তাহাজ্জত নামায শেষ করে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। তারপর পোশাক পরে রাতের অভিযানের জন্যে প্রস্তুত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
রাতেই আহমদ মুসা তার এ অভিযানের কথা ফিলিপকে বলেছিল। ফিলিপও আহমদ মুসাকে একা যেতে দিতে রাজি হয়নি। আহমদ মুসা তাকে বুঝিয়ে বলেছিল, সে যাচ্ছে একটা অনুসন্ধান মিশনে- তেজস্ত্রিয় পাতায় পরিকল্পনা- ম্যাপের সন্ধানে। এমন গোপন মিশন এক ব্যক্তির জন্যেই মানায় ভাল।’ ফিলিপ আর আপত্তি করতে পারেনি। আহমদ মুসার বিবেচনাকে সে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে।
ঘর থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসা চলে এল দু’তালায় নামার সিঁড়ির মুখে।
বাড়িটা তিনতলা। তিনতলায় থাকে ফিলিপের পরিবার। দু’তলা জুড়ে লাইব্রেরী, স্টাডিরুম, স্টোর রুম, গেস্ট রুম ইত্যাদি। নিচের তলাটা রান্না, খাবার ও কর্মী ও কর্মচারীদের বাসের জন্যে। আর বড় ড্রইং রুমটা নিচের তলাতেই- একেবারে বাড়িতে ঢোকার মুখেই।
সিঁড়ি দিয়ে নামার জন্যে পা তুলতে গিয়ে হঠাৎ বাম দিকে তিন তলায় উঠার সিঁড়ির শেষ ধাপে একটি নারীমুর্তির উপর নজর পড়ল আহমদ মুসার। আবছা আলো-অন্ধকারেও বুঝতে পারল ও মারিয়া। আহমদ মুসার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্থিরভাবে।
আহমদ মুসা চমকে উঠার চাইতে বিরক্তি বোধ করল বেশী। এই রাতে, এইখানে, এইভাবে সে মারিয়াকে আসা করেনি। নামার জন্যে এগিয়ে দেয়া পাটা টেনে এনে দৃষ্টি নিচু করে বলল আহমদ মুসা, ‘এত রাতে এখানে? কিছু বলবে মারিয়া?’ গলার স্বরটা কঠোর শোনাল আহমদ মুসার।
মারিয়ার কাছ থেকে কোন উত্তর এল না। মাথার রুমালের একটা অংশ মুখ দিয়ে কাপড় ধরে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেল তিন তলার দিকে।
আহমদ মুসা মুহূর্ত কয়েক দাঁড়িয়ে পা বাড়াল সিঁড়ির দিকে দোতলা থেকে নামার জন্যে। বিরক্তির চিহ্ন তার মুখ থেকে তখনও যায়নি। মারিয়ার কাছ থেকে এই আচরণ সে মেনে নিতে পারছে না।
নিচের তলার ড্রইং রুমের দরজায় এসে আহমদ মুসা দেখল ফিলিপ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি বারান্দায় তাকিয়ে দেখল গাড়ি রেডি।
বিস্মিত আহমদ মুসা ফিলিপের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এমন তো কথা ছিল না ফিলিপ, তুমি এভাবে উঠে বসে আছ! আমি তো দারোয়ানকে বলে রেখেছিলাম। কোনই অসুবিধা আমার হতো না।’
ফিলিপ বলল, ‘আমাকে দোষ দেবেন না মুসা ভাই। মারিয়া আমাকে ঘুমাতে দেয়নি। রাত ৩টার সময় ডেকে তুলেছে। বলেছে, ‘আপনি আমাদের মেহমান, তার উপর যাচ্ছেন ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ন্যানের ঘাটিতে। কিছুতেই আপনাকে একা ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। তার কথা, আমি যেন আপনাকে আবার অনুরোধ করি আমাকে সাথে নেয়ার জন্যে।’
আহমদ মুসার মনটা নরম হলো। একধাপ এগিয়ে ফিলিপকে দু’হাত দিয়ে কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘এ অভিযানের জন্যে যদি এমন প্রয়োজন থাকতো, তাহলে আমি অবশ্যই বলতাম ফিলিপ। যদি পারি আজ শুধু ভাসকুয়েজের ঘরটা অনুসন্ধান করব, আর কিছু নয়। যখন প্রয়োজন হবে, তখন দেখবে ডেকে নিয়ে যাব।’
বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল গাড়ি বারান্দায়।
গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে ফুয়েল মিটারের দিকে তাকিয়ে দেখল, ফুয়েল ট্যাঙ্ক ভর্তি।
আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়ে পেছনে দাঁড়ানো ফিলিপের সাথে হ্যান্ডশেক করে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে গাড়িতে উঠে বসল। দরজা বন্ধ করে গাড়িতে স্টার্ট দিল।
গাড়ি একটা গর্জন করে জেগে উঠে চলতে শুরু করল।
দারোয়ান আগেই গেট খুলে দিয়েছিল।
গেট দিয়ে বেরিয়ে এল আহমদ মুসার গাড়ি।
নিস্তব্ধ রাতের নিরব রাজপথ ধরে ছুটে চলল আহমদ মুসার গাড়ি তীর বেগে। লক্ষ ক্লূ-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের হেড কোয়ার্টার।
১৪. গোয়াদেলকুইভারে নতুন স্রোত
রাত তিনটা পঁয়তাল্লিশ। ঘুমিয়ে আছে মাদ্রিদের ফার্ডিন্যান্ড এভেনিউ। পুলিশের অথবা নাইট ক্লাব ফেরত দু’একটা গাড়ী মাঝে মাঝে এই ঘুমে কিছুটা বিরক্তি উৎপাদন করছে মাত্র।
ফার্ডিন্যান্ড এভেনিউ-এর ওপর দাঁড়ানো কু-ক্ল্যাস্ক-ক্ল্যানের বিশাল পাঁচ তলা অফিসটিও জেগে জেগে অবশেষে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। দু’একটি ঘরের জানালা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু বড় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে ওগুলোকে। যেন ওগুলোর চোখেও ঘুমের ঝিমুনি।
কু-ক্ল্যাস্ক-ক্ল্যান হেড কোয়ার্টারটি ফার্ডিন্যান্ড এভেনিউ-এর পশ্চিম পাশে। এভেনিউটি উত্তর-দক্ষিণ প্রসারিত। আর কু-ক্ল্যাস্ক-ক্ল্যানের হেড কোয়ার্টারটি প্রসারিত পূর্ব -পশ্চিমে। পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত হেড কোয়ার্টারের গেটটি ফার্ডিন্যান্ড এভেনিউ-এর গা ছুঁয়ে দাঁড়ানো। লোহার ফোল্ডিং গেট। গেটের ভেতরে লিফট রুম ও সিঁড়ির মাঝখানে দু’জন প্রহরী চেয়ারে বসে তাদের কাঁধে স্টেনগান ঝুলছে। প্রহরী দু’জনও ঝিমুচ্ছে।
বিল্ডিং-এর বাইরে আর কোন প্রহরী নেই। ভেতরে প্রত্যেক ফ্লোরে একজন করে সশস্ত্র প্রহরী রয়েছে।
সব মিলিয়ে নিরাপত্তার মিনিমাম ব্যবস্থা। এর কারণ, যে বাঘ সব সময় শিকার ধরতেই অভ্যস্ত, সে কাউকে শিকার হওয়ার ভয় করে না। কু- ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান সবার ঘরে ঢুকে, সবাইকে তাড়া করে, তার ঘরে আবার ঢুকবে কে। এমন সাহস কারও আছে বলে তারা মনে করে না।
পূর্ব পশ্চিম লম্বা অফিস বিল্ডিং এর তৃতীয় তলার একদম পশ্চিমের রুমটি ভাসকুয়েজের। এই তলাতেই মিনাত্রা সেন্ডোর স্থলাভিসিক্ত কু-ক্লাস্ক-ক্ল্যানের নতুন অপারেশন কমান্ডার জুরি জুরিটার অফিস। তবে তার একটি বিশ্রাম কক্ষ চারতলায়। কাজের অবসরে সে এখানে বিশ্রাম নেয়, রাত বেশী হলে সেখানে মাঝে মাঝে রাত যপিনও করে। আজও যেমন সে বাড়ি যায়নি-তার বিশ্রাম কক্ষেই সে রাত কাটাচ্ছে। রাত আড়াইটায় সে ফিরে এসেছে পাহারার তদারকি থেকে।
রাত ঠিক তিনটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে আহমদ মুসার গাড়ী সাপের মত নিঃশব্দে এসে থামল কু-ক্ল্যাস্ক-ক্ল্যান বিল্ডিং-এর পশ্চিম দিকে একটা ঝাউ গাছের পাশে।
কু-ক্লাস্ক-ক্ল্যান হেড কোয়ার্টারের পশ্চিম পাশে আরেকটা অফিস। সেটাও পাঁচ তলা। দুই বিল্ডিং-এর মাঝখানে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। সম্ভবতঃ পার্কিং প্লেস হিসেবে ব্যবহার হয়। পাশাপাশি দু’টি ঝাউগাছ থাকায় জায়গাটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী অন্ধকার।
আহমদ মুসা একটা ঝাউ গাছ ঘেঁষে তার গাড়ীটি দাঁড় করিয়ে নিঃশব্দে গাড়ী থেকে নেমে এল।
তারপর আশ-পাশটা ঘুরে দেখল কোন প্রহরী কোথাও নেই।
আহমদ মুসা ওপর দিকে তাকিয়ে ভাসকুয়েজের অফিস রুমটা একবার দেখে নিল। ভেতর থেকে আলোর কোন রেশ কোন দিক থেকে আসছে না।
পিঠের ব্যাগ থেকে আহমদ মুসা হুক লাগানো নাইলন কর্ড বের করে নিল।
হুকটা ছুড়ে মারল তিন তলার কার্নিশে। নিখুঁত নিশানা। হুকটা গিয়ে আটকে গেল তিন তলার কার্নিশে।
আহমদ মুসা চারদিকে একবার চেয়ে নিয়ে দড়ি বেয়ে তর তর করে উঠে তিন তলার কার্নিশে গিয়ে বসল।
উত্তর দক্ষিণে বিলম্বিত বিশাল কক্ষ ভাসকুয়েজের। পশ্চিম দিকে তিনটি জানালা। আহমদ মুসা মাঝখানে জানালার মুখোমুখি উঠে বসেছে।
জানালা পুরু লোহার গরাদে ঢাকা।
‘জানালা কি ভেতর থেকে লক করা?’ ভাবল আহমদ মুসা।
জানালার গরাদে হাত দিতে গিয়েও হাত টেনে নিল আহমদ মুসা। ভাবল, ভাসকুয়েজ জানালাকে বিদ্যুতায়িত করে রাখতে পারে।
পকেট থেকে ডিক্টেটর স্ক্রুড্রাইভার বের করে পরীক্ষা করল গরাদ। না, জানালা বিদ্যুতায়িত নয়।
গরাদ ভেতর থেকে লক করা আছে কি না তা দেখার জন্যে আহমদ মুসা স্ক্রুড্রাইভারের ধারাল অগ্রভাগ গরাদের নিচে ঢুকিয়ে ওপরের দিকে একটা চাপ দিল।
গরাদটি নিঃশব্দে নড়ে উঠে সিকি ইঞ্চি পরিমাণ ওপরে উঠে গেল। মুখে হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার। ভীষণ আত্মবিশ্বাসী ভাসকুয়েজ। তার কক্ষের নিরাপত্তার সাধারণ ব্যবস্থাটুকুও রাখেনি।
গরাদের দু’প্রান্তে দু’হাত লাগিয়ে এক টানে ওপরে উঠিয়ে ফেলল গরাদটি।
লোহার গরাদের পর জানালার কাঁচের আরো একটি গরাদ। একই ভাবে সেটিও তুলে ফেলল আহমদ মুসা।
ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আহমদ মুসা স্মরণ করল, মাঝের এই জানালাটি পুব দিক থেকে অর্থাৎ ভেতর থেকে ঘরে ঢুকার একমাত্র দরজা বরাবর এবং জানালার সামনে ভেতরটা ফাঁকা।
আহমদ মুসা জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সন্তর্পনে পা রাখল কার্পেটের ওপর।
কার্পেটের ওপর কয়েক মুহূর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরের অন্ধকারকে গা সহা করে নিল।
আহমদ মুসার লক্ষ্য ছিল ভাসকুয়েজের টেবিল। ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্যে এক খন্ড জমাট অন্ধকারের মত ভেসে উঠল ভাসকুয়েজের টেবিলটা। ভাসকুয়েজের টেবিলের ওপাশে কম্পিউটারের সাদা পর্দা অন্ধকারের বুকে ধোয়াটে সাদা চোখের মত মনে হলো তার কাছে।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে এগুলো কম্পিউটারের দিকে।
অতি সন্তর্পনে টেবিল ঘুরে আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়াল কম্পিউটারের সামনে।
এই কম্পিউটারের জন্যেই ভাসকুয়েজের অফিসে এসেছে আহমদ মুসা। তার বিশ্বাস, মাদ্রিদের মসজিদ কমপ্লেক্স এবং অন্যান্য মুসলিম ঐতিহাসিক স্থান গুলোতে তেজস্ক্রিয় পাতার পরিকল্পণা ভাসকুয়েজ নিশ্চয় তার রেকর্ডে রেখেছে। সে রেকর্ড ভাসকুয়েজ যেখানে যেখানে রাখতে পারে, তার মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় স্থান হলো তার কম্পিউটার মেমোরী। আহমদ মুসা তাই ভাসকুয়েজের কম্পিউটারে মেমোরী সন্ধান করে দেখার জন্যেই তার অফিসে ছুটে এসেছে।
কম্পিউটারের সামনে চেয়ারে বসে পড়ল আহমদ মুসা। অন্ধকার, কিছুই ঠাহর করতে পারল না।
আহমদ মুসার পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বের করে প্রথমে দেখে নিল বিদ্যুত কানেকশন ঠিক আছে কি না। তার পর দেখল কম্পিউটার স্টার্ট নেয় কি না। বোতাম টিপে দেখল ঠিক আছে। খুশী হলো আহমদ মুসা।
কিন্তু পরক্ষণেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সর্বশেষ মডেলের কম্পিউটারে গোপন লক সিস্টেম আছে, যা দিয়ে কম্পুটারের মেমোরী ফাইল লক করে রাখা যায়। কোড না জানলে তা আনলক করা যায় না। যিনি লক করেন তিনি যে কোডে লক করেছেন, সেই কোডেই শুধু আনলক করা যাবে।
আহমদ মুসা দুরুদুরু বুকে বাম হাতে টর্চ ধরে, ডান হাতে মেমোরী উইনডো স্থাপন করার জন্যে নির্দিষ্ট বোতামটিতে চাপ দিল।
মিষ্টি একটা টক্ শব্দ উঠলো সুইচের। কম্পিউটারের পর্দায় স্থির ছিল আহমদ মুসার দৃষ্টি। আনন্দে নেচে উঠল আহমদ মুসার চোখ। দেখল, সুইচ টেপার সাথে সাথেই কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠল মেমোরী উইনডো। প্রশ্ন ভেসে উঠল, জানতে চাইল পরবর্তী নির্দেশ কি?
আহমদ মুসা হাপ ছেড়ে বাঁচল, মেমোরি লক করা নেই। ভাসকুয়েজ লক করার প্রয়োজন মনে করেনি। তাঁর প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস যে, কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের গুহায় হানা দেয়া তো দূরে থাক-এ চিন্তাও স্পেনে কেউ করতে পারে না। মনে মনে আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল, ভাসকুয়েজের এই আত্মবিশ্বাস তাকে সাহায্য করেছে।
আহমদ মুসা চিন্তা করতে লাগল কম্পিউটারকে পরবর্তী নির্দেশ তিনি কি দেবেন? মেমোরির ফাইল ডাইরেক্টরী সে চাইতে পারে, ভাবল আহমদ মুসা। ফাইল ডাইরেক্টরীতে নিশ্চয় কোন ফোল্ডার থাকবে যেখানে রেকর্ড করা আছে স্পেনে মুসলমানদের ঐতিহাসিক স্থান সমূহ ধ্বংসের সেই ঐতিহাসিক পরিকল্পনা।
আহমদ মুসা বোতাম টিপে কম্পিউটারকে মেমোরি ফাইল ডাইরেক্টরী জ্ঞাপন করতে নির্দেশ দিল।
সংগে সংগে কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠল একটা স্বতন্ত্র উইনডো। উইনডোর বুকে ভেসে উঠল বোড়া বর্ণমালার দীর্ঘ তালিকা। ওদিকে তাকিয়ে হতাশ হলো আহমদ মুসা। ফাইল বা ফোল্ডার গুলোর নাম সাংকেতিক ভাবে লেখা। দু’টি করে বর্ণ দু’টি শব্দের প্রতিনিধিত্ব করে না একটি শব্দের, তাও বোঝা মুশকিল। তালিকার শীর্ষের ফাইলটির নাম PL বর্ণে লেখা। তার পরেরটি ON এই ভাবে দশটি ফাইলের তালিকা ফাইল ডাইরেক্টরীতে রয়েছে। কোড ভাঙার জন্যে আহমদ মুসা প্রত্যেকটি ফাইলের সাংকেতিক বর্ণমালা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করল। শেষ দু’টি নামে এসে আহমদ মুসার চোখ আটকে গেল। একটির সাংকেতিক নাম EP আহমদ মুসা এর অর্থ করল Enemy Personal. আর সর্বশেষটির নাম OF সে এর অর্থ বের করল Operation Final. যেহেতু কু-ক্লাস্ক-ক্ল্যান স্পেনে কোন মুসলিম ব্যক্তিত্বকে টার্গেট করেনি, টার্গেট করেছে মুসলমানদের ঐতিহাসিক সম্পদকে এবং এটা স্পেন থেকে মুসলমানদের চিহ্ন মুছে ফেলারই চক্রান্ত। তাই যথাযথভাবেই এটা Operation Final হতে পারে।
খুশি হল আহমদ মুসা। সেই সাথে আশাবাদের একটা প্রচন্ড শিহরণ খেলে গেল তার দেহে। অবশেষে সে দুর্লভ পরিকল্পনাটি পেতে যাচ্ছে। নিশ্চয় পরিকল্পনার সাথে ডায়াগ্রামও থাকবে।
আনন্দ কম্পিত হাতে বোতাম টিপে OF ফাইলটি নিয়ে এল আহমদ মুসা।
ফাইলটি ভেসে উঠল কম্পুটারের স্ক্রীনে।
স্ক্রীনের ওপর চোখ পড়তেই ম্লান হয়ে গেল আহমদ মুসার মুখ।
স্ক্রীনে ভেসে ওঠা উইনডোতে একটি মাত্র বাক্য লিখা, ‘সাইট গুলোতে রেডিয়েশন বক্স সাফল্যজনক ভাবে স্থাপিত, ডকুমেন্ট ‘ELDER’ -এর কাছে নিরাপদ।’
আহমদ মুসার হতাশ চোখ দু’টি কম্পিউটারের স্ক্রীনে যেন আঠার মত লেগে আছে কিংবা চোখ সরাতে ভুলে গেছে যেন।
হঠাৎ করে ঘিরে ধরা হতাশার আঘাত হজম করছে আহমদ মুসা।
ঠিক এই সময়ই দরজার নব ঘুরাবার মত ‘ক্লিক’ করে একটা শব্দ হলো। শব্দটা এল তার পেছন থেকে-দরজার দিক থেকে।
এক ঝটকায় মুখ ফিরিয়ে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। ঠিক সেই সময় ঘরের আলো জ্বলে উঠল, উজ্জ্বল আলোতে ভরে গেল ঘর।
আহমদ মুসা দেখল, স্টেনগান হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে একজন লোক। ছুরির ফলার মত তীক্ষ্ণ তার দৃষ্টি, স্থির চোখে তাকিয়ে আছে সে আহমদ মুসার দিকে। মুখে তার বিজয়ের হাসি। তার স্টেনগানের নল আহমদ মুসার বুক লক্ষ্যে হা করে আছে।
খোলা দরজা পথে আরও চারজন ঘরে প্রবেশ করল। তাদের হাতেও উদ্যত স্টেনগান।
ঘর ফাটানো শব্দে হো হো করে হেসে উঠল দরজায় দাঁড়ানো সেই লোকটি। বলল, আমাদের খুব ভুগিয়েছ আহমদ মুসা। আমাদের জাল গলিয়ে তুমি কেমন করে মাদ্রিদে ঢুকলে?
থামল লোকটি। উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার শুরু করল, ভালই হলো, শিকার নিজ পায়ে হেটে এসে ফাঁদে পড়েছে।
বলেই লোকটি পাশেই দাঁড়ানো চার জনের একজনকে বলল, ‘জন ওর পিঠ থেকে ব্যাগ নিয়ে ওকে একটু হালকা কর। আর পকেট আর শোল্ডার হোল্ডারও খালি কর।’
জন লোকটি গিয়ে আহমদ মুসার পিঠ থেকে ব্যাগটি নামিয়ে নিল। রিভলবার, রুমাল, চাবির রিং, এমনকি কলম হাতিয়ে নিয়ে আহমদ মুসার পকেট ও শূন্য করল।
জন ফিরে এলো ওসব নিয়ে।
সেই হেড়ে গলায় আবার হেসে উঠল লোকটি। বলল, ‘আমি শুনেছিলাম তুমি খুব চালাক, কিন্তু তুমি এই বোকামিটা কি করে করলে যে, মিষ্টার ভাসকুয়েজের ঘর মানে, কু-ক্লাস্ক-ক্ল্যানের হেড কোয়ার্টরের কেন্দ্র বিন্দুটা এতই অরক্ষিত। তুমি বুঝতে পারোনি, এই ঘরে তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ, এমনকি তোমার চোখের পলক পড়া পর্যন্ত নিখুঁত রিপোর্ট হয়েছে ইনফ্লারেড টেলিভিশন ক্যামেরার মাধ্যমে। আমাদের কনট্রোল রুমের সিকুরিটি এটেনডেন্ট মাঝখানে সামান্য ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে একটু দেরি হয়ে গেছে আমাদের।’
আহমদ মুসা অবাক হলোনা। সেও আগেই একথা বুঝতে পেরেছিল, কোন সংকেত পেয়েই ওরা এসেছে। লোকটির কথা শেষ হবার সাথে সাথে আহমদ মুসার দৃষ্টি চারদিক একবার ঘুরে এল।
ক্যামেরা খুঁজছো বুঝি? লোকটির মুখে বিদ্রুপের হাসি।
‘ঠিকই বলেছেন।’ বোকা বোকা কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
হেসে উঠল লোকটি। বলল, ‘উপরে দেখ ছাদের মাঝখানে একটা তিলক চিহ্ন। ওটা ক্রংক্রিটের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা শক্তিশালী একটা ইনফ্রারেড ক্যামেরার চোখ।’
‘আমার বুদ্ধির কি দোষ বলুন, অন্ধকার ঘরে তো ওটা দেখতে পাওয়ার কথা নয়।’ ঠোটে হাসি টেনে বলল, আহমদ মুসা।
‘কিন্তু বুঝতে পারার তো কথা। কু-ক্লাস্ক-ক্ল্যানের হেড কোয়ার্টারের এত অরক্ষিত থাকার কথা নয়।’
‘ঠিক আছে, আমারতো হার হয়েছে।’
‘এবার নিয়ে তিনবার তুমি আমাদের হাতে এলে। দু’বার জাল কেটে পালিয়েছো, আর সে সুযোগ তুমি পাবেনা।’
‘সুযোগ সব সময় আসেনা এটাই তো স্বাভাবিক।’
‘এমন ভাবে কথা বলছো, মনে হচ্ছে যেন তুমি শ্বশুর বাড়ী এসেছো। জান তোমার অপরাধ কত, কি শাস্তি অপেক্ষা করছে জন্য?’
‘অপরাধের কথা জানি, কিন্তু শাস্তির কথা জানিনা।’
‘কি শাস্তি হওয়া প্রয়োজন বলে তুমি মনে কর?’
‘আপনাদের যে শাস্তি হওয়া উচিত, তার থেকে অনেক কম।’
চোখ দু’টি জলে উঠল লোকটির। বলল, ‘খুব বেশী সাহস দেখাচ্ছ তুমি। জান আমি কে?’
‘না জানিনা।’ ঠোটে হাসি টেনে বলল, আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ঠোটে হাসি দেখে লোকটির মুখ ক্রোধে আরও বিকৃত হয়ে গেল। সে দু’ধাপ এগিয়ে এল এবং ভাসকুয়েজের টেবিল থেকে পেপার ওয়েট তুলে ছুড়ে মারলো আহমদ মুসাকে লক্ষ করে।
ক্রিকেট বলের মত ছুটে আসা পেপার ওয়েট আহমদ মুসার বুকে আঘাত করত, কিন্তু আহমদ মুসা চকিতে এক পাশে সরে দাড়ানোর কারনে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে পেপার ওয়েট টি আঘাত করলো কম্পিউটারের স্ক্রীনে। কম্পিউটারের স্ক্রীন ফেটে গেল, তার একটা অংশ ফুটো হয়ে গেল।
মুহূর্তের জন্য অপ্রস্তুত ভাব দেখা দিল লোকটির চেহারায়। পরক্ষনেই হুংকার দিয়ে উঠল। ক্রোধে কাঁপছে সে। ষ্টেনগানধারী চারজনের দিকে চেয়ে নির্দেশ দিল, একে নিয়ে চল।
ষ্টেনগানধারী চারজনের দু’জন এসে আহমদ মুসার দু’হাত দু’দিক থেকে চেপে ধরে টেনে নিয়ে চলল দরজার দিকে। অন্য দু’জন ষ্টেনগানধারী আহমদ মুসার পেছনে। তাদের ষ্টেনগানের নল আহমদ মুসার পিঠ লক্ষ্যে উদ্যত। সবার পেছনে লোকটি।
ভাসকুয়েজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে লম্বা-লম্বি করিডোর দিয়ে এগুলো তারা।
করিডোরের মাঝখানে এসে তারা লিফটে প্রবেশ করলো।
নামতে শুরু করল লিফট।
থামল এক জায়গায় এসে। আহমদ মুসা অনুভব করল তারা ইতিমধ্যেই চারতলা পরিমান স্পেস পেরিয়ে এসেছে। অর্থাৎ তাকে ভূগর্ভস্থ কোন কক্ষে আনা হল।
লিফটের দরজা খুলে গেল।
আহমদ মুসাকে নামতে সুযোগ না দিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ছুড়ে দিল কক্ষের মধ্যে। ধাক্কা দিয়েছিল স্টেনগানধারীরা নয়, সেই লোকটি। তার রাগ এখনও কমেনি।
আহমদ মুসা এমনকিছু ঘটবে তার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে ছিটকে পড়ে গেল ঘরের মেঝেতে উপুড় হয়ে।
শেষ মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়া থেকে রক্ষা পেতে চেষ্টা করেছিল আহমদ মুসা। কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা। কপালের বাম পাশটা ঠুকে গেল কংক্রিটের মেঝের সাথে। বাম চোখের ওপরটা ফেটে গেল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। মুখ ভেসে গেল সে রক্তে।
আহমদ মুসা উঠে বসল।
হো হো করে হেসে উঠল সেই লোকটি। তার চোখে ক্রুর দৃষ্টি। বলল, মিনাত্রা সেন্ডোকে তুমি চিনতে। আমি জুবি জুরিটা তার জায়গায়, এখন অপারেশন কমান্ডার। সেন্ডোকে হত্যা করেছ, সে হত্যার প্রতিশোধ আমরা নেব। সব হত্যারই প্রতিশোধ আমরা নেব তিল তিল করে।
আহমদ মুসা উঠে বসেছিল। সে কোটের হাতা দিয়ে চোখের ওপর আসা রক্ত মুছে নিয়ে বলল, ‘মিঃ জুবি জুরিটা আমার প্রতি রুঢ় না হয়ে আপনার কৃতজ্ঞ হওয়া দরকার। সেন্ডো বেঁচে থাকলে আপনার এ পদ জুটতোনা।’
‘ফের বিদ্রুপ করছ। দেখ এতক্ষণে তোমাকে কুকুরের মত গুলি করে মারতাম। কিন্তু কি করব, বস কথা দিয়েছেন আমেরিকার কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে তাদের হাতে তোমাকে তুলে দেবার। কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা তো’।
‘এই না বললেন বিচার আপনারাই করবেন তিলে তিলে?’
‘তা বটে, আমরা ওদের হাতে একটা সজীব কংকাল তুলে দেব মাত্র। আমাদের শাস্তি আমরা দিয়ে নেব।’
‘ঈশ্বরের যে নাম নিলেনা। কথায় আছে না, মানুষ ভাবে একটা, আল্লাহ করেন আরেকটা।’
‘ঈশ্বরের আর খেয়ে কাজ নেই, এখানে আসবেন নাক গলাতে। দু’বার পালিয়েছ, আর সে আশা করোনা। যেখানে রেখে গেলাম, তার পাথরের দেয়ালে মাথা ঠুকে মরতে পার, কিন্তু রেরুতে পারবে না।’
‘মাথা ঠুকে মরার কোন ইচ্ছা আমার নেই।’
‘তুমি মরলে তো আমাদের ক্ষতি। শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে, আবার আমাদের ব্যবসাও মাঠে মারা যাবে। তবে তোমাকে এখানে বেশী দিন থাকতে হবে না, ভাসকুয়েজ আসা পর্যন্তই। জরুরী কাজে আজই গেল সানফ্রান্সিসকো, খবর পেলে কাল সকালেই এসে হাজির হবে। খুব বেশী হলে সন্ধ্যাতক সময় লাগবে।
জুবি জুরিটা উঠে যাবার জন্যে লিফটের বোতামের দিকে হাত বাড়িয়েও আবার হাত টেনে নিল। আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, শুন, রোবট ‘ডেভিল’ তোমাকে খাবার দিয়ে যাবে। দেখ ওর সাথে বেয়াদবির কোন চিন্তাও যেন করোনা। ও চোখের দৃষ্টি দেখেই চিন্তা ধরে ফেলতে পারে। ওর দশ চোখ, ওকে ফাকি দেবার কোন উপায় নেই। আর ও আসার পর হাত কখনও ওপরে তুলবেনা। কোন হাত যখন তার লক্ষ্যে ওপরে ওঠে, তখন সে পাগল হয়ে যায়। ও তখন তুলাধুনো করে ছাড়বে মনে রেখ। ও কাউকে প্রাণে মারেনা, কিন্তু কেউ ওর হাতে পড়লে তাকে ছয় মাস হাসপাতালে থাকতে হয়, জীবনের মত পঙ্গু হয়ে যায় সে।’
বলে জুবি জুরিটা মুখ ফিরিয়ে লিফটের বোতামে চাপ দিল। বন্ধ হয়ে গেল লিফটের দরজা, সেই সাথে কক্ষের দরজাও।
আহমদ মুসা কোটের হাতা দিয়ে বাম চোখের পাশে জমে ওঠা রক্ত আবার মুছে নিল। তারপর ঘরের চারদিকে নজর বুলাল। সত্যই অন্ধকূপ একটা। চারদিকেই পাথরের দেয়াল। লিফটের দরজা ছাড়া কোন দরজা জানালা নেই। ওপরে ছাদের মাখানে ক্রিকেট বলের মত গোলাকার একটা জায়গায় স্টিলের একটা জাল লাগানো। আহমদ মুসা বুঝল, ঐ পথ দিয়ে ঘরের শীততাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, হয়তো ক্যামেরাও ওখানে সেট করা থাকতে পারে। তবে ভাসকুয়েজের ঘরের মত কোন কাল চোখ আহমদ মুসা সেখানে দেখল না।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে লিফটের দরজা পরীক্ষা করল। টোকা দিয়ে দেখল, পুরো স্টিলের দরজা। লিফটের সাথে এ দরজা খোলে ও বন্ধ হয়। এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা লিফটে।
আহমদ মুসা দরজা থেকে ফিরে এসে মেঝের মাঝখানে বসল। এই অন্ধকূপের মধ্যে দুনিয়াটাকে খুব সংকীর্ণ মনে হল আহমদ মুসার। মনের দরজায় এসে উদ্বেগ উকি দিল, এ অন্ধকূপ থেকে মুক্তির উপায় কি?
আহমদ মুসা তাড়িয়ে দিল উদ্বেগটাকে মনের দুয়ার থেকে। বলল, এ চিন্তার সময় পাওয়া যাবে, ভাসকুয়েজ আসতে কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা দেরী আছে। এখন একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার। মেঝেয় টান হয়ে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা। শীঘ্রই তার দু’চোখ জুড়ে নেমে এল ঘুম।