চিৎকার কানে যেতেই জেনের আব্বা জেমেনিজ থমকে দাঁড়িয়েছিল। চিৎকার সে চিনতে পেরেছে।
পিস্তল ধরা হাতটি তার স্থির হয়ে গেল, পা দু’টি তার যেন মাটিতে আটকে গেল। চোখে বোবা দৃষ্টি।
জেনের যেখানে গুলি লেগেছে, সেখানে এক থোক রক্ত গড়াচ্ছে তখনও।
পাথরের মূর্তির মত স্থির পা চালিয়ে জেমেনিজ এসে দাঁড়াল লাল তাজা সেই রক্তের সামনে। তার চোখ সেই রক্তের উপর পাথরের মত স্থির।
জেনের মা ছুটে এল বাড়ীর ভেতর থেকে। গুলির শব্দ সেও শুনেছে।
‘ওগো শুনেছ, জেন তো ঘরে নেই’ বলতে বলতে জেনের মা এসে দাঁড়াল জেমেনিজের কাছে সেই রক্তের সামনে।
রক্তের সামনে জেমেনিজকে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ ভরা উদ্বেগ নিয়ে জেনের মা একবার রক্তের দিকে, একবার জেমেনিজের দিকে তাকাতে লাগল।
তারপর আর্ত কন্ঠে বলল, ‘তোমার কি হয়েছে, এ রক্ত কার? শুনেছ, জেনকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
মূর্তির মত দাঁড়ানো জেমেনিজের হাত থেকে খসে পড়ল পিস্তল।
জেনের মা ছুটে এসে জেমেনিজের একটা হাত ধরে ঝাঁকানি দিয়ে বলল, ‘বল, এ রক্ত কার? কথা বলছ না কেন?’
জেমেনিজ রক্তের দিকে তাকিয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়েই রইল।
অল্পদূরে বিস্ফারিত চোখে দাঁড়িয়েছিল দারোয়ান। জেনের মা ছুটে গেল তার কাছে। কান্না জড়িত কন্ঠে বলল, ‘কি হয়েছে, কি দেখেছ তুমি, এ রক্ত কার? জেন কোথায়?’
দারোয়ান দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল। হাউ মাউ করে উঠে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল, ‘খুকু মনির রক্ত, গুলি লেগেছে…।’ কথা শেষ করতে পারল না দারোয়ান। একটা চিৎকার করে জেনের মা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তখন অনেক রাত।
দূরে গীর্জার কোন পেটা ঘড়িতে ১২ টা বাজার শব্দ ভেসে এল।
জেনের ঘরে মেয়ের বিছানায় পড়ে বিছানা আঁকড়ে ধরে কাঁদছে তার মা।
বাইরের ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে জেমেনিজ। তার পাশের সোফায় ভাসকুয়েজ।
ভাসকুয়েজ কথা বলছিল, ‘আপনি শান্ত হোন স্যার। আপনি দেশের গৌরব। আপনি সন্তানকেও রেহাই দেননি। জেনকে আপনি গুলি করেছেন- আপনার এ জাতি প্রেম সবাইকে অভিভূত করার মত।’
একটু থামল ভাসকুয়েজ। তারপর বলল, ‘জোয়ান ছেলেটাই শয়তানির মূল। সেই মা জেনের মাথা খারাপ করেছে। আমাদের এখন প্রথম কাজ আহত জেন এবং ডকুমেন্ট গুলোকে উদ্ধার করা। তারপর শয়তান জোয়ান এবং আহমদ মুসাদের পাকড়াও করা। আহত জেন নিশ্চয় কোন হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে উঠবে। আমরা মাদ্রিদের সকল হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আমাদের লোকদের সতর্ক করে দিয়েছি। আমাদের শত শত কর্মী গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের পাকড়াও করার জন্যে। সরকারের গোয়েন্দা বিভাগেরও সাহায্য কামনা করেছি আমি। আমি তাদের বলেছি, আপনার মেয়েকে আহত করে কিডন্যাপ করেছে আহমদ মুসার দল। এই সংবাদে সরকারের উচ্চ মহল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ পূর্ণ উদ্যমে কাজে নেমেছে। চিন্তা করবেন না স্যার ধরা তাদের পড়তেই হবে।’
জেমেনিজ শুকনো মুখে বসে ছিল। তার চোখটা ভাসকুয়েজের দিকে নিবদ্ধ ছিল বটে, কিন্তু মনটা ছুটে বেড়াচ্ছে অন্য কোথাও। ভাসকুয়েজের সব কথা কানে গিয়েছে বলে মনে হলো না। কিন্তু ভাসকুয়েজের শষ কথায় জেমেনিজ নড়ে চড়ে বসল। বলল, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। আমি ভয় করছি, ঘটনা না প্রকাশ হয়ে পড়ে। আমি চাই না, জেন কিডন্যাপ হওয়ার কাহিনী প্রচার হোক।’ শুষ্ক ও নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল জেমেনিজ।
‘না স্যার, সে ব্যবস্থা নিয়েছি। হোম মিনিস্টার, পুলিশ প্রধান ও আমি ছাড়া ঘটনা কেউ জানে না। অন্যদের শুধু ফটো সরবরাহ করে বলা হয়েছে, খুঁজে বের করে সসম্মানে পৌঁছে দিতে। হারিয়েছে, পালিয়েছে না কিডন্যাপ হয়েছে। কিছুই বলা হয়নি এবং জেনের পরিচয়ও প্রকাশ করা হয়নি।’
‘ধন্যবাদ ভাসকুয়েজ।’
একটু থামল জেমেনিজ। তারপর আবার বলল, ‘ডকুমেন্ট গুলো যদি ওদের হাতে যায় ভাসকুয়েজ?’
‘প্ল্যান ও ডায়াগ্রাম পেয়ে ওরা যা করতে পারে তা হলো, তেজস্ক্রীয় ক্যাপসুলগুলো ওরা তুলে ফেলার চেষ্টা করবে। কিন্তু সে সাধ্য তাদের হবে না। কাজে নামলেই ওদের টিপে টিপে মারবো আমরা।’
কথা শেষ করেই ভাসকুয়েজ বলল, ‘এখন উঠতে পারি স্যার? ওদিকে অনেক কাজ আছে।’
‘ঠিক আছে ভাসকুয়েজ, কোন খবর পেলেই আমাকে জানিও। জেনের মা একদম ভেঙে পড়েছে। কোন সান্ত্বনাই মানছে না। সবকিছুর জন্যে সে আমাকে দায়ী করছে। আমার রাজনীতিই নাকি জেনের এই অবস্থার জন্যে দায়ী।’ জেমেনিজের শুকনো কন্ঠ শেষের দিকে ভারি হয়ে উঠল।
‘মায়ের মন তো, একটু ভিন্ন রকম হবেই। ধৈর্য ধরতে বলুন স্যার, আমরা জেনকে বের করেই ফেলবো।’ বলে ভাসকুয়েজ উঠে দাঁড়াল।
জেমেনিজও উঠে দাঁড়িয়ে ভাসকুয়েজের সাথে হ্যান্ডশেক করে ভেতরের দিকে পা বাড়াল।
৩
ফিলিপের বাড়ির নিচতলার ড্রয়িংরুম।
আহমদ মুসা, ফিলিপ, জোয়ান, যিয়াদ, আবদুর রহমান বসে আছে সোফায়।
কথা বলছিল তখন আহমদ মুসা। বলছিল, ‘Elder’ সমস্যার সমাধান না করতে পারলে আমরা এক ইঞ্চিও এগুতে পারছি না।’
‘Elder’ অর্থ মুরুব্বী, অভিভাবক। ‘কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের মুরুব্বী বা অভিভাবক কে?’ বলল ফিলিপ।
‘এই মুরুব্বী কোন সংগঠনও হতে পারে, যারা স্পেনীয় কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের অভিভাবকত্ব করছে।’ বলল জোয়ান।
‘তা হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় তেজস্ক্রীয় পাতার যে প্ল্যান ও ডায়াগ্রাম তা আমি মনে করি তারা কাছেই রাখবে, দেশের বাইরে রাখার কিংবা অন্য সংগঠনের হাতে দেবার তাদের প্রয়োজন কি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক মুসা ভাই। স্পেনের কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান নিজেদের এত দুর্বল মনে করে না যে ডকুমেন্ট তারা নিরাপত্তার জন্যে অন্য সংগঠন বা দেশের বাইরে রাখবে।’ বলল ফিলিপ।
‘কিন্তু নিরাপত্তা হীনতার কারণেই তো তারা ডকুমেন্টগুলো তাদের হেড কোয়ার্টারে রাখার সাহস করেনি।’ বলল জোয়ান।
‘একথা ঠিক মুরুব্বী বলা হয়েছে এমন এক আশ্রয়কে যা তাদের হেড কোয়ার্টারের চেয়ে নিরাপদ।’ বলল যিয়াদ।
‘একথা আমি বুঝতে পারছি না তেজস্ক্রীয় পাতার ডকুমেন্ট ‘Elder’-এর কাছে এ কথা ভাসকুয়েজের পারসোনাল কম্প্যুটার রেকর্ড করার প্রয়োজন হলো কেন? রেকর্ড করা যখন হলোই তখন নামটাকে আড়াল করা হলো কেন?’ বলল ফিলিপ।
‘এর উত্তর সম্ভবত এটাই যে, ডকুমেন্টগুলো কার কাছে আছে এটা শুধু ভাসকুয়েজই জানে। ভাসকুয়েজের যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলেও যাতে তার স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি জানতে পারে সে তথ্য এজন্যেই তার পারসোনাল কম্প্যুটারে তা রেকর্ড করা হয়েছে। আর ‘Elder’ এর নাম না থাকার কারণ তাকে ‘Elder’ নামেই কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের দায়িত্বশীলরা সবাই জানে।’
‘Elder’ নাম রেকর্ড থাকলে তা অন্যের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে বলেই এটা উহ্য রাখা হয়েছে।’ বলল যিয়াদ।
‘বিষয়টি নিয়ে আমিও ভেবেছি, কিন্তু সমাধান খুঁজে পাইনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এর জবাব হয়তো পরেও পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন সামনে এগুবার পথ কি?’ বলল ফিলিপ।
আহমদ মুসার মুখে চিন্তার একটা ছায়া নেমে এল। বলল, ‘প্রতিটা দিন যাচ্ছে আর স্পেনে আমাদের কর্ডোভা, আল হামরা, গ্রানাডা, মাদ্রিদের মসজিদ কমপ্লেক্স প্রভৃতির জীবন থেকে একটা অংশ খসে পড়ছে। একবার ওগুলো তেজস্ক্রীয় দুষ্ট হয়ে পড়লে সেগুলো মেরামতের আর কোন উপায় থাকবে না। ওগুলো মুছে যাবে স্পেনের বুক থেকে, সেই সাথে মুছে যাবে স্পেন থেকে মুসলমানদের নাম নিশানা।’
থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘স্পেনে খৃষ্টান কিংবা শ্বেতকায়দের মুরুব্বী বা অভিভাবক বলে সাধারণ ভাবে মনে করা হয় এমন কেউ কি আছে?’
‘কার্ডিনাল পরিবারকে একবাক্যে সে ধরনের পরিবার বলা যায়।’
আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘আশ্চর্য, ক’দিনে একবারও এ পরিবারের কথা আমার মনে হয়নি। তুমি ঠিকই বলেছ জোয়ান, স্পেনের খৃস্টানদের শীর্ষ অভিভাবক পরিবার এটি। আর এ পরিবারের সাথে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। ঐতিহাসিক কার্ডিনাল হাউজের একটা অংশ কু-ক্ল্যাস্ক-ক্ল্যানকে দেয়াই তার প্রমাণ। কিন্তু জেনের আব্বা জেমেনিজ ডে সিসনারোসা কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ‘Elder’ কি না সেটাই জানার বিষয়।’
‘হ্যাঁ মুসা ভাই, এটাই জানার বিষয়।’ বলল জোয়ান।
‘মি: জেমেনিজ আমাদের প্রতিবেশী বলা যায়। লা-গ্রীনজায় আমাদের পাশেই তাদের স্বাস্থ্য নিবাসটা। ছোট বেলা থেকেই ওদের সবাইকে জানি। মি: জেমেনিজ অত্যন্ত সাধারণ ভাবে চলেন। বাড়িতে তেমন রাখ ঢাক নেই। কোন পাহারাও বাড়ীতে কখনও রাখেননি। মাদ্রিদের বাড়িও তাই। জোয়ান এটা আরও ভাল জানে। এমন লোক কিংবা এমন বাড়ী কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের মূল্যবান দলিলের নিরাপদাশ্রয় হতে পারে বলে মন বলছে না।’ বলল ফিলিপ।
‘তোমার কথা ঠিক হওয়ার যুক্তি আছে। তবে সম্ভাবনাই আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এখন বল, কার্ডিনাল পরিবারের মত অথবা জেমেনিজের মত আর কাকে কাকে আমরা এমন সম্ভাবনার তালিকায় ফেলতে পারি।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা বলার জন্য ফিলিপ মুখ তুলেছে এমন সময়, প্রহরী ছুটে এসে ডয়িং রুমে প্রবেশ করল। দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘একটা গাড়ী ভেতরে ঢুকতে চায়, গাড়ী দিয়ে গেট ধাক্কাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলে কোন কথা বলছে না। আমরা কি করব?’
সংগে সংগে আহমদ মুসা উঠে দাড়াল। ফিলিপও সংগে সংগে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মুসা ভাই আপনি এবং জোয়ান থাকুন। আমরা দেখে আসি।’
‘না ফিলিপ, এটা কোন শত্রুর গাড়ি নয়। শত্রুর গাড়ি এমন হয়না, এমন করে না।’ বলতে বলতেই আহমদ মুসা চলতে শুরু করেছে।
সবাই পিছু নিল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসারা গেটের সামনে গিয়ে দেখল গাড়িটি অবিরাম হর্ণ দেয়া ছাড়াও গেট ধাক্কাচ্ছে গাড়ী দিয়ে।
আমদ মুসা গেটের সিকিউরিটি উইনডো দিয়ে গাড়টির দিকে এক নজর তাকাল। দেখল গাড়ীতে একজন মাত্রই আরোহী।
আহমদ মুসা সুইচ টিপল। গেটের দু’টি পাল্লা সরে গেল দু’দিকে। গেটের সামনে জোয়ান ফিলিপ এবং অন্যান্যরা।
গেট খুলে যেতেই গাড়ী ঢুকে গেল ভেতরে। সেই সাথে গাড়ীর ভেতর থেকে এটা কণ্ঠ উচ্চারিত হল, ‘আমি জেন।’ কণ্ঠটা একটা দুর্বল চিৎকারের মত শোনাল।
ভেতরে প্রবেশ করেই গাড়িটা শা করে ছুটে গেল গাড়ী বারান্দার দিকে। গাড়ীর গতিটা বিশৃঙ্খল।
গাড়ীটা গাড়ী বারান্দায় স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ালোনা। বারান্দায় গিয়ে ধাক্কা খেল।
জোয়ান জেনের নাম শুনতে পেয়েছিল এবং তার কণ্ঠও চিনতে পেরেছিল। কিন্তু জেনের এই আগমন এবং চিৎকার তাকে বিস্মিত করেছিল।
জোয়ান চুটছিল গাড়ীর পেছনে।
গাড়ী দাঁড়াতেই জোয়ান গাড়ীর জানাল দিয়ে ভেতরে এক ঝলক তাকিয়েই উদ্বিগ্নভাবে এক টানে দরজা খুলে ফেলল গাড়ীর।
গাড়ী খুলেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল জোয়ানের। সিটের ওপর এলিয়ে পড়েছে জেন। গাড়ী ভেসে যাচ্ছে রক্তে।
‘জোয়ান তুমি এখানে! তোমাকেই খুব আশা করছিলাম। আমার গুলি লেগেছে।’ দুর্বল কণ্ঠে বলল জেন।
এ কি করে হলো জেন? আর্তকণ্ঠে বলল জোয়ান।
আহমদ মুসা, ফিলিপ সবাই পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা জোয়ানকে একটু পাশে ঠেলে ঝুকে পড়ে গুলিবিদ্ধ স্থানটি পরীক্ষা করল। দেখল, হাটুর নিচে মাংসল হিপটায় বিরাট ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। গুলি এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
‘জোয়ান, ফিলিপ তোমাদের কোন বিশ্বস্ত ক্লিনিক আছে? জেনকে ক্লিনিকে নিতে হবে।’ সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল আহমদ মুসা।
জেন ধীরে ধীরে না সূচক মাথা নাড়ল। বলল, না কোন ক্লিনিক নয়, হাসাপাতাল নয়। ওরা এতক্ষনে মাদ্রিদের সব ক্লিনিক হাসপাতালে লোক পাঠিয়েছে আস্তে আস্তে দুর্বল কণ্ঠে বলল জেন।
‘মুসা ভাই, বাসাতে সব ব্যবস্থা করা যাবে।’ বলল ফিলিপ।
‘ঠিক আছে, জোয়ান জেনকে ভেতরে নাও।’ আহমদ মুসা বলল।
সরে এল গাড়ির দরজা থেকে আহমদ মুসা।
ফিলিপ ছুটে গেল ভেতরে।
জেনের গায়ে কোট, পরনে হাটুর নিচু পর্যন্ত নামানো স্কার্ট। ডান হাতের ওপর ঠেস দিয়ে একটা কাত হয়ে সিটের ওপর গা এলিয়ে পড়েছিল জেন।
জোয়ান তাকে তুলে নেয়ার জন্যে এগুলো।
জেন স্টিয়ারিং হুইল ধরে সোজা হতে চেষ্টা করল। চাপ পড়ল তার গুলিবিদ্ধ বাম পা টায়। কঁকিয়ে উঠল জেন।
‘তোমাকে উঠতে হবে না জেন, তুমি উঠো না।’ বলে জোয়ান এগিয়ে গিয়ে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল জেনকে।
চোখ বন্ধ করে জেন নিজেকে এলিয়ে দিয়েছে জোয়ানের হাতের ওপর।
জোয়ান হাটতে হাটতে প্রশ্ন করল, কিছুই বুঝতে পারছিনা জেন, কোথায় কি করে এটা ঘটল?
জেন চোখ খুলল। তাকাল জোয়ানের দিকে। জেনের চোখে হাসির অস্পষ্ট প্রলেপ। বলল, ‘সব শুনবে। বলেছিলাম না আমি, তোমার কিছু কাজ আমাকে দিও’।
‘কিছু করতে গিয়েছিলে নাকি?’ জোয়ানের চোখে বিস্ময়।
‘বলব’। চোখ বন্ধ করে বলল জোন।
নিচের ড্রইং রুমের সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল ফিলিপ। জেনকে নিয়ে জোয়ান ঢুকতেই বলল তিন তলায় নিয়ে চল জোয়ান। আম্মার পাশে মারিয়ার ঘরটায় ওর জন্যে ব্যবস্থা করেছি।
দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ছিল ফিলিপের আম্মা।
মারিয়ার বান্ধবী জেনকে ছোটবেলা থেকেই চেনে ফিলিপের আম্মা।
জেনকে দেখেই কেঁদে উঠল, ‘আমার মারিয়া গেল, তোমারও এই অবস্থা?’
‘জেন চোখ খুলে মারিয়ার মা’র দিকে চেয়ে বলল, ‘মারিয়ার মত করে আমি যেতে পারলাম না খালাম্মা।’
‘ওকথা বলোনা মা, তুমি বেঁচে থাক।’ জেনের মাথায় হাত রেখে চলতে চলতে বলল মারিয়ার মা।
জেনকে নিয়ে জোয়ান এবং অন্যান্য সকলে প্রবেশ করল ঘরে।
বেশ বড় ঘর। তক তকে চক চকে ঘর। জেন মারিয়ার কাছে এ ঘরে এসেছে।
খাটে সাদা ধবধবে নতুন বিছানা পাতা। চাদরের ওপর গোটা খাট জুড়ে একটা রাবার সিট বিছানো।
জোয়ান জেনকে বিছানায় শুইয়ে দিল।
মারিয়ার মা বসল জেনের মাথার কাছে। হাত বুলিয়ে দিতে লাগল জেনের মাথায়।
আমার এক সার্জেন বন্ধুকে বলেছি, এখনই এসে পড়বেন। ফিলিপ বলল।
ফিলিপ, তাড়াতাড়ি কিছু দুধ খাইয়ে দিতে হবে জেনকে। আহমদ মুসা বলল।
‘ফিলিপের মা উঠে বলল, আমার খেয়ালই হয়নি। যাই বাবা আসছি।
বলে ফিলিপের মা বেরিয়ে গেল। জেনের গুলিবিদ্ধ ক্ষতের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ক্ষত বাধার কাপড়টা বদলে দিতে হবে, ওটা রক্তে ভিজে গেছে।
গাড়ীতেই জেন তার মাথার স্কার্ট দিয়ে ক্ষতটা বেধে নিয়েছিল। তারপর গাড়ী বারান্দায় আহমদ মুসা সেটা পাল্টে তার রুমাল দিয়ে ক্ষতস্থানটা বেধে দেয়।
‘ডাক্তার এই এসে পড়ল বলে মুসা ভাই।’ বলল ফিলিপ।
জোয়ান জেনের পাশে বসেছিল।
বিছানায় শোয়ার পর চোখ বন্ধ করে ছিল জেন। একটু রেস্ট নেবার পর সে চোখ খুলল।
কোর্টের পকেট থেকে ধীরে ধীরে বের করল সেই ইনভেলাপ। কাঁপা হাতে সেটা জোয়ানের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘মুসা ভাইকে দাও।’
জোয়ান বিস্ময়ের সাথে ইনভেলাপটি হাতে নিয়ে সেটা তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসার চোখেও কৌতুহল্
সে ইনভেলাপটি হাতে নিয়ে বলল, ‘কি আছে বোন এতে?’
জেন চোখ বুজেছিল। আবার চোখ খুলে বলল, ‘দেখুন, বলব না।’ জেনের ঠোঁটে এক টুকরো হাসি।
‘আহমদ মুসা ইনভেলাপের ভেতর থেকে কাগজগুলো বের করল। কাগজগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়েই ‘আল্লাহু আকবার’ বলে আহমদ মুসা সিজদায় পড়ে গলে মেঝের ওপর।
জোয়ান, ফিলিপ, আবদুর রহমানের চোখে মুখে বিস্ময়্
ডপলিপ কাগজুরো তুলে নিল আহমদ মুসার হাতের পাশ থেকে।
চোখ বুলিয়েই চিৎকার কওে উঠল, ‘জোয়ান এতো মুসরিম ঐতিহাসিক স্থান ও মাদ্রিদের মসজিদ কমপ্লেক্সে তেজস্ক্রিয় পাতার পরিকল্পনা ও ডায়াগ্রাম।’
‘বিস্ময়ে পাথর হয়ে যাওয়া জোয়ান ফিলিপের হাত তেকে কাগজগুলো নিয়ে ওগুলোর ওপর চোখ স্থাপন করল। আবদুর রহমানও এগিয়ে এল জোয়ানের কাছে। তারও চোখ কাগজগুলোতে।
জোয়ান, ফিলিপ, আবদুর রহমান নত মুখে কোন কথা নেই। যেন গভীর কোন স্বপ্নে নিমজ্জিত।
অনেক্ষণ পর সিজদা থেকে মাথা তুলর আহমদ মুসা। গন্ড দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তার চোখের পানি, ধীরে ধীরে বলল, ‘আমরা যা আশা করতে পারিনি, তার চেয়েও বেশী সাহায্য করেছেন আল্লাহ আমাদেরকে।’
জেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবি করুক বোন। আর মানুষ যা আশা করতে পারেনা, তার চেয়েও বড় পুরস্কার আল্লাহ তোমাকে দিন, যখন ওটা মানুষের জন্যে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হবে।’
আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল আহমদ মুসার।
জেনের চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। শুকনো লাল ঠোঁট তার কাঁপছিল। আহমদ মুসার সিজদা, তার কথা, জোয়ানদের সপ্রশংস বিস্ময়, জেনের ছোট্ট হৃদয়টা ভরে দিয়েছে অসীম আনন্দ আর আবেগে। তারও মুখে কথা সরছে না।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল, ‘আমার জীবনে আজকের মত এত খুশি কোন দিন হইনি বোন।’
জেনের দিকে চেয়ে কথাগুলো বলল আহমদ মুসা। একটু থেমেই আবার বলল জেনকে, ‘তাহলে কু-ক্ল্যাক্স- ক্ল্যানের ‘elder’ তোমার আব্বা, তাই না?’
‘জি হ্যাঁ।’ চোখ মুছে বলল জেন।
‘তোমার আব্বার গুলিতেই তুমি আহত হয়েছ, তাই না?’
‘জি, হ্যাঁ। আপনি কি করে জানলেন ভাইয়া?’ জেনের কন্ঠে বিস্ময়!
‘ব্যাপারটা খুবই সহজ। তোমার গুলি লেগেছে হাঁটুর নিচে। ভাসকুয়েজ অথবা কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের কেউ এই অবস্থায় গুলি করলে সেটা করত তারা তোমার বুকে, পিঠে অথবা মাথায়।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা কাগজগুলো ফিলিপের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘এগুলো ভালো করে রাখ তুমি।’
তারপর আব্দুর রহমানের দিকে ফিরে বলল, ‘তুমি এবং জিয়াদ বের হও বাইরে। কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের তৎপরতা সম্পর্কে খোঁজ নাও। ওরা কিন্তু এখন ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়ে যাবে। আর আমি নিচে যাচ্ছি, দেখি জেনের গাড়ীটা পরিষ্কার হলো কি না। গাড়ীর নাম্বার ব্লু-বুক সবই পাল্টে দিতে হবে।’
সবশেষে জোয়ানের দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি এখানে বস।’
জোয়ান ছাড়া সবাই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
জোয়ান বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিল। জেন তার আব্বা, তার পরিবার, তার জাতির বিরুদ্ধে গিয়ে ডকুমেন্টগুলো উদ্ধার করেছে! তার আব্বার পিস্তলে সে গুলী খেয়েছে! জেনের এই রূপ, এই বিশালতা জোয়ানের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিস্ময়ের ঘোর যেন তার কাটছে না।
আহমদ মুসা বেরিয়ে গেলে জোয়ান তার মুখটা নিচু করেছিল। তার মনে হলো আহমদ মুসা যেন ইচ্ছা করেই তাকে এবং জেনকে এভাবে একা রেখে গেল। তা নাও হতে পারে। এটা তার একটা অমূলক চিন্তা হতে পারে। কিন্তু এই চিন্তা তাকে কিছুটা আড়ষ্ট করেছিল। জোয়ান এবং জেনের ব্যাপারটা কারো কাছেই অপ্রকাশ্য থাকলো না।
জেন তাকিয়ে ছিল জোয়ানের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কথা বলছ না যে?’
জোয়ান মুখ তুলল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল জেনের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘ট্রিয়েস্টে তুমি আমাকে জীবন বিপন্ন করে বাঁচিয়ে ছিলে, তখনও পরো তোমাকে আমি চিনতে পারি নি। সত্যি আমার চোখ এত কম দেখে। আজ তোমাকে চিনতে পেরেছি জেন।’
বলতে বলতে জোয়ানের কন্ঠ ভারী হয়ে এল। চোখ ফেটে নেমে এল অশ্রু।
জেনের ঠোঁটে হাসি। বলল, ‘এই চিনতে না পারা তোমার দোষ নয় জোয়ান। তুমি বিজ্ঞানী। তুমি বস্তুর গভীরে বিচরণে ব্যস্ত, মানুষের মনে প্রবেশের তোমার সময় কোথায়?’
থেমে একটু দম নিল জেন। তারপর বলল, ‘আজ কতটা চিনতে পেরেছে বলত জোয়ান। তাহলে বুঝব, বিজ্ঞানী সাহেবের চিনার মধ্যে কোন ফাঁক আছে কি না?’
জেনের চোখের ওপর চোখ রেখে জোয়ান বলল, ‘না বলব না। এটা বলার জিনিস নয়। হৃদয় দিয়ে অনুভব করার জিনিস এটা।’ জোয়ানের কন্ঠ তখনও ভারী। চোখে তখন পানি।
জেনের মুখ লাল হয়ে উঠল। কাঁপছে আবেগে তার পাতলা শুকনো ঠোঁট। বলল সে, ‘একটু কাছে আসবে জোয়ান? অন্যায় না হলে তোমার চোখের পানিটা আমি আমার হাত দিয়ে মুছে দিতে চাই’।
‘তোমার পক্ষ থেকে আমিই মুছছি।’ বলে জোয়ান হেসে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের পানি মুছে নিয়ে রুমালটা জেনকে দিল।
জেন জোয়ানের রুমাল দু’হাত ভরে নিয়ে, সে দু’হাতের মধ্যে নিজের মুখট গুজলো।
এই সময় ফিলিপের মা দুধ নিয়ে প্রবেশ করল। তার প্রায় সাথে সাথেই ডাক্তার সহ আহমদ মুসা ও ফিলিপ ঘরে এসে ঢুকল। ডাক্তার ফিলিপের বাস্ক সম্প্রদায়েরই একজন। ডাক্তারের সাথে একজন নার্সও এসেছে।
ডাক্তার ক্ষতটি পরীক্ষা করে বলল, ‘ক্ষতটি বড়, কিন্তু বুলেট বেরিয়ে যাওয়ায় এখন আর তেমন জটিলতা নেই। কিন্তু প্রচুর রক্ত গেছে ইতিমধ্যেই, রক্ত দিতে পারলে ভাল হতো।’
‘সমস্যা আছে তুমি তো জান। অপরিহার্য হলে সে ব্যবস্থা এখানেই করতে হবে।’
ডাক্তার আরও পরীক্ষা করে বলল, ‘প্রয়োজন আছে যদিও, কিন্তু প্রয়োজনটা অপরিহার্য নয়। দু’এক দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।’
জেন দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল।
ডাক্তার নার্সকে ইশারা করল, ব্যাগ খুলে প্রয়োজনীয় সব বের করার জন্যে।
নার্স কাজে লেগে গেল।
ডাক্তার এপ্রোনটি পরে নিয়ে হাতে গ্লাভস লাগিয়ে তৈরী হলো।
হাঁটু পর্যন্ত চাঁদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হল জেনকে।
ডাক্তার ফিলিপের মাকে বলল, ‘খালাম্মা এর মাথার কাছে একটু বসেন।’
আহমদ মুসা, ফিলিপ, জোয়ান সবাই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ডাক্তার জেনকে বলল, ‘তোমাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে, একটু কষ্ট হবে বোন।’ বলে জেনকে একটা ইনজেকশন দিয়ে তুলা কাঁচি ইত্যাদি নিয়ে জেনের বুলেট বিদ্ধ ক্ষতের দিকে এগুলো।
জেন দাঁতে দাঁতে চেপে চোখ বন্ধ করল।