যখন সাতদিন পেরিয়ে গেল জেনের তরফ থেকে কোন যোগাযোগ হলোনা, তখন জোয়ান উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল, আহমদ মুসাও।
কথা ছিল, জেন গিয়ে টেলিফোন করবে না, কারন সে বাড়িতে ফেরার পর তাদের টেলিফোন টেপ হতে পারে। কিন্তু অন্য কোনভাবে তার খবরাখবর জোয়ানদের জানাবে। ফিলিপের মায়ের কাছে সে চিঠি লিখতে পারে। তবে চিঠি সে নিজে পোস্ট করবে না, বাড়ীর কাউকে দিয়েও না। কিন্তু সাতদিন পার হয়ে গেলেও জেন কিছুই জানাল না।
অবশেষে উদ্বিগ্ন জোয়ান আহমদ মুসার সাথে পরামর্শ করে আবদুর রহমানকে আজ পাঠিয়েছে হান্নার কাছে। একমাত্র হান্নার কাছ থেকেই জেনের সব খবর নিরাপদে পাওয়া যেতে পারে। আবদুর রহমানকে সরাসরি জেনের বাড়ীতে পাঠানো হয়নি, কারণ সেখানে গিয়ে অপরিচিত কেউ জেনের কথা জিজ্ঞাসা করা উচিত হবে না।
নাস্তার পর আটটার দিকে আবদুর রহমান গেছে হান্নার বাড়ীতে। জোয়ানের চিঠি নিয়ে গেছে সে।
সেই থেকে জোয়ান ফিলিপের ড্রইং রুমে বসে আবদুর রহমানের অপেক্ষা করছে।
জোয়ান ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল বেলা ১১টা। অল্প ক্ষণের মধ্যেই আবদুর রহমান এসে পড়বে। সে কি দেখা পেয়েছে হান্নার? কি খবর আনবে সে? জেন এ পর্যন্ত কোন খবর দিল না কেন? অসুখ বিসুখ করলো নাতো? এসব প্রশ্ন তোলপাড় করছে জোয়ানের মনকে।
বাইরে থেকে এসে আহমদ মুসা প্রবেশ করল ড্রইং রুমে। জোয়ানের পাশে বসতে বসতে বলল, ‘আবদুর রহমান তো এখনো আসেনি দেখছি।’
‘হ্যাঁ, বেশ দেরী করছে, বোধহয় দেখা পায়নি হান্নার।’ বলল জোয়ান।
ঠিক এই সময়ই ড্রইংরুমে এসে প্রবেশ করল আবদুর রহমান। তার মুখটা ভাবলেশহীন।
‘তুমি বহুদিন বাঁচবে আবদুর রহমান, এইমাত্র তোমার নাম করলাম আমরা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দোয়া করুন মুসা ভাই, আমার নবী যতদিন দুনিয়ায় ছিলেন তার বেশী যেন থাকতে না হয়।’ বলল আবদুর রহমান।
‘কি খবর ভাই, হান্নাকে পেয়েছিলেন?’ বলল জোয়ান।
‘প্রথমবার গিয়ে পাইনি, বাড়ী ছিল না। ঘুরেফিরে আবার গিয়েছিলাম, পেয়েছি।’
‘খবর কি?’ বলল জোয়ান।
‘জেন যেদিন গিয়েছিল, সেদিনই হান্নাকে টেলিফোন করেছিল। তারপর আর কোন কথা হয়নি। পরদিন হান্না জেনদের বাসায় যায়, কিন্তু বাসাটা জনশূণ্য এবং তালাবদ্ধ। গেটে দারোয়ানও নেই।’
থামল আবদুর রহমান।
কারো মুখে কোন কথা নেই।
জোয়ানের মুখ মলিন।
আহমদ মুসা গম্ভীর।
আহমদ মুসাই প্রথম কথা বলল, ‘কোথায় গেছে তারা, কোন আত্মীয় বাড়ী, অথবা মাদ্রিদের বাইরে এসব বিষয়ে কোন খবর নিতে পারেনি হান্না?’
‘হান্না বলেছে, তার ধারণা জেনরা কোন আত্মীয় বাড়ী, অথবা মাদ্রিদের বাইরে কোথাও বেড়াতে যায়নি। এমনটা ঘটলে বাড়ীর গেটে দারোয়ান থাকতো।’ বলল আবদুর রহমান।
‘হান্না ঠিক বলেছে। আমার মনে হয় জেনকে নিয়ে তার আব্বা আম্মারা আত্মগোপন করেছে। এ বিষয়টা যাতে জানাজানি না হয়, তাদের নতুন ঠিকানা যাতে প্রকাশ না হয়ে পড়ে, এজন্যেই দারোয়ানকে সরানো হয়েছে। যাতে যোগাযোগের কোন প্রকার ক্লু কেও না পায়। এখন প্রশ্ন হলো, জেনের কি অবস্থা, সে বন্দী না মুক্ত?’ বলল আহমদ মুসা।
‘প্রথমদিন টেলিফোনের পর আর কোন যোগাযোগ করেনি জেন হান্নার সাথে। হান্নার ধারণা, এ ধরনের যোগাযোগের সুযোগ জেনের নেই, তাকে হয়তো এ সুযোগ দেয়া হচ্ছে না।’ বলল আবদুর রহমান।
‘এটাই ঠিক। আসলে জেনের যাওয়া ঠিক হয়নি, যেতে দেয়া ঠিক হয়নি। জেন যে কাজ করেছে তাতে তাকে আটকানোই স্বাভাবিক।’ বলল জোয়ান।
‘ওর মার অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর আমরা তো তাকে বাধা দিতে পারি না। অসুস্থ মায়ের সাথে দেখা করার জন্যে জেনো আগ্রহী হওয়া স্বাভাবিক ছিল। বিজ্ঞাপনটা যে ফাঁদ ছিল জেনও তা মনে করেনি, আমরাও মনে করিনি। ভুলটা এখানেই হয়েছে আমাদের।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বিজ্ঞাপনটা ফাদ ছিল মনে করেন মুসা ভাই?’ বলল জোয়ান।
‘ফাঁদ না হলে এরকমটা ঘটতো না। প্রস্তুতি ছিল বলেই জেন যাওয়ার পর দিনই তারা স্থানান্তর হতে পেরেছে। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছিনা, জেনকে সরালেই তারা পারতো। সবাই সরে গেছে কেন? এর তো কোন প্রয়োজন ছিল না।’
‘মুসা ভাই এমনকি হতে পারে না যে, ওরা বাধ্য হয়েছে সরে যেতে।’ বলল জোয়ান।
‘কার দ্বারা বাধ্য হবে? কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানতো নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
থেমেই আহমদ মুসা আবার শুরু করল, ‘জেন এতবড় ঘটনা ঘটিয়েছে এটা কি স্পেন সরকার জানতে পেরেছে মনে কর জোয়ান?’
‘কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান জানে যখন, সরকারের কানে সেটা যাওয়া সেটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এদিকটা আপনি ভাবছেন কেন মুসা ভাই?’ বলল জোয়ান।
‘সরকারের ভূমিকা একদম বাদ দিয়ে চিন্তা করা আমাদের ঠিক নয়। স্পেন সরকার যে কারণে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ওপর ক্ষেপেছে, সেই একই কারণে জেনের ওপর ক্ষেপতে পারে। কারণ এতবড় বিপর্যয়ের ঘটনা জেনের ডকুমেন্ট পাচারের ফলেই ঘটেছে। সুতরাং কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের চেয়ে জেনকে তারা দায়ী করবে এই ঘটনার জন্যে। তাছাড়া জেন আমাকে, তোমাকে সাহায্য করেছে, আমাদের আশ্রয়ে ছিল এটাও তার অপরাধ।’
‘ঠিক বলেছেন মুসা ভাই। স্পেন সরকার এখন সবচেয়ে বেশী ক্ষ্যাপা আপনার ওপর, আমার ওপর।’ বলল জোয়ান।
‘হান্নাও তাই বলল। সে জানাল, জোয়ানকে খুব সাবধানে থাকতে বলবেন, পারলে মাদ্রিদ কিংবা স্পেনের বাইরে যেন চলে যায়। সরকার জোয়ানকে এবং আহমদ মুসাকে হন্যে হয়ে খুজছে। তাদের মতে এ পর্যন্ত যা ঘটেছে তা আহমদ মুসার পরিকল্পনার ফল।’ বলল আবদুর রহমান।
‘হ্যাঁ বুঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা। তাহলে এখন করনীয় কি আমাদের?’ বলল জোয়ান।
‘প্রথম কাজ জেন কোথায় জানা, দ্বিতীয় কাজ তাকে মুক্ত করা। অন্য কোন কাজ এখন আর আমাদের নেই। স্পেনের মরিস্করা জেগে উঠেছে, সাহস ফিরে পেয়েছে। মুসলিম বিশ্বও তাদের পক্ষে স্পেন সরকারকে চাপ দেবার উপযুক্ত হাতিয়ার পেয়ে গেছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সমাজও স্পেনের মুসলমানদের পক্ষে এগিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে স্পেনের মুসলমানদের নতুন এক শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত হবার সুযোগ এনে দিয়েছে। আল হামদুলিল্লাহ! এ সুযোগ কাজে লাগাবার জন্যে যিয়াদ বিন তারিক ও ফিলিপের লোকেরা নিরলসভাবে কাজ করছে। এখন এতবড় কাজ যার সাহায্যে আমরা করলাম, সেই জেনকে উদ্ধার করা আমাদের এক নম্বর দায়িত্ব।’ বলল আহমদ মুসা।
জোয়ানের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে আবদুর রহমানের দিকে চোখ তুলে চাইল। বলল, ‘হান্নার মধ্যে আপনি সহযোগিতার ভাব কেমন দেখেছেন?’
‘খুবই আন্তরিক মনে হয়েছে। দেখলাম, জেনকে সে খুব ভালবাসে, তোমার প্রতিও খুব সহানুভূতিশীল। সে নিজ থেকেই বলেছে জেনকে খুজে বের করার চেষ্টা সে করছে।’ বলল আবদুর রহমান।
‘মুসা ভাই, আমরা যদি হান্নাকে অনুরোধ করি, তাহলে সে এই কাজে আরও তৎপর হতে পারে।’
‘তা আমরা করব। কিন্তু আরও পথ আমাদের বের করতে হবে।’
থামল আহমদ মুসা। তার কপাল কুঞ্চিত, চিন্তা করছে সে। এক সময় বলল, ‘জোয়ান বলতে পার মিঃ জেমেনিজ নিয়মিত যান এমন কোন ক্লাব বা প্রতিষ্ঠান আছে?’
‘নিয়মিত যান বলতে পারবোনা। তবে MEC ক্লাবের সদস্য তিনি এবং সেখানে তিনি যান।’ বলল জোয়ান।
‘MEC এর পুরা নামটা বল।’
‘মাদ্রিদ এলডার্স ক্লাব।’
‘তোমাকে ধন্যবাদ জোয়ান, নামটা প্রমাণ করছে তিনি সেখানে যাবেন, যান। নিশ্চয় ক্লাবটা এলিট মানে উচু তলার লোকদের জন্যে?’
‘ঠিক বলেছেন, টপ পলিটিসিয়ান, টপ আমলা, টপ ব্যবসায়ীদের আড্ডা এটা।’
‘কোথায় এ ক্লাবটা?’
‘স্প্রিং লেকের উত্তর তীরে।’
‘তুমি চেন আবদুর রহমান?’ আবদুর রহমানের দিকে চেয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘ক্লাবে কোন দিন যাইনি, তবে লোকেশনটা জানি।’
‘চল আবদুর রহমান ক্লাবটা থেকে ঘুরে আসি।’
‘এখন তো কাউকে পাবেন না। বিকেল ৫টা থেকে সেখানে অতিথি আসা শুরু হয়।’ বলল জোয়ান।
‘কেন অফিস পাব না? এমন ক্লাবগুলোর অফিস বিভাগটা দিনে সক্রিয় থাকে।’
‘তা পাবেন।’ বলল জোয়ান।
‘না, আবদুর রহমান, তুমি এই মাত্র ঘরে এলে। তুমি রেস্ট নাও, ক্লাবের লোকেশানটা আমি বুঝেছি। আমি বের করে নেব।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
‘না মুসা ভাই, আমি মোটেই ক্লান্ত নই। রেস্ট নেয়ার কোন দরকারই আমার নেই।’ আবদুর রহমান আহমদ মুসার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাল।
জোয়ানও সমর্থন করল আবদুর রহমানকে।
‘ঠিক আছে, আমার আপত্তি নেই।’ বলে আহমদ মুসা তার ঘরের দিকে চলল তৈরী হবার জন্যে।
আবদুর রহমানও উঠে গেল তার ঘরের দিকে।
আহমদ মুসা যখন বেরিয়ে এল দেখা গেল তার মুখে গোঁফ এবং ভ্রু দুটিকে আরোও গভীর করা হয়েছে। এতটুকু ছদ্মবেশেই আহমদ মুসাকে একদম ভিন্ন মানুষ মনে হচ্ছে।
জোয়ান হৈ হৈ করে উঠে বলল, আমিও না জানলে চমকে উঠতাম দেখে।
‘ধন্যবাদ জোয়ান, তাহলে এটুকু ছদ্মবেশে কাজ কিছুটা চলতে পারে, কি বল?’
‘চলবে মানে বেশ চলবে।’
আবদুর রহমান ড্রইং রুমে এলে দুজনে বেরিয়ে এল।
মাদ্রিদ এলডার্স ক্লাবের সামনে গিয়ে যখন আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান পৌছল, তখন বেলা ১২টা।
মাদ্রিদ এল্ডার্স ক্লাব ক্লাসিক ডিজাইনের প্রাসাদের মত এক বিশাল বাড়ীতে অবস্থিত। সামনে প্রকাণ্ড ফটক।
ফটক খোলা। মুর্তির মত দুপাশে দুজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে।
ভেতরে প্রবেশের অনুমতি শুধু সদস্যদের জন্যেই।
গাড়ী থেকে নেমে গট গট করে গেটের দিকে চলল আহমদ মুসা। তার পেছনে আবদুর রহমান।
কি পরিচয় দেব আমরা, ঢুকতে দেবে তো? বলল আবদুর রহমান।
আমরা সত্য কথাই বলব। বলল আহমদ মুসা।
গেটে পৌছতেই একজন দারোয়ান এগিয়ে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বলল, ‘আমরা জেমেনিজ ডে সিসনারোসার কাছে এসেছি। আমরা তার বন্ধু।’
‘তিনি তো নেই এখন।’ বলল দারোয়ান।
‘আসবেন তিনি। কেন এ সময় তিনি আসেন না?’
‘সাধারণতঃ আসেন না।
‘গতকাল তিনি ক’টায় এসেছিলেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘গতকাল নয়, পরশু এসেছিলেন ৭টায়। তাও কয়েকদিন পর।’
‘কেন নিয়মিত আসেন না?’
‘আসেন। তবে সপ্তাহ খানেক থেকে নিয়মিত নয়।’
‘দারোয়ানদ্বয় গেট থেকে সরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসারা প্রবেশ করল ভেতরে।
প্রবেশের পর প্রথমেই বিলাশ রিসেপশন রুম। মূল্যবান সোফায় সাজানো। ঘরের একপাশে রিসেপশন কাউন্টার। কেতাদুরস্ত একজন মহিলা বসে।
সদস্যদের সাথে কেউ দেখা করতে এলে তারা এই রিসেপশনে অপেক্ষা করেন।
আহমদ মুসা রিসেপশনে প্রবেশ করে সোজা চলে গেল কাউন্টারে। বলল, ‘ম্যাডাম আমরা জেমেনিজ ডে সিসনারোসার জন্যে অপেক্ষা করতে চাই, তাঁর আসার কথা আছে।’
আহমদ মুসা এই অভিনয়টা একটা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। আহমদ মুসার টার্গেট জেমেনিজের নতুন ঠিকানা, কমপক্ষে টেলিফোন যোগাড় করা। জেমেনিজের জন্যে বেশ সময় অপেক্ষা করার পর যখন তিনি আসবেন না, তখন কাউন্টারে গিয়ে সাহায্য চাইবে; তাঁর সাথে অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন, দেখা না করলেই নয়, ঠিকানাটা অথবা টেলিফোন নাম্বারটা দিন অথবা দয়া করে এখনই যোগাযোগ করে দিন। এ ধরণের অনুরোধে রিসেপশনের কাছ থেকে অবশ্যই সহযোগিতা পাওয়া যাবে। যদি নাই পাওয়া যায়, তাহলে রিসেপশনিষ্টের হাতের কাছ সযতনে রাখা ‘মেম্বারস গাইড’ বইটা সে ছিনতাই করবে।
রিসিপশনিষ্ট সসম্ভ্রমে নরম সুরে বলল, ‘আপনারা দয়া করে বসুন। খুব বেশী হলে আধ ঘন্টা আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে। সাড়ে বারটায় অর্থ কমিটির মিটিং আছে। তার আগেই তিনি এসে যাবেন।’
আহমদ মুসা ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এসে বসল সোফায়।
ধন্যবাদ জানাল বটে হাসিমুখে, কিন্তু ভেতরে চাঞ্চল্য অনুভব করল আহমদ মুসা। এযে চাওয়ার চেয়ে বেশী পাওয়া। এই পাওয়াটা কি ভাল হবে? তারা তো জেমেনিজের সাথে দেখা করতে আসেনি, এসেছে তার ঠিকানা যোগাড় করতে।
আবদুর রহমানের চোখে আশংকার ছাপ। চুপ করে থাকতে পারলনা। বলল, ‘যদি এসে পড়েন, তাহলে কি হবে। আমাদের মিথ্যা কথা ধরা পড়ে যাবে? আর কি পরিচয় দেব আমরা?’
‘তুমি নিশ্চিন্তে বস আবদুর রহমান। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে তো আমরা যেতে পারবো না। ভেবনা, অনেক সময় আল্লাহ তার বান্দাকে চাওয়ার চেয়ে বেশী দিয়ে ফেলেন।’ হাসি মুখে বলল আহমদ মুসা। তার নিশ্চিত মুখ। প্রথমটায় যে একটা চাঞ্চল্য এসেছিল তা কেটে গেছে।
আহমদ মুসার নিশ্চিত মুখ দেখে আবদুর রহমান আশ্ব্স্ত হলো। কিন্তু তার মনে খোঁচার মত বিধেই চলল কথাটা যে, জেমেনিজের কাছে তারা তাদের কি পরিচয় দেবে আর কি কথাই বা তারা বলবে তাঁকে।
আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান দু’জনই ষ্ট্যান্ড থেকে ম্যাগাজিন নিয়ে তাতে চোখ বুলাচ্ছিল।
সময়টা যেন খুব তাড়াতাড়িই চলে গেল।
তখন ঠিক ১২টা ২০ মিনিটি।
একজন দীর্ঘদেহী প্রৌঢ় ব্যক্তি প্রবেশ করল রিসেপশন রুমে। সুন্দর-সুগঠিত দেহ। সাদা লালে মেশানো সুন্দর চেহারা।
সে প্রবেশ করতেই রিসেপমনিষ্ট উঠে দাঁড়াল।
রিসেপশনের পাশ দিয়ে ভদ্র লোক চলে যাচ্ছিল। রিসেপশনিষ্ট তাকে কিছু বলল।
ভদ্রলোক ফিরে তাকাল আহমদ মুসাদের দিকে। তার চোখে একটা তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফুঠে উঠল। তারপর সে রিসেপশনিষ্টের দিকে ফিরে কি বলে ভেতরে চলে গেল।
রিসেপশনিষ্ট আহমদ মুসাদের কাছে এল। বলল, ‘চলুন স্যার। তাঁর রুমে যেতে বলেছেন।’
আহমদ মুসারা উঠল।
‘রিসেপশনিষ্ট একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, এই ঘর, যান আপনারা।’ বলে চলে গেল রিসেপশনিষ্ট।
বন্ধ দরজার নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে প্রবেশ করল আহমদ মুসারা।
একটা ফাইলের ওপর ঝুঁকে পড়ে ছিল জেমেনিজ ডে সিসনারোসা, আমার সাথে কথা বলতে চান আপনারা?
‘জি হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি কি আপনাদের চিনি?’
‘আমরা জোয়ানের বন্ধু, জেনের শুভাকাঙ্খী।’
জেমেনিজ আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে ছিল। আহমদ মুসার মুখ থেকে কথা বেরুবার সংগে সংগে জেমেনিজের মুখের ওপর দিয়ে একটা পরিবর্তনের স্রোত বয়ে গেল। তার চোখে মুখে কঠোরতার চেয়ে বিষ্ময়ের ভাবটাই এখন বেশী। কিছক্ষণ এভাবে চেয়ে থাকার পর বলল, ‘তোমরা জোয়ানের বন্ধু, তোমরা এখানে! তোমরা জাননা কিছু?’
‘জানি, কিন্তু খুব জরুরী প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি প্রয়োজন?’
‘জেনের কোন সংবাদ জোয়ান পাচ্ছে না।’
‘আমার মেয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে। আর কি সংবাদ তার চাই?’
‘কিন্তু আমরা মনে করছি জেনকে আটক করা হয়েছে।’
‘চোখে মুখে একটা বিমর্ষের ছায়া নামল জেমেনিজের। অল্পক্ষণ একদৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আটক হলে সেটাই কি স্বাভাবিক হবে না?
‘আপনাদের দিক থেকে স্বাভাবিক।’
‘তোমাদের দিক থেকে?’
‘অন্যায়।’
‘আচ্ছা সে কথা যাক, এসেছ কেন?’
‘জেনের খবরটা জানতে।’
‘বেশ জেনে গেছ।’
‘একটু বাকি আছে, আপনার ঠিকানাটা।’
‘ঠিকানা কেন দরকার?’
‘জেনের সাথে আমরা দেখা করব।’
‘এত সাহস তোমাদের? জান সেখানে পুলিশ পাহারা আছে?
‘জানি।’
‘জানার পরও তার সাথে দেখা করতে যেতে চাচ্ছ?’
‘আমাদের আর তো কোন বিকল্প পথ নেই।’
‘কেন আমার সাহায্য তো চাইলেনা? সোজা চাইলে আমার বাড়ীর ঠিকানা।’
‘কোন সাহায্য আপনি করতে পারবেন না। আপনার মেয়ে আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বন্দী আছে।’
‘অপার বিষ্ময় ফুটে উঠল জেমেনিজের চোখে মুখে। বলল, ‘জানলে কি করে?’
‘আপনার সাথে এতক্ষণ ‘আলোচনার মাধ্যমে।’ আপনার হাতে আপনার মেয়ে বন্দী থাকলে আপনার গোটা আচরণ ভিন্ন রকম হতো।’
‘বিষ্ময় ভরা চোখে জেমেনিজ বলল, ‘আমার কথা শুনে, আমাকে দেখে তোমাদের আর কি মনে হচ্ছে?’
‘আপনি অসহায় অবস্থায় আছেন, আপনি কারো সাহায্য চান।’
‘বিষ্ময়ে বিষ্ফোরিত হয়ে গেল জেমেনিজের চোখ। বলল, ‘এটা বুঝলে তোমরা কেমন করে?’
‘বিনা জিজ্ঞাসাবাদে অপরিচিত দু’জন লোকের সাথে এই ধরণের সাক্ষাতে আপনার রাজী হওয়া থেকে।’
‘আমাকে তুমি হতবাক করেছ বৎস। কে তুমি! জোয়ানের বন্ধু মহলে এমন অসাধারণ কেউ আছে বলে তো জানি না। তোমার নাম কি বৎস্য?’
আমি আহমদ মুসা। আর এ আবদুর রহমান।
‘কি বললে তোমার মানে, আপনার নাম আহমদ মুসা!’ বিষ্ময়াভিভূত কণ্ঠে কাঁপা গলায় বলল জেমেনিজ।
বলে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ঠিক, এই দুঃসাহস, এই অসাধারণ বুদ্ধি আহমদ মুসারই হবে। কিন্তু এ আপনার ঠিক হয়নি। আপনি যান। আমার সাথে গোয়েন্দা এসেছে। গেটের সামনে তারা দাড়িয়ে আছে, কেমন করে যাবেন? আপনি জানেন না গোটা মাদ্রিদে, গোটা ষ্পেনে সেনা, পুলিশ, গোয়েন্দা মাছির মত ছড়িয়ে পড়েছে আপনাকে খুঁজে বের করার জন্যে। আপনি যান। অস্থির কণ্ঠ জেমেনিজের।
‘আমরা যাচ্ছি। আমাদের জন্যে আপনার কোন ক্ষতি হোক তা আমরা চাই না। কেউ জানতেই পারবে না আমরা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু ঠিকানাটা?’
‘জেমেনিজ খস খস করে একটা কাগজে লিখে আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বরল, ‘ঠিকানা দিলাম। কিন্তু জেনের সাথে দেখা করতে আপনারা পারবেন না, সে বন্দী আছে। আমরাও আপনাদের কোন সাহায্য করতে পারবো না তাও আপনারা জানেন।’
‘দয়া করে একটা কথা জেনকে বলবেন, তার কোন চিন্তা নেই। জোয়ান ভাল আছে। বলল আহমদ মুসা।
‘সত্যি জেনের চিন্তার কিছু নেই।’ চোখ উজ্জ্বল করে বলল জেনেনিজ।
‘হ্যাঁ জনাব।’
‘কিন্তু আপনারা ভাবছেন কি জেন জোয়ানের কি হবে? গোটা দেশ তাদের বিরুদ্ধে।’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ জেমেনিজের।
‘আমি এটুকু বলতে পারি, আল্লাহর চেয়ে বড় কোন শক্তি নেই’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার কথায় আমার আস্থা আছে বৎস।’
‘তাহলে চলি জনাব।’
বলে আহমদ মুসা ও আবদুর রহমান পা বাড়াল বেরুবার জন্যে জেমেনিজের কক্ষ থেকে।
‘কিন্তু আপনারা যাবেন কি করে? গেটে তো গোয়েন্দা পুলিশ।’ ব্যাকুল কন্ঠ জেমেনিজের।
‘কোন অসুবিধা নেই, আমরা ওদের বলব মিঃ জেমেনিজ বাড়ী বদলেছেন। আমাদের কিছু লেন দেন ছিল তার সাথে। আমরা ব্যবসায়ী।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসারা। হাঁটতে হাঁটতে বলল আহমদ মুসা, ‘মেয়েকে আটকে রাখায় তার আত্মসম্মানে যেমন ঘা লেগেছে, তেমন মনের দিক থেকেও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন মিঃ জেমেনিজ। এ ধরণের পরিস্থিতি তার জন্যে একেবারেই নতুন।’
‘জেনকে আটক করল কেন?’ বলল আবদুর রহমান।
‘তার মুখ থেকে কথা বের করার জন্যে। জেন তো আমাদের অনেক কিছুই জানে। তাছাড়া তারা মনে করছে, তাকে আটকে রাখলে জোয়ানকে, তার সাথে আহমদ মুসাকেও হয়তো হাজির করতে পারবে।’
‘এ পরিবারটি স্পেনে অত্যন্ত পপুলার, তাদের এ খবর প্রচার হলে সরকারের অসুবিধা হবে।’
‘অসুবিধা নেই। তারা বলবে পরিবারটির নিরাপত্তার জন্যেই এটা করেছে। শুধু মেয়েটিকেই তারা বেরুতে দিচ্ছে না, অন্য কারো উপর নিয়ন্ত্রণ নেই।’
ফটক দিয়ে বেরিয়ে আহমদ মুসা দেখল, ফটকের ডানপাশে দুজন লোকের সাথে দারোয়ান কথা বলছে। আহমদ মুসা বুঝল, এরা সেই দুই টিকটিকি।
গেটের বামপাশে ছিল আহমদ মুসাদের গাড়ী। ফটক থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসা গাড়ীর দিকে চলল।
গাড়ীতে উঠে বসল, এমন সময় টিকটিকি দু’জন গাড়ীর জানালায় দাড়াল। একজন আহমদ মুসা কে লক্ষ্য করে বলল, মাফ করবেন, আপনাদের পরিচয়টা দয়া করে বলবেন?’
‘আমরা ব্যবসায়ী। জেমেনিজের সাথে একটা লেনদেন ছিল। হঠাৎ সে বাড়ী বদল করেছে। নতুন বাড়ী আমরা চিনিনা। এখানেই উনি আসতে বলেছিলেন।’
কথা বলতে বলতেই গাড়ী স্টার্ট দিয়েছিল আহমদ মুসা। কথা শেষ হবার সাথে সাথে সাঁ করে বেরিয়ে গেল গাড়ী।
টিকটিকি দু’জন বাধা দিল না। বোধ হয় উত্তর তারা পেয়ে গিয়েছিল।
গাড়ীটা সদর রাস্তায় পড়লে স্পিডটা আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আবদুর রহমান এখন কি করা যায় বল, ঠিকানাটা তো পাওয়া গেল।’
‘মুসা ভাই ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও স্বপ্নের মতই মনে হচ্ছে। কার্ডিনাল পরিবারের বিখ্যাত জেমেনিজ ডে সিসনারোসা আমাদেরকে এই ভাবে সাহায্য করলেন?’
‘বললাম তো তোমাকে, মেয়ে গৃহবন্দী হওয়ায় ক্রুদ্ধ হয়েছে জেমেনিজ। কারডিনাল পরিবার বলেই তাদের বংশীয় অহমিকা আকাশস্পর্শী। জেনকে গৃহবন্দী করায় সে অহমিকা বোধে ঘা লেগেছে। মনে হয় বাড়ী পরিবর্তনও জেমেনিজের মতানুসারে হয়নি। তার ওপর জেন তাদের একমাত্র মেয়ে। একমাত্র মেয়ের পছন্দে বাধ সেধে তাকে কষ্ট দিতে চায় না। গুলিবিদ্ধ হয়ে জেন যখন ডকুমেন্ট চুরি করে চলে আসে, মনে হয় তখনি তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, জেন যখন ফিরবেনা, তখন জোয়ানের সাথেই তার বিয়ে হোক। এসব কারণ একত্রিত হয়ে জেমেনিজকে মেয়ের পক্ষ নিতে বাধ্য করেছে।’
‘আপনার কি মনে হয় মুসা ভাই, কথা আদায়ের জন্যে জেনকে কি তারা কোন কষ্ট দিচ্ছে?’
‘আমার মনে হয়না। সেরকম হলে মিঃ জেমেনিজ সেটা আমাদের বলতেন, এমনকি সাহায্যও চাইতেন।’
একটু থেমে আহমদ মুসাই আবার বলল, ‘ঠিকানা আমরা পেয়েছি, এখন কি করা যায় বলত? এদিকে ফিলিপ যিয়াদরা মাদ্রিদে নেই।’
‘কখন কি ঘটে যায়। আমি মনে করি, সময় ক্ষেপন ঠিক নয়, জেনকে মুক্ত করার কাজে আমরা এগুতে পারি।’
‘তোমার কথা ঠিক। তবে আমরা এগুবার আগে ঠিকানা সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ খবর নেবার মত সময় আমাদের নেয়া প্রয়োজন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এটুকু সময় আমাদের অবশ্যই নেয়া প্রয়োজন।’ বলল আবদুর রহমান।
আহমদ মুসা কোন কথা বললনা। তার দৃষ্টি তখন সামনে প্রসারিত।
ছুটে চলছে গাড়ী তীর বেগে।