আলবাসেট-মাদ্রিদ হাইওয়ে ধরে ছুটে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি মাদ্রিদের দিকে। তারা ঠিক দক্ষিন দিক দিয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে মাদ্রিদে। পিরেনিজ থেকে সোজা এলে উত্তরের যে কোন পথে তাদের মাদ্রিদ প্রবেশের কথা, কিন্তু আহমদ মুসা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে কাঁচ কলা দেখাবার জন্যে দিক পরিবর্তন করেছে।
চারদিক থেকে মাদ্রিদ প্রবেশের মোট হাইওয়ে আছে সাতটা। মাদ্রিদ-সারাগোসা ও মাদ্রিদ বারগোস হাইওয়ে উত্তর দিক থেকে, পশ্চিম দিক থেকে মাদ্রিদ-ভেল্লাদলিত ও মাদ্রিদ-বাজোস হাইওয়ে এবং দক্ষিনে তিনটি হাইওয়ে মাদ্রিদ-টলেড, মাদ্রিদ-আলবাসেট এবং মাদ্রিদ-ভ্যালেন্সিয়া। পিরেনিজের ভেল্লা থেকে মাদ্রিদের সোজা পথ ছিল লেরিদা-সারাগোসা-মাদ্রিদ হাইওয়ে। এ পথে এলে তারা পূর্ব-উত্তর প্রান্ত দিয়ে মাদ্রিদ প্রবেশ করতো। কিন্তু আহমদ মুসা এ সোজা পথ পছন্দ করেনি। আহমদ মুসা পরিষ্কারই বুঝতে পেরেছিল, ভেনিস থেকে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের লোকরা যখন তুলুজকে আহমদ মুসাদের ব্যাপারে সতর্ক করে দিতে পেরেছে, তখন তুলুজ মাদ্রিদকে অবশ্যই জানাতে পারে যে, আহমদ মুসারা গোরোনে হাইওয়ে ধরে ভেল্লার পথে স্পেনে প্রবেশ করছে। ভেল্লা থেকে আহমদ মুসারা যে সারাগোসা-মাদ্রিদ হাইওয়ে ধরে মাদ্রিদ প্রবেশ করছে, এ কথা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান চোখ বন্ধ করেই ধরে নেবে। সুতরাং তুলুজে তারা যে জাল পেতেছিল, তার চেয়েও বড় জাল ভাসকুয়েজ পাতবে মাদ্রিদ-সারাগোসা হাইওয়েতে। সুতরাং আহমদ মুসা ভেল্লা থেকে বেরুবার সময়ই মনস্থির করে নিয়েছিল, ভিন্ন রুটে তারা মাদ্রিদ প্রবেশ করবে।
ভেল্লা থেকে উত্তর-পূর্ব স্পেনের ক্যাটালোনিয়া প্রদেশের রাজধানী লেরিদায় প্রবেশ করে ড্রাইভিং সিট থেকে আবদুর রহমান বলেছিল, ‘তখন আমরা তো পশ্চিমে সারাগোসার দিকে চলব, তাই না মুসা ভাই?’
‘না আবদুর রহমান, সোজা পূর্ব দিকে এগিয়ে উপকুল শহর টেরাগন চল।’
‘টেরাগন? আমরা মাদ্রিদ যাব না মুসা ভাই?’ চোখ কপালে তুলে বলেছিল আবদুর রহমান।
‘যাব, তবে সোজা পথে নয়। টেরাগন থেকে যাব ভ্যালেনসিয়া, ভ্যালেনসিয়া থেকে আলমানসা হয়ে অলবাসেট এবং সেখান থেকে মাদ্রিদ।’
‘এত ঘুরার কি প্রয়োজন ছিল মুসা ভাই?’
‘ছিল না। কিন্তু ওদের চোখ এড়িয়ে আমি মাদ্রিদ প্রবেশ করতে চাই। ওরা জানুক যে, আমরা মাদ্রিদে আসিনি, তাহলে কাজের একটু সুবিধা হবে। সবচেয়ে বড় কাজ এখন আমাদেরকে মাদ্রিদে করতে হবে। ওরা যত অপ্রস্তুত থাকে তত ভাল আমাদের জন্যে।’
‘কিন্তু মুসা ভাই, ভ্যালেনসিয়া থেকে সোজা একটা হাইওয়ে গেছে মাদ্রিদে, ও পথেও তো আমরা যেতে পারি?’ বলেছিল জোয়ান।
‘পারি, কিন্তু তারচেয়েও আলবাসেট-মাদ্রিদ হাইওয়েটা নিরাপদ হবে বলে আমি মনে করি। সারাগোসা-মাদ্রিদ হাইওয়ের পাশেই তো অনেকটা ভ্যালেনসিয়া-মাদ্রিদ হাইওয়ে।’
একে তো ঘুরা পথ, তার উপর ভ্যালেনসিয়া এসে একদিন দেরী হয়েছিল আহমদ মুসাদের। ভ্যালেনসিয়া শহরটি জোয়ান এবং আবদুর রহমান দু’জনেরই আবেগের সাথে জড়িত। তাছাড়া আহমদ মুসাও স্পেনের পুর্ব উপকুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দর নগরী ভ্যালেনসিয়া একটু ঘুরে দেখার লোভ সামলাতে পারেনি।
এখনকার ভ্যালেনসিয়া একেবারে নতুন, আগের ভ্যালেনসিয়ার কোন চিহ্নই এখন বর্তমান নেই। তবু জোয়ান এবং আবদুর রহমান পাগলের মত ছুটে বেড়িয়েছে ভ্যালেনসিয়ার এগলি থেকে সেগলিতে। ভ্যালেনসিয়ার পুরানো এলাকার যে বাড়িই দেখেছে, মনে হয়েছে এখানেই হয়তো তাদের পুর্ব পুরুষ আবদুর রহমান থাকতেন অথবা এই বাড়িতেই শুরু হয় আবদুল্লাহ বিন আবদুর রহমানের দাসজীবন। তারা ঘুরে ঘুরেই জানতে পারল, অতীতের দুটো স্মৃতিই মাত্র বর্তমান। একটি হলো, আবদুর রহমান ও জোয়ানের পুর্ব পুরুষ বিজ্ঞানী আবদুর রহমানের ‘দারুল হিকমা’ বা বিজ্ঞান বিদ্যালয়ের স্থানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভ্যালেনসিয়া বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়। আরেকটি হলো, ভ্যালেনসিয়া বন্দরের ইসাবেলা জেটি। বহু আশা করে জোয়ানরা গেয়েছিল বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আধুনিক বিল্ডিং-এর সারি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি জোয়ানরা। তবু সেখানে গিয়ে সজল হয়ে উঠেছিল জোয়ান ও আবদুর রহমানের চোখ। সেখানকার মাটিতে, বাতাসে দারুল হিকমার স্পর্শ তারা খুঁজছিল। বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা চলে এসেছিল ভ্যালেনসিয়া বন্দরে ইসাবেলা জেটিতে। এখানে জোয়ান, আবদুর রহমান, আহমদ মুসা সকলেই ভাবপ্রবন হয়ে পড়েছিল। ভ্যালেনসিয়া ও পুর্ব স্পেন থেকে উচ্ছেদকৃত মুসলিম নর-নারীদের সর্বশেষ দলটিকে নিয়ে সর্বশেষ জাহাজটি ছেড়েছিল এই জেটি থেকে। জাহাজ ছাড়লে স্বদেশভুমি স্পেনের জন্যে কান্নারত পাগল নারী-পুরুষরা চিৎকার করে অভিসম্পাত দিচ্ছিল রানী ইসাবেলা ও রাজা ফার্ডিন্যান্ডকে। এর জবাবে রানী ইসাবেলা ও ফার্ডিন্যান্ডের সৈনিকরা উপকূল থেকে কামান দেগে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। নারী-পুরুষ সবাই ডুবে মরে, কাউকেই উপকূলে উঠতে দেয়া হয়নি। এই কৃতিত্বপূর্ন ঘটনার স্মরনে স্থানীয় খৃষ্টানরা এই জেটির নাম দেয় ইসাবেলা জেটি। এই জেটিতে দাঁড়িয়ে সাগরের দিকে তাকাতে গিয়ে অশ্রুতে চোখ ভরে উঠেছিল জোয়ান, আবদুর রহমান এবং আহমদ মুসা তিনজনেরই।
আহমদ মুসা তার এক হাত আবদুর রহমান আরেক হাত জোয়ানের কাঁধে রেখে সামনে সাগরের বুকের উপর দৃষ্টি রেখে বলেছিল, ‘আমরা এক জাহাজের কথাই শুধু ভাবছি, কিন্তু জান কি স্পেনের মুসলিম উদ্বাস্তু বোঝাই কত জাহাজ সামনের ঐ মেজর্কা, মানর্কা দ্বীপে লুন্ঠিত হয়েছে, কত জাহাজ ডুবেছে, ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে সামনের ঐ ভূমধ্যসাগরে? স্পেনে একটি জাতি স্বত্ত্বা ধ্বংসের যে ঘটনা, ইতিহাসে তার নজীর নেই, আবার এই সাগরে মুসলিম উদ্বাস্তুদের যে পরিনতি হয়েছে ইতিহাসের কোন অধ্যায়ে তা আর ঘটেনি। অথচ এই সাগরের দুইদিক ঘিরে তখনও মুসলিম সাম্রাজ্য!’
ভেজা চোখে তারা ফিরে এসেছিল ইসাবেলা জেটি থেকে।
তিনজনেরই পর্যটকের ছদ্মবেশ। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, কোমরে চওড়া বেল্ট। তিনজনের মুখেই দাঁড়ি ও গোঁফ লাগানো। খুব পরিচিত না হলে তাদেরকে চেনার উপায় নেই। আহমদ মুসা সাধারণত ছদ্মবেশ নেয় না, কিন্তু এবার নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেছে। সে নিরপদ্রুপে মাদ্রিদ পৌঁছাতে চায়। তার লক্ষ্য এখন কোন সংঘাত নয়, তার লক্ষ্য তেজস্ক্রিয় সেটের পরিকল্পনার মানচিত্র উদ্ধার করা।
সাগরের কূল ছেড়ে বন্দরের অনেক খানি উপরে তারা উঠে এসেছে। পার্ক করা গাড়ির দিকে এগুচ্ছিল তারা। পাশেই এ সময় ছেলে-মেয়েদের একটা জটলা দেখতে পেয়েছিল। আহমদ মুসারা তিনজনেই সেদিকে তাকিয়ে ছিল। দেখলো, বৃদ্ধ-প্রায় একটা মহিলাকে ছেলেরা উত্যক্ত করছে। সমস্বরে তারা বলছে, মরিসকো পাগলী। বার বার একথা বলছে। সুবেশা মহিলাটা কোন ভ্রুক্ষেপই করছেনা। একমনে একটা রুটি চিবাচ্ছে।
‘মরিস্কো পাগলী’র মরিস্কো শব্দটি আহমদ মুসাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
হৃদয়ে এসে ঘা দিয়েছিলো শব্দটা। মহিলাটি কি মরিস্কো জোয়ানের মনটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল। আহমদ মুসারা এগিয়ে গিয়েছিল জটলার দিকে। জোয়ান আগে আগে।
জটলা থেকে একজন যুবক ছেলে, বয়স আঠার, উনিশ হবে, চলে যাচ্ছিল আহমদ মুসাদের পাশ দিয়েই।
জোয়ান তাকে ডেকে বলেছিল, ঐ যে মহিলাটিকে তোমরা উত্যক্ত করছ সে কে?’
কেন ওকে চিনেন না। সবাই বলে মরিস্কো পাগলী। বলেছিল ছেলেটি।
‘কে ও? ওকি সত্যি পাগল? আবার জিজ্ঞাসা করে জোয়ান।
‘জানি না, সবাই বলে পাগল। কখনও হাসে, কখনও কাঁদে।’
‘ওঁর আপন কেউ নেই?’
‘ছিল, ওর আব্বা ও ভাই ছিল। কিন্তু তারা এখন নাই। ওদের হত্যা করা হয়েছে।’
‘হত্যা করা হয়েছে? কে হত্যা করেছে?’
‘ওরা মরিস্কো পরিচয় গোপন করে ওদের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিল সেই অপরাধে ওদের হত্যা করা হয় শুনেছি। আর স্বামী ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে।’ ছেলেটির কন্ঠ ভারি।
‘বুঝেছি, তোমরা এমন দুঃখী মেয়েকে কষ্ট দাও, খারাপ লাগে না?’
‘আমি দেখতে গিয়েছিলাম, আমি কিছু বলিনি, আমি কিছু করিনি’ ছেলেটির কণ্ঠ ভারি ও ক্ষুব্ধ মনে হলো।
সে কণ্ঠে চমকে উঠেছিল জোয়ান এবং আহমদ মুসারাও।
‘তুমি খুব ভাল ছেলে, মানুষের প্রতি তোমার দরদ আছে। চল তুমি একটু সাহায্য করবে, আমরা ওর সাথে কথা বলতে চাই।’
ছেলেটি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিল জোয়ান এবং আহমদ মুসাদের দিকে। পরে গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল, ‘কোন লাভ নেই, ওঁ কাউকে চিনে না, কারও সাথে কথাও বলে না। যা বলে আপন মনে বলে।’
‘তবুও চেষ্টা করে দেখি চল।’ বলেছিল জোয়ান।
পাগলিনীকে ঘিরে ছেলেদের জটলা তখন ছিল না। চলে গিয়েছিল সবাই। মরিস্কো পাগলী একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে ঢুলছিল।
আহমদ মুসারা তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের সাথে ছেলেটি। ছেলেটি হয়ে পড়েছিল গম্ভীর, তার মুখটা হয়ে উঠেছিল কেমন যেন ফ্যাকাশে। ব্যাপারটা আহমদ মুসার দৃষ্টিতে পড়েছিল।
জোয়ান মহিলাটির সামনে গিয়ে বসে পড়েছিল। মহিলাটিকে সম্বোধন করে বলেছিল, ‘মা’।
স্পষ্ট ওঁ দরদভরা কণ্ঠ ছিল জোয়ানের।
মরিস্কো পাগলী মহিলাটি মাথা খাড়া করেছিল অনেকটা চমকে উঠার মত করে। চোখ তুলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল জোয়ানের দিকে। আবার ডেকে ছিল জোয়ান, ‘মা।’
স্থির দৃষ্টি কাঁপছিল মহিলাটির। কাঁপছিল তার ঠোট। হঠাৎ তার কম্পিত ঠোট থেকে বেরিয় এল, মা, মা, মা।
‘মা’ শব্দ উচ্চারণের সাথে সাথে তার চোখের কম্পন বাড়ছিল, দৃষ্টি তীব্র হচ্ছিল। তার মধ্যে কি যেন খুঁজে পাবার আকুলি বিকুলি। অসহায়ভাবে অকূল সমুদ্রে সে যেন সাঁতরাচ্ছে, কূল খুঁজে পাচ্ছেনা।
এ সময় সেখানে দু’জন মহিলা পুলিশ এসে হাজির। তারা দু’জন দু’হাত ধরল মরিস্কো পাগলীর। টেনে তুলতে তুলতে তুলতে বলেছিল, চলুন ফেরার সময় হয়েছে।
মরিস্কো পাগলী জোয়ানের দিকে চোখ উঠিয়ে হেসে উঠেছিল উচ্চস্বরে।
পুলিশ দু’জন পাগলীকে নিয়ে চলে গিয়েছিল।
জোয়ানের বুক জুড়ে তোলপাড় করছিল, একটি কথা- ‘স্পেনে মরিসকোদের হয় দাস হতে হয়, নয়তো মরতে হয়, অথবা হতে হয় পাগল’।’
চোখের দু’কোণ ভিজে উঠেছিল জোয়ানের।
ছেলেটি ভারি চোখে, পাংশু মুখে জোয়ানের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, ‘আপনি কে?’
‘আমি? আমি ওঁর মতই একজন মরিস্কো ছিলাম। এখন মুসলমান।’
হঠাৎ ছেলেটি দেহ বাঁকিয়ে, মাথা ঝুকিয়ে বাও করেছিল জোয়ানকে। সেই সাথে তার দু’চোখে নেমে এসেছিল অশ্রু।
জোয়ান বিস্মিত হয়েছিল। বলেছিল, তুমি এভাবে বাও করলে কেন? তুমি কাঁদছোই বা কেন ?
‘আমি একজন মরিস্কো, একজন মুসলমানকে শ্রদ্ধা জানালাম। আর কাঁদছি আমি আমার দুর্ভাগ্যের জন্যে।’
‘কি দুর্ভাগ্য?’
‘আমি আমার মাকে মা ডাকতে পারি না, মা বলতে পারিনা, তার কোন সাহ্যায্যে আসতে পারি না।’
বলতে বলতে কান্নায় ছেলেটির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
আহমদ মুসা এগিয়ে এসে দু’হাত দিয়ে ছেলেটিকে কাছে টেনে বলেছিল, ‘বুঝতে পেরেছি, ঐ মরিস্কো পাগলিনী তোমার মা, তুমি তোমার মাকে মা বলতে পার না, কোন সাহায্য করতে পার না সমাজের ভয়ে। সত্যিই তুমি দুর্ভাগা।’
ছেলেটি কান্না চাপতে মুখে রুমাল চাপা দিয়েছিল।
ছেলেটির সব কাহিনী শুনেছিল আহমদ মুসারা। তার বড় দুই ভাই সরকারী অফিসার, আর সে ভ্যালেনসিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষের ছাত্র। তাদের পিতার মৃত্যু ঘটেছে অনেক দিন আগে। এরপর তারা তাদের মাকে এনে সেনিটোরিয়াসে রাখার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু মায়ের চিকিৎসার জন্যে তার কাছে মায়ের সন্তান হিসেবে হাজির হওয়া প্রয়োজন, তা তারা পারছে না। পারছে না কারন, তাতে তারাও সমাজ থেকে বিচ্যুত হবে, সব হারাবে, অন্যদিকে মায়েরও কোন উপকার করতে পারবে না। এই দুর্ভাগ্য নিয়েই তারা বেঁচে আছে। মাঝে মাঝে তারা সেনিটোরিয়াসে যায়। দূর থেকে দেখে আসে। সপ্তাহে একদিন পাগলিনী সকলকে শহরে ছেড়ে দেয়া হয়, আবার নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সপ্তাহের এ দিনটিতে তারা নিয়মিত মায়ের সান্নিধ্যে আসে, কিন্তু পরিচয় নিয়ে তার সামনে দাঁড়াতে পারে না।
কাহিনী শেষ করে ছেলেটি বলেছিল, ‘একজন মরিস্কো পাগলিনীকে, যে সকলের ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের পাত্র, মা বলে ডাকতে পেরেছেন, আপনারা কে?’
‘জোয়ান বলেছেই আমরা মুসলমান।’ জবাব দিয়েছিল আহমদ মুসা।
‘এদেশের মরিস্কো আরো আছে, মুসলমানও গোপনে আছে, কিন্তু কেউ তো এই সাহস, এই আন্তরিকতা দেখাতে পারে না?’
‘তোমার ঠিকানা তো দিয়েছই, দরকার হলে তোমার সাথে পরে যোগাযোগ করব। এখন পরিচয় নিয়ে কি করবে?’
‘জানি, আমাকে বিশ্বাস করতে পারবেন না। তবে একটা কথা বলি, আমরা মায়ের সন্তান, বাপের সন্তান নই। আমরা কিছুই করতে পারিনি, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যেও পিতাকে সমর্থন করিনি।’
‘অর্থাৎ তুমি নিজেকে মরিস্কো মনে কর তাই না?’ বলে জোয়ান জড়িয়ে ধরেছিল ছেলেটিকে। ছেলেটির পিট চাপড়ে বলেছিল, ‘মরিস্কো হওয়া গর্বের, দুঃখের নয়।’
এই সময় আব্দুর রহমান জোয়ানের কাহিনী বলেছিল ছেলেটিকে। ছেলেটি আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিল আবার জোয়ানকে। বলেছিল, ‘আপনারা যদি আমার বড় দুই ভায়ের সাথে দেখা না করে চলে যান, তাহলে ওঁরা আমার উপর ভীষণ রাগবেন। আপনারা খুশী হবেন আমার দু’ভাইয়ের সাথে দেখা করে।’
কিন্তু আহমদ মুসারা ছেলেটিকে সময় দিতে পারেনি। বলেছিল, ‘তোমাদের টেলিফোন থাকলে, আমরা কথা বলব তোমার ভাইদের সাথে।’
বিদায়ের সময় ছেলেটি ভারি কণ্ঠে বলেছিল, আপনাদের এক ঘণ্টার সঙ্গ আমার কাছে এক যুগের মত মনে হচ্ছে। আপনারা আমাকে নতুন জীবন দিয়ে গেলেন, সেই সাথে করে গেলেন অসহায়। কারণ চলার পথ আমার জানা নেই।’
আহমদ মুসা ছেলেটির কপালে চুমু খেয়ে বলেছিল, ‘আমরা গোটা স্পেনের জন্যে নতুন জীবনের সন্ধান করছি, হতাশ হয়ো না।’
আলবাসেট-মাদ্রিদ হাইওয়ে ধরে চার দিকের অখণ্ড নিরবতার মধ্যে কালো রাতের বুক চিরে চলার সময় এই কথাগুলো আহমদ মুসা, জোয়ান ও আব্দুর রহমান সকলের মনকেই তোলপাড় করে তুলছিল। ভ্যালেনসিয়ার সেই মরিস্কো পাগলিনী এবং সেই পাগলিনীর হতভাগ্য ছেলে জোসেফ ফার্ডিনান্ডের কথা তারা ভুলতেই পারছিল না।
মাদ্রিদ আর খুব বেশী দূরে নয়। সামনেই মাদ্রিদকে বেষ্টন করে তৈরি রিং রোড।
রিং রোডের উপর দিয়ে ফ্লাইওভার। ট্রাফিকের কোন ঝামেলা নেই।
একশ’ তিরিশ কিলোমিটার বেগে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি। ড্রাইভ করছিল আহমদ মুসাই। তার পরনে শিখের পোশাক। মাথায় পাগড়ী, ইয়া বড় দাঁড়ি-গোঁফ।
আর জোয়ান ও আবদুর রহমান দু’জন তরুণ ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীক কাজ সেরে তারা মাদ্রিদে ফিরছে। জোয়ানের মুখে পরিপাটি করে ছাটা দাঁড়ি-গোঁফ।
রিং রোডের ফ্লাইওভারটি তখনও পাঁচশ গজের মত দূরে। হঠাৎ ফ্লাইওভারের মুখে লাল আলো জ্বলে উঠল। দেখেই বুঝা গেল আলোটি লাইট স্টিকের। কেউ একজন উঁচিয়ে ধরে আছে।
আহমদ মুসা গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। চলে যেতে চেষ্টা করে লাভ নেই, গুলী করতে পারে। পুলিশ হতে পারে। আবার শত্রু হওয়াও বিচিত্র নয়।
ফ্লাইওভারের প্রায় কাছাকাছি এসে থেকে গেল আহমদ মুসার গাড়ি।
গাড়ি থামতেই ছুটে এল দুইজন। মনে হলো, শিখ ড্রাইভারের উপর নজর পড়তেই ওরা একটু থমকে গেল। পরক্ষণেই বলে উঠল, ‘তোমরা আরোহী ক’জন, কারা?’
‘দু’জন। ব্যবসায়ী।’ পাঞ্জাবী ও স্প্যানিশ ভাষা মিশিয়ে শিখ ড্রইভারদের মতই উত্তর দিল আহমদ মুসা।
‘ওদের নামতে বল।’
‘তোমরা কে, পুলিশ তো নও?’
‘আমরা পুলিশের বাবা।’
‘তাহলে গোয়েন্দা পুলিশ, কোন আসামী ফেরার হয়েছে বুঝি?’
‘হ্যাঁ, কথা বাড়িও না, যা বলছি কর।’
আহমদ মুসা ভেতরের আলো জ্বেলে দিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘দেখো।’
দরজা দিয়ে উঁকি দিল দু’জন। সামনেই বসে ছিল আবদুর রহমান। তারপর জোয়ান।
মাথায় হ্যাট পরা, লম্বা কালো ওভার কোটে দেহ ঢাকা লোক দু’জন পকেট থেকে ফটো বের করে আবদুর রহমান ও জোয়ানের সাথে মিলিয়ে দেখল। তারপর দরজা থেকে সরে গিয়ে ফটো পকেটে ফেলে বলল, ‘যাও।’
‘আর কত জায়গায় এভাবে আমাদের সময় নষ্ট হবে বলতো?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘না আর চেক হবে না। মাদ্রিদের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে শুধু রিং রোড়ের পয়েন্টেই চেক করা হচ্ছে।’
‘আর ওদিকে? খুব বড় কিছু ঘটেছে নাকি?’
‘ওদিকে মানে উত্তর ও পুবদিকে মাদ্রিদে পৌঁছা পর্যন্ত বার বার চেক হচ্ছে।’
‘কি ঘটেছে তা তো বললেন না?’
‘আমরা জানি না। হুকুম হয়েছে আমরা কাজ করছি।’
‘ফটোগুলো সেই ক্রিমিনালদের বুঝি?’
‘ক্রিমিনাল কিনা জানি না।’
‘ফটো মিলিয়ে দেখছ, অথচ তারা কে জান না?’
‘জানি না কে বলল, ও আহমদ মুসা নামের একজন লোক। এত জানার তোমার কি দরকার, যাও।’
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিল। লাফিয়ে উঠে চলতে শুরু করল গাড়ি।
আবার সেই গতিবেগ- একশ’ তিরিশ কিলোমিটার বেগে ছুটতে লাগল গাড়ি।
রাত তখন এগারটা।
রাস্তায় গাড়ি খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।
রাতের নিরবতায় একটানা শো শো শব্দের স্পন্দন তুলে ছুটছে আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসা মুখটা একটু পাশে টেনে পেছনে জোয়ানকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জোয়ান ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্নানের তালিকায় আহমদ মুসার পাশে তোমারও নাম উঠল মনে হয়। দ্বিতীয় ফটোটা ছিল সম্ভবতঃ তোমারই।’
‘আমার সৌভাগ্য মুসা ভাই।’ বলল জোয়ান।
‘তোমার বাড়িতে থাকা তোমার জন্যে নিরাপদ হবে?’
‘দ্বিতীয় বার পরিবর্তন করে যে বাসা নিয়েছি, সেটার সন্ধান ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ন্যান কিছুতেই পাবার কথা নয়।’
‘তবু আজ রাতেই ফিরবে বাড়িতে?’
‘অসুবিধা নেই মুসা ভাই।’
‘ঠিক আছে, চল ফিলিপের ওখানে আগে যাই, তারপর তোমাকে পৌঁছে দেব।’
‘ঠিক আছে। আবদুর রহমান ভাই আমার বাসাতে তো যাবেই।’
‘তোমাদের সম্মিলনিতে আমিও যেতে পারলে খুশী হতাম। কিন্তু ঘুমাব। ভোর রাতে আমাকে বেরুতে হবে।’
‘ভোর রাতে? কোথায় মুসা ভাই?’ বলল আবদুর রহমান।
‘যে বাঘ আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে, তার গুহায়।’
‘তার মানে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ন্যানের হেড কোয়ার্টারে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমরাও তো যাচ্ছি।’ বলল জোয়ান।
‘এবার না, কাল একাই যাব।’
আবদুর রহমান এবং জোয়ান দু’জনেরই মুখটা মলিন হলো। বলল জোয়ান, ‘কি ক্ষতি হবে আমাদের নিলে, আমরা বাইরে পাহারায় তো থাকতে পারবো।
‘কালকে আমি সংঘাত করতে যাচ্ছি না, যাচ্ছি চোরের মত গোপনে অনুসন্ধান অভিযানে। এখানে লোক যত কম, তত ভাল।’
আবদুর রহমান ও জোয়ান আর প্রতিবাদ করলো না। কিন্তু তাদের মুখ দেখে মনে হলো, আহমদ মুসার এ যুক্তি তারা গ্রহন করতে পারেনি।
আবার নিরবতা নামল গাড়িতে।
সামনে একটু দূরে লিওন সাইনে ‘ওয়েলকাম’ শব্দটি জ্বল জ্বল করছে। ওখান থেকেই মাদ্রিদ শহরের শুরু।
অল্পক্ষণের মধ্যেই মাদ্রিদ শহরে প্রবেশ করল আহমদ মুসার গাড়ি।
স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল আহমদ মুসার বুক থেকে। স্টিয়ারিং-এ হাত রেখেই সিটে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল আহমদ মুসা।
ধীর ভাবে এগিয়ে চলল গাড়ি শহরের পথ ধরে।