জেনের আব্বা জেমেনিজ ডে সিসনারোসার লাইব্রেরী কক্ষ।
একটা বিশাল কক্ষের চারদিকে ঘোরানো র্যাকে ঠাসা বই। সব ধরনের বইয়ের একটি সুনির্ধারিত সংগ্রহ এ লাইব্রেরী।
জেন এবং জেনের আব্বা জেমেনিজ পাশাপাশি চেয়ারে বসে। জেনের সামনে খোলা বিজ্ঞান ম্যগাজিন ‘নিউ ফিজিক্স’-এর সর্বশেষ সংখ্যা, আর জেমেনিজ পড়ছে চলতি সপ্তাহের ‘টাইম ইন্টারন্যাশনাল’।
লাইব্রেরীটি এই কার্ডিনাল পরিবারের একটি মিলন কেন্দ্র। ঐতিহ্যগতভাবে পরিবারের সবাই মোটামুটি পড়ুয়া। তারা ড্রইংরুমে বসে গাল-গল্পে সময় কাটানোর চাইতে লাইব্রেরীতে বসে বই পড়তে ভালবাসে। এমনকি পারিবারিক গল্প-গুজব বেশিরভাগই তাদের লাইব্রেরীতে বসেই হয়।
জেমেনিজ ডে সিসনারোসা পড়তে পড়তে পত্রিকা থেকে মুখ তুলল। জেনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, এ সংখ্যা টাইম দেখেছ?’
‘না,আব্বা।’ বই থেকে মুখ তুলে বলল জেন।
‘ট্রিয়েষ্টের ঘটনার ওপর মজার একটা স্টোরি করেছে।’
‘ট্রিয়েষ্টের ঘটনার ওপর? কি লিখেছে?’ জেনের চেহারা ম্লান হয়ে উঠল।
‘স্টোরির দুইটা অংশ। প্রথম অংশে পুলিশ এবং গবেষণাকেন্দ্রের সূত্রের বরাত দিয়ে লিখেছে, ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিয়োরিটিক্যাল ফিজিক্স’গবেষণা কেন্দ্রটি একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের অর্ডার পায়। যেদিন এ পরীক্ষণটি সম্পূর্ণ হয়, সেদিনই পরীক্ষণটি হারিয়ে যায়। সেই হারিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করেই পরীক্ষণের সাথে সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক নিহত হন এবং অন্যান্য হত্যাকান্ড ঘটে। পুলিশের মতে দুই পক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এই হত্যাকান্ড সমূহ ঘটেছে। পরীক্ষণের বিষয় কি ছিল তাও পুলিশ উদ্বার করতে পারেনি। কারণ স্যাম্পুল, পরীক্ষণ রেজাল্ট ও কম্পিউটার ডিস্ক সবই চুরি হয়ে যায়। মনে করা হচ্ছে, পরীক্ষণের সাথে সংশিস্নষ্ট বৈজ্ঞানিকের যোগসাজশেই চুরির ঘটনা ঘটে। প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টি পক্ষ পরীক্ষণের ফল হাত করতে গিয়েই ঐ হত্যাকান্ড সমূহ সংঘটিত হয়। যারা পরীক্ষণের অর্ডার দিয়েছিল, তাদের ও পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের ঠিকানা যা গবেষণাকেন্দ্রে লিপিবদ্ব আছে তা ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে।
ষ্টোরির দ্বিতীয় অংশটাই মজার। অপ্রকাশযোগ্য বিশেষ সুত্রের বরাত দিয়ে এ অংশে বলা হয়েছে, ট্রিয়েষ্টে যা ঘটেছে তার গোড়া স্পেনে। স্পেন ঘিরে একটা ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠেছে। এই ষড়যন্ত্রের মধ্যমনি হিসাবে কাজ করছেন আহমদ মুসা। মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যায়ের কৃতি ছাত্র জোয়ান ফার্ডিন্যান্ড এবং স্পেনের মরিস্করা তার সহযোগী হিসাবে কাজ করছে।’
জেনের মনে ভয় ও শংকার চেয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি হলো বেশী। এ ধরনের উল্টো ষ্টোরি টাইম ইন্টারন্যাশনালে’র মত একটা পত্রিকা করতে পারল। কারা ষড়যন্ত্র করছে, আর ষড়যন্ত্রের দায় চাপাচ্ছে কার ঘাড়ে।
জেন তার আব্বা বলা শেষ করলে বলল, ‘কিন্তু আব্বা তুমিও জান, আমিও জানি, জোয়ান একজন পিওর একাডেমিশিয়ান। ছোটবেলা থেকেই পড়া শুনার বাইরে আর কোন কিছুতে আগ্রহ নেই। দেশের বিরুদ্ধে সে কোন ষড়যন্ত্র করতে পারে তুমি বিশ্বাস কর?’
‘তুমি আগের জোয়ানের কথা বলছ মা। এখনকার জোয়ান আর আগের সেই জোয়ান এক নয়। নিজের মরিস্ক পরিচয় জানার পর সে ভিন্ন মানুষ হয়ে গেছে। মুসলমানদের তুমি জান না। সময় বদলায়, মুসলমানরা বদলায় না। মুসলমানরা তাদের ঈমান নষ্ট করে না।’
‘কিন্তু আব্বা স্পেনে মরিস্কদের পূর্ব পুরুষ মুসলমান ছিল। এখন মুসমানিত্বের কি অবশিষ্ট আছে তাদের? নামটাও তো নেই।’
‘বাইরে থেকে দেখলে এমনই মনে হয় মা। কিন্তু ওদের মনে উঁকি দিলে দেখবে, চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে ওরা মুসলমানই রয়ে গেছে।’
‘কেউ যদি মনে মনে তার বিশ্বাস লালন করতে চায়, তাহলে ক্ষতি কি? স্পেনে মরিস্করা কয়জন? ওরা যদি পুরোপুরি মুসলিম হিসাবেও জিন্দেগী যাপন করে, তাহলে কি আর ক্ষতি করতে পারবে স্পেনের?’
‘ইসলাম সংক্রামক ব্যাধি, আর মুসলমান সে ব্যাধির দক্ষ জীবানুবাহী। ওদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে অল্প দিনেই দেশের সকল মানুষকে মুসলমান বানিয়ে ছাড়বে।’
‘কি ভাবে?’
‘বললাম না ইসলাম সংক্রামক ব্যাধির মত। ওদের একটা সম্মোহনী শক্তি আছে, তার ওপর স্পেনের সাধারণ লোকদের মধ্যে স্পেনের মুসলিম শাসনকালের প্রতি একটা বিরাট মোহ আছে। তারা মনে করে, স্পেন থেকে মুসলিম শাসন চলে যাবার পরই, স্পেন ইউরোপে তার নেতৃত্ব হারিয়েছে। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সভ্যতা, কৃষি, বাণিজ্য সবদিক দিয়েই স্পেন পিছিয়ে গেছে। মুসলিম শাসন ছিল স্পেনের সৌভাগ্যের প্রতীক।’
‘কথাটা কি মিথ্যা? আব্বা?
‘মিথ্যা নয় বলেই তো মুসলমানদের নাম আমরা স্পেনে রাখতে চাই না।’
‘তাহলে বল দোষটা জোয়ানের ওপর চাপাচ্ছ কেন ষড়যন্ত্র তো তাহলে ওরা করছে না?’
‘না মা ষড়যন্ত্র ওরা করছে। না হলে আহমদ মুসা স্পেনে এসেছে কেন? তাঁর মত লোক, কোন বড় মিশন না নিয়ে কোথাও যায়না।’
‘কি ধরনের ষড়যন্ত্র তারা করছে বলে মনে কর আব্বা?’
‘ঐতো, তাদের মতলব কি, ষড়যন্ত্রের স্বরম্নপ কি, সেটারই তো আমরা সন্ধান করছি।’
‘ষড়যন্ত্রই যখন এখনও চিহ্নিত হয়নি, তখন ওদেরকে ষড়যন্ত্রকারী বলে ফেলা কি ঠিক আব্বা?’
‘অনেক ব্যাপার আছে, তুমি সব বুঝবে না।’
‘আব্বা, পারস্পরিক অনাস্থা, অবিশ্বাস ভূলে গিয়ে দেশের মানুষ আমরা সবাই কি এক হতে পারি না? কেউ যদি দেশের আইনের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করে, তাকে দেশের হাতে সোপর্দ করতে পারি।’
‘তুমি ছোট, সব জান না। যেমন তুমি সরল, দুনিয়াটা তেমন সরল নয় মা!’
‘ঠিক এই সময়ই পাশের ইন্টারকম কথা বলে উঠল। রিসেপশন থেকে কথা বলছে। বলল, ‘মিঃ ভাসকুয়েজ এসেছেন।’
জেমেনিজ চট করে ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম ভাসকুয়েজ আসার কথা।’
তারপর জেমেনিজ রিসেপশনকে বলল, ‘লাইব্রেরীতে পাঠিযে দাও।’
আধ মিনিটের মধ্যেই ভাসকুয়েজ ‘শুভ বিকেল’ জানাল জেমেনিজকে।
‘শুভ বিকেল’ কেমন আছেন মিঃ ভাসকুয়েজ?’
জেনও উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল মিঃ ভাসকুয়েজকে।
জেমেনিজও উঠে দাঁড়িয়েছিল।
ভাসকুয়েজের সাথে হ্যান্ডশেক করে জেমেনিজ ঘরের ওপাশে একটা টেবিল দেখিয়ে বলল, ‘চল আমরা ঘরের ওখানে বসি।’
জেমেনিজ ও ভাসকুয়েজ অল্প দূরে বিপরীত দিকের একটা টেবিলে গিয়ে বসল।
লাইব্রেরী ঘরের পাশেই জেমেনিজের খাস বৈঠক খানা। সম্ভবত জেমেনিজ লাইব্রেরীতে বসেছিল বলে সেখান থেকে আর বেরুতে চাইল না।’
জেমেনিজ সামনের চেয়ারে আসন নেয়ার পর, ভাসকুয়েজ বাঁকা চোখে একবার জেনের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুরু করল, ‘জরুরী একটা ব্যাপার নিয়ে এসেছি।’
ভাসকুয়েজকে নিয়ে তার আব্বাকে এ ঘরেই বসতে দেখে জেন অস্বাভাবিক বোধ করছিল। চলে যাবে কি না ভাবছিল, এই সময় ভাসকুয়েজের ‘জরুরী একটা ব্যাপার নিয়ে এসেছি’ কথাটা কানে গেল জেনের। জরুরী কথাটা কি? জোয়ানদের কথা নয়তো? জেন আগ্রহী হয়ে উঠল।
চোখটা ম্যাগাজিনের পাতায় নিবদ্ধ রেখে কানটাকে উৎকর্ণ রাখল জেন ভাসকুয়েজের দিকে।
‘জরুরী তাতো বুঝতেই পারছি।’ ভাসকুয়েজের কথার উত্তরে বলল জেমেনিজ।
একটু থেমে জেমেনিজই আবার প্রশ্ন করল, ‘জুবিজুরিটাকে কোথায় হত্যা করল জানা গেছে?’
‘না জানা যায় নি।’
‘জুবি জারিটার গড়ীর সন্ধান পাওয়া যায়নি?’
‘পাওয়া গেছে একটা নাইট ক্লাবের সামনে।’
‘গাড়ীতে জুবিজুরিটি ছাড়া আর কারো হাতের ছাপ আছে?’
‘না।’
‘নাইট ক্লাব অর্থাৎ নারী ঘটিত কোন ব্যাপার নেইতো জুবিজুরিটার হত্যার পেছনে?’
‘না স্যার।’ প্রবল ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ভাসকুয়েজ। আরো বলল সে, ‘অফিস থেকে টেলিফোন পেয়ে সে বেরিয়েছে। অফিসকে সে জানিয়েছে, আমি ওকে ফলো করছি, পালাতে পারবে না। আমি তোমাদের জানাব। সুতরাং নির্ঘাত আহমদ মুসাকেই সে ফলো করেছিল।’
‘আছা বলত, ডেভিলের মত রোবটকে ফাঁকি দিয়ে আহমদ মুসা পালাল কি করে?’
‘সে ধড়িবাজের শিরোমনি স্যার, তার বুদ্ধির শেষ নেই।’
‘আচ্ছা শাহ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্স পাহারা দিয়ে সব কটিকেই তো ধরা যায়।’
‘পাহারা বসিয়েছি কিন্তু কোন কাক পক্ষী ওদিকে যায়নি।’
‘আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুলের ব্যাপারটা ওদের কাছে ধরা পড়ল কি করে? অত্যন্ত সুপার সিক্রেট ব্যাপার ছিল এটা। কোনও ভাবে এটা ডিটেকটেবলও নয়। জানল কেমন করে ওরা?’ কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেনি তো?’
‘না স্যার সেরকম কিছু সম্ভব নয়। শীর্ষ পর্যায়ের আমরা কয়েকজন ছাড়া আর কেই জানে না। যে ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে আমরা তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল গুলো পেতেছি, সেও জানে না। সে জানত ওগুলো প্রত্নতাত্বিক গবেষনার কোন ব্যাপার। তাছাড়া সে ইঞ্জিনিয়ার বেঁচে নেই।’
‘তাহলে ওদের জানার রহস্য কি?’
‘স্যার আহমদ মুসা সব পারে, সে যাদু জানে।’
‘যাদু জানে বলছ কি তুমি?’
যাদুর মতই ব্যাপারটা স্যার। যুগোশস্লাভিয়া, ককেশাস ও মধ্য এশিয়া থেকে আমরা খবর নিয়েছি তার ভিন্ন একটা চোখ আছে। যা আমরা দেখি না, তাও সে দেখে।’
‘ভাসকুয়েজ আমি পড়েছি, সব খাঁটি মুসলমানরাই নাকি ওরকম। অনেক অলৈাকিক কাজ তারা করতে পারে। ওটাকে ওরা বলে আল্লাহর সাহায্য।’
‘ঠিক বলেছেন স্যার, চরম বিপদের মধ্যেও তারা হাসতে পারে নাকি এই কারণেই। আমারও না দেখলে বিশ্বাস হতো না। আহমদ মুসা বন্দী হলো কয়েকবার আমাদের হাতে। মৃত্যুর মুখোমুখি তাকে দাড়াতে হয়েছে। কিন্তু তাকে সামান্য চিন্তিত হতেও দেখা যায় নি।’
‘এখানেই তো আমাদের বিপদ ভাসকুয়েজ, সব মুসলমান যদি যদি খাঁটি মুসলমান হয়ে যায়, তাহলে জগতের কোন শক্তিই তাদের সামনে দাঁড়াতে পারবে না।’
‘এটা যাতে না ঘটে তারই তো চেষ্টা হচ্ছে স্যার সব জায়গায়। স্পেন থেকে ওদের আমরা নিশ্চিহ্ন করবই।’
‘এখন বল তোমার নিশ্চিহ্ন করার কাজ কতদূর? তোমার আজকের জরুরী বিষয়টা কি?’
‘বলছি স্যার’ শুরু করল ভাসকুয়েজ, ‘স্যার ওরা হন্যে হয়ে খুজছে তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল স্থাপনের প্ল্যান ও ডায়াগ্রাম। আহমদ মুসা সেদিন আমার অফিসে হানা দিয়েছিল এর খোঁজে।’
‘তাই কি করে বুঝলে?’ চোখ দুটি বড় করে নড়ে চড়ে বসে প্রশ্ন করল জেমেনিজ।
‘কম্পিউটার পরীক্ষা করে জানা গেছে। কম্পিউটারের সাবজেক্ট ফাইল থেকে সে ঐ সংক্রান্ত ফাইলটিই বের করেছে।’
কি করে জানলো অমন ফাইল ওখানে আছে?
‘বলেছি না স্যার আহমদ মুসা বাতাস থেকে গন্ধ পায়!’
‘কিন্তু ভাসকুয়েজ, এবার সে বাতাস থেকে গন্ধ পায়নি। এবার সে ব্যর্থ হয়েছে।’
‘একেবারে ব্যর্থ সে হয়নি। কম্প্যুটারের সে ফাইলে তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল স্থাপনের প্ল্যান ও ডায়াগ্রাম ছিল না বটে, কিন্তু কোথায় থাকতে পারে তার একটা ক্লু সে পেয়ে গেছে। এই বিষয়টাই আমি আপনাকে জানাতে এসেছি স্যার।’
‘কি বলছ তুমি?’
‘জি স্যার, ফাইলে বলা আছে ‘ডকুমেন্ট ‘Elder’ এর কাছে নিরাপদ।’
‘Elder’ থেকে তারা কি বুঝবে’
‘কি বুঝবে বলা মুশকিল, তবে ‘Elder’ এর সন্ধান তারা করবে এটা নিশ্চিত।’
‘আমাদের করণীয় সম্পর্কে কি বলতে চাচ্ছ?’
‘আপনার এখন সাবধান হওয়া দরকার।’
‘কেমন সাবধান, চলা পেরার ব্যাপারে?’
‘সেটা বোধহয় দরকার হবে না। একটা প্রশংসা ওদের করতে হয়। চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি না হলে শত্রকে ওরা চোরাগোপ্তা হামলা করে না।’
‘তাহলে কি সাবধানের কথা বলছ?’
‘আপনার বাসার নিরাপত্তার কথা ভাবছি, এখানে পাহারার জন্যে লোক বসাব কিনা চিন্তা করছি।’
‘ও বুঝেছি ঐ কারণে।’ বলে একটু থামল জেমেনিজ। তারপর আবার শুরু করল, ‘তার চেয়ে ভাসকুয়েজ ডকুমেন্টটা আমার বাসা থেকে সরিয়ে নাও না’।
ম্যাগাজিনে জেনের চোখটা আটকা থাকলেও সমস্ত মনযোগ একত্রিত করে উৎকর্ণ হয়ে শুনছিল তাঁর আব্বার সাথে ভাসকুয়েজের আলাপ। ‘ডকুমেন্টটা আমার বাসা থেকে সরিয়ে নাও না’ কথাটা জেনের কানে পৌছাতেই বিদ্যুত চমকিত হলো তার শরীর। যে ডকুমেন্টটা আহমদ সুসা জোয়ানরা পাগলের মত খুঁজছে সেটা তাদের বাসায়। আনন্দ উত্তেজনা- শংকায় জেনের বুকে যেন কাঁপন ধরে গেল। কিন্তু কান সে পেতে রাখল সেই কথোপকথনের দিকে।
‘কোথায় নেব, অফিস আর নিরাপদ নয়। আমাদের বাসা তো ওদের শ্যোন দৃষ্টির মধ্যে।’ জেমেনিজের প্রস্তাবের উত্তরে বলল ভাসকুয়েজ।
‘ওগুলোর কাজ তো শেষ। এখন পুড়িয়ে ফেললে হয় না ওগুলো?’
‘না, স্যার ওগুলোর সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরী। টার্গেট ধ্বংসের কাজ যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন ওগুলোকে তুলে ফেলতে হবে। না হলে ওর কার্যকারিতা চলতেই থাকবে, যা ছড়িয়ে পড়বে গোটা এলাকায়। সংশ্লিষ্ট এলাকায় যা পাবে তাকেই ঠেলে দেবে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে।’
‘সাংঘাতিক, তাহলে তো ওগুলো ভীষণ জরুরী।’
‘ঠিক স্যার।’
‘তাহলে?’
‘কার্ডিনাল পরিবারের আশ্রয়ের চেয়ে নিরাপদ স্থান স্পেনে আর নেই স্যার।’
‘এই প্রশংসায় খুশি হলো জেমেনিজ। তার পূর্ব পুরুষ কার্ডিনাল ফ্রান্সিস জেমেনিজ ডে সিসনারোসা ছিলেন স্পেনের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং রাণী ইসাবেলার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক শুরু। স্পেনে খৃষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও তার সংহত করণে তার অমূল্য অবদান রয়েছে। এই জন্যে কার্ডিনাল পরিবার এখনও গোটা স্পেনের খৃষ্টান মহলে অত্যন্ত সম্মানিত। এই পরিবারের মত সম্মান স্পেনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরাও পান না। এখনও রাস্তা-ঘাটে বাজারে কার্ডিনাল পরিবারের কাউকে দেখলে মানুষ দাঁড়িয়ে যায়।
প্রশংসায় মুগ্ধ জেমেনিজ বলল, ‘ঠিক আছে ভাসকুয়েজ, তাহলে এটা এখানে থাক।’
‘চিন্তা নেই স্যার, ওগুলো আপনার এখানে একটা নিরাপদ ব্যবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া আপনাদের ভূগর্ভস্থ কক্ষ। নিজেই সিন্ধুকের মত দুর্ভেদ্য। তার ওপর আমরা চোখ রাখব। কারও চোখ এদিকে পড়বে বলে মনে করি না।’
‘না ভাসকুয়েজ, কোন প্রহরী আমি চাই না। মানুষ কি বরবে। কার্ডিনাল পরিবারের নিরাপত্তার জন্যে কোন সময়ই প্রহরী বসান হয়নি।’
‘ঠিক আছে স্যার। তাহলে এখন উঠি।’
‘ওদিকে জেনের ভেতরটা থর থর করে কাঁপছে। তাদের ভূগর্ভস্থ কক্ষে আছে ঐ ডকুমেন্ট!
ভাসকুয়েজের উঠার কথায় শংকিত হয়ে উঠল জেন। ওকে বিদায় দিতে হবে, তার আব্বার সাথে কথা বলতে হবে। জেনের মুখ দেখলে নিশ্চয় ওদের অভিজ্ঞ চোখ সবকিছু ধরে ফেলবে। কিছুতেই মনকে সে স্বাভাবিক করতে পারছে না।
অপ্রত্যাশিত ভাবে একটি সুযোগ জেনের জুটে গেল।
ভাসকুয়েজের উঠার কথায় জেমেনিজ বলল, মুখে কিছু না দিয়ে যাবে কি করে? বলে জেমেনিজ উঠে ইন্টারকমের দিকে এগিয়ে এল। এই সময় জেন তাড়াতাড়ি উঠে দাড়িয়ে বলল, ‘আমি যাচ্ছি আব্বা, পাঠিয়ে দিচ্ছি নাস্তা।’
বলে জেন মুখ নিচু রেখেই ছুটল।
বাইরে বেরিয়ে গেল জেন। আল্লার শুকরিয়া আদায় করল সে। আল্লাহ তাকে একটা নাজুক অবস্থার থেকে উদ্ধার করেছেন।