটে জোয়ান।
যিয়াদ ও ফিলিপ জানালার কাছে দাঁড়াতেই আহমদ মুসা মুখ বের করে বলল তোমরা চলে যাও। ঠিক ১০ মিনিট পর আমি সামনের গেট দিয়ে ঢুকব।
পার্ল স্ট্রিটের এ বাইলেন দিয়ে ১৫ গজ ভেতরে গেলে হাতের ডান পাশে একটা গেট। এই বাড়ীতেই এনে রাখা হয়েছে জেমেনিজদের। আগে এটা জনৈক মন্ত্রীর বাড়ী ছিল। তাকে আরেকটা বাড়ীতে পার করে জেমেনিজকে দেয়া হয়েছে এ বাড়ী।
পার্ল স্ট্রিট মন্ত্রীদের পাড়া। রাস্তার দু’পাশে প্রধানত মন্ত্রীদের বাড়ী। প্রাইভেট বাড়ী আছে, ফ্ল্যাট বাড়ীও আছে। তবে তাদের সংখ্যা কম। এলাকাটা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বলেই জেমেনিজকে এখানে এনে রাখা হয়েছে। সরকারের ভয়, জেনকে আটকাবার পর জেমেনিজ এবং কার্ডিনাল পরিবার আহমদ মুসার রোষদৃষ্টিতে পড়বে।
আহমদ মুসারা গত তিনদিন ধরে জেমেনিজের বাড়ীর উপর চোখ রাখছে। রাতে বাড়ীর এলাকায় ঢুকে নিরাপত্তা ব্যবস্থার খোঁজ নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বিশাল এলাকা নিয়ে বাড়ী। চারদিক দিয়ে প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীরের ভেতরে বাগানের মত প্রচুর গাছ। ঠিক মাঝখানে বাড়ী। বাড়ীটি দ্বিতল।
বাড়ীর গেটে স্টেনগানধারী দু’জন প্রহরী। স্টেনগানধারী আরও দু’জন প্রহরী টর্চ নিয়ে বাড়ীর চারদিকের বাগানে ঘুরে বেড়ায়। বাড়ীর গ্রাউন্ড ফ্লোরের রিসেপশন রুমে আরও ছয়জন পুলিশ সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকে। যাতে সংকেত পেলেই যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে ছুটে যেতে পারে।
আহমদ মুসা ভেতরের প্রহরীদের দায়িত্ব দিয়েছে যিয়াদ, ফিলিপ ও তাদের দলকে। প্রাচীর টপকে বাড়ীর ভেতর প্রবেশ করে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবে। তারা ভেতরে ঢোকার ১০ মিনিট পর আহমদ মুসা প্রধান গেট দিয়ে বাড়ীতে ঢুকবে। গেটে দু’জন পুলিশের দায়িত্ব তার।
যিয়াদ ও ফিলিপরা চলে যাবার ঠিক ১০ মিনিট পর আহমদ মুসা আবদুর রহমানকে ইশারা করলেন ঢোকার জন্যে। জীপের ড্রাইভারকে বলল আরও কিছু পরে গেটে আসতে।
লেনের বাপ পাশ দিয়ে দীর্ঘ প্রাচীর। একটা বাড়ীর পেছন দিক এটা। তাই এ প্রাচীরে কোন গেট নেই।ডান পাশ দিয়েও প্রাচীর। এ প্রাচীর জেমেনিজের বাড়ীর। এ লেন দিয়ে গজ পনের এগুলেই এই প্রাচীরের সাথেই জেমেনিজের বাড়ীর গেট।
গেটের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছল আহমদ মুসার গাড়ী। দেখা গেল, গেটের দু’জন পুলিশ গেটের দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গেট খোলা।
আহমদ মুসা আবদুর রহমানকে গাড়ী ঠিক গেটের উপর নিয়ে দাঁড় করাতে বলল।
গাড়ী গিয়ে দাঁড়াল ঠিক গেটের ওপরই।
গাড়ী দাঁড়াতেই দু’দিক থেকে দু’জন পুলিশ ছুটে এল। দু’জনেই এল জানালার কাছে। একটু বাঁকা হয়ে জানালা দিয়ে ভেতরে চোখ ফেলতে চেষ্টা করল ভেতরের মানুষকে দেখার জন্যে। তাদের দু’জনের হাতেই স্টেনগান বাগিয়ে ধরা।
গাড়ী গেটে দাঁড়াবার সংগে সংগেই আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান গাড়ীর দরজা খুলে শক্ত হাতে দরজার হুক ধরে বসেছিল। দু’জন পুলিশ যেই বাঁকা হয়ে জানালা দিয়ে ভেতরে চোখ বুলাতে গেছে, অমনি আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান একই সাথে প্রচন্ড বেগে দরজা সামনে ঠেলে দিল। ছিটকে পড়ে গেল পুলিশ দু’জন।
আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান বেরিয়ে এল দ্রুত গাড়ী থেকে। পুলিশ দু’জন উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল। ওদের হাতে স্টেনগান নেই, ছিটকে পড়ে গেছে।
ওদের উঠে দাঁড়াতে দিল না আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান। কারাতের মারাত্মক ছোবল তাদের ঘুম পাড়িয়ে দিল।
ঠিক এই সময়েই বড় রাস্তার দিক থেকে দু’টি মটর সাইকেলের আওয়াজ পাওয়া গেল।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি জোয়ানকে গাড়িটা গাড়ি বারান্দায় নিতে ইশারা করে সংজ্ঞাহীন একজন পুলিশকে টেনে গেটের পাশে একটু আড়ালে নিয়ে গেল।
কিন্তু আবদুর রহমান সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করে ফেলেছিল। জোয়ান গাড়ী নিয়ে চলে যাবার পর আবদুর রহমান যখন দেখল আহমদ মুসা সংজ্ঞাহীন পুলিশটিকে সরিয়ে ফেলেছে, তখন আবদুর রহমানও অপর পুলিশটিকে সরাতে গেল। কিন্তু দেরী হয়ে গেছে তখন। ছুটে আসা মটর সাইকেল একেবারে কাছে এসে পড়েছে। ফলে সে যে একজন সংজ্ঞাহীন পুলিশকে সরিয়ে ফেলছে তা ধরা পড়ে গেল।
আবদুর রহমান সংজ্ঞাহীন পুলিশকে ছেড়ে দিয়ে তার রিভলবার বের করতে গেল। কিন্তু মটর সাইকেল আরোহীদের চারটা রিভলবার তখন তার দিকে তাক করা। মটর সাইকেল আরোহীদের থেকে একজন ভারী কন্ঠে বলল, পকেট থেকে খালি হাত বের করে নাও। না হলে মাথা গুড়ো হয়ে যাবে।
আবদুর রহমান পকেট থেকে হাত বের করে নিল।
গেটে এসে চারজন মটর সাইকেল থেকে নামল। মনে হল চারজনই পুলিশের অফিসার র্যাংকের লোক। নেমেই একজন বলল, গেটের আরেকজন পুলিশ কোথায়?’
সম্ভবত আরেকজন পুলিশকে খোঁজার জন্য দু’জন এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। আর দু’জন এগুলো আবদুর রহমানের দিকে।
আহমদ মুসা দেখল, যারা দ্বিতীয়জন পুলিশকে খুঁজছে, তাদের দৃষ্টি গেটের এদিকে। ওরা এক্ষুনি এদিকে আসবে।
আহমদ মুসা আর দেরী করা সমীচিন মনে করল না। তার হাতে তখন দ্বিতীয় পুলিশটির স্টেনগান।
স্টেনগান বাগিয়ে বেরিয়ে এল সে আড়াল থেকে। যে দু’জন পুলিশ অফিসার এদিকে আসার জন্যে ফিরে দাঁড়িয়েছিল, তারা ভূত দেখার মত চমকে উঠল।
আহমদ মুসা গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘রিভলবার ফেলে দাও।’
আহমদ মুসার কন্ঠে যারা আবদুর রহমান দিকে এগুচ্ছিল তারা চমকে ফিরে তাকাল।
আর সেই সুযোগে আবদুর রহমান বের করে নিল তার রিভলবার।
দু’জন পুলিশ অফিসার তাদের পিস্তল আগেই ফেলে দিয়েছিল। আবদুর রহমান অবশিষ্ট দু’জনের হাত থেকে কেড়ে নিল রিভলবার।
‘আবদুর রহমান ওদের মটর সাইকেলের ইমারজেন্সী কীট থেকে হ্যান্ডকাফ গুলো বের করে পিছমোড়া করে ওদের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দাও।’ নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
আবদুর রহমান এগিয়ে গেল হ্যান্ডকাফ আনার জন্যে।
এই সময় যিয়াদ ছুটে এল সেখানে।
‘ওদিকের কাজ শেষ?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘জি হ্যাঁ।’ বলল যিয়াদ।
‘যে টুকু বাকি আছে, বড় ভাই (ফিলিপ) তা সারছেন। এদিকে এই দৃশ্য দেখে আমি ছুঠে এলাম।’ কথা শেষ করল যিয়াদ।
আবদুর রহমান ও জোয়ান দু’জনে মিলে চার পুলিশ অফিসারকে পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিল। তারপর তাদের পা বেধে, মুখে রুমাল গুজে গেটের পাশে গাছপালার আড়ালে ঠেলে দিল।
গেটের ব্যবস্থাটা শেষ করে চলে এল আহমদ মুসা গ্রাউন্ড ফ্লোরের রিসেপশনে। দেখল ওখানকার ৬ জন পুলিশকে হাত-পা বেধে ফেলে রাখা হয়েছে।
‘বাগানের দু’জন প্রহরীকেও হাত-পা-মুখ বেধে ফেলে রেখে এসেছি।’ বলল ফিলিপ।
‘ফিলিপ তুমি ও যিয়াদ অন্য ভাইদের নিয়ে থাক। আমি, আবদুর রহমান ও জোয়ান ওপরে দেখছি।’ বলে আহমদ মুসা দোতালা ওঠার সিড়িঁর দিকে এগুলো। তার পেছনে আবদুর রহমান এবং জোয়ান।
দুতালার সিঁড়ি গিয়ে শেষ হয়েছে দুতালার ড্রইং রম্নমে।
দুতালার ড্রইংরুমে পা দিতেই সামনে পড়ল একজন পরিচারিকা।
রিভলবার হাতে আহমদ মুসাদের দেখে ভয়ে পাথর হয়ে গেল পরিচারিকাটি। তার হাতে একটা চায়ের কাপ ছিল, পড়ে গেল।
‘জেন কোথায়, কোন ঘরে?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
পরিচারিকার মুখে কথা সরলনা। আঙুল দিয়ে একদিকে ইংগিত করল।
‘চল দেখিয়ে দাও।’ বলে পরিচারিকাকে চলার ইংগিত করল আহমদ মুসা।
আগে আগে চলল পরিচারিকা। সে কাপঁছে। তার পেছনে আহমদ মুসা ও অন্যান্যরা।
‘ভয় করছ কেন, আমরা জেনের ভাই।’ একটু থেমেই আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘জেনের আব্বা আম্মা কোথায়?’
‘জেনকে একজন পুলিশ অফিসার জিজ্ঞাসাবাদ করছে, তারা সেখানেই বসে আছেন।’
পরিচারিকার কথা শেষ না হতেই সামনের একটা দরজা দিয়ে একজন পুলিশ অফিসারকে বেরুতে দেখল। কিন্তু রিভলভার হাতে আহমদ মুসাদের ওপর চোখ পড়তেই ঝট্ করে সে আবার ভেতরে ঢুকে গেল।
কিন্তু ঘরের ভেতরে ঢুকে সামনের দিকে তাকাতেই আহমদ মুসাকে থমকে দাঁড়াতে হলো। দেখল, পুলিশ অফিসারটি জেনের পেছনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় পিস্তল ঠেসে ধরে আছে।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াতেই পুলিশ অফিসারটি বলল, ‘তোমরা দরজা ছেড়ে দিয়ে এই মুহূর্তে সরে যাও, না হলে জেনকে হত্যা করব আমি।’
আহমদ মুসার পা আর নড়ল না। তার রিভলবারের নল পুলিশ অফিসারের দিক তাক করা, কিন্তু জেনের পেছনে পুলিশ অফিসার।
জেনের আব্বা-আম্মা বসেছিল। তারা উঠে দাঁড়িয়েছে। তাদের মুখ ফ্যাকাসে। কাঁপছে তারা।
‘তিন পর্যন্ত গুনব এর মধ্যে যদি তোমরা সবাই ঘরে ঢুকে দরজা ছেড়ে না দাও তাহলে জেনকে হত্যা করব আমি।’ চিৎকার করে বলল পুলিশ অফিসারটি।
আহমদ মুসারা ঘরের এক পাশে সরে গেল দরজা থেকে।
পুলিশ অফিসারটি জেনকে সামনে নিয়ে দেয়ালের ধার ঘেঁষে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। তার সাথে বেরিয়ে গেল আহমদ মুসাও।
জেনকে সামনে রেখে তার আড়ালে দাঁড়িয়ে এক পা এক পা করে পিছু হটছিল পুলিশ অফিসার।
সিঁড়ির মুখে গিয়ে পুলিশ অফিসার আবার চিৎকার করে বলল, ‘তোমরা আর এক পাও এগুতে পারবে না, যদি বাঁচিয়ে রাখতে চাও জেনকে।’
পুলিশ অফিসারের এই চিৎকারে খুশী হলো আহমদ মুসা। সিঁড়ি গোড়ায় বসে আছে যিয়াদ ও ফিলিপরা। নিশ্চয় তারা শুনতে পেয়েছে পুলিশ অফিসারের এ বাজখাই কন্ঠ।
তাই হল।
অপরিচিত একটা বাজখাই কন্ঠ নিচে ফিলিপদের কানে যাওয়ার সাথে সাথে তারা উৎকর্ণ হয়ে উঠে দাঁড়াল। তাদের চোখে মুখে কিছুটা উদ্বেগ নেমে এল। কিছু একটা বিপত্তি ঘটেছে ওপরে।
‘যিয়াদ তুমি বস আমি ওপরে দেখি।’ বলে ফিলিপ রিভলবার বাগিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বিড়ালের মত নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। সিঁড়ির দ্বিতীয় বাঁকে গিয়ে ওপরে চোখ ফেলতেই গোটা ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, সেই সাথে সে শিউরে উঠল। সেও যদি ঐ শয়তানের কাছে ধরা পড়ে যায়, তাহলে তাকে রিভলবার ফেলে দিতে হবে, জেনকে বাঁচাবার জন্যে। সুতরাং শয়তানটার চোখে পড়ার আগেই তাকে কাজ সারতে হবে।
চিন্তার সংগে সংগেই ফিলিপ তার রিভলবারটি তুলে নিল।
পুলিশ অফিসারটি তখন সিঁড়ির দু’ধাপ নেমে এসেছে।
ফিলিপ ধীরে সুস্থে ঠিক মাথার পেছনটা লক্ষ্য করে রিভলবারের ট্রিগার টিপল।
কোন শব্দও বেরুলনা পুলিশ অফিসারের কন্ঠ থেকে। গড়িয়ে পড়ল সিঁড়ি দিয়ে।
আহমদ মুসা তার রিভলবার পকেটে পুরল। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল আবদুর রহমান। আর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল জেনের আব্বা-আম্মা এবং তাদের সাথে জোয়ান।
পুলিশ অফিসার গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাবার সংগে সংগেই জেন ছুটে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরল।
সিঁড়ির বাঁকে এসে আটকে যাওয়া পুলিশ অফিসারের লাশের দিকে একবার চেয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠে এল ফিলিপ।
‘ধন্যবাদ ফিলিপ, তুমি সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কোন অসুবিধা হয়নি তো মুসা ভাই?’
‘ঐ টুকুই, আর কিছু নয়।’ বলে আহমদ মুসা পেছন ফিরে জেনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জেন তুমি নিচে যাও, জোয়ান তুমিও যাও।’
জেন তার আম্মাকে জড়িয়ে ধরে ছিল। আম্মাকে ছেড়ে দিয়ে জেন সোজা হয়ে দাঁড়াল। একবার আহমদ মুসা, আরেক বার তার আম্মা-আব্বার দিকে তাকাল। বিমূঢ় সে।
‘জেন আমরা কিন্তু সময় বেশী পাব না।’
‘যাচ্ছি ভাইয়া। আব্বা-আম্মার কি হবে?’
‘ওঁদেরকে একটা ষ্টোরে আটকে রেখে যাব, যাতে আমরা চলে যাবার আগে ওঁরা পুলিশকে খবর দেয়ার সুযোগ না পান।’
বলেই আহমদ মুসা তার রিভলবার উঁচিয়ে জেমেনিজকে বলল, ‘আপনাদের স্টোর রুমে নিশ্চয় টেলিফোন নেই, ওখানেই আপনাদের আটকে রাখতে চাই।’
বলে আহমদ মুসা তিন জন পরিচারিকা সহ জেমেনিজকে নির্দেশ দিল ষ্টোর রুমের দিকে হাঁটার জন্যে।
জেমেনিজ ও জেনের মা একবার আহমদ মুসার কঠোর মুখের দিকে, আরেকবার জেনের দিকে দিকে চেয়ে ভয় ও অপমান পীড়িত চেহারা দিয়ে ষ্টোরের দিকে হাঁটতে লাগল।
জেন, জোয়ান, আবদুর রহমান এবং ফিলিপ সকলেরই বিব্রতকর চেহারা। তাদের সকলের মুখেই বিমূঢ় ভাব।
আহমদ মুসা জেনের আব্বা-আম্মা ও তিনজন পরিচারিকাকে ষ্টোর রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে দিল।
ফিরে এল আহমদ মুসা ড্রইং রুমে। বলল, ‘চল।’
তখনও সকলের চোখে-মুখে বিমূঢ় ভাব। জেনের আব্বা-আম্মার সাথে আহমদ মুসার এই রূঢ় আচরণের কোন ব্যাখ্যা তারা খুঁজে পাচ্ছে না। জিজ্ঞাসা করারও সাহস নেই।
জেন প্রথমে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। তারপর জোয়ান।
সকলেই নেমে এল গাড়ী বারান্দায়।
কারের পাশে জীপও এসে দাঁড়িয়েছিল।
কারের ড্রাইভিং সিটে বসল আবদুর রহমান। সামনের সিটে আহমদ মুসা। তার পাশে জোয়ান। পেছনের সিটে জেন একা।
অবশিষ্টরা সবাই জীপে।
গাড়ী দু’টো বেরিয়ে এল পার্ল ষ্ট্রীটে।
ফিলিপের বাড়ীর গাড়ী বারান্দায় যখন তারা সবাই নামল গাড়ী থেকে, তখন রাত ১২টা।
গাড়ী থেকে নেমে সবাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাড়ীতে প্রবেশের জন্যে।
আহমদ মুসার পাশেই ছিল ফিলিপ। আহমদ মুসা সামনে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘মাফ করবেন মুসা ভাই, আমার আর তর সইছেনা। আমার একটা প্রশ্ন, আমার কেন সবারই প্রশ্ন জেনের আব্বা-আম্মার সাথে এই আচারণ না করলে কি হতো না, তাদেরকে স্টোর রুমে আটকে না আসলে হতো না ?’
‘কি করতে হতো তোমাদের মতে?’ একটু হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘তাদেরকে আটকে রাখার দরকার ছিল না। ওদের সাথে ভাল করে কথা বলে আসতে পারতাম।’
‘মন্দ হতো না, আগামী কালই ওরা গ্রেফতার হতেন। ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হতো, আমাদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করে ওরা জেনকে পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং একজন পুলিশ অফিসারকে হত্যা করিয়েছেন। এটাই কি ভাল হতো?’
‘ওদের সাথে আমাদের এই ব্যবহার ওরা জানত কি করে?’
‘একজন পুলিশ কে আমরা মারলাম, অন্যদের মেরে সংজ্ঞাহীন করলাম, কাউকে বেঁধে রাখলাম, আর ওদের কিছুই হল না, ওদের গায়ে আঁচড় ও লাগল না একে স্বাভাবিক বলে ওরা মেনে নিত না।’
‘ঠিক আছে, ওদের আটকেই রেখে আসতাম, কিন্তু ভাল করে কথা বলে আসা যেত না? শত্রুর সাথে যে আচরণ, সেই আচরণ আমরা ওদের সাথে করে এসেছি।’ বলল ফিলিপ।
‘তোমাদের এই ভাল আচরণ এবং আলাপ, কথা বার্তা পুলিশ এবং সরকারের কাছে গোপন থাকতো না।’
‘কি করে? কেউ তো দেখতে পেতনা। পুলিশ যারা সজ্ঞানে ছিল তারা তো সবাই নিচে।’
‘নিশ্চয় জেনে রেখ, এই ঘটনা নিয়ে ঐ তিনজন পরিচারেকা কে পুলিশ অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করবে। পরিচারিকাদের কাছে থেকেই সব কিছু বেরিয়ে যেত।’
ফিলিপ কোন কথা বলল না। তার মুখে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জেন, জোয়ান সকলের মুখেই তখন হাসি।
‘ভাইয়া আমাকে মাফ করবেন, এতক্ষন মনে যেমন কষ্ট পেয়েছি, তেমনি আপনার উপর হয়ে উঠেছিলাম ক্ষুব্ধ, এখন বুঝতে পারছি, আপনি আমার আব্বা আম্মাকে বাঁচিয়েছেন, মান – মর্যাদা সহ তাদের বেঁচে থাকারও ব্যবস্থা করেছেন।’
‘কার্ডিনাল পরিবার এক ভয়ানক বিপদ থেকে রক্ষা পেল।’ বলতে বলতে জেনের চোখ ছল ছল করে উঠল কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে।
একটু থেমেই জেন আবার বলল, ‘আমার আব্বা বিপদগ্রশ্থ হবেন এই আশংকা করেই আমি সেখানে বলেছিলাম, ‘ভাইয়া আমার আব্বা-আম্মার কি হবে।’ আপনি এত নিখুঁতভাবে আমার উদ্বেগের সমাধান করে দিয়েছেন, তা তখন বুঝিনি। না বুঝে কষ্ট পেয়েছিলাম।’
‘কিন্তু জেন তোমার আব্বা আম্মা আমাকে এখন কি ভাববেন, বলত?’ মুখে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা এখন যেটা বুঝলাম তারাও এটা পরে বুঝবেন। যখন বুঝবেন তখন তারা আমাদের চেয়েও বেশী খুশী হবেন। আপনি আমাদের পরিবারের কত বড় উপকার করলেন তা আপনি বুঝবেন না মুসা ভাই।’ বলল জেন।
‘মুসা ভাই, ঐ উত্তেজনার মুহূর্তে অতদুরে চিন্তা আপনি কি করে করতে পারলেন?’ বলল যিয়াদ।
‘এ জিজ্ঞাসার জবাব কি আমি দিতে পারি যিয়াদ? এ জ্ঞান যিনি দিয়েছেন, সে আল্লাহ তো সব জানেন, সব করেন, সব পারেন। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের এ ভাবেই সাহায্য করেন।’
বলে আহমদ মুসা পা বাড়াল বাড়ির ভেতরে প্রবেশের জন্য।
তাঁর পেছনে সবাই হাঁটতে শুরু করল।
সবার পেছনে জোয়ান আর জেন।
‘আম্মার সাথে দেখা করতে গিয়ে তোমাদের খুব ভোগালাম তাই না?’ জেন বলল জোয়ানকে।
‘শুধু ভোগালে, ভোগও তো করলে।’
‘শুনিনি তো, জানলে কি করে?’
‘জানার জন্য সব সময় কি শোনার দরকার হয়?’
‘তোমরা আর দেরী করলে কি হতো জানি না। জান আজ ওরা ‘মিথ্যা ধরা’ যন্ত্র এনেছিল। পুলিশ অফিসার নিচে থেকে ঐ যন্ত্রই আনতে যাচ্ছিল, এই সময় তোমরা গেছ।’
‘তোমার কাছ থেকে ওরা কি জানতে চেষ্টা করেছে?’
‘বেশীর ভাগ প্রশ্ন তোমার, মুসা ভাই আর ফিলিপ-এর ঠিকানা নিয়ে। এছাড়া তোমাদের কি পরিকল্পনা রয়েছে, কোন কোন দেশ সাহায্য করেছে, স্পেনে আর কারা সাহায্য করেছে, ইত্যাদি প্রশ্নই বার বার ওরা করেছে।’
‘মুক্তি সম্পর্কে কি ভাবতে?’
‘আমি নিশ্চিত ছিলাম, আহমদ মুসা ভাই আমাকে মুক্ত করবেনই। তারপর আব্বার কাছ থেকে মুসা ভাই আমাদের ঠিকানা নেওয়ার খবর যখন শুনলাম, তখন থেকে প্রতিদিনই তোমাদের অপেক্ষা করেছি।’
‘তোমার আব্বা আম্মা?’
‘আমার খুব ভয় ছিল আব্বা আম্মা আমার সিদ্ধান্তকে কিভাবে গ্রহন করেন। কিন্তু দেখলাম তারা মেনে নিয়েছেন। তারা মেয়ের সিদ্ধান্তকে গ্রহন করেছেন আন্তরিকভাবে।’
‘কোন সিদ্ধান্ত?’
‘জানিনা কোন সিদ্ধান্ত’ বলে জেন দ্রুত পা চালিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। তাঁর মুখ রাঙা হয়ে উঠেছে।
৫
মাগরিবের নামায শেষ করে ফিলিপের মা ঘুরে বসল জেনের দিকে। জেনের নামায তখন শেষ হয় নি।
ফিলিপ, ফিলিপের মা, জেন ক’দিন আগে ইসলাম গ্রহন করেছে। মনের দিক দিয়ে তাঁর তৈরি হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। সে দিন শুধু সকালে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিল। কলেমা শাহাদাৎ পড়ার পর তারা অজু করে দু রাক’আত নফল নামাজ পড়ে মুসলিম জীবনের নতুন যাত্রা শুরু করেছিল।
কলেমা শাহাদাৎ পড়ার পর আবেগে কেঁদে ফেলেছিল ফিলিপ এর মা।
‘কাঁদ কেন আম্মা তুমি?’ বলেছিল ফিলিপ
‘মারিয়ার কথা মনে পড়ে গেল। মারিয়া থাকলে আজ কত খুশী হতো। আরেকটা আবেগময় চিত্র আমার চোখে সুখের অশ্রু এনে দিয়েছিল বেটা।’ বলেছিল ফিলিপের মা।
তাঁর মা থামতেই ফিলিপ আগ্রহ ভরে প্রশ্ন করছিল, ‘সেটা কি আম্মা?’
‘আমার মনে হল আমার স্পেনের নতুন ইতিহাসের দিক উন্মোচন করলাম। সেই ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতনের মধ্যে দিয়ে মুসলমানের পতন ঘটেছিল স্পেনে। কিন্তু তারও আগে থেকে স্পেনীয়দের ইসলাম গ্রহনের ধারা বন্ধ হয়েছিল। ১৪৯২ সালের পর যে সব মুসলমান বাঁচতে চেয়েছিল, শুরু হয়েছিল তাদের খ্রিস্টান হবার পালা। শত শত বছরের কাল পরিক্রমা শেষে আজ আবার স্পেনে খ্রিস্টানদের মুসলমান হওয়ার পালা শুরু হল। এই নতুন ইতিহাসের যাত্রা শুরু আমরাই করলাম। এই সৌভাগ্যের অশ্রু আমি রোধ করতে পারিনি।’ বলতে বলতে আরও অশ্রু ঢল নেমেছিল ফিলিপের মার চোখে।
আহমদ মুসা, জোয়ান, ফিলিপ, জেন কারও চোখ সেদিন শুকনো ছিল না।
‘আম্মা, তুমি বিষয়টা এত আবেগ দিয়ে ভেবেছ?’ বলেছিল ফিলিপ।
‘কেন ভাববো না। আমি ছাত্রী ছিলাম ইতিহাসের। মুসলিম শাসনকাল ছিল স্পেনের স্বর্ণযুগ। এই স্বর্ণযুগ ইতিহাস আমার খুব প্রিয় ছিল। পড়তে গর্বে আমার বুক ভরে উঠত যে, আজকের লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন যখন জংগলে পূর্ণ অসভ্যতার অন্ধকারে ডুবে ছিল, তখন স্পেনের শহরগুলো ছিল আলোক প্লাবিত, চোখ ধাঁধানো হর্মরাজিতে পূর্ণ, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হাজার হাজার ছাত্রের কল গানে মুখরিত। ব্রিটেন, জার্মান, ফ্রান্সের অসভ্য-অজ্ঞ মানুষরা তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে জ্ঞান ভিক্ষা করত। মুসলমানদের এই ইতিহাস আমার প্রিয় ছিল বলেই করডোভা, গ্রানাডা, আল হামরার দুর্দশা দেখে আমার কান্না আসত। আজ স্পেনের সেই স্বর্ণযুগের নির্মাতা মুসলমানদের কাতারে যখন এসে দাঁড়ালাম, তখন আমার ছাত্র জীবনের সেই অনুচ্চারিত কান্নাই যেন আমার বুকে নতুন করে ফিরে এল।’
ফিলিপ, আহমদ মুসা, জোয়ান, জেন সকলের চোখ হয়ে উঠেছিল বিস্ময় বিমুগ্ধ। ফিলিপ যেন তাঁর মাকে আজ নতুন করে দেখেছে।
‘একটা কথা বল মা, ছাত্র জীবনে থেকে যাদের জন্য তোমার এত কান্না, তাদের জন্য কিছু করার কথা তোমার মনে হয়নি?’ বলেছিল ফিলিপ।
‘আমি ছিলাম ইতিহাসের পাঠক, নিজেকে কখনও পলিটিশিয়ান ভাবিনি।’
ফিলিপ তারপর কোন কথা বলেনি।
কথা বলে উঠেছিল আহমদ মুসা। বলেছিল আবেগে জড়িত কণ্ঠে, ‘আপনার মত এই স্পেনে আর কত মা আছে আম্মা?’
তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয়নি ফিলিপ এর মা। গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। তাঁর শূন্য দৃষ্টি জানালা দিয়ে ছুটে গিয়েছিল বাইরে। বলেছিল, তা বলতে পারব না বাছা। তবে আমার বান্ধবীদের অনেকে আমার চেয়েও অনেক আবেগ প্রবন ছিল। শুধু মা নয় বাবা, অনেক পিতাও এমন তুমি পাবে। একজন প্রবীন শিক্ষক এর কথা আমার মনে পড়ে। তিনি একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, ‘স্পেনের মুসলিম শাসন যদি আর কয়েক শত বছর থাকতো, তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে স্পেন হতো আধুনিক ইউরোপের রাজধানী।’ একজন ছাত্র তৎক্ষণাৎ একটা গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘স্পেন আধুনিক ইউরোপের রাজধানী হয়তো হতো, কিন্তু খৃষ্টানদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না।’ প্রশ্নটা শুনে স্যার অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলেন। তাঁর চোখ-মুখ ভারি হয়ে উঠেছিল বেদনায়। বলেছিলেন খুব ভারি কন্ঠে, ‘তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। কারণ, তুমি যে বই থেকে উদ্ধৃতি দিলে, তার নাম ইতিহাস হলেও ওকে রূপকথা বলাই ভাল। তবে এটুকু জেনে রাখ, মুসলমানরা আমাদের মত হলে মুসলমানদের হাত থেকে রাজ্য কেড়ে নেবার জন্যে স্পেনে একজনও খৃষ্টানও খুঁজে পাওয়া যেতো না।’ স্যারের এই কথায় আমরা সেদিন হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। স্যার তার কক্ষে ফিরলে আমি গিয়ে তাঁকে বলেছিলাম, ‘স্যার আপনার কথা কি দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে গেল না?’ তিনি ইজি চেয়ারে শুয়ে ছিলেন। তাঁর চোখ দুটি বন্ধ ছিল। তিনি চোখ বন্ধ রেখেই বললেন, ‘দেখ আমি আমার জীবনের শেষ প্রান্তে। আমার আর হারাবার কিছু নাই। যা বলিনি এখনও যদি তা না বলি কখন আর বলব?’ বাছা আমাদের এ স্যারের মত লোকের খুব অভাব নেই স্পেনে।’
এই ভাবে ইসলাম গ্রহণের অনুষ্ঠান সেদিন স্পেনের উপর এক মনোজ্ঞ আলোচনায় রূপান্তরিত হয়েছিল।
ফিলিপের মা ও জেন নামাজ পড়ছিল ফিলিপের মা’র ঘরে।
জেনের নামাজ শেষ হলে সে ফিলিপের মার দিকে ঘুরে বসল।
ফিলিপের মা চেয়েছিল জেনের মুখের দিকে।
ফিলিপের মা’র ঠোঁটে একটুকরো স্নেহ মাখা হাসি।
জেন ফিলিপের মা’র দিকে ঘুরে বসলে, ফিলিপের মা জেনের চিবুকে একটা টোকা দিয়ে আদর করে বলল, জান, আহমদ মুসা তোমাকে এবং জোয়ানকে ট্রিয়েস্টে পাঠাচ্ছে। সেখানে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিকাল ফিজিক্স (আই সি টি পি)-এ তোমাদের দু’জনেরই চাকুরী হয়ে গেছে। আমি মনে করি তার এ সিদ্ধান্ত খুবই সঠিক। এখন স্পেনে তোমার এবং জোয়ানের প্রকাশ্যে বের হওয়া সম্ভব নয়।’
‘আপনি ঠিক বলেছেন খালাম্মা। আর জোয়ানের জন্যে এটা হবে খুব খুশীর খবর।’ বলল জেন।
‘কেন তুমি খুশী হবে না?’
‘এই যাওয়াটা আমার জন্যে প্রয়োজনীয়। কিন্তু এটা আমার জন্যে খুশীর খবর নয়। খুশী হতাম যদি দেশে থাকতে পারতাম।’
‘বুঝেছি দেশকে তুমি খুব ভালবাস।’
একটু থামল ফিলিপের মা। তার চোখে মুখে চিন্তার একটা ছাপ। ফিলিপের মা’ই আবার কথা বলল। বলল, ‘তোমার সিদ্ধান্তে কোন ফাঁক নেই তো মা? পরে দুঃখ পাবে না তো?’
‘না খালাম্মা। আমি ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার এই সিদ্ধান্ত এবং আমার দেশকে ভালবাসার মধ্যে কোন বৈপরিত্য নেই। দেশকে ভালবেসেই আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘আহমদ মুসা তোমাকে আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করতে বলেছে।’
‘কি কথা খালাম্মা?’
‘আহমদ মুসা তোমাদের বিয়েটা আজ-কালের মধ্যে সেরে ফেলতে চায়। তোমার মত জানতে চেয়েছে।’
‘জেনের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। মুখ নিচু করল সে। কোন উত্তর দিল না।
ফিলিপের মার মুখে স্নেহমাখা হাসি ফুটে উঠল। সে-ই আবার মুখ খুলল। বলল, ‘বল মা তোমার মত না শুনলে তো আমরা এগুতে পারছি না।’
‘এত তাড়াহুড়োর দরকার আছে কি খালাম্মা?’ মুখ নিচু রেখেই বলল জেন।
‘আহমদ মুসা বলছে, বাপ-মা’র অভিভাবকত্ব থেকে তুমি দূরে। তাছাড়া বিপদ ঝুলছে মাথার উপর। এ সময় তোমার একা থাকা উচিত নয়। আমিও আহমদ মুসার এ মত পছন্দ করেছি।’
‘আপনারা আমার মুরুব্বী। আপনাদের মতই আমার মত’ বলে জেন লজ্জা রাঙা মুখ নিচু করেই ছুতে পালাল ফিলিপের মার সামনে থেকে।
‘সোনার মেয়ে, আজকালকার মেয়েদের এই লজ্জা দুর্লভ’- বলে ফিলিপের মা উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা, ফিলিপ, জোয়ান, আবদুর রহমান, যিয়াদ বসে ছিল নিচের ড্রয়িংরুমে।
ড্রয়িংরুমে নেমে এল ফিলিপের মা। আহমদ মুসারা সবাই উঠে দাঁড়াল।
‘বস তোমরা। আমি জেনের সাথে কথা বলেছি। তোমরা বিয়ের ব্যবস্থা কর।’ বলল ফিলিপের মা। খুশিতে তার মুখ উজ্জ্বল।
‘আল্লাহু আকবর’ বলে আবদুর রহমান গিয়ে জড়িয়ে ধরল জোয়ানকে।
জোয়ানের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।
‘খুব তো খুশী আবদুর রহমান, ভাইয়ের বিয়ের কথা শুনে। কিন্তু ভাইয়েরইতো মত নেয়া হয়নি। বল জোয়ান তোমার মত, জেনের মত তো পেয়েছি।’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল ফিলিপ।
‘থাক, জোয়ান বড় লাজুক ছেলে। ওকে জ্বালাসনে। তোর বিয়েতে পত জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেছিলি তুই? শুনেই তো দৌঁড় দিয়েছিলি ঘর থেকে।’ বলল ফিলিপের মা।
‘ঠিক আছে আম্মা, আমরা সব ব্যবস্থা করছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু বাছা, বিয়েটা লা-গ্রীনজায় হতে হবে।’ বলল ফিলিপের মা।
‘সবাইকে এখানে নিয়ে এলেই তো হবে আম্মা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সবাইকে আনা যাবে, আমার মারিয়াকে তো আনা যাবে না।’ ভারি কন্ঠ ফিলিপের মার।
ফিলিপের মার কথার সঙ্গে সঙ্গে সকলের মুখ ম্লান হয়ে গেল। বেদনার ছায়া নেমে এল সবার মুখে।
‘ঠিক আছে, আপনি যা বলেছেন সেটাই হবে আম্মা।’ শুষ্ক কন্ঠে বলল আহমদ মুসা। মারিয়ার প্রসঙ্গ উঠলে আহমদ মুসা আনমনা হয়ে যায়। সে বেদনা পাওয়া ছাড়াও তার মনে এক ধরনের অপরাধবোধ জাগে। তার জন্যেই মারিয়া জীবন দিয়েছে।
ফিলিপ কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল, এই সময় ড্রয়িং রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল গেটের প্রহরী। আহমদ মুসা, ফিলিপ সবাই তার দিকে চাইল।
‘স্যার গেটে একটা গাড়ী এসেছে, গাড়ীতে তিনজন লোক।…’
গেট-প্রহরীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই প্রশ্ন করল ফিলিপ, ‘কি চায়? কি বলে ওরা?’
গেট-প্রহরী এগিয়ে এসে ফিলিপের হাতে একটা নেম-কার্ড তুলে দিল।
ফিলিপ কার্ডের দিকে একবার নজর বুলিয়েই তুলে দিল তা আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা নজর বুলাল কার্ডে। কার্ড হোল্ডারের নাম ‘জো-ডোমিংডো’। পরিচয় লেখা আছে শুমারী অফিসার, গৃহ শুমারী কমিশন।
কার্ডটি পড়েই ভ্রু কুঁচকালো আহমদ মুসা। ফিলিপের দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘দেশে কি গৃহ শুমারী হচ্ছে? এরকম কোন ঘোষণা আছে?’
‘না দেশে গৃহ শুমারী হচ্ছে না। এ রকম কোন ঘোষণাও ছিল না। তবে আজ সকালের নিউজে এবং পরে আরও বার কয়েক ঘোষণা দিয়েছে, রাজধানী মাদ্রিদে জরুরী ভিত্তিতে গৃহ শুমারী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সবাইকে সহযোগিতা করার আবেদন জানানো হয়েছে।’
‘আজ ঘোষণা, আজই গৃহ শুমারী শুরু?’ বলে আহমদ মুসা ধপ করে বসে পড়ল সোফায়। আহমদ মুসার মুখে ভাবনার একটা কালো ছায়া নেমে এসেছে।
ফিলিপ অবাক হলো আহমদ মুসার ভাবান্তরে। গৃহ শুমারীর মধ্যে অস্বাভাবিকতা কি আছে!
আহমদ মুসা মুহূর্ত কয়েক চোখ বন্ধ করে থেকে তড়াক করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল ফিলিপকে লক্ষ্য করে, ‘আমার গাড়ীটা বাড়ীর পাশে গাছের নিচটাতেই তো পার্ক করা আছে না?’
‘জি, কেন?’ বলল ফিলিপ। তার চোখে উদ্বেগ।
‘এই মুহূর্তে জোয়ান জেনকে নিয়ে ঐ গাড়ীতে গিয়ে বস। আর ফিলিপ তুমি গৃহ শুমারীর লোকদের নিয়ে এস।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জোয়ান ছুটল। আহমদ মুসার আদেশ পালন করার জন্যে।
ফিলিপ ব্যাপারটা কিছু আঁচ করল এতক্ষণে। গেটের দিকে পা বাড়াবার আগে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি নিজের কথা ভাবছেন না মুসা ভাই?’
‘তুমি যাও, আমার একটা ব্যবস্থা করছি।’ বলে আহমদ মুসা তার ঘরে যাওয়ার জন্যে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।
‘বড় কিছু আশংকা করছ বাছা?’ আহমদ মুসার সাথে চলতে চলতে বলল ফিলিপের মা। তার চোখে মুখে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা তার দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, ‘আমি সন্দেহ করছি আম্মা, শুমারী-টুমারী কিছু না, ওরা বাড়ী সার্চ করতে এসেছে।’
‘কেন?’
‘সম্ভবত আমাকে, জোয়ানকে এবং জেনকে ওরা খুঁজছে।’
‘এতক্ষণে সব বুঝেছি বাছা, আল্লাহ সহায়। তুমি একটু সাবধান হও, ওদের সামনে পড়োনা।’
দু’তলায় উঠে আহমদ মুসা চলে গেল তার ঘরের দিকে। আর ফিলিপের মা উঠে গেল তিন তলায়।
আহমদ মুসা যখন সিঁড়ি দিয়ে নিচের ড্রয়িং রুমে নামছিল, তখন ফিলিপ ও গৃহ শুমারীর তিনজন লোক সোফা থেকে উঠছিল। আহমদ মুসা সবাইকে গুড নাইট জানিয়ে আগন্তুকদের দিকে ইংগিত করে বলল, ‘এঁরা কে?’
‘এঁরা এসেছেন গৃহ শুমারীর পক্ষ থেকে।’ ফিলিপ বলল।
‘উঠছ কোথায়, ওঁদের সব তথ্য দিয়েছ?’
‘ঘরে ঘরে গিয়ে সরেজমিনে গিয়ে ওরাই লিখবেন।’
‘তাই বুঝি নিয়ম?’ গৃহ শুমারীর লোকদের দিকে চোখ তুলে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘জি, এবার শুমারীতে সরকার কোন ফাঁক রাখতে চান না।’ বলল আগন্তুকদের একজন।
‘বেশ ভাল।’ বলে আহমদ মুসা গিয়ে সোফায় বসল।
আহমদ মুসার মুখে বাস্ক পাদ্রীদের মত লম্বা দাড়ী, ইয়া লম্বা গোঁফ। মাথায় কাল হ্যাট, গায়ে লম্বা ওভার কোট। হাতে লাঠি। তাকে দেখলে মনে হচ্ছে, বাস্কদের একজন ধর্মীয়নেতা যেন পায়চারি করতে বেরুচ্ছে রাতের অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি রাস্তায়।
ফিলিপের চোখ দেখেই আহমদ মুসা বুঝেছে, তার ছদ্মবেশ খারাপ হয়নি। ফিলিপ প্রথমে তার দিকে যে ভাবে তাকিয়েছিল তাতে আহমদ মুসা ভয় পেয়ে গিয়েছিল, ফিলিপ বেফাঁস কিছূ বলে বসে কিনা। ফিলিপ নিজেকে সামলে নিয়েছিল।
মিনিট দশেক পর ফিলিপ গৃহ শুমারীর তিনজন লোক নিয়ে নিচে ড্রইং রুমে এল।
ওরা এসে বসল সোফায়।
বসেই গৃহ শুমারীর জো ডেমিংগো লোকটি বলল, ‘কষ্ট দিলঅম আপনাদের।’
‘না না কষ্ট কি, আপনি আপনার কর্তব্য করেছেন। আপনাদের সহযোগিতা আমাদের দায়িত্ব।’ বলল ফিলিপ।
সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে আহমদ মুসা সেদিনের ‘দি ইসপানিয়া’ কাগজটি সামনে তুলে ধরে ওতে চোখ বুলাচ্ছিল। ফিলিপের কথা শেষ হলে আহমদ মুসা কাগজটি মুখের সামনে থেকে একটু সরিয়ে জো ডেমিংগো’র দিকে চেয়ে বলল, ‘সরকার নিশ্চয় বড় কোন প্রকল্প নিতে যাচ্ছেন যার জন্যে এই জরুরী গৃহ শুমারী।’
‘আজ সকালে হুকুম পেয়ে, বেলা এগারটা থেকে কাজে নেমেছি। অত কিছু আমরা জানি না স্যার। তবে আমার মনে হয়, সরকার কোন বড় প্রকল্প নিয়ে নয়, বড় একটা সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।’
‘সমস্যা? সে তো অনেক আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি বিশেষ সমস্যার কথা বলছি স্যার। মাত্র একজন লোক স্পেনে ওলট পালটের সৃষ্টি করেছে। তার সাথে আরও দুজনকে খুঁজে পাওয়ার জন্যে সরকার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।’
‘কে সেই লোক? তার সাথে আরও দুজন কারা? কি ওলট-পালট তারা করেছে?’
‘ওলট-পালটের চেয়েও বেশী। মুসলমানদের ঐতিহাসিক স্থানগুলো ধ্বংসের জন্যে পাতা তেজষ্ক্রিয় ক্যাপসুল খুঁজে পাওয়ার পর সরকার প্রচন্ড চাপের মধ্যে পড়েছে এবং চারদিকের চাপে মুসলমানদেরকে স্বীকৃত সংখ্যালঘুর মর্যাদা দিতে হচ্ছে, তাদেরকে সকল নাগরিক অধিকার দিতে হচ্ছে, তাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে তাদের ঐতিহাসিক স্থানগুলো। খৃস্টানদের মত তারাও স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ, ধর্মপ্রচারের অধিকার পাবে। এটা স্পেনের জন্যে অকল্পনীয় ছিল।’
থামল জো ডেমিংগো।
‘সেই একটি লোক এবং তার সাথের দু’জন কে, যারা এতবড় লন্ড-ভন্ড কান্ড ঘটাল?’
‘বলা যাবে না তাদের নাম পরিচয়। তবে জেনে রাখুন তারা ধরা পড়ছেই।’ বলল জো ডেমিংগো।
‘যাদেরকে এতবড় লন্ড-ভন্ডের হোতা বলছেন, তারা তো নিশ্চয় কোন সাংঘাতিক কিছু। যদি তাই হয়, তাহলে তারা ধরা পড়বেই এমন কথা এত নিশ্চিত করে কি বলা যায়?’
‘যায় অবস্থা দেখে। সেই লোক তিনটিকে ধরার জন্যে সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। তারা এখনও রাজধানীতেই আছে। রাজধানীর ঘরে ঘরে তাদের খোঁজা হবে। রাজধানী থেকে তাদের বের হবার কোন পথ খোলা রাখা হয়নি যে, তারা পালিয়ে যাবে। সেনা বাহিনী, পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ সকলকে নিয়োগ করা হয়েছে। শুধু সড়ক পথ নয়, মাদ্রিদের গোটা সীমান্ত সীল করা হয়েছে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন।’
‘সাংঘাতিক ব্যাপার। এতো তিনজন মানুষের বিরুদ্ধে একটা রাষ্ট্রের যুদ্ধ ঘোষনা। অথচ আমরা কিছুই জানিনা।’
‘জানবেন কি করে, প্রকাশ হলে তো ওরা সাবধান হবার সুযোগ পাবে। তাছাড়া এই গোপনীতার আরেকটা কারন হলো, যে লোকটি সবকিছুর হোতা, তার জগৎ জোড়া নাম আছে এবং তার পেছনে মুসলিম দেশসমূহ, বিশেষ করে মুসলিম জনগনের একচ্ছত্র সমর্থন আছে। সুতরাং পৃথিবীর সকলের অজ্ঞাতে তাকে পাকড়াও করে শেষ করে দিতে চায় সরকার।’
‘লোকটি নিশ্চয় ধরা পড়বেই তাহলে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ সবাই এটা আশা করছে। জানেন গত তিনদিনে লোকটিকে সন্দেহ করে প্রায় ৮শ’র মত লোক আটক করা হয়েছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে সন্দেহ হলে তাকে যেন আর না ছাড়া হয়। জেলা পর্যায়ের কোন উর্ধ্বতন অফিসার পরীক্ষা করার পরই কোন লোককে শুধু ছাড়া যাবে।
‘এই ব্যবস্থা শুধু কি মাদ্রিদের জন্যে?’
‘না, হাইওয়ে গুলো এবং নদী পথ, রেলপথকেও এর সাথে শামিল করা হয়েছে।’
জো ডেমিংগো কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আপনার অনেক সময় নষ্ট করেছি, চলি এবার।’
জো ডেমিংগোর সাথী দু’জনও উঠে দাঁড়াল। ফিলিপও উঠে দাঁড়াল তাদের সাথে। ফিলিপ ওদের নিয়ে বেরিয়ে গেল। ফিলিপরা বেরিয়ে যাওয়ার অল্পক্ষণ পরেই ঘরে ঢুকল জোয়ান ও জেন।
জেনের মাথা ও গায়ে চাদর।
এক পাশে ভিন্ন এক সোফায় গিয়ে সে বসল।
জেন ও জোয়ানদের পর পরই ঢুকল ফিলিপ। ঢুকেই বলল, ‘আচ্ছা মুসা ভাই আপনি কি বাতাস থেকে বিপদের গন্ধ পান নাকি? গৃহ শুমারী কমিশনের লোকদের দেখে কি করে বুঝলেন যে, ওরা বাড়ী সার্চ করতে এসেছে এবং আপনাদেরকেই খুঁজতে এসেছে ওরা।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এটা একটা সাধারন অনুমানের ব্যাপার। যখন ঘোষণা তখন থেকেই গৃহ শুমারী শুরু কোন দেশে কোথাও কখনও হয়নি। পূর্বাপর অবস্থা সামনে নিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি, সরকার এই ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিটি বাড়ী সার্চের ব্যবস্থা নিয়েছে।
জোয়ান, আহমদ মুসার খুলে রাখা দাড়ি এবং গোঁফ বসে বসে নাড়ছিল। আহমদ মুসা থামতেই সে বলল, ‘আপনাকে ওরা চিনতে পারেনি তো মুসা ভাই? এই ছদ্মবেশ কি যথেষ্ঠ ছিল! আপনার ফটো নিশ্চ্য় ওদের কাছে ছিল।’
‘শুধু আমার নয় জোয়ান। তোমার এবং জেনের ফটোও তাদের কাছে ছিল। আমার সাথে তোমাদেরও খুঁজতে এসেছিল ওরা।’ বলে আহমদ মুসা জো ডেমিংগো’র কাছ থেকে পাওয়া সব কথা জোয়ন ও জেনকে শোনাল।
শুনতে শুনতে জোয়ান ও জেন দু’জনের মুখই মলিন হয়ে উঠল। তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠল উদ্বেগ।
যিয়াদ ও আবদুর রহমান গোটা সময় গো-বেচারার মত বসেছিল পাশের এক সোফায় পাশাপাশি। এতক্ষনণে মুখ খুলল যিয়াদ। বলল, ‘আল্লাহর হাজার শুকরিয়াহ। তিনি আপনার মাধ্যমে আমাদেরকে আর এক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছেণ। এখন বলুনতো, ওদের জাল ছিড়ে আমাদের বেরুতে হবে এবং সেটা অবিলম্বেই। সেটা কি ভাবে?
‘সেটা কি ভাবে, এখনি তা ভেবে দেখিনি যিয়াদ। এবারের পরিস্থিতিটা একেবারে ভিন্নতর। সংঘাতটা এবার আমাদের ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সাথে নয়, সংঘাত এবার খোদ সরকারের সাথে – সরকারের সেনা, পুলিশ ও ঝাঁক ঝাঁক গোয়েন্দার সাথে।’
‘সরকার এই ভাবে খড়গহস্ত হওয়ার ব্যাখ্যা কি মুসা ভাই? তাদের এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।’ মুখ মলিন করে বলল জোয়ান।
‘খুবই স্বাভাবিক জোয়ান। মূল অপরাধটা ক্লু-ক্ল্যাক্স ক্ল্যানের হলেও সব দায়-দায়িত্ব গিয়ে পড়েছে স্পেন সরকারের ঘাড়ে। মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি তার আচরণ এই সুত্রে প্রকাশ হয়ে পড়ায় সে ভীষণ বেকাদায় পড়েছে এবং অভিযুক্ত হয়েছে সে সাধারনভাবে সকলের কাছেই। চাপের মুখে মুসলমানদেরকে তাদের সকল অধিকার ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। এই পরাজয়ের সকল ক্রোধ গিয়ে পড়েছে আমাদের ওপর। পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার জন্যে সে মরিয়া হয়ে উঠেছে।’
আহমদ মুসা থামতেই ঘরে প্রবেশ করল গেটের একজন সিকিউরিটি।
সে এগিয়ে এসে ফিলিপের হাতে একটা ইনভেলাপ তুলে দিল।
ইনভেলাপটির মুখ বন্ধ। কোন নাম ঠিকানা লিখা নেই ইনভেলাপে।
‘কোথায় পেলে?’ সিকিউরিটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ফিলিপ।
‘একটা গাড়ী থেকে একজন লোক নেমে গেটের লেটার বক্সে এটা ফেলে গেল এইমাত্র।’ বলে সিকিউরিটি চলে গেল।
ফিলিপ খুলল ইনভেলাপ।
ইনভেলাপের মধ্যে ছোট্ট একটি চিরকুট। তাতে হিজি বিজি কি লিখা। সে পড়তে পারল না, চিনতেও পারল না কোন ভাষা।
ফিলিপ চিরকুটটি আহমদ মুসার হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘মনে হয় কোন সাংকেতিক ভাষায় লেখা।’
‘চিরকুটটি জোরে জোরে পড়ল আহমদ মুসা।
‘ফরাসী রাষ্ট্রদুত মিঃ প্লাতিনি বলেছেন তিনি আপনার পরিচিত। তার অনুরোধ, আজ রাত দশটায় তিনি ফরাসী কালচারাল সেন্টারের গেটে অপেক্ষা করবেন, তিনি আপনার সাক্ষাৎ চান।
আপনার চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়টি বিবেচনা করে আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন, এটা আপনাদের মত।’
চিরকুটে কোন সম্বোধন নেই, আবার কে লিখেছে তারও কোন নাম-পরিচয় নেই।
‘নিশ্চয় কোন সাংকেতিক ভাষা? কারা লিখেছে মুসা ভাই? মনে হচ্ছে পরিচিত কেউ?’ বলল ফিলিপ।
‘ফিলিস্তন মুক্ত করেছে যে আন্দোলন, সেই ‘সাইমুম’ এর নাম তোমরা সকলেই জান। এই সাংকেতিক ভাষা তাদের। ফিলিস্তিন দূতাবাস থেকে এই চিঠি এসেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখন রাত সাড়ে ৯টা। ১০টায় দেখা করতে হলে এখনি যাত্রা করতে হয়।’
‘কিন্তু মুসা ভাই চিরকুটে আপনার চলাচলকে মনে হয় নিরুৎসাহিত করেছে।’ ফিলিপ বলল।
‘নিরুৎসাহিত করেনি ফিলিপ, সাবধান করেছে। আমরা তো সাবধান আছিই।’
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘তোমরা কে ফ্রান্স কালচারাল সেন্টার চেন?’
‘আমি চিনি।’ ফিলিপ বলল।
‘তাহলে তুমি তৈরী হও, আমার সাথে যাবে।’
কিন্ত্মু মুসা ভাই, ফরাসী রাষ্টদুতকে কি এতটা বিশ্বাস করা যায় ?’ বলল জেন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘জেন, ফরাসী রাষ্টদুতকে হয়তো এতটা বিশ্বাস করা যায় না, কিন্তু ডোনার আব্বা মিঃ প্লাতিনিকে বিশ্বাস করা যায়। আমি ফরাসী রাষ্টদুতের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি না, আমি সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি ডোনার আব্বার সাথে।’
আর কেউ কোন কথা বলল না। ডোনার কাহিনী জেন ও ফিলিপ শুনেছে। অন্যেরা তো জানেই।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে উঠে দাঁড়াল ফিলিপ।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দু’জন তারা তৈরী হয়ে বেরিয়ে এল।
বেরিয়ে এল ওরা গাড়ী বারান্দায়।
‘ডোনার দেয়া গাড়ীটাই নাও ফিলিপ নম্বারটা পাল্টে নিও।’ বলল আহমদ মুসা।
গাড়ীর ড্রাইভিং সিটে বসল ফিলিপ। পাশের সিটে বসল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা কোন ছদ্মবেশ নেয়নি। শুধু মাঝারী সাইজের গোঁফ লাগিয়েছে মুখে।
ফিলিপ গাড়ী ষ্টাট দিলে আহমদ মুসা বলল, ‘এখান থেকে ফ্রান্স কালচারাল সেন্টারে পৌঁছতে কতটা বড় রোড ক্রসিং আছে?’
‘আমরা যদি এই সার্কুলার রোড হয়ে যাই, তাহলে আনেক গুলো ক্রসিং পার হতে হবে। আর যদি পাশের এইট্থ ষ্ট্রিট হয়ে ইসাবেলা এভেন্যু দিয়ে যাই, তাহলে একটি মাত্র রোড ক্রসিং পার হতে হবে।’
‘ঠিক আছে ইসাবেলা এভেন্যু দিয়ে যাও। ‘
চলতে শুরু করল গাড়ী।
বিশাল ইসাবেলা এভেন্যু। সেই তুলনায় গাড়ী অনেক কম। প্রায় ফাঁকা রাস্তা। ঝড়ের বেগে গাড়ী চালাচ্ছে ফিলিপ। স্পিডো মিটারের কাটা একশ’ তিরিশে উঠে থর থর করে কাঁপছে।
‘স্পিড কমাও ফিলিপ, কেউ আমাদের চলার মধ্যে কোন উদ্দেশ্য আবিস্কার করতে পারে।’
‘না মুসা ভাই, মাদ্রিদের ব্যাপার অন্যরকম। যে গাড়ীর যত স্পীড, মনে করা হয় সে গাড়ী তত বড় লোকের।’
‘ছোট একটা বাঁক ঘুরতেই সামনে অনেক আলোর গুচ্ছ দেখা গেল।
‘ওটাই একমাত্র ক্রসিং মুসা ভাই।’
‘দেখ ভালোয় ভালোয় ওটা পার হতে পারি কি না।’
ইসাবেলা এভেন্যুর ক্রসিংটিতে এক গুচ্ছ ফ্লাইওভার। তবে ইসাবেলা এভেন্যুটি ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে সরলভাবে সামনে চলে গেছে।
ফ্লাইওভারের কাছাকাছি আসতেই আহমদ মুসার নজরে পড়ল, ফ্লাইওভারের নিচেই একটা গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে হেলান দেয়া চারজন লোকও তার নজরে পড়ল।
ফ্লাইওভারের বিশ গজের মধ্যে আসতেই সামনে লাল সংকেত জ্বলে উঠল।
আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইলনা তাদের দাঁড়াতে বলছে ওরা কারা।
ফিলিপ আহমদ মুসার দিকে তাকাল। আহমদ মুসা বলল, ‘দাঁড়ালেই ভাল ফিলিপ।’
ঠিক ফ্লাইওভারের নিচে গিয়েই দাঁড়াল আহমদ মুসার গাড়ী।
গাড়ী দাঁড়াতেই চারজন সৈনিক এসে গাড়ী ঘিরে ফেলল। তাদের হাতে উদ্যত স্টেনগান।
ফ্লাইওভারের নিচে ওদের গাড়ী থেকে আরও দু’জন নেমে এল তারা সৈনিক নয়, তাদের পরনে সাদা পোষাক। তারা দু’জন গাড়ীর দু’পাশে দুই জানালায় এসে দাঁড়াল। তাদের হাতে টর্চ।
তরা একই সংগে আলো ফেলল আহমদ মুসা ও ফিলিপের মুখে। গভীর তারা পর্যবেক্ষন করল। আহমদ মুসাকে যে দেখছিল, সে কি বুঝল। পকেট থেকে বেছে বেছে একটা ফটো বের করল। আহমদ মুসার ফটো। আহমদ মুসার মুখের পাশে এনে দেখতে লাগল একবার আহমদ মুসার মুখ, আরেকবার ফটোটির দিকে।
লোকটি হঠাৎ এক টানে আহমদ মুসার গোঁফ খুলে ফেলে চিৎকার করে উঠল ‘পেয়েছি, পেয়েছি, আহমদ মুসাকে পাওয়া গেছে।’
চোখের পলকেই ঘটে গেল ঘটনা। ওরা পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের এমন ব্যবস্থা করেছে আহমদ মুসা তা ভাবেনি। তার ছদ্মবেশ খুব সাধারন হলেও এটা কোন সাধারন চোখে ধরা সম্ভব নয়। এ নিয়ে আহমদ মুসা নিশ্চিন্তই ছিল। ধরা পড়ার পরেই সে বুঝল, আইডেনটিফিকেশন এক্সপার্টদের ওরা কাজে লাগিয়েছে।
আহমদ মুসা যখন সব বুঝল, তখন সে চারটি স্টেনগান এবং দু’টি পিস্তলের মুখে।
লোকটি চিৎকার করে উঠার সংগে সংগে চার জন সৈনিকের একজন বাঁশি বাজাল।
বাঁশি বাজার মুহূর্ত কয়েক পরেই ফ্লাইওভারের ওপর থেকে এবং সামনে থেকে ছুটে আসতে লাগল আরও সৈনিক ও সাদা পোষাকের লোক।
গাড়ীর দু’পাশে ভীড় জমে গেল।
ফিলিপের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তার হাতে রিভলভার দেখল আহমদ মুসা। রিভলভারটা একজন সৈনিকও দেখতে পেয়েছিল। সে তার স্টেনগানের নল ফিলিপের মাথায় ঠেকিয়ে চিৎকার করে উঠল, দিয়ে দাও রিভলভার, না হলে মাথা ছাতু হয়ে যাবে এখুনি।
‘ওরা জিতে গেছে, দিয়ে দাও রিভলভার।’ স্বাভাবিক কন্ঠ আহমদ মুসার, ঠেঁটে হাসি।
‘দু’জনকে নামিয়ে আগে সার্চ কর।’ আরেক জন সৈনিক চিৎকার কওে উঠল।
গাড়ীর দু’পাশ থেকে দু’জন হাত বাড়িয়েছিল গাড়ী খোলার জন্যে। ঠিক এই সময়েই পেছন থেকে স্টেনগান গর্জন করে উঠল। দু’টি এবং এক সংগে।
মাত্র সেকেন্ড পাঁচেকের ঘটনা। গাড়ীর দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো লাশ হয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। রক্তের স্রোতে ডুবে গেল তারা।
স্টেনগান থেমে যাবার সাথে সাথে আহমদ মুসা ফিলিপকে ইংগিত করল গাড়ী ষ্টার্ট দেবার জন্যে।
ইংগিত পাওয়ার সাথে সাথেই লাফিয়ে উঠল গাড়ী। তীর বেগে ছুটল ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে।
গাড়ীটি ফ্লাইওভার ক্রস করেছে এই সময় ফ্লাইওভারের ওপর দু’টি রিভলভার গর্জন করে উঠল। আহমদ মুসার গাড়ীর পেছনে উইন্ড স্ক্রিন গুড়ো হয়ে গেল। কিছু ভাঙা টুকরো আহমদ মুসাদের সিটে এসে আঘাত করল। কিছু মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল।
পর পরই আরো দু’টি গর্জন শুনা গেল সেই ফ্লাইওভারের উপর থেকে রিভলভারের। কিন্ত্মু ততক্ষণে গাড়ী অনেক সামনে চলে এসেছে। গুলি দু’টো রাস্তার কংক্রিটে মুখ থুবড়ে পড়ল।
আহমদ মুসার গাড়ীর স্পীডোমিটারের কাটা তখন একশ’ পঞ্চাশ কিলোমিটারে।
আহমদ মুসা পেছনে চোখ রেখেছিল অনেক্ষণ পর মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘না কেউ অনুসরণ করছে না। সম্ভবত অনুসরণ করার মত লোক ওদের অবশিষ্ট নেই।’
যারা পরে গুলী করেছে, তারা গাড়ীর কাছে গিয়ে গাড়ী ষ্টার্ট দিতে অনেক সময় নেবে। ‘ওরা আসছে না, যারা আমাদের মুক্ত করল ?’ সামনে দুষ্টি রেখেই জিজ্ঞেসা করল ফিলিপ।
‘না ওরা আসছে না, আসবে না। আসলেও ভিন্ন পথ দিয়ে আসবে।’
একটু থামল আহমদ মুসা। থেমেই আবার বলল, ‘ভাঙা উইন্ডস্ক্রিন নিয়ে আমরা বেশী দুর এগুতে পারবো না। আর কতদূরে ফরাসী কালচারাল সেন্টার ?’
‘এসে গেছি, ঐ তো সামনে।’
ইসাবেলা এভেন্যুর ওপরেই ফরাসী দুতাবাসের কালচারাল সেন্টার।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটা।
ঘড়ি থেকে মুখ তুলেই আহমদ মুসা দেখল কালচারাল সেন্টারের গেটে গাড়ী। গেট খোলা। গেটে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং মিঃ প্লাতিনির মেয়ে।
আহমদ মুসা খুশী হলো তাকে দেখে।
গেটে গাড়ী আসতেই মিঃ প্লাতিনী এবং ডোনা একপাশে সরে দাঁড়াল এবং গাড়ীকে ভেতরে প্রবেশের ইংগিত করল।
গাড়ী ঢুকে পড়ার সংগে সংগে প্লাতিনি ভেতরে ঢুকে পড়ে হাতের একটা ক্ষুদ্র রেগুলেটরের সুইচ টিপে দূর নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় গেটটি বন্ধ করে দিল।
পেছনের উইন্ডস্ক্রিন ভাঙা গাড়ীর দিকে নজর পড়তেই উদ্বেগ আর দূর্ভাবনার ছাপ ফুটে উঠেছিল মিঃ প্লাতিনি এবং ডোনার চোখে মুখে। গেট বন্ধ হতেই তারা দু’জন ছুটল গাড়ী বারান্দার দিকে। তারা যখন গাড়ী বারান্দায় পৌঁছল, তখন আহমদ মুসা গাড়ী থেকে নামছিল।
‘তুমি, তোমরা ভালো আছো, কোন ক্ষতি হয়নি তো?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর মিঃ পস্নাতিনির।
‘গুড নাইট ভাইয়া।’ মিঃ প্লাতিনির কন্ঠ মিলিয়ে যাবার আগেই শুস্ক কন্ঠে ম্লান হেসে আহমদ মুসাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল ডোনা।
‘গুট নাইট বোন।’ ডোনার জবাব দিয়েই আহমদ মুসা মিঃ প্লাতিনির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘না জনাব আমরা ভালো আছি। শুধু মারাত্মক আহত হয়েছে ডোনার গাড়ীই।’ আহমদ মুসার মুখে হাসি।
‘আমার কোথায় গাড়ী, আপনাকে দিয়ে দিয়েছি না মালিকানা?’ ভ্রুকুটি করে বলল ডোনা।
‘তা ঠিক, সাবেক মালিকের নামে পরিচয় দিলাম মাত্র।’
‘গাড়ীর নাম্বার দেখি পাল্টেছেন।’
‘এখানে আসার আগে পাল্টালাম। এ নাম্বারের গাড়ীটা বিকল অবস্থায় একটা গ্যারেজে পড়ে আছে। গাড়ীর নাম্বার ওরা নিয়ে থাকলে বোকা বনবে।’
‘চল ভেতরে গিয়ে বসি।’ বলে মিঃ প্লাতিনি পা বাড়াল ড্রয়িং রুমের দিকে।
ডোনা ও মিঃ প্লাতিনি পাশাপাশি বসল। দু’পাশের দু সোফায় বসল আহমদ মুসা ও ফিলিপ।
আহমদ মুসা পরিচয় করিয়ে দিল ফিলিপকে মিঃ প্লাতিনি ও ডোনার সাথে।
‘বলত কি ঘটনা, রাস্তায় বড় কিছু ঘটেছে নিশ্চয় ?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠ মিঃ প্লাতিনির।
‘ঘটনা মানে রীতি মত যুদ্ধ’, শুরু করল আহমদ মুসা, ‘তবে যুদ্ধের সে ময়দানে আমরা ছিলাম বলা যায় নিরব দর্শক।’
‘খুলে বল আহমদ মুসা।’ প্লাতিনির চোখে নতুন আগ্রহ।
আহমদ মুসা শুরু থেকে সব ঘটনা খুলে বলল।
সব শুনে মিঃ প্লাতিনি বিষন্ন মুখে বলল, ‘এখন বুঝতে পারছি, আমার এভাবে আসতে বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু উপায় ছিল না বলে। পেছন থেকে ওরা সাহায্য না করলে কি হত বলত? পেছন থেকে সাহায্য করেছে ওরা কারা ছিল?’
‘আমি জানি না। জানতে পারিনি।’
‘জান না?’
‘এ ধরনের কোন শক্তি কিংবা কেউ এখানে আছে, এমন কোন ইংগিত কখনও পাইনি।’
‘আশ্চর্য ! তাহলে ওটা কি সরকার বিরোধী কোন গ্রুপ ? কিংবা কেউ তোমাদের ভুল করে সাহায্য করেনি তো?’
‘সেটাই এখন আমার কাছে অন্ধকার।’
‘আচ্ছা ভাইয়া, ওরা ধরে নিয়ে আটকাতে পারতো? বহুবার তো এমন আটকা পড়েছেন।’ বলল ডোনা।’
‘জানি না ডোনা, বহুবার নিজেকে ছাড়াতে পেরেছি, কিন্তু সব সময় তা পারব সেটা বলা যাবে না।’
‘যারা নিজের শক্তির এতটা বিবেচক, বিজয়ই তাদের ভাগ্য লেখা আহমদ মুসা। যাক, তোমাকে কয়েকটি কথা বলবার জন্যে ডেকেছি, হয়তো তুমি তা জেনেছও। তবু তোমাকে না বলে থাকতে পারছিলাম না।’
থামল মিঃ প্লাতিনি।
আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। উদ্গ্রীব হলো শোনার জন্যে।
‘প্রথমে তোমাকে,’ শুরু করল মিঃ প্লাতিনি, ‘ধন্যবাদ জানাই তোমার বিস্ময়কর সাফল্যের জন্যে। তুমি বিনা রক্তপাতে স্পেনে যে বিপ্লব করলে, আমি মনে করি, ফিলিস্তিনের বিপ্লবের চেয়ে তা ছোট নয়। যাদের অস্তিত্ব স্বীকৃত ছিল না, সেই মুসলমানরা বৈধ সংখ্যালঘু হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে, লাভ করেছে ধর্মপালন ও ধর্ম প্রচারের স্বাধীনতা। সর্বোপরি তারা ফেরত পেয়েছে তাদের ঐতিহাসিক স্থানগুলো। এখন আমার কি মনে হচ্ছে জান, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান মুসলিম ঐতিহাসিক স্থানগুলো ধ্বংসের জন্যে তেজস্ক্রিয় পেতে স্পেনের মুসলমানদের মহা উপকার করেছে। হিটলার ইহুদি নির্যাতন না করলে, যেমন ইসরাইল রাষ্ট্র এভাবে হতো না, তেমনি ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান মুসলমানদের ধ্বংসের চেষ্টা না করলে স্পেনে মুসলমানদের এই উত্থান ঘটত না। আন্তর্জাতিক সহানুভূতি ও সহযোগিতা একটা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ষড়যন্ত্র নিউজ মিডিয়ায় আনার যে ঐতিহাসিক সিন্ধান্ত গ্রহন করেছিলে তার ফলেই অসম্ভব সম্ভবে পরিনত হয়েছে। এ ঐতিহাসিক সিন্ধান্ত গ্রহনের জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।’ থামল একটু প্লাতিনি।
সেই ফাঁকে আহমদ মুসা বলল, ‘কিন্তু এ সিন্ধান্ত বাস্তবায়নে আপনারা সকলে সহযোগিতা করেছেন।’
মিঃ প্লাতিনি আহমদ মুসার কথার দিকে কর্ণপাত না করে বলে চলল, ‘কিন্তু তোমার সাফল্য যত বিরাট, সে রকমই বিরাট শত্রুতা তুমি অর্জন করেছো স্পেনের শাসক মহলের। তোমাকে, জোয়ানকে, জেনকে ধরার জন্যে বিশেষ করে তোমাকে জীবিত অথবা মৃত ধরার জন্যে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমি এ সম্বন্ধে কিছু বলার জন্যেই তোমাকে ডেকেছি।’
থামল প্লাতিনি। সতৃষ্ণ চোখে তাকাল একটু দুরে টেবিলে রাখা অভিজাত মদ শ্যাম্পেনের বোতল ও খালি গ্লাসের দিকে। তারপর ঠোঁটে একটু হাসি টেনে বলল, ‘তোমরা শ্যাম্পেন, বিয়ার, কোন মদই খাও না। অবাক ব্যাপার আহমদ মুসা, তোমার সাথে সাক্ষাতের সময় থেকে ডোনাও মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তুমি যাদু জান না কি?’
‘যাদু জানলে তো আপনিও ছেড়ে দিতেন।’ বলল আহমদ মুসা একটু হেসে।
‘ছাড়িনি বটে, তবে এই দেখ এখন খাচ্ছি না, অথচ এক বুক তৃষ্ণা বুকে। এটাই কি কম যাদু!’
‘যাদু নয় আব্বা, আম্মা বলেন, ভালো মুসলমানদের চরিত্রে এমন একটা প্রভাব আছে যা মানুষকে তার অলক্ষ্যে পরিবর্তিত করে ফেলে’, বলল ডোনা
‘সত্যি নাকি আহমদ মুসা?’
‘মনুষ্যত্ব, সততা, সদাচার এবং স্রষ্টার প্রতি আত্নসমর্পিত মানুষের একটা বিশেষ শক্তি থাকে। এই গুণ গুলো যার মধ্যেই থাকবে সে সেই শক্তির অধিকারী হবে। ইসলাম মানুষকে এসব গুণের অধিকারী হওয়ার শিক্ষা দেয়।’
‘অন্য ধর্মও তো এ শিক্ষ দেয়।’ বলল মিঃ প্লাতিনি।
‘দেয় বটে, কিন্তু তার পেছনে সুনির্দিষ্ট এবং প্রশ্নাতীত স্রষ্টার বিধান নেই বলে তা নিঃস্বার্থ ভাবে পালিতও হয় না, তেমনি তার পেছনে কোন নৈতিক শক্তিও সৃষ্টি হয় না।’
‘অর্থাৎ তুমি বলছ, অন্য ধর্মের বিধান গুলো অসম্পুর্ন এবং বিরোধপূর্ন। তাই এর প্রতিপালনের মাধ্যে মানুষ কোন নৈতিক শক্তিও পায় না এবং নিঃস্বার্থতাও তাদের আসে না।’ বলল মিঃ প্লাতিনি।
‘এটা ঐ ধর্মগুলোর কোন দোষ নয়। স্বাভাবিক এটা। সব ধর্মই স্রষ্টার। কিন্তু মানুষের প্রয়োজনে তিনি এক ধর্ম বাতিল করে অন্য ধর্ম দিয়েছেন। সর্বশেষ এবং আধুনিক ঐতিহাসিক ধর্ম ইসলাম। ইসলাম আসার পর অন্য সব ধর্ম বাতিল হয়ে গেছে। অন্য সব ধর্মের অসম্পুর্ণতা, বিরোধপূর্ণতা, ঐশি বিধান অবিকৃত অবস্থায় না থাকা, প্রভৃতি ঐ ধর্ম গুলো বাতিল হয়ে যাবারই প্রমান।’
‘ঠিক আছে আহমদ মুসা, এস এবার দর্শন থেকে বাস্তবে আসি। আমি যে কথা বলছিলাম। স্পেন সরকার কার্যত তোমাদের তিনজনকে ধরার জন্যে দেশে জাতীয় অবস্থা ঘোষনা করেছে। কি টাইট পাহারার ব্যবস্থা করেছে তোমরা কিছুটা টের পেয়েছ আসার সময়। আমি মনে করি অবিলম্বে তোমাদের মাদ্রিদ ত্যাগ করা দরকার। কিন্তু ভাবছি কিভাবে। সে জন্যেই তোমাকে ডাকা।’
‘আপনার পরামর্শ কি বলুন।’
‘বিমান পথে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। নদী ও সড়ক পথে পাহারার বেড়াজাল। গোপনে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এবং দেশের সব ক্রিমিনালদের ব্যবহার করা হচ্ছে। ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ফটো সবখানে – নদী বন্দর, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, হোটেল, রেস্তোরা কোন কিছুই বাদ রাখা হয়নি। এই অবস্থায় সড়ক, নৌপথও নিরাপদ নয়। আমি ভাবছিলাম, আমি কোন সাহায্য করতে পারি কি না।’
‘কি ভাবে?’
‘ডোনা বলছে, আমার গাড়িতে যদি তোমরা যাও তাহলে নিরাপদে যাওয়ার একটা হতে পারে। কুটনীতিকের গাড়ী, বিশেষ করে ইউরোপীয় কোন কুটনীতিকের গাড়ী সার্চ হবে না। তোমার মত কি বল?’
আহমদ মুসা চিন্তা করে বলল, ‘সার্চ হয় না, কিন্তু যদি হয়?’
‘আমি পরিবার নিয়ে সড়কপথে প্রায় যাতায়াত করি। সার্চ হবে তা মনে করি না।’
আহমদ মুসা ভাবল কিছুক্ষন। তারপর বলল, ‘আপনার এ প্রস্তাবের জন্যে ধন্যবাদ।’
কিন্তু আমাদের জন্যে আপনি কোনও ভাবে বিপদগ্রস্থ হন আমি চাই না। আপনি শধু একজন ব্যাক্তি নন, আপনি একটি দেশ। আপনার কিছু হলে সেটা দেশের ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে আপনাকে দু’দিক থেকে বিপদগ্রস্থ হতে হবে।’
‘প্রকাশ হলে তুমি যা ভয় করছ তা ঘটবে। প্রকাশ হওয়ার ভয় করছ কেন?’
‘জনাব আপনার দেশের প্রতি, আপনার লোকজনের প্রতি সম্মান রেখে আমরা বলছি, আপনার সব লোকের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে কি আপনি শতভাগ গ্যারান্টি দিতে পারেন? আমি মনে করি পারেন না। এমনও হতে পারে, এই এ্যামবেসির অথবা সংশ্লিষ্ট কেউ আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ মনিটর করছে।’ থামল আহমদ মুসা।
মিঃ প্লাতিনি তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না, বলতে পারল না। তাঁর পলকহীন দৃষ্টি আহমদ মুসার ওপর নিবদ্ধ। তার সে দৃষ্টিতে বিস্ময়, আনন্দ, শ্রদ্ধা চিক চিক করছে।
অভিভূতের মত প্লাতিনি অনেক্ষন আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে গিয়ে আহমদ মুসার কপালে চুম্বন করল। ধীর কন্ঠে বলল, ‘তুমি আমার ছেলের বয়সের। কিন্তু আজ তোমার কাছে যে শিক্ষা আমি পেলাম তা কোন দিন আমি ভুলব না। তুমি যা বললে সেটা আমি জানতাম না তা নয়। কিন্তু আমার ব্যাপারে আমি ভাবিনি। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’
বলে মিঃ প্লাতিনি তার জায়গায় ফিরে এল। বসেই বলল, ‘আহমদ মুসা তোমার সম্পর্কে আমি অনেক শুনেছি। কিন্তু যা শুনেছি তার চেয়ে তুমি বড়। তুমি আমার নিরাপত্তার কথা ভাবলে, আমার ভালোর দিকটা চিন্তা করলে, কিন্তু তোমার কথা তুমি ভাবলে না, একটা সুন্দর সুযোগ তুমি গ্রহন করলে না। অন্যের জন্যে এমন করে ভাববার মত মানুষ আজকাল চোখে পড়ে না। সত্যিকার মুসলমানেরা কি এমনই হয়ে থাকে আহমদ মুসা?’
‘একজন মুসলমানের ঘোষনা হলো, আমার জীবন, আমার মরন, আমার সাধনা, আমার কোরবানী সব কিছু বিশ্ব নিয়ন্তা আল্লাহর নামে নিবেদিত। এই ঘোষনা দেয়ার মাধ্যমে একজন মুসলমান আল্লাহর স্বার্থ অর্থাৎ আল্লাহর বান্দাদের স্বার্থ, মুক্তি ও মঙ্গল চিন্তাকে অগ্রাধিকার দেয়।’
‘ঐ ঘোষণাবাণী কি তোমার ধর্মগ্রন্থের?’
‘জি হ্যাঁ।’
‘কিছু মনে কর না, একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করব। ভাল মানুষের গড়া সূখের স্বর্গরাজ্য গঠনের চিন্তাকে এখন আমরা আকাশচারী চিন্তা বলি। তোমার মত কি?’
‘আমি যে ঘোষনার কথা বললাম, সে ঘোষনা দেয়ার সাথে সাথে মানুষ সোনার মানুষ হয়ে যায়। সে সোনার মানুষ দিয়ে সুখের স্বর্গরাজ্য গড়া সম্ভব এই মাটির পৃথিবীতে।’
‘তুমি আমাকে সম্মোহন করছ আহমদ মুসা। মনে হচ্ছে একটা আশার আলো যেন আমি দেখতে পাচ্ছি।’ মিঃ প্লাতিনির ঠোঁটে স্বচ্ছ এক টুকরা হাসি।
‘আব্বা, আমি ভূমিকা সহ, ‘মিনিং অব দ্যা কোরআন’- এর প্রথম খন্ড পড়ে শেষ করেছি। তুমি পড়ে দেখ, শুধু আশার আলো নয় সোনালী সুর্যোদয় তুমি দেখতে পাবে।’
‘ও বইটা তো দেখিনি, কোথায় পেলি?’
‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীতে।’
‘বুঝলে আহমদ মুসা’, আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল মিঃ প্লাতিনি, ‘আমি অনেক মুসলিম দেশে ছিলাম। ইসলামের ওপর কিছু কিছু বই পড়েছি। মিশেছি অনেকের সাথেই। কিন্তু তোমার সাথে মিশে, তোমাকে দেখে, তোমার কথা শুনে যে ইসলামকে পেলাম, যা আমাকে সম্মোহন করেছে বললাম, সেই ইসলাম কোথাও দেখিনি। থাক এসব কথা এখন, আসল কথায় ফিরে আসি। তুমি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছ। যুক্তিও দিয়েছ। এ যুক্তি অস্বীকার করার সাধ্য আমার নেই। এখন বল এ সংকটের সমাধান কিভাবে? আমি খুবই উদ্বেগ বোধ করছি তোমাদের নিয়ে।’
‘জেন ও জোয়ানকে আমি ট্রিয়েস্টে পাঠাতে চাই। ওখানে আই সি টি পি’তে ওদের চাকুরী হয়ে আছে। জোয়ান প্রতিশ্রুতিশীল একজন বিজ্ঞানী, জেনও বিজ্ঞানের প্রতিভাদীপ্ত ছাত্রী। এই মূল্যবান দম্পতির জন্যেই আমি উদ্বিগ্ন। চিন্তা করে দেখলাম, এই দু’জনের দায়িত্ব আপনি নিতে পারেন, ওদেরকে স্পেনের বাইরে নিতে সাহায্য করতে পারেন।’ থামল আহমদ মুসা।
মিঃ প্লাতিনির চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘নিলাম দু’জনের দায়িত্ব। কিন্তু তোমার কি হবে? তুমিই তো আসল টার্গেট।’
‘আল্লাহ ভরসা। আমাকে নিয়ে চিন্তার দায়িত্বটা আল্লাহর হাতে তুলে দিতে চাই। তিনি আমাকে একা স্পেনে এনেছেন, তিনিই আমাকে স্পেন থেকে বের করবেন।’
মিঃ প্লাতিনি, ডোনা, এমনকি ফিলিপের চোখেও নেমেছে আবেগাপ্লুত একটা বিষয়। কেউ কথা বলছে না। তারা যেন বোবা হয়ে গেছে। নিজের মাথার ওপর যখন বিপদের আকাশ ভেঙে পড়েছে, তখন নিজের কথা না ভেবে কর্মীর নিরাপত্তা বিধানের চিন্তায় ব্যস্ত। নিজের ভারটা ছেড়ে দিয়েছে স্রষ্টার হাতে!
আবেগাপ্লুত মিঃ প্লাতিনি উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আহমদ মুসা তুমি সার্থক নেতা, তুমি সার্থক বিপ্লবী। যে ভয়, উদ্বেগ, চিন্তা কোন কিছুই নিজের জন্যে না রেখে সব কিছু স্রষ্টার ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয় সে হয় দুর্বার, তাকে জয় করা কঠিন। তাই তুমি অজেয় আহমদ মুসা।’
ডোনার চোখে দু’ফোটা অশ্রু বিদ্যুতের আলোয় চিক চিক করে উঠল। তার গভীর নীল চোখে অখন্ড এক ভাবালুতা। যেন কোন রূপকথার রাজ্যে সে বিচরণ করছে।
গর্বে ফুলে উঠেছে ফিলিপের বুক আহমদ মুসার ভাই এবং সাথী হওয়ার গৌরবে।
মিঃ প্লাতিনি ফিরে এসে তার সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘আজ আমি ও ডোনা তোমাদেরকে দিয়ে আসব এবং বাড়িটা চিনে আসব। কাল ভোর পাঁচটায় জোয়ান ও জেনকে নিয়ে ফ্রান্সে যাত্রা করব। এখান থেকে আমি ও ডোনা ভোরে একবারেই বেরুব। ওদেরকে তুলে নিয়ে যাতে সোজা চলে যেতে পারি।’
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘একটা সুন্দর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে অফিসের চোখ থেকে আপনি বাঁচবেন।’
‘এই ব্যবস্থায় তুমি যেতে পার না?’
‘আমি এবং জেন ও জোয়ান এক নই। ওদের ব্যাপারে কৈফিয়ত দেয়ার অনেক আছে। আপনি বলতে পারবেন, জেন ও জোয়ান স্পেনের দু’জন সম্মানিত নাগরিক। তারা কোন ব্যাপারে অভিযুক্ত কি না তা আপনার জানা নেই, তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পত্রিকায় কিংবা কোনওভাবে প্রকাশ হয়নি। তাই তাদের বহন করে আপনি কোন অন্যায় করেন নি।’
হাসল প্লাতিনি। বলল, ‘বুদ্ধিতে তোমার সাথে জিততে পারবো না। তবে ভালই হলো তোমার যুক্তিটা পেয়ে। হয়ত একথাটা আমার মাথায় নাও আসতে পারতো।’
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল।
মিঃ প্লাতিনিও তাকাল তার ঘড়ির দিকে। বলল, ‘চল তোমাদের দিয়ে আসি।’
উঠল ডোনা।
সবাই বেরিয়ে এল।
গাড়ী বারান্দায় দাঁড়ানো মিঃ প্লাতিনির গাড়ী।
ড্রাইভিং সিটে বসল ডোনা। পাশে মিঃ প্লাতিনি। পেছনে সিটে আহমদ মুসা ও ফিলিপ।
ডোনা স্টার্ট দিল গাড়ীতে।
গাড়ী স্টার্ট দিয়ে ডোনা পেছনে না তাকিয়েই বলল, ‘ভাইয়া আপনি কোন পথে কি ভাবে স্পেন থেকে বের হবেন জানি না। কিন্তু মন্টেজুতে আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করব। আপনি না যাওয়া পর্যন্ত আমি জেন ও জোয়ানকে ছাড়ব না।” ভারী ও কাঁপা শোনাল ডোনার কন্ঠ।
‘কথাটা আল্লাহর কাছে বললেই ভালো হয় ডোনা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাঁকে আমি বলব। আপনাকে জানালাম।’
গাড়ী রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে।
ছুটে চলল গাড়ী ইসাবেলা এভেন্যু ধরে।