এদিকে ভাসকুয়েজ এয়ারকন্ডিশন ঘরে বসে ঘামছে।
রাত তখন ২ টা।
ইন্টারকমে অফিস প্রশাসক ভেগাকে আসতে বলল।
ভাসকুয়েজের চুল উস্কো-খুস্কো।
চোখ দু’টি লাম।
টেবিলের সামনে কয়েকটি ট্রাভেল ব্যাগ ঠিক ঠাক করে রাখা।
টেবিলের ওপর টেলিপ্রিন্টারে আসা নিউজের স্তুপ। নিউজগুলো তার তেজস্ক্রিয় ডকুমেন্ট গুলোর ওপর। WNA এবং EWNA দু’টি সংবাদ সংস্থাই নিউজ করেছে।
রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নিউজ EWNA করলনা। ভাসকুয়েজ তখন খুশি হয়ে উঠেছিল। ভেবেছিল তার লবী কাজ দিয়েছে। কিন্তু রাত ১১ টায় তাকে বিস্মিত করে নিউজ প্রচার শুরু করে WNA এর পনর মিনিট পর EWNA এর টেলিপ্রিন্টার নিউজ আসতে থাকে।
একেবারে আকাশ থেকে পডে ভাসকুয়েজ।পশ্চিমে সংবাদপত্রসহ বিশের সংবাদ পত্র খবরটা ছাপাবে। আর এর প্রতিক্রিয়া কি হবে তা সে ভালো করেই জানে। ইতিমধ্যেই ভাসকুয়েজ খবর পেয়েছে জাতিসংঘে ডকুমেন্ট গুলো পৌছেছে। খোদ ও আই সি এ ব্যাপারে লবী করেছে। তার সাথে যোগ দিয়েছে জাতিসংঘের থার্ডওয়ার্ল্ড গ্রুপ। অর্থাৎ ভীষণ হৈ চৈ হবে বিষয়টা নিয়ে। ভাসকুয়েজের সব চেয়ে বড় ভয় স্পেন সরকারের প্রতিক্রিয়াকে। স্পেন সরকার নিজে অপবাদ থেকে বাঁচার জন্য কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ওপর খড়গ হস্ত হবে। সবচেয়ে বড় টার্গেট হবে ভাসকুয়েজ।
এসব ভেবে চিন্তে ভাসকুয়েজ দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার পরিবার ইতিমধ্যে বিমান বন্দরে পৌঁছে গেছে। ঘরে ঢুকল ভেগা। দাঁড়াল টেবিলের সামনে।
ভাসকুয়েজ চোখ তুলল তার দিকে।
‘শুনেছ তো আমি দেশের বাইরে যাচ্ছি। আমরা একটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছি। অবস্থা ভালো হলে আমি ফিরে আসব।’
একটা ঢোক গিলল ভাসকুয়েজ। তারপর শুরু করল, ‘তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না। আমি টাকার ব্যবস্থা করে গেলাম। একাঊণ্টেণ্ট তোমাদের যখন যা প্রয়োজন দেবে। আর অফিস থেকে মুল্যবান জিনিসপত্র আজকেই সরিয়ে নাও। কাল থেকে অফিস বন্ধ থাকবে।’
বলে উঠে দাড়াল ভাসকুয়েজ। বলল বেয়ারাকে পাঠিয়ে ব্যাগগুলো গাড়িতে দাও।
বেরিয়ে এল ভাসকুয়েজ।
ক’মিনিট পর কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সদর দপ্তর থেকে একটা গাড়ি বেরিয়ে বিমান বন্ধরের উদ্দেশ্যে ছুটল।
৪
জেনের আব্বা জেমেনিজ যে সিসনারোসা ঘরে ঢুকল তার মুখে অস্বস্তির চিহ্ন।
প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকেছিল। সকালে টেলিফোন করে জেমেনিজকে আনুরোধ করেছিল। প্রেসিডেন্ট এবং তিনি জেমেনিজের সাথে অত্যন্ত জরুরী কিছু কথা বলতে চান। জেমেনিজ কষ্ট করে গেলে তারা বাধিত হবেন। জেমেনিজ দেখতে পাচ্ছিল দেশ এক সঙ্কটজনক অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছে। জেনের চুরি করা ডকুমেন্ট দুনিয়াময় প্রচার হওয়ার পর স্পেনীয় কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সর্বনাশ তো হয়েছেই স্পেন সরকারও ভীষণ চাপের মধ্যে পডেছে। যার ফলাফল সে নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ পাওয়ার পর জেমেনিজ বিস্মিত হয়ছিল প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দেশের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করবেন কু–ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সম্পর্কেও তাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে? এ সব চিন্তা করে জেমেনিজেরও মনে হয়েছিল আলোচনা নিশ্চয় খুব জরুরী। তাই জেমেনিজ টেলিফোন পাওয়ার পর আর দেরি করেনি।
জেমেনিজ যখন ঘরে ঢুকল জেনের আম্মা তখন শুয়ে। অত্যন্ত মলিন চেহারা। দেহের সব রস শুকিয়ে তার দেহটা যেন চুপসে গেছে। জেন চলে যাওয়ার পর জেনের আম্মা শয্যা নিয়েছে। জেন তাদের একমাত্র সন্তান। একমাত্র সন্তান গুলিবিদ্ধ হওয়া এবং তার কোন খোঁজ না পেয়ে জেনের আম্মা খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে যখন সে শুনেছিল মাদ্রিদের কোন হাসপাতালে, ক্লিনিক, ডাক্তার খানায় জেনকে পাওয়া যায়নি, পুলিশ গোয়েন্দা বিভাগ ও কু–ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান মিলে চেষ্টা করেও জেনকে বের করা যায়নি জেনের মা তখন জ্ঞান হারিয়েছিল। তারপর যেদিন সে দেখল জেনের নিয়ে যাওয়া ডকুমেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর খবর হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে বিশ্বের সংবাদ সমুহে সেদিন জেনের মা আশা ফিরে পেয়েছে যে জেন বেঁচে আছে এবং যারা এতবড় কাজ করেছে তাদের কাছে জেন ও জোয়ান ভালই থাকবে। তাছাডা এ বিষয়টাও জেনের মাকে আশ্বস্ত করেছে যে আহমদ মুসা শুধু অসাধারণ কুশলী একজন বিপ্লবীই নন খাটি মুসলিম চরিত্র আছে তার। আর একজন খাটি মুসলমান পরিচয় নির্বিশেষে সব মানুষকে ভালোবাসে, বিপদগ্রস্ত সকলকে সাহায্য করে। এসব চিন্তা জেনের মা’র মনকে কিছুটা সুস্থ করে তুলেছে। খাওয়া দাওয়া কিছু শুরু করেছে।
দরজার দিকে মুখ করেই শুয়েছিল জেনের আম্মা। জেনের আব্বার মুখের অস্বস্তির কালো ছায়াটা দেখতে পেল।
জেমেনিজ কাপড় ছেড়ে ফিরে এল ঘরে।
জেনের আম্মা উঠে বসল।
জেমেনিজ এসে বসল তার পাশে। বলল, ‘কেমন লাগছে আজ?’
‘ভালো। দেখা হলো ওদের সাথে?’
‘হয়েছে।’
‘কথার ফলাফল বোধ হয় খুব ভাল হয়নি।’
‘একথা বলছ কেন?’
‘তোমার মুখে একটা অস্বস্তির ছায়া দেখছি।’
‘অস্বস্তির কথাই তো, দেশ এখন খুব অসুবিধায়।’
‘কি শুনলে?’
‘অনেক কথা।’
‘খারাপ কিছু?’
‘অবশ্যই। মাদ্রিদের শাহ ফয়সাল মসজিদ সহ মুসলিম ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল পুতে রাখার অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এবং ইউনেস্কোর যৌথ কমিটি সবগুলো ঐতিহাসিক স্থানের মাটি পরীক্ষা করেছে। সব জায়গাতেই তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া গেছে একটা।’
‘তা হলে ঐ সব স্থানের সবগুলো বিল্ডিং কি এখন ধসে যাবে?’
‘না তেজস্ক্রিতার সবে প্রাথমিক অবস্থা। আরও বছর খানেক বিকিরণ চললে সে অবস্থার সৃষ্টি হতো।’
একটু থামল জেমেনিজ। তারপর আবার শুরু করল, ‘যে কথাটা বলেছিলাম। এই তেজস্ক্রিয়তা প্রয়োগকে একটা জাতির অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য ধ্বংসের একটা জঘন্য ষড়যন্ত্র এবং মানবতার বিরুদ্ধে এক অপরাধ হিসাবে দেখছে জাতিসংঘের একটা মহল এবং বিশ্বের অনেকে মনে করছে স্পেন সরকারও এর সাথে জড়িত আছে। স্পেন সরকারকে বলা হয়েছে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুলগুলো তুলে ফেলা হবে। তবে এর সমূদয় খরচ বহন করতে হবে স্পেন সরকারকে। স্পেন সরকারকে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতে হয়েছে যদিও এটা অপমানকর। সবচেয়ে….’
‘অপমানকর কি করে? কথার মাঝ খানে বলে উঠল জেনের মা।’
‘স্পেন সরকার বলেছিল তারা নিজেরাই তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল তুলে নেবে। কিন্তু স্পেন সরকারকে বিশ্বাস করা হয়নি। এখন তারা কাজ করবে খরচ দিতে হবে স্পেনকে এটা অপমানকর নয়?’
কথা শেষ করে আগের কথায় আবার ফিরে গেল জেমেনিজ। বলল, ‘সবচেয়ে অপমানকর হলো মুসলিম ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো এখন মুসলিম কম্যুনিটির হাতে ছেড়ে দিতে হবে। জাতিসংঘের সমাজিক সংস্থা বিপুল ভোটাধিক্যে এ সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে।’
‘বল কি? এতবড় সিদ্ধান্ত নিল কি করে? নিতে পারল কি করে?’ বলল জেনের আম্মা বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে।
বিশ্বের ৫৫টি মুসলিম দেশ এবং তাদের সংগঠন ও আই সি এই ব্যাপারে গোটা দুনিয়া জুড়ে লবীং করেছে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে গোটা থার্ডওয়ার্ল্ড লবী। তারাই জাতিসংঘের এখন সামাজিক সংস্থার মত সংগঠনে তো বটেই। সুতরাং মুসলমানদের অনুকুলে সিদ্ধান্ত পাশ করাতে বেগ পেতে হয়নি। আমাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে যুক্তিটা কাজ করেছে, সেটা হলো আমরা ঐতিহাসিক স্থানগুলোর প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন কারন ওগুলো সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থাই আমরা করিনি।’ বলল জেমেনিজ।
‘জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তো করডোভা, গ্রানাডা, সেভিল, মালাগা, টলেডো শুধু নয়, সারাগোসা, লিস্তন, জাহিন ও স্যালমনিকার মত শহরের বৃহত্তর অংশ ওদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।’
‘হ্যাঁ তা যাবে।’
‘স্পেন সরকার কি মেনে নেবে?’
‘না মেনে উপায় কি?’
‘স্পেনের জন্য এটা একটা বিরাট ব্যাপার হবে।’
‘এর চেয়েও বড় ঘটনা আছে।’
‘সেটা কি?’ বিস্মিত কণ্ঠ জেনের আম্মার।
‘তুমিও তো খবর পড়েছ যে করডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, টলেডো, সেভিল প্রভৃতি শহর ছাড়া খোদ মাদ্রিদেও মরিস্করা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে, মিছিল করেছে। তারা দাবী করেছিল মুসলিম হিসাবে তাদের সংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে সংখ্যালঘু জাতি গোষ্ঠী হিসাবে তাদের ন্যায্য অধিকার দান সহ তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে হবে। তাদের এসব দাবীর পক্ষে মুসলিম দেশগুলোর এবং ও আই সি র কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে গোটা তৃতীয় বিশ্ব ও বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থা গুলো সোচ্চার হয়েছে। গত পরশু জাতিসংঘের সামাজিক কমিশন আরেক প্রস্তাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, মরিস্কদেরকে সংখ্যালঘু হিসাবে সংবিধানিক ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং মুসলমানদেরকে সংখ্যালঘু হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদেরকে সকল নাগরিক অধিকার দিতে হবে। তাদের সম্পত্তি ও বাড়ি ঘর ফিরিয়ে দিতে হবে।’
থামল জেমেনিজ।
জেমেনিজ থামলেও জেনের মা কোন কথা বলতে পারলোনা। বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে তার মুখ। অনেক্ষন পর বলল, ‘এতবড় ঘটনা ঘটল কি করে? জানি তুমি বলবে মুসলিম দেশ গুলো লবীং করে জাতিসংঘকে দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বলত রাজধানী মাদ্রিদসহ এতগুলো শহরে মরিস্করা বিক্ষোভ প্রদর্শন করল কি করে? যারা ভয়ে নাম প্রকাশ করে না, পরিচয় দেয়না, তারা এ ভাবে সংঘবদ্ধ হলো কি করে, এ সাহস পেল কোথায়?’
‘এক কথায় তোমার প্রশ্নের উত্তরঃ আহমদ মুসা। এ সবকিছুর মূলে রয়েছে তার পরিকল্পনা ও প্রয়াস।’
‘কিন্তু আহমদ মুসা তো একজন মানুষ।’
‘অর্গানাইজ করতে একজন মানুষই লাগে। আহমদ মুসার নেতৃত্বে কাজ করেছে ‘নিউ ফ্যালকন অব স্পেন’ বলে পরিচিত গ্রানাডা অঞ্চলের যিয়াদ বিন তারিক এবং বাস্ক গেরিলা নেতা ফিদেল ফিলিপের দলে কার্যরত মুসলমানদের একটা শক্তিশালী গ্রুপ। প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তাতে বুঝেছি, যিয়াদ বিন তারিকের দল ও বাস্কের মুসলমানরা স্পেনের শহরে শহরে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে মরিস্কদের সংঘবদ্ধ করে ঐ সব শহরে জড়ো করে বিক্ষোভ মিছিলের ব্যবস্থা করেছে।’
‘কেন তাদের ধরা যায়নি?’
‘সরকার সার্বক্ষনিক শ্যেন দৃষ্টি রেখেছিল আহমদ মুসা ও জোয়ানের উপর। কিন্তু সরকারের রিপোর্ট মতে তারা মাদ্রিদ থেকে বের হয়নি। মাদ্রিদে বসে আহমদ মুসা কলকাঠি নেড়েছে। যিয়াদ বিন তারিক এবং বাস্কদের কোন মুসলমান নেতাকে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ চেনে না। তাই ওদের বাধা দেয়া যায় নি, ধরা যায়নি।’
থামল জেমেনিজ। থেমে পা দু’টো খাটের উপর তুলে ভালো করে বসল, জেনের আম্মার মুখোমুখি। তারপর শুরু করল, ‘দেখ, সরকার আহমদ মুসাকেই মনে করছে সব নষ্টের মূল। তারা মনে করে জোয়ানকে হাত করে জোয়ানের মাধ্যমে জেনকে ফুসলিয়ে সে রাজী করিয়েছে ঐ ডকুমেন্ট চুরি করার জন্যে। জেন বন্ধু জোয়ানকে সাহায্য করেছে মাত্র। আর ডকুমেন্ট গুলোকে জেন সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে করেনি। সরকার জেনকে কোন দোষ দিচ্ছে না। জেনকে উদ্ধারের জন্যে সরকার আগের চেয়ে অনেক বেশী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু কিছুতেই তার সন্ধান করা যাচ্ছে না।’
থামল একটু জেমেনিজ। একটা ঢোক গিলল। তারপর বলল, ‘সরকার একটা পরামর্শ দিয়েছে।’
‘পরামর্শ! কি পরামর্শ?’ জেনের আম্মার চোখে কৌতুহল।
‘তুমি খুবই অসুস্থ, এমন খবর দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে। তাদের বলতে হবে তুমি একটি বারের জন্যে জেনকে দেখতে চাও।’
‘জেন আসবে?’ জেনের আম্মার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘আমার এবং সবার ধারনা সে আসবে। সে আমাদের একমাত্র সন্তান। সে একটা কাজ করেছে বটে, কিন্তু তোমার অসুস্থতার কথা শুনলে সে স্থির থাকতে পারবে না।’
‘সে তো ভয় করতে পারে।’
‘ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে ভয় করার ছিল, কিন্তু ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান তো এখন নেই। ভাসকুয়েজ দেশ ত্যাগ করেছে। উর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা যারা ঘটনা কিছু কিছু জানত তারা গ্রেফতার হয়েছে। সুতরাং তার তো ভয় করার কিছু নেই।’
‘কেন সরকারকে ভয় করবে না?’
‘তার বিষয়টা তো সরকারের জানার কথা নয়। আমরা জানি, আর খুব বেশী হলে ‘ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান জানবে, এটাই সে জানে।’
‘আমিও তো এটাই জানি, কিন্তু বল তো সরকার জেনের ব্যাপারে জানলো কি করে?’ চিন্তিত কন্ঠে বলল জেনের আম্মা।
‘ভাসকুয়েজই গোয়েন্দা বিভাগকে জানিয়ে গেছে।’
জেমেনিজ কথা শেষ করলেও জেনের আম্মা কথা বলল না। ভাবছিল সে। কিছুক্ষন পর বলল, সরকার এখন তো জানে, সরকার আহমদ মুসা ও জোয়ানের উপর খুব ক্ষ্যাপা। জেনকে আবার সরকার আটকাবে নাতো?’ চিন্তিত কন্ঠ জেনের আম্মার।
‘না জেনকে তারা আটকাবে কেন? হয়তো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। তার বেশী কিছু নয়।’
‘একটা কথা বলব?
‘কি কথা?’
‘মেয়ের সিদ্ধান্তের সাথে আমাদের কোন দ্বিমত করা ঠিক হবে না।’
‘কোন সিদ্ধান্তের কথা বলছ?’
‘জেন জোয়ানকে পছন্দ করে।’
‘সেটা বুঝেছি, আগে হলে বিরোধিতা করতাম। এখন তার কোন যৌক্তিকতা দেখিনা।’
‘ঠিক বলেছ।’
‘কিন্তু তুমি আমি কি সত্যিই সুখী হতে পারব? তুমি নিশ্চয় জান, কার্ডিনাল পরিবারের জন্যে এটা কত বড় আঘাত। যে কার্ডিনাল পরিবার মরিস্কদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতা, সেই কার্ডিনাল পরিবারের নয়নের মনি যাবে পরিস্ক পরিবারে।’
‘জেন তো জানতো না জোয়ান মরিস্ক।’
‘পরে তো জেনেছে।’
‘তা জেনেছে, কিন্তু তুমি বল জোয়ান অন্য সব দিক দিয়েই উপযুক্ত কি না।’
‘কিন্তু মানুষটি কে, তার রক্ত কি, এই বিবেচনাই সবচেয়ে বড় নয়কি?’
‘তুমি অন্যভাবে নিওনা, মরিস্কদের মানে মুসলমানদের রক্ত তুমি ছোট মনে কর?’
‘ছোট-এর সংজ্ঞা তো অনেক আছে।’
‘যে সংজ্ঞাই ধর, ওরা রাজার জাতি, নেতৃত্বের গুণ ওদের রক্তের সাথে মিশে আছে, ওদের স্বাধীন সত্ত্বা কেউ ধ্বংস করতে পারে না, স্পেন শত শত বছরেও পারেনি।
‘বুঝেছি মেয়ে তোমাকে ভাল ভাবেই দলে টেনেছে।’
‘ওকথা বলোনা, মেয়েটা যে কার টান বেশী টানে, কাকে দু’দন্ড না দেখলে যে হাঁপিয়ে ওঠে, সে কথা আর বলিয়ে নিও না।’
জেনের আম্মার মুখের কথা শেষ করার আগেই জেমেনিজের চেহারার রং পাল্টে গেল। তার চোখ মুখ ভারী হয়ে উঠল। মুখ নিচু করল জেমেনিজ। ধীরে ধীরে তার চোখ ভিজে উঠল অশ্রুতে।
তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল, ‘জানি না, মা আমার কোথায় আছে, কেমন আছে। জানিনা, মা আমাকে মাফ করেছে কি না। গুলিবিদ্ধ জেনের চিৎকার এখনও আমার কানে বাজে, আমাকে পাগল করে তুলে।’
জেমেনিজের শেষ কথাগুলো রুদ্ধ হয়ে গেল কান্নায়।
জেনের আম্মার চোখও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। বলল, ‘কোন খারাপ চিন্তা তুমি করোনা, জেন নিশ্চয় ভাল আছে।’
‘জেনের মা বিজ্ঞাপনটা তোমার নামে দেই, আমার নামে দিলে যদি না আসে? আমাকে মাফ করতে পেরেছে কিনা জানি না।’
‘এসব বাজে চিন্তা করোনা, তুমি জেনকে চিনতে পারলে গুলি করতে পারতে না, একথা জেন জানে।’
‘জানে বলছ?’
‘অবশ্যই জানে।’
‘কেমন করে তুমি বলছ?’
‘চেনার পরেও জেনকে বাধা দেবার জন্যে যদি গুলি করতে, তাহলে জেনকে পালাতে দিতে না। তাকে আরেকটা গুলি করতে পারতে। কিংবা গাড়ির চাকা ফুটো করে দিতে পারতে, তাহলেই জেন আটকে যেত। কিন্তু তুমি তা করো নি, জেনের চিৎকার শোনার পর তুমি থেমে গিয়েছিলে। এটাই প্রমাণ করে জেনকে আগে চিনতে পারনি। চিনতে পারার পর স্মিয় বেদনায় হতভম্ব হয়ে পড়েছিলে, তোমর থেমে যাওয়ার কারণ ছিল এটাই।’
‘এসব কথা জানে জেন? সত্যিই ্লছ জানে?’
‘দেখ, জেন তোমার আমার চেয়ে অনেক বুদ্ধিমতি।’
‘তোমার কথা সত্য হোক জেনের মা। আজ আমার মনটা খুব হালকা লাগছে। একটা দুঃখের কাল পাথর চেপে ছিল আমার মনে।’
‘তুমি সুস্থ মাথায় ছিলে না, তাই বুঝনি। চল উঠি।’
বলে জেনের মা দু’টি পা নিচে নামাল।
‘তাহলে আজই বিজ্ঞাপনটি দিয়ে দেই?’
‘দাও।’
বিছানা থেকে নামল জেনের মা। জেনের আব্বা জেমেনিজও উঠে দাঁড়াল।
জেনের আম্মার পেছনে পেছনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল জেনের আব্বা জেমেনিজ।