পরের দিন সকাল।
নামাজ পড়েই তারা আলোচনায় বসল।
আহমদ মুসা জেনের ডকুমেন্ট উদ্ধারের কাহিনী শুনিয়ে বলল, ‘জেন আজকের ত্যাগ ও সাহসের একটা দৃষ্টান্ত। সে আমাদের জন্যে আল্লাহর পত্যক্ষ সাহায্য। জেনের আজ বেশ জ্বর উঠেছে। সবাই দোয়া কর, আল্লাহ জেনকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তুলুন।’
একটু থামল আহমদ মুসা। থেমেই আবার শুরু করল, ‘এখন কাজের কথায় আসি। যে ডকুমেন্টের জন্যে এতদিন আমরা উন্মুখ হয়েছিলাম, আল্লাহ সেটা আমাদের জুটিয়ে দিয়েছেন। এখন বল আমরা কোন পথে এগুবো?’
‘আমাদের কাছে তো একটাই পথ। ডায়াগ্রাম অনুসারে খুঁড়ে তেজস্ক্রিয়গুলো তুলে ফেলতে হবে।’ বলল যিয়াদ বিন তারিক।
ফিলিপ, জোয়ান, আব্দুর রহমান সবাই তাকে সমর্থন করল।
‘কিন্তু এভাবে,’ বলতে শুরু করল আহমদ মুসা, ‘তুলে ফেলা কি সম্ভব? প্রথম কথা হলো ঐতিহাসিক স্থান গুলো সরকারের নজরে রয়েছে, তারা এভাবে খুড়তে দেবে কেন? সব চেয়ে বড় কথা হলো, তেজস্ক্রিয় পাতার ডকুমেন্টগুলো হারাবার পর কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এখন নজর রাখবে মাদ্রিদের শাহ ফয়সাল মসজিদ সহ কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, প্রভৃতি সবগুলো মুসলিম ঐতিহাসিক স্থানের উপর। কাজ করতে গেলেই ওদের হাতে ধরা পড়তে হবে অথবা সংঘাত বাঁধবে। এসবের মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারবো না।’ কথা শেষ করল আহমদ মুসা।
ফিলিপ, জোয়ান, যিয়াদ, আব্দুর রহমান সকলেরই মুখ মলিন হয়ে উঠল। হতাশা দেখা দিল তাদের চোখে মুখে।
ফিলিপ বলল, ‘আপনি ঠিক বলেছেন মুসা ভাই। আমরা এ দিকটা চিন্তা করিনি। ওদের চোখ এড়িয়ে তেজস্ক্রিয় তুলে ফেলার কাজ কিছুতেই সম্ভব নয়।’
‘উপায় কি তাহলে এখন?’ বলল যিয়াদ।
‘ডকুমেন্ট পরীক্ষার করার পর গত রাত থেকে আমি ভিন্ন একটা চিন্তা করছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি সেটা?’ তিন জন এক সাথে বলে উঠল।
‘আমি ভাবছি, ডকুমেন্ট গুলো আন্তর্জাতিক একটি নিউজ মিডিয়া এবং মুসলিম বিশ্বের সংবাদপত্র গুলোর কাছে পাচার করে দেব’।
‘তার পর।’ বলল ফিলিপ।
‘আন্তর্জাতিক নিউজ মিডিয়া এবং মুসলিম বিশ্বের সংবাদপত্র গুলো এখবর লুফে নেবে বলে আমি মনে করি।’
‘তাতে আমাদের কি লাভ? আমাদের উদ্দেশ্য তো তাতে সিদ্ধ হবে না। তেজস্ক্রিয় গুলো তো উঠবে না।’ বলল যিয়াদ।
‘বল কি! আমরা একটা নয়, তখন তিনটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারবো।’
তিনজনই বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
‘প্রথম লাভ হলো, শুরু করল আহমদ মুসা, কু-ক্ল্যাক্স- ক্ল্যানের ভীষন বদনাম হবে, তার উপর সব দিক থেকে চাপ পড়বে এবং তাতে সংগঠনটাই দূর্বল হয়ে পড়বে। দ্বিতীয় লাভ মুসলিম জাতি সম্পর্কে স্পেনীয় দৃষ্টিভংগি বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে, তার ফলে স্পেন সরকারের উপর প্রচন্ড চাপ পড়বে। তাছাড়া ঐতিহাসিক স্থান গুলো ধ্বংস হলে প্রতি বছর কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রার আয় থেকে বঞ্চিত হবে স্পেন। স্পেন প্রতি বছর পর্যটন খাত থেকে আয় করে ১৬ বিলিয়ন ডলার, এর মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার আসে মুসলিম ঐতিহাসিক স্থান গুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট পর্যটকদের কাছ থেকে। সুতরাং বদনাম ও চাপ থেকে রক্ষা পাওয়া অন্য দিকে দেশের আর্থিক স্বার্থ রক্ষার জন্যেই স্পেন সরকার সরকারী ভাবে তেজস্ক্রিয় গুলো তুলার ব্যবস্থা করবে। তৃতীয় লাভ হলো, স্পেনীয় মুসলমানদের সম্পর্কে এই সচেতনতার সুযোগে স্পেনের মুসলমানরা তাদের ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করে নেবার সুযোগ পেতে পারে।
থামল আহমদ মুসা।
ফিলিপদের চোখে তখন বিস্ময় ও আনন্দ ঠিকরে পড়ছে।
‘আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন।’ আপনি ক’টি কথায় একটা সোনালী স্বপ্ন ফুটিয়ে তুলেছেন আমাদের সামনে। আপনার প্রতিটি কথা সত্য হোক।’ আবেগের সাথে বলল যিয়াদ।
‘যিয়াদ স্বপ্ন বলেছে, কিন্তু আমার কাছে আপনার প্রতিটি কথা বাস্তব মনে হচ্ছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন, কু-ক্ল্যাক্স- ক্ল্যান বা স্পেনের উপর চাপ আসবে কেন? মুসলমানদের সে রকম বন্ধু কোথায়?’ ফিলিপ বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তোমার কথা ঠিক কিন্তু তোমরা জান, প্রত্যেক জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিধান আছে। এরই অংশ হিসেবে ইউনেস্কো পৃথিবীব্যাপী জাতি সমূহের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি রক্ষার চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক এ বিধি, নিয়ম ও মনোভাবের সাহায্য আমরা পাব। কর্ডোভা ও গ্রানাডার অমন কীর্তিসমূহ এবং আল-হামরার মত অতুলনীয় স্থাপত্য কীর্তি ধ্বংস হোক দুনিয়ার মানুষ তা চাইবে না। সুতরাং চারদিক থেকে চাপ আসবেই।’
‘কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে তো চাই ব্যাপক প্রচার এবং প্রচারের মাধ্যমে বিশ্বজনমত গঠন। এটা কি সম্ভব হবে?’ বলল ফিলিপ।
‘কতখানি সম্ভব হবে জানিনা। তবে চেষ্টা আমাদের করতে হবে। আজ ভোরেই আমি ফিলিস্তিন, মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্র ও সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলচনা করেছি। আমি তাঁদের ইংগিত দিয়েছি মুসলিম বিশ্বের কাগজ গুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ডকুমেন্ট ছাপার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে অনুরোধ করেছি কোনও ভাবে EWNA(EURO WORLD NEWS AGENCY)-এর সাথে যোগাযোগ করে ডকুমেন্টটি তাদের মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করতে। তারা কাজ শুরু করে দিয়েছে। ১০টার দিকে তাদের কাছ থেকে জানতে পারবো কতদূর তারা এগুলো। মনে রেখো তোমরা, আজ সকাল ১০টায় যিয়াদকে সেন্টপল গীর্জার গেটের পশ্চিম পাশে দাঁড়ানো ৭৮৬৭৮৬ নং গাড়িতে গিয়ে উঠতে হবে। সেই গাড়ী কোন এক জায়গায় মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূতের সাথে তাকে দেখা করিয়ে দেবে। ডকুমেন্ট গুলো তাকে দিতে হবে, সেই সাথে আমার চিঠি। আর তিনি যে খবর দেবেন তা আনতে হবে।’
থামল আহমদ মুসা।
‘আল হামদুলিল্লাহ, আপনি তো অনেক দূর এগিয়েছেন মুসা ভাই।’ বলল আবদুর রহমান।
‘অনেক দূর কোথায়, সবে তো শুরু।’
‘যোগাযোগের কাজটা তো হয়েছে, এই কাজেই তো আমাদের লাগতো দিনের পর দিন।’
‘তা হয়েছে।’
‘মুসা ভাই, বলতে শুরু করল জোয়ান, আমি একটা কথা ভাবছি, ডকুমেন্ট গুলো দিয়ে কি আমরা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করতে পারবো যে, তেজস্ক্রিয় দিয়ে মুসলিম ঐতিহাসিক স্থানগুলো ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রটি কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের? আর ডকুমেন্ট গুলো দিয়ে কি প্রমাণ করা যাবে যে, সেটা এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র? যদি তা যায়, তা’হলে আমি মনে করি বিশ্বের নিউজ মিডিয়ায় তা ভাল কভারেজ পাবে, দুনিয়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করবে।’ বলল জোয়ান।
‘তুমি একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলেছ জোয়ান। ডকুমেন্টগুলোর নির্ভরযোগ্যতাই কিন্তু আমাদের মূলধন। এ বিষয়টা নিয়ে আমি চিন্তা করেছি। পরিকল্পনা আমরা যেটা পেয়েছি, তাতে তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুলের কার্যকারিতার প্রকৃতি, কার্যকারিতার মেয়াদ, বিল্ডিং ও স্থাপনার প্রকৃতি ও থাকার আয়তন অনুসারে লক্ষ্য অর্জনের মেয়াদের বিভিন্নতা, কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, মাদ্রিদ শাহ্ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্স, প্রভৃতি থেকে তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল তুলে নেবার সময় নির্দিষ্ট, না তুললে এলাকার কি কি ক্ষতি হবে, ইত্যাদির বিবরণ সুষ্ঠভাবে দেয়া আছে। আর ডায়াগ্রামে রয়েছে কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, প্রভৃতির ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর কোন কোন স্থানে তেজস্ক্রিয় পুঁতে রাখা হয়েছে তার নিখুঁত মানচিত্র।…’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে ফিলিপ বলে উঠল, ‘আচ্ছা পরিকল্পনা ও ডায়াগ্রামে কর্ডোভা, গ্রানাডা প্রভৃতিকে কি তাদের নামেই উল্লেখ করা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এখন বাকি থাকল,’ আহমদ মুসা শুরু করল আবার, ‘কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এটা করেছে কি না তা প্রমাণ করা, এই তো? সেটাও সহজে প্রমাণ করার মত দলিল আমরা পেয়েছি। প্ল্যান ও ডায়াগ্রামের সাথে আদেশ দান সুলভ একটা চিঠি আছে। চিঠিতে কোন পটভূমিতে কি উদ্দেশ্যে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এর নির্বাহী কমিটি এ সিদ্ধান্ত নেয় তার উল্লেখ করে প্ল্যান কার্যকর করার নির্দেশ জারী করা হয়েছে। শেষে স্বাক্ষর রয়েছে ভাসকুয়েজের। আমি মনে করি, তেজস্ক্রিয় ষড়যন্ত্রের সাথে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সম্পর্ক প্রমাণের জন্যে এ চিঠিই যথেষ্ট।’
ফিলিপদের মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
ফিলিপ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলুন, নাস্তা রেডি।’
সবাই উঠে দাঁড়াল।
রাত তখন দশটা।
ফিলিপের তিনতলার ড্রইংরুমে বসেছিল আহমদ মুসা, ফিলিপ ও জোয়ান।
খুশীতে মুখ উজ্জ্বল করে বাইরের দরজা দিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল যিয়াদ ও আবদুর রহমান।
ওদের সাথে মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতের সময় ছিল রাত ৮টায়। ডকুমেন্ট গুলো বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচারের কি ব্যবস্থা হয়েছে সে বিষয়ে রাষ্ট্রদূতের যিয়াদদেরকে জানাবার কথা এ সময়।
ওদের হাসি মুখ দেখে খুশী হল আহমদ মুসারা।
ওরা এসে বসল।
‘কাঁটায় কাঁটায় দশটায়, কথা শুরু করল যিয়াদ, মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূতের সাথে আমাদের দেখা হলো। তিনি আমাদের দেখে হাসলেন। বললেন, মাই বয় ইনশাআল্লাহ্ আমরা খেলায় জিতে যাচ্ছি। সৌদি আরব, আফগানিস্তান, ইরান ফিলিস্তিন সরকার এ বিষয়টাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে। যা কল্পনাও করতে পারিনি আমরা। দুপুরের মধ্যেই আমার সরকারের কাছ থেকে ওরা ডকুমেন্ট পেয়ে গেছে। সংগে সংগেই সৌদি আরব বিষয়টা ও আই সি সেক্রেটারিকে জানিয়েছে। খবরটা আজ শুধু মুসলিম দেশগুলোর পত্রিকায় আসবে তা নয়, খবর বেরুবার সাথে সাথে ও আই সি সহ দেশগুলোর তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ব্যবস্থাও হয়েছে। অন্যদিকে একটা সূত্রের মাধ্যমে ডকুমেন্টগুলোর Euro World News Agency এর ফ্রান্স অফিসে পৌঁছিয়েছি। সূত্রের মাধ্যমে আমরা জানিয়েছি তারা যদি আজ রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে নিউজটি ক্রিট করে, তা’হলে মুসলিম দেশের পত্র পত্রিকা তাদের নিউজই ছাপাবে, অন্যথায় সরাসরি ডকুমেন্ট গুলো আমরা তাদের দিয়ে দেব। EWNA নিউজটার প্রতি খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে সূত্রের মারফৎ আমরা জানতে পেরেছি। যদি EWNA নিউজটি শেষ পর্যন্ত ক্রিট না করে। বিকল্প চিন্তাও আমাদের আছে। এই হলো মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূতের খবর, আমি তার কথাতেই পেশ করলাম।’
থামল যিয়াদ।
আহমদ মুসা সহ সবারই মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আহমদ মুসা বলল, ‘মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়ার সাথে সাথে আমরা ইউনেস্কো মানবাধিকার কমিশন, প্রভৃতি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও মানবাধিকার গ্রুপগুলোর প্রতিবাদ, অনুকুল প্রতিক্রিয়া আমরা চাই।
‘হ্যাঁ মুসা ভাই,’ বলতে শুরু করল যিয়াদ, ‘রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারেও বলেছেন। বলতে ভুলে গেছি। তিনি বলেছেন, ও আই সি’র মাধ্যমে আজকেই ইউনেস্কো মানবাধিকার কমিশন সহ জাতিসংঘে ডকুমেন্টগুলো পৌঁছে দেয়া হবে। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছেও ও আই সি ডকুমেন্টগুলো পৌঁছানোর দায়িত্ব নিয়েছে।’
‘আল হামদুলিল্লাহ। প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজটা মনে হচ্ছে ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। তবে একটা কথা ভাবছি, E.W.N.A. W.N.A. N.A.N.A. ইত্যাদির মত পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা যদি নিউজটা প্রচার করা না যায়, তা’হলে পশ্চিমা সংবাদ পত্রে কভারেজ পাবে না এবং তার ফলে পশ্চিমা জনমতকে অনুকুলে আনা কঠিন হবে।’ চিন্তিত ভাবে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা কথা শেষ করার সাথে সাথেই সামনে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠল।
টেলিফোন ধরল ফিলিপ।
টেলিফোন ধরে ওপারে কথা শুনেই চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল ফিলিপের। তার চোখে মুখে বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল। বলল সে, ‘Hold on please দিচ্ছি।’ বলে ফিলিপ টেলিফোনটা আহমদ মুসাকে দিয়ে দিল।
আহমদ মুসা ‘হ্যালো’ বলার পর ওপারের কথা শুনার সংগে সংগেই তার চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমাল বের করে রিসিভারের স্পীকারের ওপর বসিয়ে বলল, ‘সরি, রং নাম্বারে টেলিফোন করেছেন। নাম্বার আবার চেক করুন। থ্যাংকস।’ বলে আহমদ মুসা টেলিফোন রেখে দিল।
ফিলিপের মুখ কালো হয়ে গেছে আহমদ মুসার মিথ্যা বলা দেখে। বলল, ‘এ কি মুসা ভাই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদের সাথে কথা বললেন না। আর একেবারে…’
কথা শেষ করতে পারলনা ফিলিপ। আহমদ মুসা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,‘মিথ্যা বললাম’ এই তো? মিথ্যা না বলে উপায় ছিলনা। মাহমুদ যে এতবড় ভুল করবে, ভাবতে আমার বিস্ময় লাগছে। সম্ভবত ডকুমেন্টগুলো পেয়ে এত খুশী হয়েছে কিংবা উত্তেজিত হয়েছিল যে, সে কাণ্ডজ্ঞান কিছুটা হারিয়ে ফেলেছিল। যা হোক, দেখো তার সাথে আমার কথা বলার অর্থ হলো, আহমদ মুসা কোন টেলিফোনে এখন আছে তা স্পেনের গোয়েন্দা বিভাগকে জানিয়ে দেয়া। আর টেলিফোন নাম্বার পেলে কম্পিউটারে মালিকের ঠিকানা বের করা কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা কি ভেবে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা ফিলিপ মাহমুদ তোমাকে কি বলেছিল?’
‘বলেছিল, আমি ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ বলছি। আহমদ মুসার সাথে কথা বলব।’
চোখে চাঞ্চল্য এবং কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল আহমেদ মুসার। বলল,‘ফিলিপ নতুন বাড়ীতে উঠার তোমার কতদূর?’
‘আজ বিকেলে আম্মা এবং জেন চলে গেছে ওখানে। আম্মা কিছু জিনিষপত্রও নিয়ে গেছেন। অবশিষ্ট নিয়ে কালকেই আমরা চলে যাব।’ বলল ফিলিপ।
কাল সময় পেলে পার হওয়া যাবে, কিন্তু এখনি আমাদেরকে এখান থেকে সরতে হবে। আমার অনুমান মিথ্যা না হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই অথবা আজ রাতে সরকারী গোয়েন্দারা অথবা তাদের কাছ থেকে খোঁজ পেয়ে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এ বাড়ীতে চড়াও হবে। আমি যদিও রং নাম্বার বলে টেলিফোন রেখে দিয়েছি, যদিও টেলিফোনের স্পিকারে রুমাল লাগিয়ে কণ্ঠ বদলের চেষ্টা করেছি, তবু এ কথা স্পেনের গোয়েন্দা বিভাগ নিশ্চিত ধরে নেবে, একটা দেশের প্রেসিডেন্ট কোন রং নাম্বারে টেলিফোন করতে পারেন না। তা’ছাড়া প্রথমে আমি অরিজিনাল পরে ‘হ্যালো’ বলেছি, পরে স্বর পরিবর্তন করেছি, এটাও তাদের নজর এড়াবে না। এখন ‘হ্যালো’ শব্দ যে আহমদ মুসার তা তারা রেকর্ডের সাথে মিলালেই বুঝতে পারবে। অতএব তারা নিশ্চিত হয়ে অথবা নিশ্চিত হবার জন্যে অবশ্যই এখানে ছুটে আসবে’।
কথা শেষ হবার সংগে সংগেই ফিলিপ উঠে দাঁড়াল। আবদুর রহমানকে লক্ষ্য করে বলল, ড্রাইভারদের গাড়ি বের করতে বল। জেনের গাড়িও।
ফিলিপ ছুটে ওপরে গেল।
‘আচ্ছা মুসা ভাই, আপনার চিন্তা কি রকেটের গতিতে চলে? কোন কিছুই কি আপনার নজর এড়ায় না?’ বলল যিয়াদ।
‘টেলিফোনের ব্যাপারটা বলছ তো? ওটা তো একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল’।
‘কিন্তু আপনি না বললে এর মধ্যে কোন অস্বাভাবিক বা ক্ষতিকর কিছু খুঁজে পেতাম না’। বলল জোয়ান।
‘এখন বলছ পেতেনা, কিন্তু দায়িত্বে থাকলে অবশ্যই পেতে’। হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘শুধু দায়িত্বের কারণে এ জ্ঞান আসে না, এমন জ্ঞান যাদের আছে তারাই দায়িত্বে আসে’। বলল যিয়াদ।
‘মৌলিক ভাবে তোমার এ কথা ঠিক যিয়াদ। কিন্তু দায়িত্বে গেলে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রসারিত হয়’। বলল আহমদ মুসা।
ফিলিপ তার লোকদের সাথে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে নেমে এল।
সবাই মিলে চারটি গাড়িতে চেপে একে একে চলে গেল। সর্বশেষ গাড়িতে আহমদ মুসা ও ফিলিপ।
তিনটি গাড়ি চলে গেল।
আহমদ মুসাদের গাড়ি ফিলিপের বাড়ীর বিপরীত পাশের পার্কিংটায় গিয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসাদের খুব বেশী বসতে হলো না।
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই চারটি পিক-আপ ফিলিপের বাড়ীর কিছুটা দুরে এসে দাঁড়াল। তারপর পিকআপ থেকে নেমে এল প্রায় চার ডজন সামরিক লোক। তারা ছুটে গিয়ে ঘিরে ফেলল বাড়ী। আহমদ মুসা ও ফিলিপ দুজনেই দূরবীনে এ দৃশ্য দেখল।
‘আপনার জ্ঞান সামান্য ভুল করলে এখন কি ঘটত মুসা ভাই। ইদুর ফাঁদে পড়ার মতই আমরা ফাঁদে পড়তাম’। হেসে বলল ফিলিপ।
‘চল আমাদের কাজ শেষ, ওরা খুঁজে মরুক, আমরা চলে যাই’।
ফিলিপ স্টার্ট দিল গাড়িতে।
পার্কিং থেকে বেরিয়ে গাড়ী ছুটল ফিলিপের নতুন বাড়ির দিকে।