বেশ আগে ঘুম থেকে উঠেছে আহমদ মুসা। অনুমান করে মাগরিবের নামাজটাও পড়ে নিয়েছে। এই অন্ধকুপে সময়ের বিচার একেবারেই অসম্ভব। নাস্তা ও দুপুরের খানা থেকে সময়ের একটু পরিমাপ করে নিয়েছে আহমদ মুসা। এই হিসেব থেকে সে যোহর ও আছরের নামায পড়েছে। আছরের নামাজ পড়ে সে আবার ঘুমিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে আহমদ মুসা অনুমান করেছিল দু’ঘন্টার বেশী সে ঘুমায়নি। সুতরাং সে ঘুম থেকে উঠেই মাগরিবের নামাজ পড়ে নিয়েছে।
সকালেও একবার ঘুমিয়েছে আহমদ মুসা। রোবটের পায়ের শব্দে তার ঘুম ভেঙেছিল। চোখ খুলেই সে দেখতে পেয়েছিল রোবটকে। লিফট থেকে বেরিয়ে হেঁটে আসছে মেঝের উপর দিয়ে। নিঃশব্দ গতি, তার মুখ দিয়ে অব্যাহতভাবে একটা শব্দ বেরুচ্ছে ‘নাস্তা নাস্তা।’ এই শব্দেই তার ঘুম ভেঙেছিল।
রোবটের হাতে ছিল একটা টিফিন বক্স। সে বক্সটি এনে আহমদ মুসার সামনে রেখেছিল। রাখার সংগে সংগেই তার মুখের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আহমদ মুসা আগেই উঠে বসেছিল।
রোবটের উচ্চতা সাড়ে চার ফুটের মত হবে, আহমদ মুসা অনুমান করে নিয়েছিল। ঠিকই বলেছিল জুবি জুরিটা, রোবটের মাথায় দশটি চোখ। দশটি চোখেই উজ্জ্বল দৃষ্টি। রোবটের হাত দুটি দীর্ঘ এবং বলিষ্ঠ। হাতের দিকে তাকিয়েই আহমদ মুসা বুঝেছিল, হাত দু’টি সামনে পিছনে, ডানে বামে সব দিকে সমানভাবে সক্রিয় হতে পারে। আস্থার সাথে নিখুঁতভাবে পা ফেলে সে। সবই ঠিক আছে, শুধু মুখ দেখেই বলা যায় তার ‘ডেভিল’ নাম স্বার্থক। কুৎসিত এবং ভয়ংকর তার মুখ। ঐ মুখ নিয়ে যখন সে এগিয়ে আসে মনে হয় খুন করতেই আসছে।
টিফিন বক্স রেখে রোবট দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা বুঝেছিল, সে খেলে টিফিন বক্সটি ফেরত পাবে, তার পরেই রোবট যাবে।
টিফিন বক্সটি বিরাট। তার মধ্যে নাস্তা পানি সবই আছে।
বক্সটি খুলল আহমদ মুসা।
রোবট সম্পর্কে সাবধান হওয়ার ব্যাপারে জুবি জুরিটার কথা আহমদ মুসার মনে ছিল কিন্তু হঠাৎ এক সময় মাথা চুলকাবার জন্যে তার ডান হাত উপরে উঠে গেল। আঁৎকে উঠল আহমদ মুসা, এই বুঝি কি ঘটে যায়। কিন্তু কিছুই ঘটল না। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। পরক্ষণেই ভাবল, হাতটা বিশেষ ভংগিতে না উঠলে সম্ভবতঃ রোবট প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবেনা। সে বিশেষ ভংগিটা কি, অনুমান করতে চেষ্টা করল আহমদ মুসা। নিশ্চয় হাত রোবটের দিকে টার্গেট হতে হবে এবং চোখও বোধ হয় রোবটের দিকে নিবদ্ধ হতে হবে। কাউকে আক্রমণের সময় মানুষের চোখ ও হাতের এমন অবস্থানই হয়ে থাকে। এমন ভাবে চিন্তা করতে পারায় আহমদ মুসা খুশী হলো। তার এই চিন্তা সঠিক কি না দুপুর বেলা আহমদ মুসা পরীক্ষা করল।
সকালে যেমন রোবট লিফটে করে একা এসেছিল দুপুরেও তাই এলো। আহমদ মুসা বুঝল রোবট লিফট চালাতেও জানে।
রোবট খাবারের বক্স ঘরের ঠিক মাঝখানে রেখে দাঁড়িয়েছিল।
রোবট যখন ঢোকে, তখন আহমদ মুসা ঘরে পায়চারি করছিল।
রোবট খাবারের বাক্স রেখে দাঁড়ালে আহমদ মুসাও খাবারের বাক্সের কাছে এসে দাঁড়ালো। তারপর সে দু’হাত তুলে গা থেকে কোট খুলে হাতে নিয়ে বসে পড়ল। এ সময় আহমদ মুসার চোখ ছিল নিচু। কি ঘটে সেই চিন্তায় তার দেহের প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রী টান টান হয়ে উঠল।
না, কিছুই ঘটলনা। রোবট হাত নিচু রেখে যেমন দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে থাকল। আহমদ মুসা নিশ্চিত হয়ে গেল, তার চিন্তা ঠিক। হাত ও চোখ এক সাথে রোবটের দিকে টার্গেটেড না হলে রোবট সক্রিয় হবে না, শত্রুতা করবেনা। আহমদ মুসা জানে, রোবটের চোখ গুলো হলো দূরনিয়ন্ত্রিত টিভি ক্যামেরা অথবা এ চোখ গুলোর সাথে রোবটের ভেতরের কমান্ডসেল যুক্ত রয়েছে। চোখগুলো দিয়ে দেখেই কমান্ডসেল রোবটকে নির্দেশ দেয়।
এই চিন্তা সামনে রেখে আহমদ মুসা একটা পরিকল্পনা আঁটলো। রোবট খাবার বক্স নিয়ে চলে যাবার পর অন্ধকূপের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে আহমদ মুসা তার পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিল। এবং স্থির করল, আল্লাহর ওপর ভরসা করে রাতেই সে তার পরিকল্পনা কার্যকর করার উদ্যোগ নেবে।
মাগরিবের নামাজের পর আহমদ মুসা ঘণ্টা খানেক ধরে হালকা ব্যায়াম করল। তারপর ঘরময় সে পায়চারি করতে থাকে।
কতক্ষণ পায়চারি করেছে, কত রাত হয়েছে কে জানে। তবে রাতের খাবার সময় পার হয়ে যায়নি, কারণ রোবট খাবার নিয়ে আসেনি। ঠিক খাবারের সময়েই রোবট খাবার নিয়ে আসবে। মনে মনে আহমদ মুসা জুবি জুরিটার প্রশংসা করল। অন্ততঃ খাবারটা সে ঠিকমত দিচ্ছে। শিকারকে খাইয়ে দাইয়ে সম্ভবতঃ মোটা তাজা করে নিতে চায় জুবি জুরিটা।
খুট করে একটা শব্দ হলো লিফটের দরজায়। খুলে গেল লিফটের দরজা ধীরে ধীরে। খোলা দরজা দিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে এল রোবট। আগের দু’বারের মত রোবট খাবারের বক্সটি এনে মেঝের ঠিক মাঝখানে রাখল।
আহমদ মুসা বিপরীত দিকের দেয়ালের কাছে তখন। লিফটের দরজা খোলার সাথে সাথে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
রোবট খাবারের বক্সটি মেঝেতে নামিয়ে রাখার পর আহমদ মুসা ধীরে ধীরে সেদিকে এগুলো। আহমদ মুসার দৃষ্টি রোবটের দিকে নয়, খাবারের বক্সে দিকে। আহমদ মুসা যতই খাবারের বক্সে কাছাকাছি হচ্ছে, ততই তার স্নায়ুতন্ত্রীর উত্তেজনার চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আল্লাহ তাকে সফল করবেন তো? আহমদ মুসার হিসেব যদি ঠিক না হয়ে থাকে, যা সে চিন্তা করেছে তার চেয়ে ভিন্ন ধরণের যদি হয় রোবটের প্রকৃতি। আহমদ মুসা জীবনে বার বার ঝুঁকি নিয়েছে, কিন্তু এমন অনিশ্চিয়তার মুখোমুখি সে কোন দিন হয়নি।
রোবট খাবার বক্স থেকে এক গজেরও কম দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা খাবারের বক্সের এক ফুটের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। তার নিম্নমুখী চোখ রোবটের পা দেখতে পাচ্ছে। সে ঠিক দুপুরের মতই চোখ নিচু রেখে হাত দু’টি তুলে কোট খুলতে লাগল। কোট খুলে দু’হাত দিয়ে ধরে সামনে নিয়ে এল। তারপর ঠিক ভাজ করার জন্যে কাপড় যেভাবে মানুষ টান করে ধরে -ঠিক সেভাবে দু’হাতে কোট টান করে সামনে ধরল। এর পরেই চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনাটা। আহমদ মুসা বিদ্যুত বেগে দু’হাতে ধরা কোটটি আর একটু ওপরে তুলে ছুড়ে দিল রোবটের মাথায়।
নিখুঁত টার্গেট। প্রসারিত কোটটি গিয়ে রোবটের মাথার গোটাটাই ঢেকে দিল।
কোট ছুঁড়ে দিয়েই ছুটল সে খোলা লিফটের দিকে।
লিফটে গিয়ে উঠল আহমদ মুসা।
লিফটের দরজা ক্লোজ করার বোতামে টিপ দেবার আগে আহমদ মুসা রোবটের দিকে তাকিয়ে দেখল, রোবট ঘুরছে, উথাল পাথাল করছে, কিন্তু হাতে দুটি তাঁর মাথা থেকে কোট সরাতে পারছে না। কারন চোখ বন্ধ থাকায় এ ধরনের কাজের কমান্ড সে পাচ্ছে না। রোবটের চোখ বন্ধ হয়ে যাবার সাথে সাথে ভেতরের কমান্ড সেলও অন্ধ হয়ে গেছে। রোবট বুঝতেই পারলনা আহমদ মুসা লিফটের চলে গেছে।
লিফটকে ক্লোজ করার বোতাম টিপে দিল আহমদ মুসা। কোন তলায় গিয়ে লিফট থেকে নামবে, সেটা ঠিক করতে গিয়ে সুইচ প্যানেলে দেখল, একতলা ও দোতলায় কোন স্টপেজ নেই। স্টপেজ আছে তিন, চার ও পাঁচ তলায়। আহমদ মুসা বুঝল, এটা বিশেষ লিফট, এ লিফট দিয়ে বাইরে বেরুনো যাবে না।
আন্ডার গ্রাউন্ড সেলে নামানো হয়েছিল। আহমদ মুসা তিন নম্বর বোতামটিই টিপে দিল। তিন তলায় নামবে সে।
তিন তলায় এসে লিফট থেমে গেল।
আহমদ মুসার মনে আছে, যাবার সময় লিফটের এ দরজায় একজন প্রহরী দেখেছিল। তাঁর হাতে তখন স্টেনগান ছিল। লিফটের দরজা ধীরে ধীরে খুলছে। আহমদ মুসা ভাবল, প্রহরী নিশ্চয় মনে করছে রোবট নামবে লিফট থেকে। অথবা যদি রোবট তিন তলায় নামার ব্যাপার নয়, তাহলে মনে করতে পারে কোন অফিসার আসছেন। অথবা এ সময় এখানে যদিও কারও নামার কোন ব্যাপার না হয়, তাহলে প্রহরী সন্দেহ করতে পারে। আহমদ মুসা যে কোন অবস্থার জন্য নিজেকে তৈরি করল।
লিফটের দরজা অর্ধেকটা খোলা হতেই আহমদ মুসা লিফট থেকে এক লাফে করিডোরে পড়ল।
প্রহরী দরজার এক পাশে স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা গিয়ে একদম তাঁর মুখের সামনেই পড়ল।
ভুত দেখার মত আঁতকে উঠল প্রহরী। পরক্ষনেই সে নিজেকে সামলে নিল। মনে হলো সে চিনতে পেরেছে আহমদ মুসাকে। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রহরী তাঁর স্টেনগান তুলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে সুযোগ আর পেল না। আহমদ মুসার ডান হাতের প্রচণ্ড এক কারাতে গিয়ে পড়ল তাঁর বাম কানের নিচে ঘাড়টায়। সঙ্গে সঙ্গেই সে সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তাকে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলে টেনে লিফটে নিয়ে এল। তারপর লিফট ক্লোজ করে আন্ডার গ্রাউন্ড বোতাম টিপে দ্রুত বেরিয়ে এল। তারপর পড়ে থাকা স্টেনগান টি করিডোরে থেকে তুলে নিয়ে মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল, কোন দিকে যাবে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। করিডোরে একদম ফাকা। প্রহরী শ্রেণী ছাড়া অফিসে রাতে সাধারণ কর্মচারীরা কেও থাকে না।
করিডোরের পূর্ব প্রান্তে বেরিয়ে যাবার লিফট ও সিঁড়ি। নিশ্চয় রাতে বাইরে বেরুবার গেট বন্ধ, তাঁর উপর সেখানে আছে দু জন প্রহরী। তাছাড়া তাঁর পালাবার খবর প্রকাশ হতে দেরী হবে না। সে ক্ষেত্রে প্রথমে সবাই গেটের দিকেই ছুটবে। করিডোরটি পশ্চিমে গিয়ে ভাস্কুয়েজের কক্ষে শেষ হয়েছে।
আহমদ মুসা ভাস্কুয়েজের কক্ষের দিকেই ছুটল। তাকে খোঁজার জন্য। প্রথম দিকে অবশ্যই কেও এদিকে আসবেনা।
ভাস্কুয়েজের বন্ধ দরজার সামনে দাড়িয়ে আহমদ মুসা দ্রুত জুতার গোড়ালি থেকে ল্যাসার নাইফ বের করে নিল। তারপর ল্যাসার বিম দিয়ে কয়েক সেকেন্ডে এর গলিয়ে ফেলল লোক।
আহমদ মুসা ভাস্কুয়েজের ঘরে ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। মেঝেয় পা বারাতে গিয়ে, ছাঁদ থেকে তাকিয়ে থাকা ইনফারেড ক্যামেরা এর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল বটে, কিন্তু বিকল্প সন্ধানে এর তখন কোন সময় ছিল না। তাছাড়া করিডোরেও তো ক্যামেরা থাকতে পারে। সুতরাং তাঁর গতি বিধি ধরা পড়ে যাবেই। যতক্ষণ সুযোগ আছে, তাঁর দ্রুত সদ্ব্যবহার করতে হবে।
আহমদ মুসা দৌড় দিল জানালা লক্ষ্য। দৌড় দেয়ার জন্য পা তলার পরেই তাঁর ডান পা টি কিসের সাথে ধাক্কা খেল। থেমে ঝুকে হাত দিয়েই বুঝতে পারল তাঁর ব্যগ। আহমদ মুসা র মনে পড়ল তাঁর কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে একজন প্রহরী দরজার সামনে ডান পাশটায় রেখে দিয়েছিল। ব্যাগটা ওখানই আছে। ওরা নিয়ে যায়নি, রেখে দিয়েছে ভাস্কুয়েজের জন্য। অথবা তারা ভুলেই গেছে ব্যাগের কথা, আহমদ মুসাকে পাওয়ার আনন্দে।
খুশী হল আহমদ মুসা ব্যাগটি পেয়ে। ব্যাগ হাতে তুলে আবার ছুটল আগের সেই জানালার দিকে।
জানালার গরাদ পরীক্ষা করে খুশী হল। আজকেও জানালার গরাদ লক করা নেই। আহমদ মুসা ধরা পড়ার পর এর প্রয়োজন বোধ হয় তারা মনে করেনি।
আহমদ মুসা জানালার গরাদ উঠিয়ে সংকীর্ণ কার্নিশটি তে নেমে এল। কার্নিশে দাড়িয়ে নিচে তাকিয়ে হতাশ হল আহমদ মুসা। সেদিন যেমন এ পাশটা অন্ধকার ছিল, আজ অন্ধকার নয়। এ পাশে নতুন একটা লাইট পোস্ট বসানো হয়েছে। তবে আহমদ মুসা খুশী হল, ছোট ঝাউ গাছটার ওপাশে তাঁর গাড়িটা সে যেখানে রেখে গিয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। নিচটা ভাল করে দেখতে গিয়ে আরও হতাশ হল আহমদ মুসা। তাঁর সোজাসুজি নিছের জায়গাটা থেকে গজ তিনেক দক্ষিণে স্টেনগান হাতে একজন প্রহরী দাড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। তবে ভাগ্যটা এখনও এই টুকু ভাল যে, লোকটা এদিকে তাকিয়ে নেই। দক্ষিন মুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিন দিকে অল্প দূরে দাঁড়ানো একটা বিল্ডিং থেকে পিয়ানোর সুন্দর সুর ভেসে আসছে। প্রহরী ওদিকে চেয়ে সম্ভবত সে সুরেই শুনছে।
আহমদ মুসা মুহূর্ত কয়েক অপেক্ষা করে সিল্কের কর্ডের হুকটি জানালায় লাগিয়ে নিল এবং বিসমিল্লাহ বলে নিঃশব্দে কর্ডে ঝুলে পড়ল। এই ঝুঁকি নেয়া ছাড়া তাঁর সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না। অপেক্ষা করার উপায় নেই। সময় যত যাবে, বিপদ ততই বাড়বে।
স্টেনগান দাঁতে কামড়ে দ্রুত নামছে আহমদ মুসা। অর্ধেক পথ নেমেছে এমন সময় কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান হেড কোয়ার্টার এর ভেতর থেকে সাইরেন বেজে উঠল। আহমদ মুসার গোটা দেহে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। সে পালিয়েছে একথা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ঘণ্টা বাজিয়ে প্রহরীদের সতর্ক করা হচ্ছে।
আহমদ মুসা নিচে একবার তাকিয়ে কর্ড ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে পড়ল। একটু দখিনে দাঁড়ানো প্রহরী সাইরেন এর শব্দ শুনে সতর্ক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে তাকাচ্ছিল পূর্ব দিকে – বিল্ডিং এর যেদিকে গেট। আহমদ মুসার লাফিয়ে পড়ার শব্দ হল।
চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল প্রহরী। দেখতে পেল আহমদ মুসা, সেই সাথে ঝুলে থাকা কর্ডটি। শত্রুকে চিনতে তাঁর দেরী হল না। হাতের স্টেনগান টি তুলতে গেল সে।
আহমদ মুসা লাফিয়ে পড়েই স্টেনগান তুলতে গেল আহমদ মুসাকে গুলি করার জন্য, তখন আহমদ মুসাকে ট্রিগার টিপতেই হল। আহমদ মুসার স্টেনগান থেকে বেরিয়ে গেল এক পশলা গুলি।
প্রহরী যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, সেখানেই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা ছুটল ঝাউ গাছের ওপাশে গাড়ির কাছে। গাড়ি খোলাই রেখেছিল আহমদ মুসা, চাবিও রেখে গিয়েছিল কি হলে। চাবি কি হলে ঠিক সেভাবেই রয়ে গেছে। সে কিছুটা বিস্মিত হল। ওরা কি এদিকে কোন খোঁজ করেনি। কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের মত সংগঠনের জন্য এটা অস্বাভাবিক মনে হল তাঁর কাছে।
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি যখন বেরিয়ে আসছিল লন থেকে, তখন ঝাউ গাছের ওপাশে শোর-গোল শুনতে পেল। স্টেনগান বাগিয়ে কয়েকজন ছুটে এল ঝাউ গাছের এ পাশে। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটে এল অনেক দূরে।
ওদের জেদ দেখে হাশ্ল সে।
আহমদ মুসা এ গলি সে গলি ঘুরে অবশেষে ফারদিনান্দ এভেনিউতে উঠে এল।
রাতের রাস্তা, গাড়ি চলাচল অপেক্ষাকৃত কম। তীব্র গতিতে ছুটছে আহমদ মুসার গাড়ি। সারাদিন পর মনে পড়ল মারিয়ার কথা, ফিলিপের কথা। নিশ্চয় ওরা উদ্বেগ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফিলিপ নিশ্চয় তাঁর খোঁজে এদিকে এসেছে। সে তো বসে থাকার ছেলে নয়। মারিয়া যে তাকে একা আসতে না দেবার জেদ ধরেছিল, তাও মনে পড়ল আহমদ মুসার। মারিয়ার সে আশংকাই সত্য হল। নিশ্চয় মারিয়া অনেক কথা বলবে। কেন বলবে? কেন তাকে নিয়ে মারিয়ার এত আশংকা? একথা ভাবতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল তাঁর। ভুল পথে চলেছে মারিয়া। এ ভুল পথ থেকে মারিয়াকে ফেরাতে হবে। ভোরে মারিয়াকে ঐ ভাবে শক্ত কথা বলা যদিও খারাপ হয়েছে, মারিয়া এতে নিশ্চিত কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু মারিয়াকে শোধরাতে হলে এমন কঠোরতার প্রয়াজন আছে। আহমদ মুসার মন থেকে তৎক্ষণাৎ কে যেন বলে উঠল, মারিয়াকে এই কষ্ট দেয়া হবে, তাঁর অপরাধ কি? মারিয়ার যে বিষয়কে ভুল বলা হচ্ছে, তাঁর জন্য মারিয়া কতটুকু দায়ী ? আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ এর কোন জবাব দিতে পারলনা। মারিয়া ভুল পথে চলছে বলা যায়, কিন্তু তাকে তো অপরাধী বলা যায় না। মেইলিগুলিকে তো আমি অপরাধী বলিনি বরং তাকে তো আপন করে নিয়েছি। আর মারিয়া যে ভুল পথে চলছে, তাঁর জন্য ও মারিয়া তো প্রকৃত পক্ষে দায়ী নয়, সে পরিস্থিতির শিকার। আমার সাথে তাঁর দেখা, তাঁর পরিচয়, তাঁর আলাপ কোনটাই তাঁর সৃষ্ট নয়, আর আমিও এর জন্য দায়ী নই। আমিও ছিলাম অবস্থার শিকার, যে জ্ঞান ও দায়িত্ববোধ আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছেন তাঁর নির্দেশে আমি কাজ করছি। আমি জ্ঞানত কোন সীমা লঙ্ঘন করিনি। আবার কে যেন অন্তর থেকে বলে উঠল, মারিয়া কোন অন্যায় না করার পরও মারিয়ার প্রতি তুমি কঠোর হয়েছ এবং তাকে ভুল পথে চলার কথা বলছ তোমার স্বার্থ সামনে রেখেই। আসল কথা হল, মেইলিগুলিকে যা দিয়েছ, তাঁর অংশ তুমি কাওকে দিতে চাও না। এই কথায় আহমদ মুসা নিজেকে খুব দুর্বল অনুভব করল, তাঁর চিন্তা ঝাপসা হয়ে এল। বলল সে, আমি যা পারিনা তা না পারা কি অন্যায় ?
এই সময় আহমদ মুসার গাড়ি এসে মারিয়াদের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল। চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে গেল তাঁর।
হর্ন না বাজিয়ে গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা। গেট খোলার কৌশল সে জানে। বাইরে থেকে সুইচ টিপে গেট খোলা যায়, আবার সুইচ টিপে বন্ধ করা যায়।
একটি বিশেষ স্থান দিয়ে হাত দিয়ে সুইচ টিপল। খুলে গেল দরজা। গাড়ি নিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে।
দরজা খোলাই থাকল। মনে করল, পরে এসে বন্ধ করে দিয়ে যাবে।
আহমদ মুসার গাড়ী, গাড়ী বারান্দায় প্রবেশের আগেই ফিলিপকে ছুটে আসতে দেখল।
গাড়ী বারান্দায় প্রবেশ করল আহমদ মুসার গাড়ী।
গাড়ী দাঁড়াতেই পাশে পাশে ছুটে আসা ফিলিপ গাড়ীর দরজা খুলে ফেলল।
বলল, ‘মুসাভাই আপনি ভাল আছেন তো?’
আহমদ মুসা গাড়ী থেকে নামতে নামতে বলল, ‘ভাল আছি ফিলিপ। তোমাদের সব ভালতো?’
গাড়ী থেকে নেমেই আহমদ মুসা দেখতে পেল মারিয়াকে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার শান্ত দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ।
‘সব ভাল, তবে মারিয়া আজ সারাদিন এই দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।’ বলল ফিলিপ।
‘ভাইয়া তুমি সত্য বলছ না।’ প্রতিবাদ করল মারিয়া।
‘ঠিক আছে, খাবার জন্যে একবার ওপরে উঠে গিয়েছিলি, তারপর দরজা থেকে মাঝে মাঝে গিয়ে ড্রইংরুমে বসেছিস, হলো তো? সত্য কথাই বললাম।’
মারিয়া আর কিছু বলল না।
ফিলিপ আহমদ মুসার একটা হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে চলল। মারিয়া আগেই ঢুকে গিয়েছিল ড্রইং রুমে।
আহমদ মুসার বাম ভ্রুর ওপর রক্ত শুকিয়ে থাকা ক্ষতচিহ্ন এবং মুখে শুকিয়ে থাকা রক্ত প্রথম দেখতে পেল মারিয়া। দেখেই বলে উঠল, ‘ভাইয়া তুমি দেখ, উনি আহত।’ আর্তনাদের মত শোনাল মারিয়ার কন্ঠ।
শুনেই ফিলিপ মুখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ইস্ খুশিতে এদিকে খেয়ালই হয়নি। কপালটা সাংঘাতিক ফেটে গেছে। আসুন।’
বলে টেনে আহমদ মুসাকে ড্রইংরুমের শোফায় নিয়ে বসাল।
ক্ষতটা পরীক্ষা করে ফিলিপ বলল, মারিয়া তুই যা ফাষ্টএইড বক্স নিয়ে আয়, একটু পরে ডাক্তার ডাকব।
মারিয়া এক দৌঁড়ে ওপরে উঠে গেল।
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ফিরে এল মারিয়া, এক হাতে ফাষ্ট এইড বক্স, অন্য হাতে একটা পাত্র, তাতে পানি।
সিঁড়ি থেকে নেমে বাইরের দরজা বরাবর এসে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে ‘ভাইয়া’ বলে চিৎকার করে উঠল মারিয়া। মরিয়া দেখল গাড়ী বারান্দা থেকে শিকারী বিড়ালের মত পা টিপে টিপে দরজার দিকে উঠে আসছে একজন লোক। তার হাতে উদ্যত রিভলভার।
আহমদ মুসা সোফায় বসেছিল। পাশের সোফায় বসে ফিলিপ মারিয়ার অপেক্ষা করছিল, আর কথা বলছিল আহমদ মুসার সাথে।
মারিয়ার চিৎকারে দু’জনই চমকে উঠে মারিয়ার দিকে চোখ ফেরাল। তারপর তাদের চোখ গিয়ে পড়ল দরজার ওপর। দরজায় উদ্যত রিভলভার হাতে দাঁড়ানো একজন লোক। ফেল্টহ্যাটে কপালটা ঢাকা থাকলেও জুবি জুরিটাকে চিনতে আহমদ মুসার অসুবিধা হলোনা।
দরজায় রিভলভার হাতে লোক দেখেই ফিলিপ বিদ্যুত গতিতে তার রিভলভার বের করল।
ফিলিপের হাতে রিভলভার উঠতে দেখে জুবি জুরিটার রিভলভার ধরা হাতটি একটু নড়ে স্থির হলো আহমদ মুসার লক্ষ্যে।
কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে একটুও কষ্ট হলো না মারিয়ার। সে হাত থেকে ফাষ্টএইড বক্স ও পানির পাত্র ছেড়ে দিয়ে পাগলের মত ছুটে গিয়ে আহমদ মুসাকে আড়াল করে দাঁড়াল। আর ঠিক সে সময়েই জুবি জুরিটার রিভলভার অগ্নি উৎগিরণ করল। গুলি গিয়ে বিদ্ধ হলো মারিয়ার বুকে। মারিয়া বুক চেপে ধরে উল্টে পড়ে গেল ঠিক আহমদ মুসার পায়ের ওপর।
জুবি জুরিটার রিভলভার গর্জন করার সাথে সাথেই ফিলিপের রিভলভার গর্জন করে উঠল। ফিলিপের গুলি গিয়ে বিদ্ধ করল জুবি জুরিটার বুক। জুবি জুরিটাও উল্টে পড়ে গেল দরজার ওপর।
ফিলিপ গুলি করার পরই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মুসা ভাই আপনি মারিয়াকে দেখুন। আমি বাইরেটা একটু দেখি, আরও কেউ থাকতে পারে।’
ফিলিপ ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসা সোফা থেকে নেমে মারিয়ার মাথা তুলে নিল। মারিয়ার চোখ তখন বোজা।
‘মারিয়া, মারিয়া।’ আহমদ মুসা ডাকল।
মারিয়া চোখ খুলল। তার চোখে আতংক নেই, সেখানে একটা প্রশান্তি।
ধীরে ধীরে বলল, ‘আপনি ভাল আছেন, আপনার গুলি লাগেনিতো?’
‘তুমি এ কি করলে, আমাকে বাঁচাতে গিয়ে…?’
কথা শেষ করতে পারলনা আহমদ মুসা। তার বাক রুদ্ধ হয়ে গেল।
ওপর থেকে সুমানো ও অন্যান্যরা এবং বাইরে থেকে ফিলিপ এসে মারিয়ার পাশে বসল। আতংক, উদ্বেগ, আকষ্মিকতায় কথা বলতেও সবাই যেন ভুলে গেছে।
মারিয়া তখন আহমদ মুসাকে বলছিল, ‘এমন সুখের মৃত্যু, এমন তৃপ্তির মৃত্যু পৃথিবীতে কদাচিৎ দু’একজনের ভাগ্যে জোটে জনাব।’
মারিয়ার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। আহমদ মুসা দ্রুত ফিলিপকে বলল, ‘চল একে হাসপাতালে নিতে হবে।’
ফিলিপ উঠে দাঁড়াল।
মারিয়া আবার চোখ খুলল। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘ভাইয়া তুমি আমার পাশে বস। আমার সময় বেশী নেই।’
কেঁদে উঠল ফিলিপ।
কেঁদে উঠল সবাই, আহমদ মুসা ছাড়া।
বসল ফিলিপ মারিয়ার পাশে। বলল, ‘এ কি হলো বোন তোর?’
মারিয়া চোখ টেনে টেনে ফিলিপের দিকে তাকাল, বাম হাতটা তুলতে চেষ্টা করল, পারলনা। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘ভাইয়া তুমি সব সময় তোমার আদরের বোনের সুখ দেখতে চেয়েছ না? আজ আমার চেয়ে সুখি আর কেউ নেই। সমগ্র দুনিয়া তুমি দিলেও এত সুখ আমাকে দিতে পারতে না। তুমি হাস ভাইয়া, তোমার হাসি দেখে যেতে চাই।’
কান্নায় আবার ভেঙে পড়ল ফিলিপ।
মারিয়া তার মুখের কাছে বসা সুমানোর দিকে চোখ তুলে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, ‘দেখ সুমানো আমি আর কাঁদছিনা, হাসছি তাই তোমার প্রশ্নের জবাবের আর কোন প্রয়োজন নেই।’ আরও ক্ষীণ হয়ে উঠল মারিয়ার কন্ঠ।
তখনও আহমদ মুসার কোলে মারিয়ার মাথা।
মারিয়া চোখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। টেনে টেনে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘মুসলমান কি ভাবে হতে হয়?’
“এক আল্লাহকে স্বীকার করা এবং মুহাম্মদ (সঃ) কে শেষ রসূল হিসেবে মেনে নেয়া।’
‘আমি স্বীকার করছি আল্লাহ এক, মুহাম্মদ তার রসূল।’ ক্ষীণ কন্ঠে কাঁপা গলায় বলল মারিয়া।
এতক্ষণে আহমদ মুসার দু’চোখ থেকে নেমে এল দু’ফোটা অশ্রু। বলল, ‘আমি আল্লাহর কাছে সাক্ষ্য দিব মারিয়া শেষ বিচারের সেই দিনে, তুমি আল্লাহর সত্য দ্বীন গ্রহণ করেছ।’
আবার ঠোঁট নড়ে উঠল মারিয়ার। তার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘সেখানে আপনার সাথে দেখা হবে কি আমার?’
‘আশা করা যায়।’ কাঁপা গলায় বলল আহমদ মুসা।
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মারিয়ার। প্রশান্তিতে চোখ বুজল। আবার চোখ খুলল মারিয়া। আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল-
‘আমার পক্ষ থেকে মেইলিগুলি আপাকে একটা কথা বলবেন?’ আহমদ মুসার চোখে চোখ রেখে ক্ষীণ অনুনয় জানাল মারিয়া।
‘বল, কি কথা?’
‘বলবেন, আমি খুব ভালোবেসেছি তাঁকে, জগতের মধ্যে সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী নারী তিনি।’
আহমদ মুসার চোখের অশ্রু আবার সজীব হয়ে উঠল। বলল, ‘বলব।’
একটু থেমে, একটা ঢোক গিলে আহমদ মুসা বলল, ‘আমাকে তুমি মাফ করে দিও মারিয়া, আমি তোমার প্রতি কঠোর হয়েছিলাম।’
‘না কঠোরতা নয়, আপনি ঠিক করেছিলেন। এ না করলে অন্যায় দাবির কাছে পরাজিতের মত আপনি সাধারণ হয়ে যেতেন। তাহলে আজকের জগতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিকে ভালোবাসার বুক ভরা গৌরব নিয়ে আমি মরতে পারতাম না।’
মারিয়ার শেষ কথা গুলো টেনে টেনে বেরিয়ে এল, ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে গেল। সেই সাথে চোখ বুজে গেল তার। যেন গভীর এক প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল সে। যে ঘুম কোনদিন ভাঙবেনা।
আহমদ মুসা ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়ে মাথাটা অতি আস্তে নামিয়ে রাখল কার্পেটে।
ফিলিপ, সুমানো কেঁদে উঠে আছড়ে পড়ল মারিয়ার দেহের ওপর।
সুমানো চিৎকার করে বলল, আজ দুপুরে বলেছিলাম, জীবন থেকে তুই পালাতে পারবিনা। কিন্তু একদিনও তুই পার হতে দিলিনা। পালিয়ে গেলি এমন করে।
ফিলিপ শান্ত হলে আহমদ মুসা বলল, ‘ফিলিপ আমি যখন ওদের অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে আসি, কোন গাড়ী অবশ্যই আমাকে ফলো করেনি। তাহলে জুবি জুরিটা এখানে এল কি করে?’
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, চলো তো গাড়ীটা একটু পরীক্ষা করি, আমার মনে হচ্ছে ওরা গাড়ীতে কোন ফাঁদ পেতে রেখেছিল।’
আহমদ মুসা ও ফিলিপ গিয়ে আহমদ মুসার গাড়ীর ভেতর বাহির তন্ন তন্ন করে খুজে দেখল। পেল তারা। গাড়ীর নিচে চেসিসের সাথে টেপ দিয়ে বাঁধা একটি স্বয়ংক্রিয় অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার। সেটাই সংকেত দিয়ে ডেকে এনেছে জুবি জুরিটাকে।
অয়্যারলেসটাকে গাড়ী থেকে খুলে নিয়ে আহমদ মুসা ওটা বন্ধ করে দিল। বলল, গাড়ীটা যথাস্থানে থাকাটা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। কিন্তু তখন এ নিয়ে ভাবার খেয়ালও হয়নি, সুযোগও ছিলনা। আসলে জুবি জুরিটা আমাদের ঠিকানা চিহ্নিত করার জন্যেই গাড়ীতে অয়্যারলেস পেতে রেখেছিল। সে নিশ্চিত ছিল আমার খোঁজে কেউ না কেউ যাবে এবং গাড়িটা পেয়ে গেলে নিয়ে আসবে। এ থেকে আরও একটা জিনিস বুঝা যায়, শুধু আমাকে নয়, আমার সাথে আরও যারা আছে তাদেরকেও তারা খুঁজে পেতে চায়।’
‘কিন্তু জুবি জুরিটা একা এল কেন, আরও কেউ এখানে আসবে বলে মনে করেন?’ চিন্তিত কন্ঠে বলল ফিলিপ।
‘আমার মনে হয় জুবি জুরিটা প্রস্তুতি ছাড়াই তাড়াতাড়ি চলে এসেছে, খবর পেয়ে সম্ভবতঃ অফিস থেকে আসেনি। একারণেই তার সাথে কেউ আসতে পারেনি। আর তার এ মিশনের খবর অফিস অবশ্যই জানেনা। জানলে এতক্ষণ একটা দল এসে পড়ত। আর অয়্যারলেসের সংকেতের ব্যাপারটা মনে হয় জুবি জুরিটাই জানত শুধু। সুতরাং আর কেউ এখানে আসবে বলে মনে করিনা।’
একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘জুবি জুরিটার লাশটা সরিয়ে ফেলতে হবে। চল ওকে ওর হেডকোয়ার্টারের সামনেই রেখে আসি।’
‘ঠিক বলেছেন।’ বলে উঠল ফিলিপ।
জুবি জুরিটার লাশ রেখে যখন আহমদ মুসা ও ফিলিপ ফিরে এল, তখন রাত এগারটা। এসে দেখল, যিয়াদ বিন তারিক তার লোকজন সহ এসে গেছে। পরিকল্পনা ছিল রাত ১২টায় ভাসকুয়েজের হেডকোয়ার্টারে তারা যাবে, রাত তিনটায় তারা হানা দেবে। ফিলিপের লোকরা আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ১২টার পর ওখানে জমায়েত হবে। আহমদ মুসার মুক্তি ও জুবি জুরিটার নিহত হওয়া যিয়াদের যে আনন্দ দিতে পারতো, মারিয়ার মৃত্যু তা হতে দিল না। সবাই বিষন্ন।
সবাই গোল হয়ে বসেছিল ড্রইংরুমে।
ফিলিপ বলল, ‘মারিয়ার সৎকার কিভাবে হবে মুসা ভাই, সে তো মুসলমান হয়েছে।’
‘তুমি আপত্তি না করলে মুসলিম হিসেবে তার দাফন হওয়া উচিত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপত্তির প্রশ্নই ওঠেনা, মারিয়ার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।’
‘কিন্তু মারিয়ার কবর কিভাবে হবে। স্পেনে তো প্রকাশ্যে এটা হতে পারেনা, মাদ্রিদে তো নয়ই।’
‘কিছু ভাববেন না মুসা ভাই, মারিয়া আমার এবং আমার পরিবারের সবচেয়ে আদরের। ওর কবর লা গ্রীনজায় আমার বাড়ীতে হবে। ও যাতে সব সময় আমার চোখের সামনে থাকে।’
অশ্রু গড়িয়ে এল ফিলিপের চোখ থেকে।
ফিলিপ কথা শেষ করেনি, বলছিল, ‘জেরামা হ্রদের তীরে লা গ্রীনজা পার্বত্য নগরীকে মারিয়া অত্যন্ত ভালবাসত। সবচেয়ে ভালোবাসত লা-গ্রীনজার আমাদের বাড়ীটাকে। মারিয়া ওখানেই ঘুমিয়ে থাকবে।’
‘ধন্যবাদ ফিলিপ, কিন্তু খৃষ্টান বাড়ীতে মুসলিম কবর নিয়ে কেউ কথা তুলবেনা তো?’
হাসল ফিলিপ। হাসিটা কান্নার মত। বলল, ‘মারিয়া আমার আদরের বোন, চিন্তার সাথীও। কেউ আমরা কোন কথা গোপন করতাম না। আমার মনের কথাই মারিয়া আমার আগে বলে গেছে। আমার আর মারিয়ার পথ আলাদা নয়।’
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ফিলিপকে। বলল, ‘বলনি তো এতদিন ফিলিপ।’
‘মারিয়ার নিষেধ ছিল। ও বলেছিল একটা উপযুক্ত সময়ে দু’ভাই বোন মিলে আপনাকে ‘সারপ্রাইজ’ দেয়া হবে।’
‘সে কথা রেখেছে ফিলিপ।’ আহমদ মুসার কন্ঠ খুব ভারি শোনাল।
এই সময় ফিলিপের সহকারী আবদুর রহমান এবং বাস্ক গেরিলাদের অন্য কয়েকজন নেতা প্রবেশ করল ড্রইং রুমে।
ফিলিপ আহমদ মুসার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আবদুর রহমানকে প্রশ্ন করল, লা –গ্রীনজায় যাত্রার সব রেডি হয়েছে কি না।
আবদুর রহমান মাথা নেড়ে বলল, ‘সব রেডি।’
ফিলিপ আহমদ মুসার দিকে ফিরে বলল, ‘আপনি হুকুম দিন ভাইয়া, আমরা যাত্রা করি।’
‘চল’ বলল আহমদ মুসা।
সবাই উঠে দাঁড়াল।
২
মাদ্রিদের সেন্টপল গীর্জার দক্ষিণ পাশের বাগান। বাগানের একদম দক্ষিণ পাশে একটা গোলাপ ঝোপের আড়ালে একটা বেঞ্চিতে একা বসে আছে জেন। নির্জন এবং অন্ধকার জায়গাটা।
সূর্য ডুবে মাত্র অল্পক্ষণই হয়েছে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন অনেক রাত। চারদিকের গাছপালা এবং ঝোপঝাড়ই সেখানে বাড়তি অন্ধকার সৃষ্টি করেছে।
অন্ধকারে জেনকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। কাল স্কার্টের ওপর কাল কোট পরেছে জেন। অন্ধকারের মধ্যে গোটা দেহটাই তার হারিয়ে গেছে শুধু শ্বেত স্বর্ণাভ মুখটি ছাড়া। কিন্তু মুখটি তার বড় বিষন্ন। ঠোঁট তার শুকনো। চোখ থেকে রাজ্যের উদ্বেগ যেন ঠিকরে পড়ছে।
মাদ্রিদের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় গীর্জা সেন্ট পল। গীর্জার চারদিক ঘেরা বিশাল বাগান। বাগানটাকে পার্ক বলাই ভালো। বাগানের মধ্যে জালের মত বিছানো রাস্তা। মাঝে মাঝে বেঞ্চি। বাগানে বেড়ানো যায়,বিশ্রাম করা যায়। যারা গীর্জায় প্রার্থনার জন্যে আসেন, যারা গীর্জার সান্নিধ্যে সময় কাটাতে চান কিংবা যারা দেখতে আসেন গীর্জা, তাদের জন্যেই এই ব্যবস্থা। গীর্জার গেট বন্ধ হওয়া পর্যন্ত সবার জন্যে খোলা থাকে এই বাগান। গীর্জার বাগান, তাই বোধহয় লোকজন সব সময় কম থাকে, একমাত্র রোববার ছাড়া।
সন্ধ্যার পর বাগানে সেদিন লোকজন নেই বললেই চলে। বিশেষ করে গীর্জার পেছনের অংশ-দক্ষিণ অংশে কেউ নেই একমাত্র জেন ছাড়া।
জেন বেঞ্চি থেকে মাঝে মাঝে উঠে পায়চারি করছে। আর বেঞ্চির পাশ দিয়ে উত্তরে এগিয়ে যাওয়া পথের দিকে তাকাচ্ছে বার বার।
জেন অপেক্ষা করছে জোয়ানের।
ইতালির ট্রিয়েস্ত থেকে আসার পর জেন-জোয়ানের মধ্যে আর দেখা হয়নি। জোয়ানের দেখা করতে আসার তো প্রশ্নই ওঠে না, জেনও ভয়ে জোয়ানের ওদিকে পা তুলতে পারেনি। ইতালি থেকে আসার পর জেন ভয়, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়েছে। তার উদ্বেগ জোয়ানের নিরাপত্তা নিয়ে, দুশ্চিন্তা জোয়ানদের ভবিষ্যত নিয়ে।
হান্নার মাধ্যমে জোয়ানের এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছে জেন। জায়গাটা জেনেরই সিলেকশন।
পায়চারি থামিয়ে হঠাৎ রাস্তার ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াল জেন। গাছ ও ঝোপ-ঝাড়ের পাশ গলিয়ে একটা ছায়ামূর্তি এদিকে এগিয়ে আসছে। মুহূর্ত খানেক ওদিকে চেয়ে জেনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, জোয়ান আসছে।
জোয়ান এলো।
জেন দু’ধাপ সামনে এগিয়ে জোয়ানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘উঃ এলে! পথ চেয়ে অপেক্ষা করা যে কত কঠিন।’
জেনের সাথে হ্যান্ডশেক না করে জোয়ান বলল, ‘মাফ কর জেন, আমি এখন শুধু জোয়ান নই, মুসা আবদুল্লাহ। আমি মেয়েদের সাথে হ্যান্ডশেক করিনা এবং পারতপক্ষে মেয়েদের সাথে আগের মত মেলামেশাও করি না।’
‘মাফ কর জোয়ান, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’ বলল জেন।
‘এস বসি’ বলে জেন গিয়ে বেঞ্চিতে বসল।
জোয়ান গিয়ে বসল তার পাশে।
‘অনেকক্ষণ থেকে বুঝি অপেক্ষা করছ তুমি? কষ্ট পেয়েছ না?’
‘এমন কষ্টের সুযোগ যদি প্রতিদিন পেতাম!’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল জেন।
‘কেমন আছ?’ জোয়ান বলল।
‘কেমন আছি বলে তুমি মনে কর?’
জোয়ান তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ।
‘জেন?’ মুহূর্ত কয়েক পরে ডাকল জোয়ান।
‘বল’।
‘তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার সুযোগ আমার হয়নি’।
‘কিসের কৃতজ্ঞতা?’
‘তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছ।’
‘তুমি একথা বলতে পার? তুমি না মুসলমান? জীবন মৃত্যু কি এককভাবে স্রষ্টা-আল্লাহর হাতে নয়?’
‘ঠিক বলেছ জেন, কিন্তু নিজের জীবন বিপন্ন করে যে অবিশ্বাস্য কাজ তুমি করেছ………।’ কথা শেষ না করে থেমে গেল জোয়ান। তার কন্ঠ ভারি হয়ে উঠল।
‘বড় কিছু কি করেছি? তুমি হলে আমার জন্যে এটা করতে না?’
জবাব দিলনা জোয়ান। একটু নিরব থেকে বলল, ‘তোমাকে নিয়ে আমার খুব ভাবনা হয় জেন?’
‘কি ভাবনা?’
‘চরম বিপদগ্রস্ত এবং অনিশ্চিত একটা জীবনের সাথে তুমি নিজেকে জড়িয়েছ।’
‘হান্নাও একথা আমাকে বলে। কিন্তু আমার কি করার ছিল। তুমি ছিলে আমার চির প্রতিদ্বন্দ্বি। কিন্তু আমি কি জানতাম অজান্তে প্রতিদ্বন্দ্বির কাছে আমার সবকিছু হারিয়ে বসে আছি। যখন তোমার বিপদ এল, আমার অজানার অর্গল ভেঙে গেল। তারপর প্রবল স্রোতের এক ঘূর্ণি আমার জীবনকে মিশিয়ে দিল তোমার জীবনের সাথে।’ ভারী গলায় বলল জেন।
‘কিন্তু এর পরিণতি কি?’
‘পরিণতির চিন্তা আমি করিনা। ওটা আল্লাহর কাজ। আমি শুধু জানি, আমি কোন অন্যায় করিনি, কোন পাপ চিন্তাও কোনদিন আমার মধ্যে জাগেনি।’ আবেগ কম্পিত কন্ঠে বলল জেন।
জোয়ান কোন কথা বলল না।
জেন একটু থেকে আবার শুরু করল, ‘কেন তোমাকে ডেকেছি জান?’
‘জানি না’।
‘একটা অনুরোধ করার জন্যে’।
‘কি অনুরোধ?’
̒’আমার প্রথম অনুরোধ তুমি প্রকাশ্যে চলাফেরা করো না, দ্বিতীয় অনুরোধ, তুমি আপাতত মাদ্রিদ থেকে দূরে কোথাও সরে থাক।’
‘কেন?’
‘কেন বলছি তুমি জান। ট্রিয়েষ্টের হত্যাকান্ডের জন্যে, যাবতীয় তৎপরতার জন্য তোমাকে মধ্যমনি ভাবা হচ্ছে। সেই থেকে ওরা তোমার উপর ভীষন ক্ষেপে আছে। এই সেদিন কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান অফিসে আহমদ মুসার হানা এবং কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের অপারেশন কমান্ডার জুবিজুরিটার হত্যাকান্ডের জন্য তোমাকে কেন্দ্রবিন্দু ভাবা হচ্ছে। সব মিলিয়ে আহমদ মুসা যদিও তাদের এক নাম্বার টার্গেট, তবু তুমি এদেশীয় বলে তোমার উপর রাগ তাদের শতগুণ বেশী। যেমন করেই হোক তোমাকে ওরা ধরবে। অতএব তোমাকে সরে থাকতেই হবে।’
‘জেন তুমি বল, মুসা ভাই ও অন্যান্যদের মাঠে রেখে আমি জীবনের ভয়ে সরে থাকতে পারি?’
‘জানি আমি-তুমি একথা বলবে। কিন্তু আমার কথা হলো, তুমি একাজের লোক নও, তুমি বিজ্ঞানী, তুমি ভিন্ন জগতের মানুষ।’
‘জোয়ান বিজ্ঞানী কিন্তু মুসা আবদুল্লাহ বিজ্ঞানী নয়।’
‘তুমি তর্ক করবে জানি। কিন্তু আবার বলছি তোমাকে ছোটবেলা থেকে আমি জানি। তুমি মারামারি করা ও গোলাগুলি চালানোর লোক নও।
‘হতে পারিনা? জেন তুমি জাননা, একজন মুসলমানকে একই সাথে গৃহী, পুলিশ ও সৈনিকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। একজন মুসলমান যেমন সার্বক্ষণিক গৃহী, তেমনি সার্বক্ষণিক পুলিশ এবং সৈনিকও।’
‘জোয়ান সবাই কি এক ফ্রণ্টে কাজ করে, কাজের বিভাগ কি থাকে না?’
‘থাকতে পারে কিন্তু সে কার্য বিভাগের দায়িত্ব তো আমার নয়।’
‘যদি এ বিষয়টা আমি আহমদ মুসা ভাইকে বলি ?’
‘বলার আগে জেন তুমি কি আমার দিকটা চিন্তা করবেনা, শুধু মাত্র জীবন বাঁচানোর জন্যে সংগ্রামের ক্ষেত্র থেকে আমি চলে যেতে পারি? তুমি কি চলে যেতে পারতে?’
‘জেন কোন উত্তর দিল না। কিন্তু চোখ ফেটে কান্না এলো। একটু পরে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল, তোমার কি বিপদ তোমাকে বোঝাতে পারবোনা। ওদের কাছে তোমার ব্যাপারটা অন্যদের থেকে আলাদা।’
‘জানি জেন। তোমার কথা আমি বুঝেছি। তোমার কথার গুরুত্ব দিচ্ছিনা তাও না। কিন্তু ওঁদের রেখে যে আমি যেতে পারি না। তুমি জান আমার জাতির ওপর কতবড় বিপদ। ওরা সকল মুসলিম ঐতিহাসিক স্থান এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ও সম্পদ ধ্বংসের জন্য গোপনে মাটির তলায় তেজস্ক্রিয় স্থাপন করেছে। এর ফলে মুসলিম ঐতিহাসিক স্থান ও কেন্দ্রগুলো আপনাতেই ধ্বসে পড়ার এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার মুসলমানরাও ঐ তেজস্ক্রিয়ের প্রভাবে চিরতরে পঙ্গু,তারপর ধ্বংস হয়ে যাবে। এ তেজস্ক্রিয়ের কোন প্রতিষেধক নেই। একমাত্র উপায় ঐ তেজস্ক্রিয় গুলো তুলে ফেলা। কিন্তু তেজস্ক্রিয় গুলো ডিটেক্ট করা সম্ভব নয়। সুতরাং তেজস্ক্রিয় স্থাপনের যে প্ল্যান ও মানচিত্র কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের কাছে আছে তা উদ্বার করা গেলেই শুধু তেজস্ক্রিয় গুলো তুলে ফেলা যাবে। ট্রিয়েষ্ট থেকে ফিরে আহমেদ মুসা পাগলের মত খুঁজে ফিরছে সেই প্ল্যান ও মানচিত্র। সেদিন ভাসকুয়েজের অফিসে আহমদ মুসা হানা দিয়েছিল ঐ দু’টি দলিলের সন্ধানেই। তুমি জান সেই অভিযানে আহমদ মুসা ধরা পড়েছিল, আহত হয়েছিল এবং পরে মারিয়া জীবন দিয়েছে আহমদ মুসাকে রক্ষা করতে গিয়ে। যে গুলিটা আহমদ মুসার মাথা গুড়ো করত, সেই গুলি মারিয়ার বক্ষ বিদ্ধ করেছে। এই অবস্থায় বল জেন -তুমি চাইতে পার আমি কাপুরুষের মত মাঠ থেকে চলে যাই!’
জোয়ান কথা শেষ করার পরও জেন অনেকক্ষণ কথা বলল না। সব শুনে তার মুখ দিয়ে কথা সরছেনা। অনেকক্ষণ পর বলল, ‘আমাকে মাফ কর জোয়ান, এত কিছু আমি জানতাম না, এত বড় জঘন্য ও ভয়াবহ ষড়যন্ত্র তারা করছে। এ ষড়যন্ত্র মুসলমানের বিরুদ্বে নয়, স্পেনের স্বার্থের বিরুদ্ধেও।’
একটু থামল জেন, তারপর আবার শুরু করল, ‘তাহলে জোয়ান, আমার প্রথম অনুরোধের কথা বলছি, তুমি প্রকাশ্যে চলাফেরা করোনা। তুমি যদি ধরাই পড়ে যাও তাহলে কাজ করবে কি করে।’
‘গোপনেই তো এখন চলাফেরা করছি।’
‘আরেকটা অনুরোধ।’
‘কি?’
‘প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে না পারার কারণে তোমার যা করতে অসুবিধা হয়, সে দায়িত্ব তুমি আমাকে দেবে এবং আরও যা করা দরকার তা আমাকে নির্দশ দিবে।’
‘তুমি করবে?’ জোয়ানের চোখে মুখে আনন্দ।
‘কেন তোমার কাজ কি আমার কাজ নয়?’
‘যতখানি আমার কথা ভাব,তার একাংশ কি ভাব নিজের কথা?’
‘ভাবি বলেই তো এত সাবধানতা। কোথায় এসে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করি দেখনা। আমি ভাবেছিলাম কি জান, এই রাতে এই নির্জনে তুমি আসতেই চাইবে না।’
‘চাইতাম না তুমি ছাড়া অন্য কেউ হলে।’
‘ধন্যবাদ।’
‘উঠতে বলছো?’
‘কেন উঠতে মন চাইছে না?’
‘তোমার চাইছে?’
‘আবার দেখা হবে?’
‘সেটা তোমার হাতে। আন্ডারগ্রাউন্ডে ঠেলে দিচ্ছ তো আমাকে।’
‘ঠিক আছে আমার হাতেই থাকল। কিন্তু কথা রইল তুমি প্রকাশ্যে কোথাও বেরুবে না।’
‘আহমদ মুসা ভাইয়ের জন্য কিছু বলবে না? জান ট্রিয়েষ্টে আমার রুমের দরজায় তুমি দু’জন সন্ত্রাসীকে হত্যা করে আমাকে বাঁচালে, তখন মুসা ভাই বলেছিলেন, এ কাজ একমাত্র জেনই করতে পারে।’
‘কি করে উনি বললেন?’ জেনের চোখ ভরা বিস্ময়।
‘আমি জানি না, মনে হয় তার তৃতীয় একটা চোখ আছে, সেটা দিয়ে তিনি অদৃশ্য সবকিছু দেখতে পান।’
‘জোয়ান, আমরা তাঁকে যত বড় বলে মনে করি, তার চেয়েও তিনি বড়।’
‘সেই সাথে সকলের মত স্পর্শকাতর একটা মন তাঁর আছে।’
‘কেন একথা বলছ?’
‘মারিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর মনটা খুব ভারি দেখছি।’
‘স্বাভাবিক, মারিয়া তাঁর জন্যে জীবন দিয়েছে।’
‘আরও কথা আছে।’
‘কি কথা?’
‘না, থাক জেন, অহেতুক আলোচনা এখন এটা।’
‘মারিয়ার কথা বলতে চেয়েছিলে তো। আমি জানি মারিয়া একটা ভুল করেছিল। এই ভুল আহমদ মুসাকে কষ্ট দিয়েছে।’
‘তুমি জানলে কি করে?’
‘লা-গ্রীনজায় আমাদের পার্বত্য নিবাসটা ওদের পাশের টিলায়। ছোটবেলা থেকে ওর সাথে আমার পরিচয়। মাদ্রিদে এলে ও আমার সাথে দেখা করেই।’
‘তাহলে তো সব জানই। কিন্তু বলত মারিয়ার ভুল কি স্বাভাবিক ছিল না?’
‘ওদের পরিস্থিতি-প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল, সেখানে অস্বাভাবিকটাও স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবে তোমাদের ইসলামী মূল্যবোধে এতবড় ভুলের কোন সুযোগ নেই, সেখানে আবেগের সাথে অবগতিও একটা শর্ত।’
‘এ শর্ত কি তুমি আমার ক্ষেত্রে মেনেছিলে?’
‘পুরোপুরি জানতাম তোমাকে আমি।’
‘আমি মরিস্ক তা তো জানতে না।’
‘তুমিও জানতে না।’
‘যখন জানলে…?’
‘তখন আর করার কিছু ছিল না।’
‘কতকটা তোমার ভুলের মতই ছিল মারিয়ার ভুল।’
‘রাত অনেক হয়েছে। তোমার সাথে তর্ক করার এখন আর নেই। তবে সমগ্র অন্তর দিয়ে আমি কামনা করি, মারিয়ার মত অমন পরম মৃত্যুর সুযোগ যদি আমারও হতো।’ কন্ঠ ভারি শোনাল জেনের।
‘যাও বাজে বকো না। চল উঠি।’
‘বলে জোয়ান উঠে দাঁড়াল। তার সাথে জেনও।