মন্ট্রেজু থেকে গোরানে হাইওয়ে ধরে পিরেনিজ পর্বতমালার কোলে দাঁড়ানো দক্ষিণ ফ্রান্সের সর্বশেষ শহর। ম্যানোনার দিকে এগিয়ে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি। গাড়িটি ডোনার। মন্ট্রেজু থেকে আসার সময় গাড়িটি ডোনা উপহার দিয়েছে আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা নিতে অস্বীকার করেছিল। বলেছিল স্পেনে যাবার ট্যাক্সি সার্ভিস আছে, অসুবিধা হবে না। উত্তরে ডোনা কিছু বলেনি। তার দু’চোখ ভরে উঠেছিল অশ্রুতে, নেমে এসেছিল দু’গন্ড বেয়ে। ডোনার আব্বা পাশেই দাঁড়িয়েছিল। পক্ককেশ কুটনীতিক চার্লস প্লাতিনি আহমদ মুসার পিট চাপড়ে বলেছিল, আমার একটি মাত্রই মা। বড় একা। তাই বোধহয় বড় জেদি। একটা ভাই পেয়ে ওর কি গর্ব। ওকে প্রত্যাখান করো না।
‘না, আব্বা, থাক। কারো ভাল লাগা, না লাগা, পছন্দ-অপছন্দের উপর জোর খাটানো যায় না আব্বা।’ বলে ডোনা দু’হাতে মুখ ঢেকে ছুটে পালাচ্ছিল।
‘ডোনা, দাঁড়াও। আহমদ মুসা শক্ত কণ্ঠে নির্দেশের সুরে বলেছিল। ডোনা এ নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারেনি। নির্দেশের সাথে সাথে সে দাঁডিয়ে গিয়েছিল। দাঁড়িয়ে থেকেই ধীরে ধীরে সে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। অশ্রুতে তার চোখ ভিজা।
আহমদ মুসা দু’ধাপ সামনে এগিয়ে তার সামনা-সামনি হয়ে বলেছিল, আমার উপর অবিচার করছ ডোনা। উপহার মানুষ যত্নে রাখে। আমার সে জায়গা কোথায়, সময় কোথায়? চীনে তোমারই মত এক বোন তার প্রিয় সাদা রিভলবার আমাকে উপহার দিয়েছিল। আমি তা রাখতে পারিনি। বলকানে এসে তা খুইয়েছি। তোমার গাড়ি আজ নেব, কালকেই হয়তো দেখবো এক ঝাঁক গুলীতে এর দেহ ঝাঝরা হয়েছে, অথবা বোমা মেরে কেউ উড়িয়ে দিয়েছে। অথবা আমার হাত ছাড়াও হতে পারে। তখন আমার কষ্ট লাগবে।’
‘তাহলেও ঐ পিস্তলের মত আমার গাড়ি হবে সৌভাগ্যবান।’
‘ঠিক আছে, তোমারই জয় হলো ডোনা। তোমার এই সহমর্মীতা ও সহযোগীতার জন্যে ধন্যবাদ তোমাকে।’
‘কোথায় আমি কি করলাম? ‘
‘তোমার গাড়ি আমাদের যাত্রাকে অনেক সহজ ও স্বাধীন করবে।’
‘ধন্যবাদ। আমার ভাগ্য, আমার গাড়ি বিশ্ববিখ্যাত আহমদ মুসার সঙ্গ পাবে।’
বলে ছুটে চলে গিয়েছিল ডোনা তার গাড়ির কাছে।
আহমদ মুসার পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়েছিল ওদের কাছে আহমদ মুসা ডোনার বাড়িতে আসার পরেই।
ডোনার আব্বা চার্লস প্লাতিনি তার মা’ অসুস্থতার খবর স্পেন থেকেই পেয়েছিল। পেয়েই স্থল পথে ছুটে এসেছিল মন্ট্রেজু’তে। ডোনা পৌঁছার আগেই তার আব্বা পৌঁছে গিয়েছিল।
ডোনা বাড়িতে পৌঁছে আহমদ মুসাদের ড্রইং রুমে বসিয়ে ছুটে গিয়েছিল ভেতরে। ভেতরে ঢুকে পেয়েছিল তার আব্বাকে। তার আব্বা তখন টেলিফোন করছিল তুলুজে। ডোনাকে দেখে টেলিফোনে রেখে সে লাফিয়ে উঠেছিল। জড়িয়ে ধরেছিল ডোনাকে। বলেছিল, সেই সন্ধ্যায় বেরিয়েছিস তুলুজ থেকে। তোর কোথায় কি হলো ভেবে আমাদের দম বন্ধ হবার যোগাড়। রাস্তায় কিছু হয়েছিল? এত দেরী হলো কেন? কেন রাতে একা বেরিয়েছিলি?’
ডোনা সংক্ষেপে বলেছিল তার কিডন্যাপ হওয়া এবং উদ্ধার পাওয়ার ঘটনা।
শুনতে গিয়ে বার বার কেঁপে উঠেছিল ডোনার আব্বা চার্লস প্লাতিনি। শেষে আহমদ মুসার নাম শুনে চমকে উঠেছিল। বিস্ময়ের সাথে বলেছিল, ঠিক বলছিস ওঁর নাম, উনি আহমদ মুসা বলেছিলেন? ঠিক শুনেছিস তুই?’
‘ঠিক আব্বা। নাম বলতে চাননি, বলেছিলেন, এ.এম। তারপর তার সাথীর ডাক থেকে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। পরে স্বীকার করেন।
থেমেছিল ডোনা একটু, ‘তারপরেই আবার চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে বলেছিল, ওভাবে যে বলছ, চেন নাকি আব্বা তাঁকে?
‘বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম বিপ্লবী আহমদ মুসাকে জানি, তার ফটো দেখেছি। তোমার মুখে যে দুঃসাহসিক কাজ ও যে দুর্লভ চরিত্র বৈশিষ্টের কথা শুনলাম, তাতে ইনিই সেই আহমদ মুসা হবে। আমরা জেনেছি তিনি স্পেন অঞ্চলে এসেছেন।’
আব্বার কথা শুনে ডোনার মুখ থেকে ও বিস্ময় আনন্দ ঠিকরে পড়েছিল। আহমদ মুসার কথা পড়েছে পত্রিকায়। বার বার তাকে নিয়ে আলোচনাও হয়েছ। কেউ তাকে ‘নিউ সালাহ উদ্দিন বলতো, কেউ বলতো সে মুসলমানদের ‘মাওসেতুং’, কারও কাছে সে ছিল স্পেন বিজয়ী ‘তারিক বিন জিয়াদ’ ও ‘মুসা বিন নুসায়ের’-এর নতুন রূপ, কেউ আবার তাকে ডাকতো ‘মুসলিম রবিনহুড’ বলে। আসার পথে ডোনার একবারও কিন্তু এসব কথা খেয়াল হয়নি, একবারও মনে আসেনি এ আহমদ মুসা সে আহমদ মুসাই হতে পারে!
আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিল ডোনা। বলেছিল, ‘ঠিক বলেছ আব্বা, ইনি তিনিই হবেন। এ আহমদ মুসা সে আহমদ মুসা হলেই শুধু সব দিক থেকে মানায়।’
তারপর বাপ-বেটি দুজনেই ছুটে গিয়েছিল তাদের ড্রইং রুমে।
ডোনা ছোট্র চঞ্চলা বালিকার মত ছুটে গিয়ে আহমদ মুসার সামনে গিয়ে বলেছিল, ‘বুঝেছি, আপনার নাম বলতে চাননি কেন? চিনেছি আপনাকে। আপনি সেই আহমদ মুসা।’
একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোককে সাথে নিয়ে ডোনাকে এসে দাঁড়াতে দেখে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু আহমদ মুসা মুখ খোলার আগেই ডোনার আব্বা আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, ওয়েলকাম গ্রেটম্যান, আমি ডোনার আব্বা চার্লস প্লাতিনি।
আহমদ মুসা হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, ‘খুশী হলাম আপনার সাথে দেখা হওয়ায়।
চার্লস প্লাতিনি আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। বলেছিল, ডোনা আমার একমাত্র সন্তান, তাঁকে আপনি নতুন জীবন দিয়েছেন। আমার কৃতজ্ঞতা গ্রহন করুন।
‘জনাব, আমার বা আমাদের কারও কৃতিত্ব নেই আমরাও হাইজ্যাক হয়েছিলাম। নিজেরা বাঁচতে গিয়ে ওকে বাঁচানোর সুযোগ পেয়ে যাই আমরা। প্রশংসা আল্লাহর। তিনিই আমাদের সাহায্য করেছেন।’
‘ধন্যবাদ আপনাকে, গ্রেটম্যানের কথা এরকমই হয়ে থাকে।’
‘লজ্জা দেবেন না, আমি আপনার ছেলের মত। আমাকে ‘তুমি’ বললে খুশি হবো।’
পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আহমদ মুসা ডোনাদের বাড়িতে ছিল। অনেক কথা হয়েছিল ডোনার সাথে, ডোনার আব্বার সাথে।
ডোনার আব্বার সাথে পরিচয় হয়ে উপকৃত হয়েছে আহমদ মুসা। ডোনার আব্বা চার্লস প্লাতিনি প্রবীণ কুটনীতিক। কুটনৈতিক ও গোয়েন্দা সূত্রের অনেক খবর তিনি রাখেন। তিনি আহমদ মুসা কে জানিয়েছিলেন, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান স্পেনে মুসলিম স্থাপনা ও ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্ন গুলোতে যে তেজস্ক্রিয় পেতেছে, তা ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থা অতি সম্প্রতি জানতে পেরেছে এবং স্পেন সরকারকে জানানো হয়েছে। কিন্তু স্পেন সরকার এটাকে ভিত্তিহীন প্রপাগান্ডা বলে অভিহিত করেছে। তাদেরকে বিশ্বাস করাবার মতো কোন ডকুমেন্টও নেই। ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে কেউ-ই ঘাটাতে চায় না বলে ফরাসি গোয়েন্দা বিভাগও এ নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছে না। ডোনার আব্বা আরও একটা মূল্যবান তথ্য আহমদ মুসাকে জানিয়েছিল। সেটা হলো, প্রথমে মুসলিম স্থাপনাগুলোর বিস্তারিত নক্সা তৈরী হয়। সেই নক্সায় বৈজ্ঞানিক পরিমাপ অনুযায়ী তেজস্ক্রিয় সেট করার স্থান নির্দিষ্ট হয়। সেই নক্সা অনুসারে নিখুঁতভাবে তেজস্ক্রিয়গুলো পাতা হয়। এই নক্সা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এর কারও কাছে আছে। সেই নক্সা না পাওয়া গেলে সেই তেজস্ক্রিয় ইউনিটগুলো খুঁজে বের করা অসম্ভব।
আহমদ মুসা বলেছিল, স্থাপনাগুলোর ইট, পাথর, সিমেন্ট, মাটি ইত্যাদি পরীক্ষা করলেই তো তেজস্ক্রিয় ধরা পড়বে, স্পেন সরকারের কাছে এটা কি ডকুমেন্ট হতে পারে না?
ডোনার আব্বা উত্তরে বলেছিল, ‘এক খন্ড কংক্রিট পরীক্ষা করলে ঐ টুকুর মধ্যে যে মাত্রার তেজস্ক্রিয় পাওয়া যায় তা এতই স্বল্প যে, এ থেকে প্রমাণ হয় না অস্বাভাবিক কোন তেজস্ক্রিয় সংক্রমণের ফল এটা এবং এ থেকে আরও প্রমাণ হয় না যে, অব্যাহত তেজস্ক্রিয় সংক্রমন চলছে।’
কথার উপসংহার টানতে গিয়ে ডোনার আব্বা আরও বলেছিলেন, এ নতুন ধরণের এক ভয়ানক যন্ত্র। ইউরোপের দু’একটা ল্যাবরেটরীই হয়তো পারে এর সঠিক প্রকৃতি প্রতিক্রিয়া নিরুপণ করতে। এখানেই হয়েছে মুস্কিল, কেউ ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না।’
আহমদ মুসা এই মূল্যবান তথ্য পেয়ে খুশী হয়েছিল, সেই সাথে ভীষণ হতাশও হয়ে পড়েছিল। চার্লস প্লাতিনি স্বান্তনা দিয়ে বলেছিল, মাদ্রিদে ফরাসি দূতাবাসের দ্বার আহমদ মুসার জন্যে খোলা, যতটা পারে, যতদিক দিয়ে পারে সে তাদেরকে সাহায্য করবে।’
পরদিন সকাল ১০টায় আহমদ মুসা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল।
বিদায়ের সময় চার্লস প্লাতিনি এবং ডোনা দুজনেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল। ডোনার আব্বা আহমদ মুসার সাথে বিদায়ী হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে বলেছিল, ‘যুগের সবদিক থেকে সর্বোৎকৃষ্ট মানুষের সাথে একটা রাতের একটা অংশ আর একটা সকাল কাটাবার সৌভাগ্য আমার হলো। এমন সময় আরও পেলে খুশী হবো। আর ডোনা বলেছিল, ‘আমি আপনাকে বিদায় দিচ্ছি না, বোন ভাইকে বিদায় দেয় না।’ বলেই মাথা নিচু করেছিল ডোনা। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল। একটা ভেঙ্গে পড়া উচ্ছ্বাসে তবু কাঁপছিল তার ঠোঁট।
ডোনার একথাগুলো এবং ডোনার আব্বার অনেক কথা বাজছিল আহমদ মুসার কানে, তার চোখে ভাসছিল ডোনাদের শেষ বিদায়কালীন ছবি। আহমদ মুসা ভাবল, মানুষের মনের মায়া-মমতা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সুন্দরতম নেয়ামত। এই নেয়ামতই মানুষের সমাজকে মানুষের সমাজ রেখেছে।
ড্রাইভিং সিটে ছিল আব্দুর রহমান সপ্তম।
ছুটে চলছিল গাড়ি ডোনাদের মন্ট্রেজুকে পেছনে ফেলে ফ্রান্সের সীমান্ত শহর ম্যানোনার দিকে গেরোনে হাইওয়ে ধরে।
ম্যানোনা যতই কাছে এগিয়ে আসছে, পথ ততই দুর্গম হয়ে উঠছে। গাড়ির গতি কমে আসছে ততই। বেলা একটার দিকে ম্যানোনা অতিক্রম করলো আহমদ মুসার গাড়ি। ম্যানোনা শহর পার হয়ে একটা উপত্যকায় গাড়ি থামিয়ে আহমদ মুসারা নামায পড়ে নিল।
ম্যানোনা থেকে ১০মাইল দূরে ফ্রান্স স্পেন সীমান্ত। সীমান্ত রেখাটি পিরেনিজের উত্তর ঢাল বরাবর। ফরাসী সীমান্ত পুলিশের ফাঁড়িতে নাম লিখিয়ে পাসপোর্ট দেখিয়ে স্পেনে প্রবেশ করতে হয়। স্পেন পুলিশের সীমান্ত ফাঁড়িতেও এ ধরণের একটা ব্যবস্থা। এসব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে কোনই অসুবিধা হয়নি আহমদ মুসাদের। যাবার সময়ই আহমদ মুসার পাকা কাগজ-পত্র তৈরী হয়েছিল। স্পেনের নাগরিক হিসেবে পাসপোর্ট করা হয়েছিল আহমদ মুসার।
সীমান্ত ফাঁড়ির ঝামেলা চুকানোর পর আবার যাত্রা শুরু হলো আহমদ মুসাদের। এবার পথ আরও দুর্গম। পিরেনিজের একদম বুকের উপর দিয়ে চলছে এখন তারা। ভেল্লা পর্যন্ত পথ এ রকমই। ভেল্লা এখনও পনের মেইল দূরে।
ভেল্লা ছোট্ট একটি পার্বত্য শহর। উত্তরে স্পেনের সর্বশেষ শহর এটি। বাসক এলাকার মধ্যে পড়েছে এ অঞ্চলটি।
বেলা ৪টার দিকে। আহমদ মুসারা ভেল্লা শহরে প্রবেশ করল। আহমদ মুসারা ঠিক করেছে শহরে নাস্তা সেরে নামায পড়ে তারা আবার যাত্রা শুরু করবে মাদ্রিদের পথে। ভেল্লা থেকে মেইল দশেক পশ্চিমে পাহাড় ঘেরা একটা উপত্যকায় আব্দুর রহমান সপ্তমের বাড়ি। যাওয়ার পথে আহমদ মুসা আব্দুর রহমান সপ্তমের বাড়িতে গিয়েছিল। এক রাত সেখানে থেকেছিল। এবার আর সে রকম কোন প্রোগ্রাম নেই। আহমদ মুসা যতটা সম্ভব দ্রুত মাদ্রিদ পৌঁছুতে চায়।
নাস্তা ও নামায সেরে আবার যাত্রা শুরু করেছিল আহমদ মুসারা। আগের মতই ড্রাইভিং সিটে আবদুর রহমান সপ্তম।
একটা হাসপাতলের পাশ দিয়ে এগুচ্ছিল গাড়ি। হঠাৎ আবদুর রহমান সপ্তম ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দরজা খুলে হাঁক দিলঃ আবুল হাসান।
কয়েক মুহূর্ত পরেই এক যুবক এসে দাঁড়াল আবদুর রহমান সপ্তমের সামনে।
‘আম্মা অসুস্থ, আমি ওষুধ নিতে এসেছি।’ এসে দাড়িয়েই যুবকটি বলল।
আহমদ মুসা যুবকটিকে চিনতে পারল। আবদুর রহমান সপ্তমের ছোট ভাই সে।
কি অসুখ? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল আবদুর রহমান সপ্তম।
‘বুঝা যাচ্ছে না। ডাক্তার দেখেছেন। ওষুধ নিতে এসেছিলাম।’
আবদুর রহমান সপ্তম তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল আবদুর রহমান সপ্তমের মনের কথা। বলল আবদুর রহমান গাড়ি ঘুরাও। ওঁকে না দেখে যাওয়া যায় না।
‘ধন্যবাদ মুসা ভাই। বলে আবদুর রহমান আবুল হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল,’ গাড়ি এনেছ?’
‘হ্যাঁ’। বলল আবুল হাসান।
‘যাও, গাড়ি নাও, চল যাই।’
আবুল হাসান এগিয়ে গেল কার পার্কিং এর দিকে।
এবার গাড়ি চলতে শুরু করল। আবদুর রহমান সপ্তমের বাড়ির দিকে। আগে আহমদ মুসাদের গাড়ি। পেছনে আবুল হাসানের গাড়ি।
‘আবদুর রহমান সপ্তমের বাড়ি কোথায় কতদূর?’ বলল জোয়ান।
‘নিউ ভ্যালেনসিয়া, মাইল দশেক পশ্চিমে।’
নিউ ভ্যালেনসিয়া একটা সমৃব্ধ উপত্যকা। চারদিকে পাহাড়ের দেয়াল।
উপত্যকায় প্রবেশের একটাই পথ, উত্তর দিকের একটি মাত্র গিরি পথ। বেশ প্রসস্ত। এটাই উপত্যকায় প্রবেশের দরওয়াজা।
উপত্যকায় উর্বর মাটিতে প্রচুর ফল ও ফসল উৎপাদিত হয়। বাসিন্দারা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে প্রচুর পরিমানে বাইরে বিক্রি করতে পারে।
উপত্যকায় প্রায় ৫’শ বাসক ও মুসলিম পরিবার বাস করে। জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজারের মত। এর প্রায় সবাই মুসলমান। এদের অনেকে দক্ষিণ ও স্পেন থেকে পালিয়ে আসা তবে বেশির ভাগই ধর্মান্তরিত। বাসক সম্প্রদায়ের প্রচুর পরিবার খৃষ্ট ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। জনশ্রুতি আছে ষোড়শ শতকের শুরুতেই এক দরবেশ নানা স্থান ঘুরে তার স্ত্রৗ সহ এসে এই উপত্যকায় আস্তানা গেড়েছিলেন। স্থায়ী জনপদ তখন এ উপত্যকায় গড়ে উঠেনি। সে পবিত্র দরবেশকে ঘিরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল স্থায়ী জনপদ। সে দরবেশ জ্ঞানে ছিলেন সবজান্তা সুপন্ডিত, চরিত্রে ছিলেন ফেরেশতা তুল্য। মানুষ তাকে ভক্তি, শ্রদ্ধা দিয়ে মাথায় রাখতো, কিন্তু তিনি নিজেকে মনে করতেন মানুষের এক নগন্য সেবক। যেখানে মানুষের বিপদ সেখানেই তিনি। প্রতিটি দুঃখী ও অসুস্থ মানুষ নিশ্চিন্ত থাকতো, তাদের পাশে সাহায্যের হাত নিয়ে, চিকিৎসকের সেবা নিয়ে পবিত্র দরবেশ আবদুর রহমান আসবেনই। তার চরিত্রে ইসলামের রুপ-মাধুর্য দেখে শুধু এই উপত্যকার নয়, আশে পাশের শত শত পরিবার ইসলাম গ্রহণ করে। আবদুর রহমান সপ্তমরা সেই দরবেশ আবদুর রহমানেরই বংশধর। উপত্যকার একটি সুন্দর সবুজ টিলায় তাদের বাড়ি। উপত্যকায় প্রবেশ করলেই দেখা যায় সুন্দর টিলাটি, তার আগে দেখা যায় টিলায় অবস্থিত মসজিদের সুউচ্চ মিনার।
আহমদ মুসাদের গাড়ি উপত্যকায় প্রবেশ করল, আযান ধ্বনিত হচ্ছিল সে মিনার থেকে। আযানের ধ্বনি সেই কেঁপে কেঁপে ছড়িয়ে পড়ছিল সমগ্র উপত্যকায়, প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল পাহাড়ের বুকে।
সবে সূর্য ডুবেছে। কিন্তু পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় তখন অন্ধকার। উপত্যকার সবুজ আর সন্ধ্যার কালো একসাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
অন্ধকার জড়িত নিঃশব্দ এই পরিবেশে মধুর আযানের ধ্বনি প্রতিধ্বনি অপরুপ লাগছিল আহমদ মুসার কাছে। সমগ্র সত্তা দিয়ে উপভোগ করছিল আহমদ মুসা সেই আযান।
‘এই আযান বাসক এলাকা ছাড়া স্পেনের আর কোথাও পাবেন না মুসা ভাই।’ বলল আবদুর রহমান সপ্তম।
‘এমন পরিবেশ হৃদয় আকুল করা এমন আযান জীবনে আর একবার শুনেছিলাম মধ্য এশিয়ায় উজবেকিস্তানের একটা গ্রামে। এ মসজিদটি কোথায়, কতদূরে আবদুর রহমান?’
‘আমাদের বাড়ির সামনে মুসা ভাই। চলুন নামায আমরা ধরতে পারবো।’
আবদুর রহমান সপ্তমদের সুন্দর বিশাল বাড়িটির সামনে ছোট একটা চত্তর, তারপরেই মসজিদ। বিশাল মসজিদ। প্রথমে মসজিদটি ছিল বেড়ার। দরবেশ আবদুর রহমানের সময়েই জনগণ পাহাড় থেকে পাথর বয়ে এনে মসজিদ তৈরী করেছে। পরে আরও সম্প্রসারণ হয়েছে মসজিদটির।
মসজিদটি দেখে চমৎকৃত হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ইতিহাসে পড়েছিল, মুসলিম সেনাপতি মুসা বিন নুসায়ের পিরেনিজ পর্বতে উঠেছিলেন, কিন্তু ফিরে যেতে হয়েছিল তাঁকে। সেই সাথে ইসলামও এখানে থেকে পশ্চাতপসরণ করেছিল, ইতিহাস এটাই বলে। কিন্তু ইতিহাস জানে না, পিরেনিজ এর বুকে এ রকম সুন্দর মসজিদ আছে, এ রকম সুন্দর সমৃদ্ধ মুসলিম জনপদ লুকিয়ে আছে। ইতিহাস শুধু রাজা-বাদশাহদের কথাই লিখে, লিখে না দরবেশ আবদুর রহমানদের কথা। লিখে না বলেই জানে না ইতিহাসের পরেও ইতিহাস আছে।
মাগরিবের জামায়াতের নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল আহমদ মুসাকেই।
নামায শেষে আবদুর রহমান সপ্তম শুধু নামটা গোপন রেখে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আহমদ মুসাকে। সকলের অনুরোধে ছোট-খাট বক্তৃতাও দিতে হয়েছিল আহমদ মুসাকে বিশ্বে মুসলমানদের বর্তমান অবস্থার উপর। উপসংহারে আহমদ মুসা একজন মহান ব্যক্তির কথা উদ্বৃত করে বলেছিল, ‘ইসলাম জিন্দা হয় প্রত্যেক কারবালার পর। কয়েক শতাব্দীর এক ভয়াবহ কারবালা মুসলমানদের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। এবার তাদের উত্থানের পালা। এই জাগরণের গান শোনা যাচ্ছে চারদিকে। সামনের অন্ধকারের ওপারে সোবহে সাদেকের সফেদ আলোকছটা দেখা যাচ্ছে। মুক্তি আমাদের সুনিশ্চিত।’
নামায শেষে সকলের সাথে সালাম-মোহসাফা শেষ করে আহমদ মুসা আবুল হাসানের সাথে এল আবদুর রহমান সপ্তমের বাড়িতে। আবদুর রহমান সপ্তম আগেই চলে এসেছিল তার মায়ের কাছে।
বাড়িতে ঢোকার পথে দরজার উপরে কাঠের ফলকে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা ‘দারুল হিকমাহ’। তার নিচে আরবৗ অক্ষরে একই কথা লেখা আছে। আহমদ মুসা, জোয়ান সবাই এ লেখাটা পড়ল। বুঝল এটা বাড়ির নাম।
প্রবেশ করল বৈঠক খানায়।
বিরাট বৈঠকখানা।
ঘরের চারদিকে সাজানো সোফা। একসাথে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন লোক বসতে পারে।
আবদুর রহমান সপ্তমের বাড়ি শুধু এই উপত্যকায় নয় গোটা এই অঞ্চলের মিলন ক্ষেত্র। যত শালিস-দরবার সব এখানেই হয়। উত্তরাধীকার সূত্রে আবদুর রহমান সপ্তম এই এলাকার সর্দার। তবে আবদুর রহমান বাসক গেরিলা বাহিনীর দায়িত্বশীল পদে উন্নীত হবার পর তার ভাই আবুল হাসান তার পক্ষ থেকে সরদারীর দায়িত্ব পালন করে।
আহমদ মুসা ঘরে প্রবেশ করেই দেখল টেবিলে শরবত রাখা হচ্ছে। আঙুরের শরবত।
আবুল হাসান আহমদ মুসাদের শরবত পান করিয়ে ভেতরে চলে গেল।
আহমদ মুসা ও জোয়ান যেখানে বসেছিল সেখান থেকে সোজা ওপাশের দেয়ালে হাতে আঁকা পাশা-পাশি দু’টি ছবি। একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোকের আর অন্যটি একটি বালকের।
ছবি দু’টি চোখে পড়ল জোয়ানের। ভাবল সে, নিশ্চয় বৃদ্ধের ছবিটি দরবেশ আবদুর রহমানের, আর বালকটি নিশ্চয় আবদুর রহমান সপ্তম হবে।
কৌতুহল হলো জোয়ানের। লোকটির চেহারার সাথে আবদুর রহমানের চেহারা মিলছেনা। আরও ভাল করে দেখার জন্যে জোয়ান উঠে গিয়ে ছবি দু’টির সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর পর ছবির নিচের লেখাগুলো জোয়ানের কাছে স্পষ্ট হলো।
প্রথমে চোখ পড়ল বৃদ্ধের ছবির নিচে লেখাগুলোর দিকে।
পড়ল জোয়ান -“নাম আব্দুর রাহমান। জন্ম পূর্ব স্পেনের ভালেন্সিয়ার ১৪৫৫সালে। ভালেন্সিয়ার দারুন হিকমার তিনি অধ্যক্ষ ছিলেন। বিজ্ঞানের উপর অনেক গ্রন্থের তিনি প্রণেতা। সব মুসলিমদের সাথে তাকেও উচ্ছেদ করা হয় ভালেন্সিয়া থেকে ১৫০৩ সালে। তিনি ইন্তেকাল করেন ১৫৩০ সালে। তিনি হক্কুল্লাহ ও হক্কুল এবাদ প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করেন। আল্লাহ তার বেহেস্ত নসিব করুন”।
পড়তে পড়তে হৃদয়টা কেঁপে উঠল জোয়ানের। মনে পড়ল তার পূর্ব পুরুষ আবদুল্লাহ বিন আব্দুর রাহমান খাতার কথা, খাতায় লেখা স্মৃতি কথার বিষয় গুলো। তার পূর্ব পুরুষ আবদুল্লাহর পিতার নামও তো ছিল আব্দুর রাহমান। তিনি দারুল হিকমার অধ্যক্ষ ছিলেন। ভালেন্সিয়া থেকে তিনিও উচ্ছেদ হয়েছিলেন। ঐ সময়েই।
কম্পিত হৃদয় নিয়ে জোয়ান গিয়ে দাঁড়াল বালকটির ছবির নিচে। বালকটির ছবির নিচে একটা কবিতা। চার লাইনের কবিতার সার কথা হলঃ “বালকটি দশ বছরের আবুদুল্লাহ বিন আব্দুর রাহমান। সেদিন ভালেন্সিয়ায় রাজা ফিলিপ্সের নিষ্ঠুর সৈন্যরা ক্রন্দনরত বালকটিকে কেড়ে নিয়েছিল ক্রন্দনরত মায়ের বুক থেকে, পিতার কাছ থেকে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া বালকটির নেগাহবান আর কেও ছিল না।“
পড়া শেষ করার আগেই জোয়ানের গোটা সত্তা জুড়ে নেমে এল দুর্বোধ্য এক অবসন্নতা। এই উপত্যকার নাম “নিউ ভালেন্সিয়া, এই বাড়ির নাম ‘দারুল হিকমা’ কেন তা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। মনে হল এ নামগুলো, এই ছবিগুলো তারই জন্য অপেক্ষা করছিল। আব্দুর রাহমান সপ্তম-এর অর্থ তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেল। সেই মহান আব্দুর রাহমানের সপ্তমের অধস্তন পুরুষ এই আব্দুর রাহমান।
মনে হল। এই “সপ্তম” শব্দটাও যেন তারই জন্য এক সংকেত। তার পূর্ব পুরুষ হতভাগ্য আবদুল্লাহ বছরের পর বছর দেশ-দেশান্তর ঘুরে যার দেখা পাননি, আমি আজ তার ঠিকানায়। আর চিন্তা করতে পারল না জোয়ান। সেই আচ্ছন্নতা গাড় অন্ধকার হয়ে ঘিরে ধরল তাকে। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল সে মেঝের উপর।
ছুটে গেল আহমদ মুসা।
কোলে তুলে নিল জোয়ানকে।
অজ্ঞান জোয়ানকে যখন সোফায় শুইয়ে দিচ্ছে আহমদ মুসা, আব্দুর রাহমান সপ্তম এবং আবুল হাসান তখন ঘরে ঢুকল। জোয়ানকে ঐভাবে দেখে তাদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।
দ্রুত এগিয়ে এল তারা আহমদ মুসার কাছে।
“কি ব্যাপার, জোয়ানের কি হয়েছে মুসা ভাই?” জিজ্ঞাসা করল আব্দুর রাহমান সপ্তম।
জোয়ানকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে আহমদ মুসা বলল, দেয়ালের ঐ ছবি দুটো দেখতে গেয়েছিল জোয়ান। ছবি দেখতে দেখতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছে জোয়ান। বলে আহমদ মুসা জোয়ানের একটি হাত তুলে নিল।
“ডাক্তার ডাকব মুসা ভাই”?
“না, দরকার নেই। এখনি ওর জ্ঞান ফিরে আসবে।“
বলে আহমদ মুসা জোয়ানের জুতা খুলে ওর পায়ের তালুর বিশেষ কিছু জায়গায় বিশেষ নিয়মে খোঁচা দিতে লাগল।
“আব্দুর রাহমান, ঐ ছবি দুটো কার”? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
ছবি দুটির পরিচয় দিল আব্দুর রাহমান। তারপর বলল, “ছবি দুটো দেখেই কি জোয়ান….।
“তা বলতে পারব না আব্দুর রাহমান। তবে ছবি দেখার সময় তাকে স্বাভাবিক মনে হয় নি।
মিনিট তিনেক পার হল।
আহমদ মুসা জোয়ান এর পায়ে সেই খোঁচা দিয়েই চলেছিল।
নড়ে উঠল জোয়ান। ধীরে ধীরে চোখ মেলল সে। চোখ মেলেই তড়িঘড়ি উঠে বসল।
সামনেই দাড়িয়ে আব্দুর রাহমান সপ্তম। জোয়ান উঠে দাড়িয়ে “আমার ভাই” বলে জড়িয়ে ধরল আব্দুর রাহমানকে। বলল, “পিরেনিজের বুকে এইভাবে আমাদের দেখা হবে কে জানত”। আবেগে ভারি হয়ে উঠল জোয়ানের কণ্ঠ।
আব্দুর রাহমান সপ্তম কিছু বুঝতে না পেরে বিব্রত বোধ করছিল। আব্দুর রাহমানের ন’বছরের মেয়ে বৈঠক খানায় ঢুকেছিল সেও হ্যাঁ করে দেখছে ব্যাপারটা।
জোয়ান আব্দুর রাহমান সপ্তমকে ছেড়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, “মুসা ভাই আমার পূর্ব পুরুষ যা খুঁজে পায়নি, আমি তা পেয়েছি, এ বড় আনন্দের। কিন্তু এ আনন্দে হাসা যায় না, কান্না পায়।“
জোয়ান ভারি কণ্ঠে যখন এ কথা গুলো বলছিল, অশ্রু ঝরছিল তখন জোয়ানের চোখ দিয়ে।
আব্দুর রাহমান এগিয়ে এসে জোয়ানের পিঠ হাতে রেখে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা ভাই, খুলে বলুন।
জোয়ান ঘুরে দাঁড়াল। অশ্রুতে ভেজা জোয়ানের চোখ।
কোন কথা না বলে জোয়ান আব্দুর রাহমান সপ্তমের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বৃদ্ধের ছবির কাছে। বলল, “ভালেন্সিয়ার দারুল হিকমার অধ্যক্ষ এই আব্দুর রাহমান কে আপনার?”
“আমার পূর্ব পুরুষ, নিউ ভালেন্সিয়ার এই উপত্যকায় তিনি এসে বসতি স্থাপন করেন,”। বলল আব্দুর রাহমান।
জোয়ান গিয়ে দাঁড়াল বালকের ছবির নিচে। বলল, আর এ হতভাগ্য বালক হল আমার পূর্ব পুরুষ যাকে ফিলিপের সৈন্যরা ছিনিয়ে এনেছিল পিতা-মাতার বুক থেকে, যাকে মর্মস্থুদ এক দাস জীবনযাপন করতে হয়েছে খ্রিষ্টান পরিবারে।
“জোয়ান” বলে চিৎকার করে আব্দুর রাহমান সপ্তম জড়িয়ে ধরল জোয়ানকে। এবার আব্দুর রাহমান সপ্তমের চোখ ফেটে বেরিয়ে এসেছে অশ্রু।
পাশে মূর্তির মত দাড়িয়ে আছে আবুল হাসান।
আব্দুর রাহমান জোয়ানকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে চলে গেল ভিতরে। আবুল হাসানও। সেই ন’বছরের মেয়েটিও।
জোয়ান ফিরে এল সোফায়।
বসল আহমদ মুসার পাশে।
আহমদ মুসাও এই মিলন দৃশ্যে অনেকটা নির্বাক হয়ে গিয়েছিল।
প্রথমবারের মত মুখ খুলে বলল, এই মিলন আমার কাছে রূপ কথার চেয়েও অপরূপ লাগছে জোয়ান। স্পেনে মুসলমানদের বিপর্যয় বিচ্ছিন্ন একটি বংশের দুটি ধারার শত শত বছর পর এই মিলন অকল্পনীয়। আল্লাহর হাজার শুকরিয়া।“
কিছুক্ষণ পরে বৈঠকে খানায় ফিরে এল আব্দুর রাহমান সপ্তম। বলল, না বলেই চলে গিয়েছিলাম, মাফ করবেন মুসা ভাই। নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম হারানো মানিকের সন্ধান পেয়ে। আমরা কল্পনাও করতে পারি না মুসা ভাই, আমার পূর্ব পুরুষ দরবেশ আব্দুর রাহমান খ্রিস্টান এর ছদ্মবেশ নিয়ে ভালেন্সিয়ায় কত দিন কত রাত যে খুঁজে বেড়িয়েছে তার হৃদয়ের ধন ঐ বালককে! সন্ধান তিনি পাননি, সেই পাওয়া আজ আমরা পেলাম।
আব্দুর রাহমান সপ্তম চোখ মুছল। বলল, চলুন মুসা ভাই, চল জোয়ান, খাবার রেডি। আম্মা এবং পরিবারের সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে জোয়ানের কথা শোনার জন্য, কিন্তু তার আগে খাওয়া।
খাবার ব্যবস্থা হয়েছিল পারিবারিক ডাইনিং রুমে। খাওয়া শেষে আহমদ মুসা ও জোয়ানকে এনে বসানো হল পারিবারিক ড্রইং রুমে। ড্রয়িং রুমের পাশেই একটা ঘরে বসেছে আব্দুর রাহমান সপ্তমের পরিবারের মেয়েরা।
ড্রয়িং রুমে আহমদ মুসা ছাড়াও রয়েছে আব্দুর রাহমান সপ্তমের ন’বছরের মেয়ে ৫ বছরের একটি ছেলে, আবুল হাসান এবং তারও পাঁচ বছরের একটি ছেলে, আব্দুর রাহমান সপ্তম ভিতরে ছিল।
অল্পক্ষণ পর সে ড্রয়িং রুমে এসে প্রবেশ করল। বলল, আমার আম্মা, আমার স্ত্রী ও আবুল হাসানের স্ত্রী এবং আমাদের দুই বোন আহমদ মুসা ভাই ও জোয়ানকে সালাম দিয়েছেন।
সালাম বিনিময় পর আব্দুর রাহমান সপ্তম বলল, আল্লাহর হাজার শুকরিয়া যে শত শত বছরের বিচ্ছিন্নতার পর আমাদের বংশের দুটি ধারার আল্লাহ মিলন ঘটিয়েছেন। আমাদের পরিচয় হয়েছে, জানাজানি হয়নি। আমাদের সবার মন আকুল বিকুল করেছে এই জানার জন্য, আমি ভাই জোয়ানকে অনুরোধ করছি, কিছু কথা বলার জন্য। পরিবারের সবাই এ কথাগুলো শুনতে চায় এ জন্য এই ব্যবস্থা।
জোয়ান শুরু করল-আমার নাম জোয়ান ফারদিনান্দ। এই নামেই আমি বড় হয়েছি, এই নামই আমার পরিবারে, এই নামেই আমার লেখাপড়া, পরিচয়, সবকিছু। আমার পিতার নাম জন সেমেনিজ। বাড়ির কেও কোনদিন গীর্জায় যায়নি, আমাদের বাড়িতে বাইবেল নেই, কিন্তু আমরা খ্রিষ্টান ছিলাম। নিজেকে আমি খ্রিস্টান মনে করতাম। আমি মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয় এর ভাল ছাত্রদের একজন ছিলাম। সব পরীক্ষায় সব সময় প্রথম স্থানে থেকেছি। আমার জীবনের মোড় পরিবর্তন ঘটল আমার অনার্স পরীক্ষার রেজাল্টের দিন। প্রথমবারের মত প্রথম স্থান থেকে দ্বিতীয় স্থানে নেমে গেলাম। সেই দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে শুনলাম আমি মরিসকো, আমি ছদ্মবেশী মুসলমান। আমার এ পরিচয়ের কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম, পরিচয়টা আমার কাছে আমার জন্যে মৃত্যুর পরোয়ানার মত ছিল। আমি ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েছিলাম। পাগলের মত ছুটে এসেছিলাম বাড়িতে। আব্বা মারা গেছেন অনেক আগে। চাইছিলাম, আম্মা বলুন আমি মরিসকো নই, আমি ছদ্মবেশী মুসলমান নই, আমি খৃস্টান। না হলে যে আমার ২২ বছরের সাজানো জীবন মিথ্যা হয়ে যাবে। কিন্তু আম্মার কাছে, দাদির কাছে যা শুনলাম তা আমার উদ্বেগ-আতংককে আরও বাড়িয়ে দিল। তাঁরা বললেন, তাঁরা দু’জন মরিসকো, কিন্তু আমার আব্বা, আমার দাদা মরিসকো ছিলেন কিনা তা তারা জানেন না। আমার তখন মনে হলো আমার আব্বা, আমার দাদা নিশ্চয় মরিসকো ছিলেন। না হলে তারা মরিসকোকে বিয়ে করেছেন কেন। আমার ঘরে ফিরে আমি ভীষণভাবে কাঁদলাম। দুপুরে কিছু খেলাম না। গোটা দুনিয়া আমার কাছে বিষাদ হয়ে গেল। মনে হলো, আমার মরা আর বাঁচার মধ্যে আজ আর কোন পার্থক্য নেই। বিকেলে মা এলেন আমার ঘরে। তিনিও কাঁদছিলেন। তিনি আমার হাতে একটা কাঠের বাক্স তুলে দিয়ে বললেন, বেটা, এই বাক্স তোমার আব্বা তাঁর মৃত্যুকালে আমার কাছে আমানত রেখে গিয়েছিলেন। কথা ছিল, যেদিন তোমার বয়স বাইশ বছর পূর্ণ হবে, সেদিন যেন এই বাক্স তোমার হাতে তুলে দেই। বাক্সে কি আছে আমি জানি না।
বাক্স আমার হাতে তুলে দিয়ে আম্মা চলে গিয়েছিলেন। আমি পাগলের মত বাক্স খুলে ফেলেছিলাম। পেয়েছিলাম আমার কাছে লেখা আব্বার একটা চিঠি এবং একটি খাতা। চিঠির খামে লেখা ছিল ‘মুসা আবদুল্লাহ ওরফে জোয়ান ফার্ডিনান্ড’। এই প্রথম জানলাম আমি জোয়ান ফার্ডিনান্ড নই, আমি মুসা আবদুল্লাহ। আব্বার চিঠি পড়লাম। মূল কথাটা যা তিনি লিখেছেন, তা হলো- এই চিঠির সাথে চামড়া বাঁধানো যে খাতা পাবে, তা আমি পেয়েছিলাম এমনি বাক্সে করে আমার আব্বার কাছ থেকে। আমার আব্বা পেয়েছিলেন তার আব্বার কাছ থেকে। ছয় পুরুষ ধরে এই বাক্স এমনিভাবে আসছে। সপ্তম পুরুষ হিসেবে তোমার জন্যে বংশের এই পবিত্র আমানত আমি রেখে গেলাম।’
বংশের পবিত্র আমানত খাতা খানি আমি পড়লাম। ওটা ছিল আপনাদের বৈঠক খানায় যার ছবি টাঙানো আছে সেই বালক আবদুল্লাহ বিন আবদুর রহমানের আত্মকথা।’
জোয়ান সেই আত্মকথা ধীরে ধীরে বর্ণনা করলো। কেমন করে তাকে পিতা-মাতার কোল থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল, কি করে খৃস্টান শহর কোতোয়ালের বাড়িতে তার দাসজীবন শুরু হয়েছিল, কি মর্মন্তুদ নির্যাতন সেই বালকের উপর নেমে এসেছিল, কি শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের মধ্যে সে বড় হয়ে উঠল, কি করে অবশেষে মুক্তি পেল, কি করে খৃস্টানের ছদ্মবেশে তার জীবন শুরু হলো, কেন তাকে শেষে পালিয়ে আসতে হলো মাদ্রিদে, কিভাবে শুরু হলো মাদ্রিদে তার ছদ্মবেশী খৃস্টান জীবন- সব কথাই জোয়ান একে একে বর্ণনা করল। বলতে বলতে বারবার কান্নায় জড়িয়ে গিয়েছিল জোয়ানের কথা। আবদুর রহমান সপ্তম, আবুল হাসান দু’জনেই কেঁদে ফেলেছিল শুনতে শুনতে। আহমদ মুসারও চোখ শুকনা ছিল না। সে আগে শুনেছিল, কিন্তু এতটা শুনেনি।
জোয়ান থামার পর অনেকক্ষণ কেউ কথা বলল না।
আবদুর রহমান সপ্তমের ৫ বছরের ছেলেটি ভেতর থেকে এসে তার আব্বার কানে কানে বলল, দাদি কাঁদছে।
আবদুর রহমান সপ্তম তার মুখ চাপা দিয়ে বলল, বেটা, তুমি যাও দাদির কাছে। তাঁর কোলে গিয়ে বস।
চলে গেল ছেলেটি।
আবদুর রহমান সপ্তম ধীরে ধীরে বলল, আল্লাহর হাজার শোকর, পূর্ব পুরুষরা এ কথাগুলো রেখে না গেলে অতীত শুধু আমাদের হারিয়ে যেত না, হারাতাম আমরা ভবিষ্যতও।
‘ঠিক বলেছেন ভাই জান, পূর্ব পুরুষ আবদুল্লাহ বিন আবদুর রহমানের স্মৃতি কথা পড়ার পর আমি আমার অতীতকে নিয়ে গর্ব করতে শিখেছি, নিজের পরিচয়কে ভালবাসতে শিখেছি এবং জাতির প্রতিও ভালবাসা সৃষ্টি হয়েছে।’ বলল জোয়ান।
‘আমাদের পূর্ব পুরুষ দরবেশ আবদুর রহমান কোন স্মৃতি কথা রেখে যাননি। রেখে গেছেন একটা ডাইরী। সেটা ঘটনার একটা দিনপঞ্জী। জাহাজ যোগে যাত্রা শুরুর পর কিভাবে ভূমধ্যসাগরের মেজর্কাদ্বীপে পৌঁছলেন, কি করে জাহাজ লুন্ঠিত হলো, কিভাবে তারা ফ্রান্সের ভেনড্রেস বন্দরে পৌঁছলেন, কিভাবে সেখান থেকে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হলো পিরেনিজের পার্বত্য অঞ্চলের দিকে, কিভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে, গাছের ফল-মূল খেয়ে বেঁচে থেকে অবশেষে একদিন এই উপত্যকায় পৌঁছলেন। প্রতিদিনের ঘটনাই সে ডাইরীতে লিখিত আছে। সে এক হৃদয় বিদারক উপন্যাস। ডাইরীটার আমরা কপি করিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছি। একটা কপি ভাই জোয়ান তোমাকে দেব।’
থামল আবদুর রহমান সপ্তম।
জোয়ান বলল, ‘খুব খুশি হবো। আমার পূর্ব পুরুষ আবদুর রহমানের সন্তান আবদুল্লাহর স্মৃতি কথায় পড়েছি, তিনি তাঁর পিতার সন্ধানে মেজর্কা গেছেন, পিরেনিজের উত্তর পাদদেশেও ঘুরে বেরিয়েছেন দিনের পর দিন। সন্ধান পাননি তার পিতার। আমি খুশী হবো জানতে পারলে সেই কাহিনী, যা আমার পূর্ব পুরুষ জানতে পারেননি।’
‘জোয়ান ভাই, দরবেশ আবদুর রহমানও তার সন্তানকে খুঁজতে গেছেন ভ্যালেনসিয়া পর্যন্ত। একবার নয়, কয়েকবার। কিন্তু পাননি সন্ধান। সে সব কথাও তাঁর ডাইরীতে আছে।’ বলল আবদুর রহমান সপ্তম।
গভীর রাত পর্যন্ত চলল তাদের কথাবার্তা। ছোট ছেলেমেয়েরা সবাই সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেদিকে কারও খেয়াল ছিল না।
অবশেষে আবদুর রহমান সপ্তমের অসুস্থ মা ওপার থেকে বলেছিল, বেটা আবদুর রহমান, দীর্ঘ পথ তোমরা সফর করে এসেছ। সবাই তোমরা ক্লান্ত। মেহমানদের আর কষ্ট দিও না। ওঁদের শুইয়ে দাও। কালকে কথা বলা যাবে।
রাতে শোবার সময় আহমদ মুসা আবদুর রহমানকে বলল, আবদুর রহমান সপ্তম এবং আবদুল্লাহ সপ্তম, দুই সপ্তমে কাটাকাটি করলে দুই সপ্তমও শেষ হয়। সুতরাং আর সপ্তমের দরকার নেই। যে কারণে গুণাগুণি সেই প্রয়োজন শেষ।
‘ঠিকই বলেছেন মুসা ভাই, আর প্রয়োজন নেই।’ বলল আবদুর রহমান।
আহমদ মুসাদের শুইয়ে দিয়ে আবদুর রহমান চলে যাচ্ছিল। তাকে লক্ষ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘আব্দুর রহমান আমরা সকালেই কিন্তু চলে যাব, কিছুতেই দেরী করা যাবে না।’
আবদুর রহমান মাথা নেড়ে চলে গেল।
পরদিন সকাল ৮টা।
আহমদ মুসা এসে গাড়িতে উঠেছে। জোয়ান তখনও আসেনি। বিদায় নিতে গেছে আবদুর রহমানের মা’র কাছে। সকালেই আরেক দফা কথা হয়েছে জোয়ানের সাথে আবদুর রহমানের মা’র। ফজরের নামাযের পর আবদুর রহমান জোয়ানকে নিয়ে গিয়েছিল অন্দর মহলে বাড়ি-ঘর এবং অন্যান্য সব স্মৃতি চিহ্ন দেখাবার জন্যে। জোয়ান ঘুরে ঘুরে গোটা বাড়ি দেখেছে।
আবদুর রহমানের মা জোয়ানকে বলেছে, জোয়ান বেটা, দরবেশ আবদুর রহমানের সম্পত্তির তুমিও অংশীদার। এ বাড়িতে তোমারও ভাগ আছে। আজ থেকে তুমিও এ বাড়ির একজন!
শুনে কেঁদে ফেলেছে জোয়ান। বলেছে, মা, আপনাদের পেয়েছি এর চেয়ে বড় সম্পত্তি আর নেই। তবু আবদুর রহমানের মা কথা আদায় করেছে যে, সে তার মা’র দেয়া প্রস্তাব প্রত্যাখান করবে না।
সোয়া আটটার দিকে ফিরে এল জোয়ান ও আবদুর রহমান। জোয়ানের মুখ ভারি, চোখ ভেজা।
পেছনে বাড়ির দরজায় মেয়েরা দাঁড়িয়ে তাদের বিদায় দেয়ার জন্যে।
গাড়িতে চড়ল জোয়ান ও আবদুর রহমান।
আহমদ মুসা আগেই ড্রাইভিং সিটে উঠে বসেছিল।
গাড়ি স্টার্ট নিল। চলতে শুরু করল গাড়ি। জোয়ান ও আবদুর রহমান দু’জনেই পেছন ফিরে দেখল বিদায় দিতে আসা আপনজনদের। বাড়ির মেয়ে ও শিশু-কিশোর হাত নেড়ে বিদায় জানাল তাদের। আহমদ মুসা তার গাড়ির রিয়ার ভিউ-এ দেখতে পেল দৃশ্যটা। তার মনের কোথায় যেন খচ করে উঠল। মনে হল, এমন একটা গৃহস্থান তার নেই, যেখানে মা, বোনেরা একান্ত আপনজনরা তার পথ চাইবার জন্যে দাঁড়াতে পারে! আহমদ মুসার চোখে ভেসে উঠল সিংকিয়াং-এর এক গ্রামের দৃশ্য, সেই গ্রামের একটি সুন্দর বাড়ির ছবি, যা তার বাবা, মা, ভাই, বোন সকলের কলরোলে একদিন মুখরিত ছিল। কিন্তু সব হারিয়েছে, তার চোখের সামনেই তারা নিহত হয়েছে একের পর এক। আজ সে নিঃস্ব, ঠিকানাহীন! তাকে বুকে ধারণ করার জন্যে এমন কোন বাড়ি অবশিষ্ট নেই, এমন কোন আপনজন তার নেই। অজান্তেই চোখের কোণটা তার ভিজে উঠল। মনে পড়ল আমিনার কথা। তার মত সেও এক হতভাগী। কত কষ্ট পাচ্ছে কে জানে।
আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। ঢিলে হয়ে গিয়েছিল হাতের স্টিয়ারিং হুইল। গাড়িটা বেঁকে গিয়ে ধাক্কা খেতে যাচ্ছিল একটা গাছের সাথে। শেষ মুহূর্তে আহমদ মুসা গাড়িটাকে নিয়ন্ত্রনে আনতে পেরেছে।
গাড়ির এই অবস্থা দেখে বিস্মিত হলো জোয়ান। বিস্মিত হয়ে সে তাকালো আবদুর রহমানের দিকে। দেখল তারও চোখে বিস্ময়। বিস্মিত হবারই কথা। আহমদ মুসা অকল্পনীয় ধরনের সুনিপুণ ও সুদক্ষ ড্রাইভারই শুধু নন, গাড়ি চালনা যে চমৎকার একটা আর্ট সেটা আহমদ মুসার হাতেই তারা দেখেছে।
আহমদ মুসা গাড়িটা ঠিক লাইনে ফিরিয়ে এনে দাঁড় করাল। নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। বলল, ‘আবদুর রহমান তুমি এস ড্রাইভিং সিটে।
জোয়ানের বিস্ময় উদ্বেগে পরিনত হলো। বলল, ‘মুসা ভাই শরীর খারাপ করছে না তো আপনার?’
‘না জোয়ান, এমনি একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম।’ মুখে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
মুখে হাসি টানলেও জোয়ান ও আবদুর রহমান আহমদ মুসার চোখের কোণে জমে উঠা সেই অশ্রু বিন্দুটা দেখতে পেল।
আবদুর রহমান পেছনের সিট থেকে নেমে ড্রাইভিং সিটের দিকে এগুলো।
‘কিন্তু মুসা ভাই, এমন আনমনা হতে কোনদিন আপনাকে দেখিনি। আপনার চোখে আবার অশ্রুও দেখেছি।’ বলল জোয়ান।
‘ও কিছু নয় জোয়ান, হঠাৎ চীনের সিংকিয়াং-এ আমার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া গ্রামের কথা মনে পড়েছিল, মনে পড়েছিল আমার ছোট বাড়িটার কথা, মনে পড়েছিল হারিয়ে যাওয়া আব্বা, আম্মা, ভাই-বোনের কথা।’
‘মুসা ভাই, আপনিও এমন করে এসব ভাবেন? ভেবে এইভাবে আনমনা হন, কাঁদেনও?’
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে বসেছিল। চলতে শুরু করেছিল গাড়ি আবার।
‘কেন জোয়ান, একজন বাপের, একজন মায়ের আদরের সন্তান কি আমি নই? একজন ভাই, একজন বোনের স্নেহময় ভাই কি আমি না? তারা আজ কেউ নেই, স্মৃতি তো আছে।’ সামনে দূর দিগন্তের দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে বড় নরম কন্ঠে বলল আহমদ মুসা। আবার আনমনা হয়ে পড়ল সে।
জোয়ান পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে। কথা বলতে আর সাহস করল না জোয়ান। মনে হচ্ছে আহমদ মুসা পাশে থেকেও যেন নেই। বাল্য কিংবা কৈশোরের কোন স্মৃতি সে হাতড়ে ফিরছে কে জানে! জোয়ানের কাছে বিপ্লবী নেতা আহমদ মৃসার এ এক নতুন রূপ।
কথা বলে আহমদ মুসার এ ধ্যান-মগ্নতা ভাঙতে চাইলো না জোয়ান। বিস্ময়ের সাথে ভাবল শুধু, আহমদ মুসার সংগ্রামী জীবনের আড়ালে তার একান্ত ব্যক্তিগত একটা জীবন আছে যেখানে সে বড় দুর্বল, বড় একা। সেখানে তাকে পীড়া দেবার মত আছে অনেক অশ্রু, অনেক কান্না।
পাহাড়িয়া পথে এঁকে-বেঁকে চলছিল তখন গাড়ি। আবদুর রহমানের শক্ত হাতে ধরা স্টিয়ারিং হুইল।
প্রথমে তারা পার্বত্য শহর ভেল্লায় ফিরে যাচ্ছে। সেখান থেকে তাদের যাত্রা শুরু হবে মাদ্রিদের দিকে।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আহমদ মুসা মাদ্রিদ পৌছতে চায়।
৫
মাদ্রিদে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের হেড কোয়ার্টার।
ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের প্রধান বুটাগুয়েনা ভাসকুয়েজ বিরাট কক্ষের বিশাল টেবিলে বসে আছে। তার সামনে টেবিলে একটা মেসেজ। ফ্যাক্সে এসেছে অল্প আগে। এসেছে ইটালীর ট্রিয়েস্ট থেকে।
এয়ার কন্ডিশন ঘরেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে ভাসকুয়েজের। মনের ভেতরের অবস্থা তার আরও খারাপ। ক্রুদ্ধ অন্তর থেকে তার রক্ত ঝরছে যেন। গোটা দেহের রক্ত তার টগবগ করে ফুটছে। এতবড় পরাজয়, এতবড় বিপর্যয়ের কথা ভাবতে পারেনি ট্রিয়েস্টে। রাত আটটায় সে খবর পেল, জোয়ান যে স্যাম্পল নিয়ে গিয়েছিল তেজষ্ক্রিয় পরীক্ষার জন্যে সে স্যাম্পলসহ তেজষ্ক্রিয় রিপোর্ট এবং কম্পিউটার ডিস্ক ইরগুন জাই লিউমির হাতে এসেছে। সে স্যাম্পল, তেজষ্ক্রিয় রিপোর্ট এবং কম্পিউটার ডিস্কসহ মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাসফরে যাওয়া দলটিকে রাত ১২টা প্লেনে মাদ্রিদে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। ভীষণ খুশী হয়েছিল ভাসকুয়েজ আহমদ মুসার পরিকল্পনা ভন্ডুল করতে পেরে। এক ট্রিয়েস্টেই এই পরীক্ষা আহমদ মুসা করতে পারতো, কিন্তু সেটার হলো গুড়ে বালি। ট্রিয়েস্টে আর পারবে না তারা এই পরীক্ষার জন্যে যেতে। আর ইউরোপ আমেরিকার কোন গবেষণাগারে তো আহমদ মুসা কিংবা হিদেন(মুসলমান) তো ঢুকতেই পারবে না। সুতরাং বুঝতেই পারবে না, স্পেনের বাদশাহ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্সসহ স্পেনের ঐতিহাসিক মুসলিম স্থাপনা কোন মহাধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব খুশীর চিন্তা বুকে নিয়েই ভাসকুয়েজ রাতে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু সকালে ৮টায় অফিসে এসেই এই ফ্যাক্স মেসেজ পেল ট্রিয়েস্ট থেকে। ভয়ানক দুঃসংবাদ।
ট্রিয়েস্ট থেকে ইরগুন জাই লিউমি লিখেছে, ‘গত রাত ১২টার দিকে সি-কুইন মোটেলের সামনে ইরগুন জাই লিউমি’র একজন গেরিলাকে হত্যা করে শিক্ষাসফর দলের নেতা মিঃ ভিলারোয়াকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে তার কাছ থেকে সেই স্যাম্পল, তেজষ্ক্রিয় রিপোর্ট, ডিস্ক সব কেড়ে নিয়েছে একজন লোক। এর কিছুক্ষন আগে দাউদ ইমরানের বাড়িতে আমাদের দ’জন মূল্যবান লোক খুন হয়েছে। এছাড়া রেস্ট হাউজে জোয়ানের ঘরের সামনে আরো দু’জন এবং গবেষণা কেন্দ্রের ফটকে অন্য আরো চারজন লোক আমাদের নিহত হয়েছে। ইরগুন জাই লিউমি’র মূল্যবান বিজ্ঞানী দাউদ ইসরানের পোড়া দেহ পাওয়া গেছে তার নিজ গাড়ির ধ্বংসাবশেষ থেকে। মোট আমাদের দশজন খুন হয়েছে আপনার কাজে। এর জন্যে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আরও এক মিলিয়ন ডলার আমরা চাই।’
ইরগুন জাই লিউমি’র এই মেসেজ পড়েই এয়ার কন্ডিশন ঘরে ঘামছে ভাসকুয়েজ। কাজের কাজ কিছুই হলো না। এক মিলিয়ন ডলার যাবার পথে।
ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান ট্রিয়েস্টের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র আই সি টি পি থেকে জোয়ানের নিয়ে যাওয়া স্যাম্পলটি, এর তেজষ্ক্রিয় রিপোর্ট এবং ডিস্ক চুরি করার দায়িত্ব দিয়েছিল ইরগুন জাই লিউমিকে। বিনিময় হিসেবে অগ্রিম দিয়েছিল এক মিলিয়ন ডলার। আরও কথা দিয়েছিল প্রতিটি লোকের ক্ষতির জন্যে দেবে এক লাখ ডলার।
মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জোয়ান পুরাতন কিছূ ইট খন্ড ও কংক্রিট খন্ডাংশের তেজষ্ক্রিয় পরীক্ষার জন্যে এসেছে ট্রিয়েস্টে-একথা ইরগুন জাই লিউমিই জানিয়েছিল ভাসকুয়েজকে। ভাসকুয়েজের ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান যে স্পেনের মুসলিম স্থাপনাগুলো ধ্বংসের জন্যে তেজষ্ক্রিয় প্রয়োগ করেছে, এখবর ইরগুন জাই লিউমি রুশ গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জানতে পারে। ইরগুন জাই লিউমি’র এজেন্ট আই সি টি পি’র বিজ্ঞানী দাউদ ইমরান পুরোনো ইটের ভাঙা টুকরার বয়স পরীক্ষা করেই ধরে নেয় ওগুলো কর্ডোভা বা গ্রানাডার মুসলিম স্থাপত্য থেকে আনা। যেহেতু সে জানে, তার কাছে সব বিষয় পরিস্কার হয়ে যায়। সংগে সংগেই সে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বিষয়টি ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে জানাবার ব্যবস্থা করে।
ভীষণ ক্রোধ ও দুঃখের সাথে বিস্ময়ও বোধ হচ্ছিল ভাসকুয়েজের। ইরগুন জাই লিউমি’র ১০জন গেরিলা এজেন্টকে খুন করল কে? জোয়ান সম্পর্কে আমরা জানি যে, সে জীবনে কোনদিন পিস্তল ধরেনি। সে নিরেট একজন একাডেমিশিয়ান। তার কাছ থেকে এ ধরনের কাজ আশা করা যায় না। তাহলে এই হত্যাকান্ড চালাল কে? আহমদ মুসা কি!
এই সময় ইন্টারকম কথা বলে উঠল। বলল, ট্রিয়েস্ট থেকে ফিরে আসা শিক্ষা সফরকারী দলের সহকারী নেতা অধ্যাপক জোস এসেছেন।
‘পাঠিয়ে দাও।’ দ্রুত বলল ভাসকুয়েজ।
মিনিট খানেকের মধ্যেই মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোককে নিয়ে ভাসকুয়েজের সেক্রেটারী প্রবেশ করল।
ভদ্রলোক বসলে বেরিয়ে গেল ভাসকুয়েজের পি, এস।
কথা বলল ভাসকুয়েজ প্রথম। বলল, ‘ক’টার প্লেনে উঠেন ট্রিয়েস্ট থেকে?’
‘রাত বারটায়।’
‘তাহলে ১২টার আগের সব খবর আপনি রাখেন।’
‘সব জানি না, কিছু শুনেছি মাত্র। বিজ্ঞানী দাউদ ইমরানের বাড়িতে তার দু’জন লোক খুন হয়েছে।’
‘আর কিছু?’
‘জানি না।’
‘কি জন্যে এসেছেন, কি বলতে চান, বলুন।’
‘অধ্যাপক ভিলারোয়া আপনাকে বলতে বলেছেন, আপনার কাছে পৌঁছানোর জন্যে বিজ্ঞানী দাউদ ইমরান কিছু কাগজ ও জিনিসপত্র দিয়েছিলেন, সেগুলো একজন লোক ছিনিয়ে নিয়েছে তাকে কিডন্যাপ করে। যে তাঁকে কিডন্যাপ করেছিল, সেই লোকটিই মটেল সি-কুইনের গাড়ি বারান্দায় একজন লোককে খুন করে। খুন করার পরেই অধ্যাপক ভিলারোয়াকে কেডন্যাপ করা হয়।’
‘আপনি তখন সেখানে ছিলেন?’
‘ছিলাম।’
‘আর কে ছিল?’
‘হোটেলের কয়েকজন সহ আসরা সাত আটজন ছিলাম।’
‘একজন লোক এসে একজনকে খুন করল, আর একজনকে কিডন্যাপ করল, আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি কাজটা করেছিলেন?’
‘কি ঘটল, কি ঘটছে তা আমরা বুঝে উঠার আগেই সব শেষ হয়ে গেছে তাছাড়া লোকটি সশস্ত্র, ভয়ানক ক্ষিপ্র। আমরা ছিলাম খালি হাতে’
‘আপনি খুনি লোকটাকে দেখেছেন ?’
‘দেখেছি’
‘কি রকম সে দেখতে ?’
‘গায়ের রং সাদাটে স্বর্ণাভ। কালো চুল। চেহারায় এশীয়।’
একটু ভাবল ভাসকুয়েজ। তারপর পাশের ফাইল কেবিনেট থেকে একটা ফটো বের করে অধ্যাপক জোসের সামনে তুলে ধরল। বলুন তো, ‘এই লোক কি না।’
অধ্যাপক জোস খুশী হয়ে উঠল। বলল, ঠিক এই লোক। এখানে জ্যাকেট গায়ে, আর সেখানে স্যুট পরে।’
চোখ দু’টি জ্বলে উঠল ভাসকুয়েজের। মুখের মাংস পেশীগুলো যেন শক্ত হয়ে উঠল তার।
‘ধন্যবাদ অধ্যাপক, আমার কথা শেষ। ‘ কষ্ট করে যেন কথা কয়টি উচ্চারন করল ভাসকুয়েজ।
অধ্যাপক জোস বেরিয়ে যেতেই ভাসকুয়েজ প্রচন্ড এক মুষ্টাঘাত করল টেবিলে। মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘বিষ্ট আহমদ মুসা! তুমিই তাহলে গিয়েছিলে ট্রিয়েস্টে।’
বলেই ইন্টারকমে পি,এস, কে নির্দেশ দিল, ‘জুবি জারিটাকে আসতে বল, এখুনি।’
জুবি জারিটা স্প্যানিশ ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের নতুন অপারেশন চীফ। অপারেশন চীফ সিনাত্রা সেন্ডো নিহত হবার পর জুবি জারিটা এই দায়িত্বে এসেছে। মাদ্রিদের বাদশাহ ফয়সাল কমপেক্সে আহমদ মুসাদেরকে ধরার জন্যে যে অভিযান করেছিল, সেই অভিযানে সিনাত্রা সেন্ডো নিহত হয়। সিনাত্রা সেন্ডো তার চারজন সাথীকে নিয়ে যে গাড়িতে ছিলো, সেই গাড়িটিই আহমদ মুসার বোমায় বিস্ফোরিত হয় এবং সংগীদের সমেত নিহত হয়।
মিনিট দেড়েকের মধ্যেই জুবি জাড়িটা দরজায় এসে দাঁড়াল এবং প্রবেশ অনুমতি চাইল।
অনুমতি নিয়ে দরজা ঠেলে জুবি জাড়িটা প্রবেশ করল ঘরে।
সারে পাঁচ ফিটের প্রমান সাইজের মানুষ জুবি জাড়িটা। সামরিক বাহিনীর কর্নেল ছিলেন। চাকুরী থেকে বরখাস্ত হয়েছে চরম বর্নবাদী মানসিকতার জন্যে। ন্যাটো বাহিনীতে এক মহড়া কালে একজন আমেরিকান মুসলিম নিগ্রো অফিসারের সাথে অন্যায়ভাবে মারপিট করার কারনে তাকে বরখাস্ত করা হয়। ক্লু-ক্ল্যাঙ্-ক্ল্যান তাকে লূফে নিয়েছে। মাত্র দু’বছরের মধ্যে সে অপারেশন চীফের আসন লাভ করেছে। ভাসকুয়েজ খুবই আদর করে তাকে, তার এক রোখা ও আপষহীন আচরনের জন্যে।
উত্তেজিতভাবে পায়চারি করছিল ভাসকুয়েজ। জুবি জারিটা ঘরে ঢুকতেই ভাসকুয়েজ ফিরে এল তার চেয়ারে।
চেয়ারে বসে দাঁড়ানো জুবি জাড়িটাকে বসতে বলল। জুবি জাড়িটা মেরুদন্ড খাড়া রেখে এ্যটেনশনের কায়দায় চেয়ারে বসল।
‘জানো কিছু খবর?’ নিরস কন্ঠে বলল ভাসকুয়েজ।
‘কোন খবর স্যার?’
‘এক মিলিয়ন ডলার গেছে, আরেক মিলিয়ন ডলার যাবার পথে।’
জুবি জাড়িটা কোন প্রশ্ন না করে উদ্বেগের সাথে তার প্রশ্ন বোধক দৃষ্টি তুলে ধরল।
ভাসকুয়েজই আবার মুখ খুলল। বলল, শয়তান জোয়ানই জয়ী হয়েছে। সেই স্যাম্পুল, তেজস্ক্রিয় রিপোর্ট এবং কম্পিউটার ডিস্ক যা হাত করা হয়েছিল আই সি টি পি’ থেকে, তা ওরা ছিনিয়ে নিয়েছে, তার সাথে ইরগুন জাই লিউমি’র দশ জন লোক খুন হয়েছে। এক মিলিয়ন ডলার পানিতে গেল। দশজন লোকের ক্ষতিপুরণ আরও ১ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে।’
‘ওরা ছিনিয়ে নিয়েছে? ইরগুনের দশজন লোক খুন হয়েছে?’
বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল জুবি জাড়িটা।
‘এই সর্বনাশ করেছে কে বলতে পার?’
‘জোয়ান তো অবশ্যই নয়, গবেষণা কেন্দ্রের কেউ হতে পারে বলে আমি মনে করি না।’
‘তাহলে?’
‘এতবড় কাজ এমন নিখুঁত ভাবে একজনেই করতে পারে, সে হলো আহমদ মুসা।’
‘ধরতে পেরেছ তাহলে। লজ্জা বোধ হচ্ছে না একজনের কাছে বার বার এভাবে হারতে।’
জুবি জাড়িটার মুখে যেন এক পোচ কালি কেউ মাখিয়ে দিল।
একটা ঢোক গিলে জুবি জাড়িটা বলল, ‘কি করতে হবে স্যার, আদেশ করুন।’
‘কি আদেশ করবো, কি করতে হবে তা শোনার জন্যেই তো তোমাকে ডেকেছি। ‘
‘স্যার আমি ট্রিয়েস্টে যেতে পারি। ওখানে নিশ্চয় আহমদ মুসার সাঙাত আছে, ওদের খুঁজে বের করে আহমদ মুসার কাছে পৌঁছার পথ করতে পারি।’
‘গর্দভ, আহমদ মুসার সাঙাত খোঁজার জন্যে ট্রিয়েস্ট যাবে, এখানে মাদ্রিদে আহমদ মুসার সাঙাত নেই?’
‘স্যার জোয়ানের পরিবারের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি অনেক চেষ্টা করেও। ওরা তাদের নিজের বাসায় থাকে না।’
‘আর কোন সাঙাত বুঝি আহমদ মুসার নেই?’ জানো, বাসক গেরিলা নেতা ফিলিপের বোনকে বাঁচিয়ে আহমদ মুসা এখন বাস্কদের কাছে জামাই আদর পাচ্ছে ?’
‘জি স্যার, আমি বাস্কদের পরিচিত ঘাটিগুলোর দিকে নজর রেখেছি। তবে, ফিলিপ ও ফিলিপের বোন মাদ্রিদে এলে এক ভাড়া বাড়িতে থাকে, সেই বাড়িটার সন্ধান এখনও আমরা করতে পারিনি।’
জুবি জাড়িটা একটু থেমেই আবার মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘স্যার একটা কথা বলব।’
‘কি কথা ?’
‘ফ্রান্সিসকো জেমেনিজ সিসনারোসার মেয়ে জেন ক্যাথারিনার গতিবিধি সন্দেহজনক। তাকে শিক্ষা সফরে পাঠানো ঠিক হয়নি, বিশেষ করে জোয়ান যেহেতু সেখানে গিয়েছিল।’
‘তোমার সন্দেহ অমূলক গর্দভ। জেনের পিতার কাছ থেকেই শুনেছি, জেন শিক্ষা সফরে কিছুতেই যেতে চায়নি, তাকে সবাই জোর করে নিয়ে গেছে। তাছাড়া জোয়ান সেখানে গেছে এটা কারোই জানা ছিলো না। জেনের সম্পর্কে তোমার কথা সত্য হলে, জেন জানত যে জোয়ান ট্রিয়েস্ট গেছে এবং সেক্ষেত্রে জেন আগ্রহী হতো ট্রিয়েস্ট যাবার জন্যে।’
একটু থামল। তারপর চেয়ারে নড়ে-চড়ে বসে আবার বলল, ‘জুবি, ভবিষ্যতে জেন সম্পর্কে এইভাবে কথা বলবে না। সে ফ্রান্সিসকো জেমেনিজের মেয়ে। আর ফ্রান্সিসকোর অবদান ক্লু-ক্যাক্স-ক্ল্যানে তোমার আমার চেয়ে অনেক বেশী।’
‘স্যরি স্যার।’
‘করণীয় তো কিছু বের করতে পারলে না। এখন শুন, গোটা মাদ্রিদ ঘিরে ফেলতে হবে।’
‘ইয়েস স্যার। কিন্তু.. ..।’
কেন ঘিরে ফেলতে হবে সেটাই তো বলবে? বলত আহমদ মুসা তেজস্ক্রিয়া রিপোর্ট নিয়ে এখন কি করবে?
এর এন্টিডোট খুজবে অথবা তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল গুলো তুলে ফেলার চেষ্টা করবে তাদের উল্লেখযোগ্য স্থাপনা গুলো থেকে।
গর্দভ তেজস্ক্রিয়ের কোন এন্টিডোট নেই। তাদের হাতে একটাই বিকল্প। সেটা হলো তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল গুলো মাটির তলা থেকে তুলে ফেলা। এই কাজের জন্য প্রথমেই আহমদ মুসা আসবে মাদ্রিদ, এখন পরিষ্কার হয়েছে কেন মাদ্রিদ ঘিরে ফেলতে হবে ?
ইয়েস স্যার। এতক্ষণে হাসি ফুটে উঠল জুবি জারিটার মুখে।
শুধু ইয়েস স্যার নয়। আজকেই কাজে লেগে যাও। মাদ্রিদ প্রবেশের প্রতিটি পথে পাহারা বসাও। তোমাদের নজর এডিয়ে একটা পিপড়াও যেন মাদ্রিদ প্রবেশ করতে না পারে। যাও এখন।
ইয়েস স্যার। বলে উঠে দাডাল জুবি জারিটা।
চারদিন পরের ঘটনা।
ভাসকুয়েজ তার টেবিলে জুবি জারিটার রিপোর্ট পডেছিল। জুবি জারিটা মাদ্রিদ বন্দের জন্য কি কি পদক্ষেপ গ্রহন করেছে এ তারই রিপোর্ট। ভাসকুয়েজের ঘরে ঢুকল তার মিডিয়া অপারেটর মেয়েটি। তার হাতে সদ্য আসা একটা ফ্যাক্স মেসেজ।
পায়ের শব্দে মুখ তুলল ভাসকুয়েজ। ভ্রু কুচকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল জরুরী কিছু?
জরুরী মেসেজ অপারেটর নিজেই সোজাসুজি নিয়ে এল ভাসকুয়েজের কাছে, এটাই নিয়ম। সাধারণ ও রুটিন মেসেজ গুলো ফাইল আকারে পি এস এর কাছে যায় পি এস সেগুলো নিয়ে আসে ভাসকুয়েজের কাছে।
জি স্যার। তুলুজ থেকে জরুরী মেসেজ।
ভাসকুয়েজ হাত বাডিয়ে মেসেজটি নিল নজর বুলাল মেসেজটিতে তুলুজের ক্ল ক্ল্যাক্স ক্ল্যান ইউনিটের সহকারী ডুপ্লে লিখেছে।
গতকাল সন্ধ্যায় আমরা ভেনিস থেকে জানতে পারি আহমদ মুসা তার দুইজন সাথী সহ তুলুজ গামী বিমান উঠেছে। বিমান বন্দরে আমার তিনটি গাডির একটা ফাদ তৈরী করি। আহমদ মুসা সহ তারা তিনজনই আমাদের ফাদে পডে যায়। আমার ট্যাক্সিতেই ওরা ভাডায় উঠে। আমিই গাড়ি চালাচ্ছিলাম। অন্য দুটি গাডি নিয়ে আমাদের কমান্ডারসহ চারজন আমাদের গাডির পেছনে আসছিল। আমাদের টার্গেট ছিল ওদেরকে আমাদের ঘাটিতে নিয়ে আটকানো। ওরা গেবোনে হাইওয়ে হয়ে সুরেট যাবার জন্য আমার গাডিতে উঠেছিল। ওরা তিনজন কেউ রাস্তা চেনে না তবু ওদের সন্দেহ হয় আমি ঠিক পথে চলছি না। পেছনে থেকে একটা হাত এসে আমার গলা চেপে ধরে আমাকে অজ্ঞান করে ফেলে। পুলিশ আমার জ্ঞান ফেরায়। দেখতে পাই আমাকে অজ্ঞান করে কমান্ডার সহ চারজনকে খুন করে আহমদ মুসারা পালিয়েছে। আমাকে জড়িয়ে কেস হয়েছে। আমি পুলিশ কাস্টোডিতে থেকেই একজনকে পয়সা দিয়ে এই মেসেজটি পাঠালাম।
মেসেজটি পডে কুইনাইন খাওয়ার মতো বিকৃত হয়ে গেল ভাসকুয়েজের মুখ। আবার আহমদ মুসার কাছে পরাজয়। কিন্তু এ পরাজয়টা হলো কি করে। একজনকে না হয় অজ্ঞান করে একটা গাডি দখল করল অন্য দুটি তখন কি করছিল। কিছু করতে তারা না পারুক দুটি গাডির সবাই আহমদ মুসার হাতে হাওয়া খেতে বেরিয়ে গুলী খেয়ে টপটপ করে ঝরে পডেছে। মন বিষিয়ে উঠল ভাসকুয়েজের।
ভাসকুয়েজ কিছুক্ষণ পায়চারি করল। তারপর এসে দাডাল দেয়ালে টাঙানো বিশাল মানচিত্রের সামনে। দৃষ্টি নিবন্ধ করল দক্ষিণ ফ্রান্সের উপর। তুলুজে ওদেরকে খুন করে আহমদ মুসা নিশ্চয় মুরেটে এসেছে মুরেটে কেন? আসলে মুরেট একটা স্টপেজ। সে আসছে স্পেনে সম্ভবত গোরোনে হাইওয়ে ধরে মন্টেজূ ও ম্যানোনা হয়ে বাসাক এলাকার মধ্যে দিয়ে সে স্পেনে প্রবেশ করবে। দুঃখের মধ্যেও এ হদিসটুকু পেয়ে খুশি হলো ভাসকুয়েজ।
চেয়ারে আবার ফিরে এল ভাসকুয়েজ। ইন্টারকমে যোগাযোগ করল জুবি জারিটার সাথে। বলল শুনো পিরেনিজ থেকে বিশেষ করে পিরিনিজ এর ভেল্লা এলাকা থেকে যে সব রাস্তা সে সব রাস্তার উপর বিশেষ নজর রাখতে হবে। আহমদ মুসা ঐ পথ দিয়েই স্পেনে প্রবেশ করছে। আর মাদ্রিদের উত্তর মুখি রাস্তা গুলোর উপরই পাহারা জোরদার কর।
তুলুজে ক্লু ক্ল্যাক্স ক্ল্যানের বিপর্যয় ও চারজন নিহত হবার কথা ভাসকুয়েজ জুবি জারিটার কাছে চেপে গেল। ভাসকুয়েজ চায় না যে ওদের মধ্যে একটা আতংক সৃষ্টি হোক। আত্মবিশ্বাস কমে যাক এবং আহমদ মুসাকে ভয় করতে শুরু করুক।
জুবি জারিটার সাথে কথা শেষ করে ভাসকুয়েজ সবে একটা ফাইলে মনোযোগ দিয়েছে এমন সময় ইন্টারকম কথা বলে উঠল জুবি জারিটার গলা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠ। বলল স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে।
কি সর্বনাশ হয়েছে?
তুলুজে আহমদ মুসা আমাদের চারজন লোককে খুন করেছে। আহমদ মুসাকে ওরা …।
তুমি কোথেকে জানতে পারলে এ খবর? জুবি জারিতাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল ভাসকুয়েজ।
ফরাসি ইন্টেলিজেন্সের একটা মেসেজ এইমাত্র পেলাম।
হু করে একটা শব্দ বেরুল ভাসকুয়েজের মুখ থেকে। বলল হ্যা ওরা খুশী হয়ে খারাপ খবরটা তাডাতাডি দিয়েছে, ভাল কোন খবর ওদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না।
বলে ভাসকুয়েজ ইন্টারকম অফ করে দিল। মুখটা বিরক্তিতে ভরা।
সামনে খোলা ফাইলটি বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ভাসকুয়েজ। চোখ বন্ধ করল। কিছুক্ষণ সব ভুলে থেকে শান্তি পেতে চায় সে কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই ব্যর্থতার ভয়াবহ চিত্রগুলো এক এক করে ছায়াছবির দৃশ্যের মত তার সামনে এসে হাজির হতে লাগল। বিশ্রাম হলো না। উঠে দাডালো ভাসকুয়েজ।
ঘরময় আবার পায়চারি শুরু হলো তার।