তুই আমাকে বিশ্বাস করিস না। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল হান্না জেনকে।
তোকে বিশ্বাস না করলে দুনিয়াতে আর কাকে বিশ্বাস করি বলত? আমার গোটা হৃদয় তোর কাছে খোলা। বলল জেন হান্নার একটি হাত নিজের বুকে জডিয়ে ধরে।
কেন কেউ নেই? জোয়ান?
জোয়ানের সাথে তো আমার বিশ্বাসের সম্পর্ক নয় ও আমার সত্তা আমার সব। আর তুই আমার একমাত্র বন্ধু যার কাছে আমার হৃদয় খোলা।
না তুই আমাকে বিশ্বাস করিস না জেন। আবার জোর দিয়ে বলল হান্না।
তুই বাজে বকছিস।
বাজে বকছি? আচ্ছা বলত ত্রিয়েস্তে সি কুইন মোটেলের সামনে যে দিন হত্যার ঘটনা ঘটল। সেদিন রাত আটটায় তুই কোথায় গিয়েছিলি ?
প্রশ্ন শোনার পর জেন কিছুক্ষণ হান্নার দিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকল। যেন জেন পাঠ করার চেষ্টা করছে হান্নাকে।
একটু পর ধীরে কণ্ঠে বলল তুই কত টুকু জানিস হান্না?
কিছুই জানিনা তুই কোথাই গিয়েছিলি বল? হেসে বলল হান্না।
জেনের মুখে কিন্তু হাসি নেই। হান্নার একটি হাত তুলে নিয়ে বলল না তুই জানিস। বল কতটুকু জানিস?
জেনের অবস্থা দেখে হান্নার বোধ হয় করুনা হলো বলল সেদিন বিকেলে থেকেই তোকে আমি আনমনা দেখি। তারপর রাত ৮টার দিকে তুই যখন বাইরে যেতে চাইলি এবং আমাকে সাথে নিতে চাইলি না তখন আমার সন্দেহ হলো নিশ্চয় জোয়ানের ওখানে যাচ্ছিস। তোর অভিসার যাত্রাকে অনুসরন করলাম। জোয়ানের রেস্ট হাউসের দিকে যাচ্ছিস দেখে আমার অনুমান সত্য হওয়াই ভীষণ খুশী হলাম কিন্তু শীঘ্রই আমার খুশী কৌতুহলে রূপ নিল যখন দেখলাম তুই ওঁত পেতে বসলি। ভাবলাম এই লুকোচুরি খেলার শেষ দেখতে হবে। অভিসারের এ আবার কোন রূপ, অবশ্য পরক্ষনেই জোয়ানের ঘরের দরজা খোলা দেখে আমার মনে হয়েছিল নিশ্চয় জোয়ানের ঘরে লোক আছে এ জন্য তোর এই লুকানো। মজা দেখার লোভ নিয়ে তোর থেকে সামান্য দুরে একটা ঝাউগাছের আডালে বসে রইলাম। মজা দেখার আনন্দ আতংকে রূপান্তরিত হলো যখন দেখলাম দু জন স্টেনগানধারী জোয়ানের ঘরের দরজায় গিয়ে স্টেনগান উদ্যত করে দাঁড়াল। তারপর তোর দিকে তাকিয়ে তো আমার বুকের কাঁপুনি ধরে গেল। দেখলাম তোর হাতে উদ্যত পিস্তল, তুই গুড়ি মেরে এগুচ্ছিস জোয়ানের ঘরের দিকে। ভয়ে আমি আড়ষ্ট, কিন্তু চোখ সরাতে পারলাম না তোর উপর থেকে। তারপর দেখলাম তোকে গুলি করতে এবং ঐ দুই স্টেনগানধারীকে পড়ে যেতে। আমি তখন কাঁপছি। আমার পাশ দিয়েই দৌড়ে চলে গেলি। কিন্তু আমি নড়তে পারছিলাম না, কথাও বলতে পারছিলাম না। তুই চলে আসার পর আমার ভয় ধরে গেল, আমি না ধরা পড়ে যাই। কম্পিত পায়ে গুড়ি মেরে ফুলের গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। তারপর ছুটলাম। মটেলে আসতে ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল আমিই যেন খুন করেছি, কারও সাথে দেখা হলেই ধরা পড়ে যাব। চলে এলাম নিচে। এক বেঞ্চিতে নিরিবিলি বসে থাকলাম আধা ঘন্টা। ভয় কমলে, মনটা শান্ত হলে মটেলে ফিরে এলাম। তোর সাথেও কথা বলতে ভয় হচ্ছিল। শুয়ে পড়লাম কম্বল মুড়ি দিয়ে।’
থামল হান্না।
জেনের মুখে কোন কথা নেই। মুখ নিচু।
হান্নাই আবার কথা বলল। বলল, ‘এত বড় ঘটনা আমার কাছ থেকে লুকিয়েছিস, নিশ্চয় তুই আমাকে বিশ্বাস করিস না।
মুখ তুলল জেন। বলল,’তোকে বলিনি কেন জানিস, তোকে বললে তুই আমাকে যেতে দিতিস না ঐ কাজে। ‘প্রায় কান্না ভেজা কন্ঠে বলল, জেন।
‘অবশ্যই যেতে দিতাম না। কি সর্বনাশা পথ ওটা! যদি স্টেনগানধারীরা টের পেত, যদি কিছু ঘটত! তোর ভয় করেনি?’
‘ভয়ের কথা তখন মনে হয়নি, এখন ভয় করে মনে হলে। তখন আমার সমগ্র চেতনা জুড়ে জোয়ানের নিরাপত্তার প্রশ্ন। বিকেলে দাউদ ইমরানের ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় শুনেছিলাম, রাত ৯টায় অপারেশন জোয়ানের ঘরে। সন্ধ্যায় জোয়ানের আনা স্যাম্পুল, তেজস্ক্রিয় রিপোর্ট, এমনকি ডিস্ক গায়েব হবার খবর যখন শুনলাম, তখন বুঝলাম জোয়ানকে সরানোর পরিকল্পনাও চূড়ান্ত। এটা বোঝার পর আর আমার জ্ঞান ছিল না।’
তাই বলে তুই নিজ হাতে পিস্তল ধরে খুনিদের মোকাবিলা করার সাহস করলি, খুন করতেও পারলি?’
‘কেমন করে পেরেছি জানিনা, একটা চিন্তাই তখন আমার মনে ছিল, জোয়ানকে বাঁচাতে না পারলে আমার বেঁচে লাভ নেই। আমি মরেও যদি ওকে বাঁচাতে পারি।
থেমে গেল জেন। ভারি হয়ে উঠেছিল ওর কন্ঠ।
‘আমি দুঃখিত জেন, এটা তোর বাড়াবাড়ি। জোয়ানের অবস্থা তুই জানিস। তার সাথে তোর জীবনকে এভাবে জড়ালে তার পরিণতি কি?
‘আমি জানিনা। আমি ওসব ভাবি না।’
না ভাবলে চলবে কি করে? ট্রিয়েস্টে তুই তাকে বাঁচালি। কিন্তু ও এখন স্পেনে ফিরবে কি করে? ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান তাকে ছাড়বে মনে করিস?’
‘জেন, মা, তোমার এ্যাটলাস বইটা একটু দাও তো দেখি’-বলতে বলতে ঘরে প্রবেশ করল জেনের আব্বা মিঃ ফ্রান্সিস্কো জেমেনিজ। ঘরে ঢুকে হান্নাকে দেখে বলে উঠল, ‘বাঃ হান্না, কখন এসেছ মা?’
‘এই অল্পক্ষণ।’ উঠে দাঁড়িয়ে বলল হান্না।
এ্যাটলাস বুক নিয়ে চলে যেতে শুরু করে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে জেনের আব্বা বলল, শুনেছ মা জেন, মা হান্না, ট্রিয়েস্টে কি ঘটেছে? তোমরা কিছু তো দেখেছও।’
জেন কিছু বলল না।
‘কি ঘটেছে চাচাজান? আমি তো একজন লোক খুন হয়েছে দেখে এসেছি। ‘বলল হান্না।
‘একজন বলছ, দশজন খুন হয়েছে এবং এই সবগুলো খুনের জন্যে আহমদ মুসা দায়ী। আর তোমাদের জোয়ান এখানে নাটের গুরু হিসেবে কাজ করেছে।’
‘মুখটা লাল হয়ে উঠল জেনের।’
হান্নাই আবার কথা বলল। বলল, ‘চাচাজান, আমরা তো তেমন কিছু দেখিনি। সে তো কি একটা কাজে আই সি টি পি’তে গিয়েছিল। ওখানে কারও সাথে তার তেমন কোন পরিচয়ও নেই’। ‘তোমরা ছেলে মানুষ কি জান। সে এক সাংঘাতিক মিশনে ট্রিয়েস্টে গিয়েছিল। ওটাকে কেন্দ করেই তো ঐসব খুন-জখম। ছেলেটা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারল।’
‘কিভাবে চাচাজান? সে কি কাউকে খুন করেছে? কারও ক্ষতি করেছে?’
‘ওর পক্ষে এসব কথা বাইরে বলো না হান্না। সে এখন আমাদের জাতীয় শত্রু। ও স্পেনে আর ফিরতে পারবে না, ফিরতে পারলেও বাঁচবে না।’
বলে জেনের আব্বা বেরিয়ে গেল।
জেনের মুখে তখন কোন রক্ত নেই। কাঁপছে তার ঠোঁট।
হান্না তার একটা হাত ধরে বলল, ‘জেন তোকে পাগলামি ছাড়তে হবে, শুনলি তো সব?’
জেন হান্নার দুই হাত জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। বলল, ‘আমি পারবো না, আমি পারবো না। আমি ওসব কথা বিশ্বাস করি না। জোয়ান নির্দোষ। বরং জোয়ান ষড়যন্ত্রের শিকার।’
‘এ কথা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারবি?’
‘কোন ক্ষতি নেই কেউ বিশ্বাস না করলে। আমি শুধু বিশ্বাস করতে চাই।’
‘জোয়ান যদি স্পেনে না ফিরতে পারে?’
একটু চুপ করে থেকে জেন বলল, যেখানেই থাকুক, ভাল থাকলে, নিরাপদ থাকলে আমি খুশী হবো। তবে আমি কি মনে করি জানিস, জোয়ান স্পেনে আসবে, কোন বাধা তাকে রুখতে পারবে না।’
‘এতবড় কথা কি করে বলছিস? ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ক্ষমতা তুই জানিস?’
‘জেনেই বলছি হান্না।’
‘কিন্তু আমি কোন যুক্তি দেখছি না, জোয়ান তো শান্ত-শিষ্ট এক ছেলে। ওর মাথা আছে, কিন্তু হাত তো নেই।’
‘ট্রিয়েস্টে বাকি যে আটটি খুনের ঘটনা ঘটল, তার একটিও জোয়ান করেনি। তাহলে এসব ঘটল কি করে বলতে পারিস?’
‘আমারও বিরাট জিজ্ঞাসা এটা।’
‘সব ঘটনা একজনে ঘটিয়েছেন না।’
‘একজনে? কে সে?’
‘আহমদ মুসা।’
‘আহমদ মুসা? কোন আহমদ মুসা?’
‘আজকের বিশ্বে সবাই চেনার মত আহমদ মুসা একজনই আছে।’
‘সেই আহমদ মুসা স্পেনে এসেছে? ট্রিয়েস্টে গিয়েছিল? চাচাজানের কথা তাহলে ঠিক?’ চোখ কপালে তুলে বলল হান্না।
‘হ্যাঁ।’
‘তুই কি করে জানলি?’
মুহূর্তের জন্যে দ্বিধায় পড়ে গেল জেন। তারপর বলল, ‘আমি তার ফটো দেখেছিলাম, ট্রিয়েস্টে দেখেই চিনতে পারি।’
‘ট্রিয়েস্টে দেখেছিস, কোথায়?’
‘মটেল সি-কুইনের সামনে তিনিই হত্যা করলেন অধ্যাপক ভিলারোয়ার সাথের লোকটিকে।’
‘ওই লোক আহমদ মুসা?’
একটা ঢোক গিলল হান্না। তারপর আবার বলল, ‘তাই হবে আমিও ভেবেছি, এতগুলো লোকের সামনে এত শান্তভাবে এতগুলো কান্ড ঘটিয়ে গেল যে লোক সে সাধারণ নয়। তাছাড়া মিঃ ভিলারোয়াকে যে লোকটি নিয়ে এসেছিল, সেই তো প্রথম পিস্তল বের করে, কিন্তু ব্যবহার আগে করতে পারেনি। আহমদ মুসা লোকটি কিভাবে কখন পিস্তল বের করল, ব্যবহার করল বোঝাই গেল না।’
আবার থামল হান্না। থেমেই আবার শুরু করল, ‘কিন্তু আহমদ মুসা জোয়ানের সাহায্যে আসবে কেন?’
‘আহমদ মুসা বিপদগ্রস্ত মানুষ, বিপদগ্রস্ত জাতির পাশে দাঁড়ান।’
‘কিন্তু জোয়ান যে বিপদে পড়েছে, সে বিপদ তো দু’চারশ’ লোকের বিরুদ্ধে লড়াই করে দূর করা যাবে না।’
‘আমি এসব কিছুই জানিনা হান্না,কিন্তু মনে হচ্ছে বড় একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’
‘তুই এটা বোঝার পরেও জোয়ানের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছিস কি করে?
‘হয়তো এটাই আমার ভাগ্য।’
‘তুই বুদ্ধিমতী, কিন্তু এই ব্যাপার নিয়ে তুই এত অবুঝ হবি, ভাবতে বিস্ময় লাগছে।’
কেঁদে ফেলল জেন। বলল, ‘ও নিরপরাধ, ওর প্রতি আমার দেশ, আমার জাতি, সরকার সবাই অবিচার করছে। আমি ওকে আঘাত দিতে পারিনি।’
‘জেন, আমি তো সাক্ষী, জোয়ান তোর কাছ থেকে সরে যেতে চেয়েছিল।’
‘সরে যেতে চেয়ে ও প্রমান করেছে ও অসাধারন। কেন আমি প্রমান করব না যে, আমি ওর চেয়ে ছোট নই। থাক এসব কথা হান্না। তুই সব বুঝেও এমন করে বলছিস। জানি তুই আমার ভাল চাস। কিন্তু চরম অবিচারের শিকার হয়ে জোয়ান যদি শেষ হয়ে যায়, আমি বাচঁব না। তার চেয়ে ভাল, যতটুকু পারি ওর পাশে থেকে লড়ব জাতির অবিচারের বিরুদ্ধে। তাতে জীবন যদি আমার যায়, তাতে আমার এই কার্ডিনাল পরিবারের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হবে। মরিসকোদের উপর জুলুম আমার মনে হয় আমার পরিবারের চেয়ে বেশী কোন পরিবার করেনি।’
জেনের দু’চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু খসে পড়ল, নেমে এল গন্ড বেয়ে।
হান্না জড়িয়ে ধরল জেনকে। বলল, ‘হতভাগী বান্ধবী আমার। তোকে আমার চেয়ে কে বেশী বোঝে! আমি যাই মনে করি আমাকে তোর পাশে পাবি।’
‘আমি জানি হান্না।’ হান্নাকে জড়িয়ে ধরে বলল জেন।
দুই বান্ধবীর চোখেই তখন অশ্রু।
ঘরের বাইরে জেনের আম্মার কন্ঠ শোনা গেল, তার সাথে পায়ের শব্দ।
জেন ও হান্না দু’জনেই তাড়াতাড়ি তাদের চোখের পানি মুছে ফেলল।