ফ্রান্সের তুলুজ বিমান বন্দরে পা দেবার পর আহমদ মুসার মনটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল নতুন চিন্তায়। চিন্তাটা স্পেনের মুসলিম স্মৃতি চিহ্নগুলো এবং মাদ্রিদের শাহ ফয়সাল মসজিদ কমপ্লেক্সকে তেজষ্ক্রিয়তার হাত থেকে উদ্ধার করার প্রশ্ন নিয়ে। একটা উদ্বেগ তার মনকে এসে ঘিরে ধরেছিল। মনে হচ্ছিল তার, একটি করে দিন যাচ্ছে আর তেজষ্ক্রিয় দানবের ভয়ংকর রূপ ভয়ংকরতর হয়ে উঠছে। যার গ্রাসে শেষ হয়ে যাচ্ছে স্পেন থেকে মুসলিম ইতিহাসের শেষ উপস্থিতিটুকু।
আহমদ মুসা বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠল এই চিন্তা মাথায় নিয়ে।
ভাড়া করা ট্যাক্সি। মুরেট পর্যন্ত ভাড়া করেছে। মুরেট তুলুজের ৫০ মাইল দক্ষিণে একটা ছোট্ট শহর। মুরেটে আব্দুর রহমান সপ্তমের বন্ধুর বাড়ি। রাতে তারা ওখানেই উঠবে।
গাড়ি ভাড়া করেছে আব্দুর রহমান সপ্তম। সে বসেছে ড্রাইভারের পাশে। পেছনের সিটে আহমদ মুসা এবং জোয়ান।
মধ্যরাতের তুলুজ। রাস্তায় লোকজন গাড়ি-ঘোড়া খুব কম। আধা ঘুমন্ত নগরী। আলো-আধারীর লুকোচুরি খেলা ছাড়া দু’পাশে দেখার কিছু নেই। আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে চোখ বন্ধ করে সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে। তাকে আবার সেই চিন্তাই পেয়ে বসেছে। বিজ্ঞান যে তেজষ্ক্রিয়ের লোকেশনকে ডিটেক্ট করতে পারছেনা, সেই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে সে অগ্রসর হবে কোন পথে! তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ হওয়ার আগে কিংবা শুরুর পর্যায়ে তেজষ্ক্রিয় কেন্দ্রকে চিহ্নিত করা যেত, কিন্তু তেজষ্ক্রিয় একবার চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ওই তেজষ্ক্রিয়ের কেন্দ্র আর চিহ্নিত করা যায় না। কারণ তেজষ্ক্রিয় রাখা আছে ডিটেকশন প্রুফ কন্টেইনারে। কয়েকটি সুক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে তেজষ্ক্রিয়ের বিকিরণ হয়। বিকিরণের মাত্রা এত সুক্ষ্ম যে, ছড়িয়ে পড়া তেজষ্ক্রিয়ের সাথে তা প্রায় একাকার থাকে। এই অবস্থায় কেন্দ্রকে ডিটেক্টর আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারে না। এই অবস্থায় তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের উৎস চিহ্নিত করে তা অপসারণের কোন উপায় নেই, সেই সাথে এর কোন এন্টিডোটও নেই। এখন এগুবার পথ কি! এই চিন্তাটাই আহমদ মুসাকে পেয়ে বসেছে।
রাতের জনবিরল রাস্তায় তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছিল আহমদ মুসাদের ভাড়া করা গাড়ি।
ড্রাইভার ছেলেটি যুবক বয়সের। পরনে ট্রাওজার, গায়ে জ্যাকেট। মাথার হ্যাটটা কপাল পর্যন্ত নামানো।
‘কি ড্রাইভার, আমরা এতক্ষণও তো গেরোনে হাইওয়ে পেলাম না?’ বলল আব্দুর রহমান সপ্তম।
ড্রাইভার তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না।
আব্দুর রহমান সপ্তমের কথা বলার শব্দে আহমদ মুসার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।
‘একটু অন্য পথ দিয়ে যাচ্ছি তো।’ একটু সময় নিয়ে জবাব দিল ড্রাইভার।
আব্দুর রহমান সপ্তমের প্রশ্ন, ড্রাইভারের দেরী করে জবাব দেয়া এবং ড্রাইভারের জবাবের ধরণ শুনে ভ্রু-কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার। একটু ভাবল আহমদ মুসা। তারপর বলল, অন্য পথটা কি বাঁকা পথ ড্রাইভার?
ড্রাইভার আবার একটু সময় নিয়ে বলল, জ্বি, একটু বাঁকা।
‘এয়ারপোর্ট থেকে গেরোনে হাইওয়ে কোন দিকে?’
‘পশ্চিম দিকে।’ ড্রাইভার মুখ খোলার আগেই জবাব দিল আব্দুর রহমান সপ্তম।
আহমদ মুসা বসেছিল ড্রাইভারের পেছনের সিটেই।
আব্দুর রহমান সপ্তম কথা শেষ করার সংগে সংগে আহমদ মুসার বাম হাতটি দ্রুত গিয়ে ড্রাইভারের গলা সাপের মত পেঁচিয়ে ধরল।
আহমদ মুসা দেখছিল স্পিডোমিটারের পাশে দিক নির্দেশক বোর্ডে গাড়ি যাচ্ছে উত্তর দিকে। কিন্তু আহমদ মুসা জানে তাদের গন্তব্যস্থল মুরেট দক্ষিণ দিকে। মুরেটগামী গেরোনে হাইওয়েতে পড়ার জন্য দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘোরা স্বাভাবিক, কিন্তু উত্তরে যাওয়া স্বাভাবিক নয়।
আহমদ মুসার হাত সাঁড়াশির মত চেপে ধরেছিল ড্রাইভারের গলা।
ড্রাইভারের গলা থেকে একটা শব্দও বের হলো না। রুদ্ধশ্বাস ড্রাইভারের চোখ দু’টি বিষ্ফারিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু হাত দু’টি তার সক্রিয় ছিল। এক হাত ছিল স্টিয়ারিং হুইলে, অন্য হাতে চেপে ধরেছিল হর্ন। একটানা বেজে চলছিল হর্ন।
আহমদ মুসা তার ডান হাত দিয়ে ড্রাইভারে হাত সরিয়ে দিল হর্ন থেকে। আহমদ মুসার বুঝতে অসুবিধা হয়নি হর্নের মাধ্যমে সংকেত পাঠাচ্ছে সে।
ওদিকে আব্দুর রহমান সপ্তম আহমদ মুসা ড্রাইভারের গলা পেঁচিয়ে ধরার সাথে সাথে এগিয়ে গিয়ে স্টিয়ারিংটা ধরে ফেলেছিল। গাড়িটা অল্পকিছু এঁকে-বেঁকে এগিয়ে আবার সোজা চলতে শুরু করল।
ড্রাইভারের দেহটা শিথিল হয়ে এলে আহমদ মুসা টেনে তুলে তার দেহটা পেছনে নিয়ে এল এবং তাকে উপুড় করে ফেলে তাকে বেঁধে ফেলার জন্যে বলল জোয়ানকে। তারপর উঠে এল ড্রাইভারের সিটে। স্টিয়ারিং হুইল আব্দুর রহমান সপ্তমের হাত থেকে নিয়ে তাকে বলল, তুমি পেছনে গিয়ে ওকে সামলাও।
ড্রাইভিং সিটে বসে রিয়ার ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা দেখল, পেছন থেকে তীব্র বেগে চার’টি হেডলাইট ছুটে আসছে।
মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই পেছন থেকে আহমদ মুসার গাড়ির দু’পাশে দু’টি গাড়ি উঠে এল। ঘন ঘন হর্ন দিচ্ছিল গাড়ি দু’টি।
আহমদ মুসা বুঝল, গাড়ি দু’টি ড্রাইভারের দলের। ওরা নিশ্চয় পেছন থেকে অনুসরণ করছিল। নিয়ে যাচ্ছিল আহমদ মুসাদেরকে নিশ্চয় কোন একটা ফাঁদে। ড্রাইভারের হর্নে বিপদ সংকেত পেয়েই সম্ভবত ওরা এসেছে খোঁজ নিতে। হর্ন দিয়ে ওরা জানতে চাচ্ছে, ড্রাইভার ঠিক আছে কিনা।
আহমদ মুসা আরও বুঝল, তারা কোন এক অজ্ঞাত শত্রুর কবলে পড়েছে। কিন্তু কারা এরা? বিমান বন্দরে কেউ কি তাদের চিনে ফেলল? তা হলেও এটা কি করে সম্ভব! বিমান বন্দরে চিনে ফেললেও শত্রুদের পক্ষে এই আয়োজন এত তাড়াতাড়ি করে তো সম্ভব নয়! মনে হচ্ছে ফাঁদ যেন পেতে রাখা হয়েছিল। তাহলে কি তাদের আগমনের খবর আগেই এসে পৌঁছেছিল? হতে পারে ভেনিস অথবা মার্শেই বিমান বন্দরে কেউ তাদের চিনে ফেলে টেলিফোন করে দিয়েছে এখানে। ফ্রান্সের মার্শেই বিমান বন্দরেও তাদের ১ ঘন্টা যাত্রা বিরতি করতে হয়েছিল। কারা এই শত্রু? ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান কি? ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের হর্ন কোডের সাথে এদের হর্ন-সংকেতের মিল আছে। কিন্তু আনাড়ী মনে হচ্ছে অনেকটা। হতে পারে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানেরই কোন একটা গ্রুপ।
দু’পাশ থেকে দু’টি গাড়ি সমান্তরালে চলে আসার সাথে সাথে আহমদ মুসা গাড়ির গতি বেগ আকস্মিকভাবে বাড়িয়ে দিল। তীব্র বেগে সামনে এগোলো আহমদ মুসার গাড়ি।
ওরা মনে করল শত্রু পালাচ্ছে। ওরাও বাড়িয়ে দিল গাড়ির বেগ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের গাড়ি আবার আহমদ মুসার গাড়ির পেছনে চলে এল। এবার পেছন থেকে ওরা গুলী করল আহমদ মুসার গাড়ি লক্ষ্যে। পর পর দু’টো গুলী। আহমদ মুসার গাড়ির দু’টি টায়ার প্রায় একই সাথে ভীষণ শব্দে ফেটে গেল।
কয়েক গজ মাটি কামড়ে, এগিয়ে গাড়িটি স্থির দাঁড়িয়ে গেল।
‘আব্দুর রহমান দেখো, ওর পকেটে নিশ্চয় পিস্তল আছে।’
আব্দুর রহমান সপ্তম পিস্তল আগেই বের করে নিয়েছিল। দ্রুত সে পিস্তলটি আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
পিস্তলটি হাতে নিয়েই আহমদ মুসা ডানদিকে তাকাল। দেখ গাড়ি থেকে বেরিয়ে দু’জন ছুটে আসছে। হাতে ওদের পিস্তল। আহমদ মুসা মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে পর পর দু’টি গুলী ছুড়ল। অব্যর্থ নিশানা। গাড়ি থেকে মাত্র দু’হাত দূরে এসে লোক দুটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা গুলী করার পর ওদিকে আর না তাকিয়েই লাফ দিয়ে চলে এল গাড়ির বাম পাশে।
‘মুসা ভাই গাড়ির এ পাশটা লক করে দিয়েছি। দু’জন ওপাশে গেছে।’ বলল আব্দুর রহমান সপ্তম।
‘ধন্যবাদ আব্দুর রহমান, ডান পাশটাও লক করে দাও।’ বলে আহমদ মুসা বাম পাশের দরজা খুলে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। তারপর সাপের মত দ্রুত বুকে হেঁটে গাড়ির সামনের দিকটা ঘুরে এসে ডান প্রান্তে উঁকি দিল। দেখল ওরা দুজন পিস্তল বাগিয়ে গাড়ির গা ঘেঁষে বুকে হেঁটে এগিয়ে আসছে গাড়ির সামনের দরজার দিকে।
আহমদ মুসা সময় নষ্ট করল না। আরও দুটি গুলী বেরিয়ে এল তার পিস্তল থেকে পর পর। গুরিয়ে গেল ওদের দুজনের মাথা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় সামনে ডান পাশের গাড়ি থেকে নারী কন্ঠের একটা গোঙানী ভেসে এল। আহমদ মুসা পিস্তল বাগিয়ে ছুটল ঐ গাড়ির দিকে। গাড়ির দরজা খোলাই ছিল। আহমদ মুসা দেখল হাত, পা, মুখ বাঁধা একটা মেয়ে গাড়ির সিটে বসে। মুখের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসা পিস্তলটি পাশে ফেলে দিয়ে মেয়েটির মুখের বাঁধন খুলে দিল।
মুখের বাঁধন খুলে গেলেই মেয়েটি কেঁদে উঠল হাউ মাউ করে।
আহমদ মুসা মেয়েটির হাত খুলে দিতে দিতে বলল, ‘কেঁদো না বোন, তোমার আর কোনও ভয় নেই।’
এ সময় পাশে এসে দাঁড়াল আব্দুর রহমান সপ্তম। তার সাথে জোয়ানও।
‘তোমরা গাড়িটা লক করে দিয়ে এসেছো?’ বলল আহমদ মুসা।
‘জি হ্যাঁ।’ বলল আব্দুর রহমান সপ্তম।
‘ভাল করেছ, পুলিশ অন্তত একজনকে তো পাবে। কিছু জানতে পারবে।’
মেয়েটির পায়ের বাধনও খোলা হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটি মুখে রুমাল চেপে কাঁদছে তখনও।
‘বোন তুমি উঠে এসে সামনের সিটে বস।’ বলল আহমদ মুসা।
মেয়েটি সংগে সংগেই যন্ত্রের মত নির্দেশ পালন করল। সামনে ড্রাইভিং সিটের পাশে গিয়ে বসল।
আহমদ মুসা উঠে বসল ড্রাইভিং সিটে।
জোয়ান ও আব্দুর রহমান বসল পিছনের সিটে।
দূরে পেছনে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল।
আহমদ মুসা স্টার্ট দিল গাড়িতে। ব্রান্ড নিউ গাড়ি। মাইল মিটারে দেখল মাত্র পাঁচশ মাইল চলেছে।
‘পেছনে চারটি হেডলাইট দেখা যাচ্ছে, পুলিশের গাড়ি এদিকে আসছে।’ পেছন থেকে বলল আব্দুর রহমান সপ্তম।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে।
সব ঘটনা মাত্র দু’মিনিটে শেষ হয়ে গেল।
সামনেই রাস্তায় বড় একটা টার্ন। সে টার্নটি পার হবার পর পুলিশের গাড়ি আর দেখা গেল না। আহমদ মুসা আলো নিভিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। সুতরাং অত পেছন থেকে আহমদ মুসার গাড়ি তাদের নজরে পড়ার কথা নয়।
আহমদ মুসার গাড়ি চলছিল একশ’ চল্লিশ কিলোমিটার বেগে।
টার্ন নেবের পর আহমদ মুসা গাড়ির গতিবেগ কমিয়ে আশিতে নিয়ে এল।
মেয়েটি তখনও রুমালে মুখ বুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
মেয়েটির পরনে ব্রাউন স্কার্ট, ব্রাউন কোট। মাথায় সাদা পশমের টুপি। বয়স বিশ বছরের বেশী হবে না। নিরেট ফরাসী চেহারা।
‘বোন, তুমি কে? কি করে ওদের হাতে পড়লে?’ বলল আহমদ মুসা মেয়েটির দিকে না তাকিয়েই।
মেয়েটির কান্না বেড়ে গেল। একটু পরে চোখ মুছে সে বলল, আমার দাদি মুমূর্ষ। টেলিফোন পেয়ে আমি যাচ্ছিলাম ওঁর কাছে। রাত ১১টায় ওরা আমাকে আমার এই গাড়ি সমেত কিডন্যাপ করে গেরোন হাইওয়ে থেকে।
‘কেন কিডন্যাপ করে?’
‘প্রথমে আমার গাড়ি ব্যবহার ওদের টার্গেট ছিল। পরে আমাকেও ওদের ঘাটিতে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওদের মতলব খুব খারাপ ছিল।’
‘তোমার দাদির বাড়ি কোথায়?’
‘মন্ট্রেজু’তে।’
‘মন্ট্রেজু’তে? এত দূরের রাস্তা একা বেরিয়েছিলে এত রাতে?’
‘কি করব আমার আব্বা আম্মা থাকেন স্পেনে, ফ্রান্সের কূটনীতিক মিশনে। আমি তুলুজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, একা থাকি।’
‘এখন তুমি কি করবে? কোথায় যেতে চাও?’
তৎক্ষণাৎ মেয়েটি কোন উত্তর দিল না। মনে হয় স্থির করতে পারছিল না।
আহমদ মুসাই কথা বলল আবার। বলল, দ্বিধা করো না বোন। এটা তোমার গাড়ি। যদি মনে কর আমরা এখানেই নেমে যাচ্ছি, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাও। আর আমি মনে করি মন্টেজু-তে আজ তোমার যাওয়া ঠিক হবে না।
মেয়েটি মুখ তুলে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন। মনে তার প্রশ্ন, কে এরা? সে নিজ চোখেই দেখেছে এই লোকটিই ঐ চারজন গুন্ডাকে পাখি শিকারের মত করে খুন করেছে। এর তো হওয়া উচিত ছিল ওদের চেয়েও কঠিন হৃদয় ও লোভী। এই রাত সাড়ে বারটায় যখন গাড়ি পাওয়া দুস্কর, তখন এভাবে গাড়ি ছেড়ে নেমে যাওয়ার প্রস্তাব করছে কেমন করে? এমন অস্বাভাবিক ব্যবহার তো সে দেখেনি!
“আজ আমাকে মন্টেজু” তে যেতে নিষেধ করছেন আপনি? বলল মেয়েটি।
ঠিক নিষেধ করছি না, আমি মনে করি একা যাওয়া নিরাপদ নয়।
মেয়েটির আরেক দফা বিস্মিত হবার পালা। একজন অচেনা, অজানা লোক তার নিরাপত্তার কথা এই ভাবে ভাবছে। মেয়েটির মনে পড়ল তার ছোটবেলার কথা। তখন পিতা মাতার সাথে থাকতো কায়রোতে। ওখানকার এক বৃদ্ধকে সে দেখত। তার কাজ ছিল অসুস্থ লোকের সেবা করা, পথহারা লোকদের পথ দেখানো এবং হারানো শিশুদের বাড়িতে পৌছে দেয়া। কিন্তু সে কারও গায়ে আচড় দিত না, আর এতো জলজ্যান্ত ৪টি লোক এখনি মারল। এখনও পিস্তল ওর পকেটে। এরপরও লোকটি এমন দায়িত্বশীল ও সৌজন্য বোধ সম্পন্ন হলো কি করে!
এ সময় নেমে গেলে আপনারা গাড়ি পাবেন কোথায়? এত রাতে তুলুজে কচ্চিত গাড়ি মেলে। বলল মেয়েটি।
কোন চিন্তা করো না। মানুষের চেষ্টা যেখানে শেষ হয়, বিধাতার চেষ্টা সেখান থেকে শুরু হয়।
মেয়েটি চোখ বড় বড় করে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, আপনি বুঝি ঈশ্বরে খুব বিশ্বাস করেন?
অবশ্যই। তিনি আমার স্রষ্টা, তিনি আমার প্রতিপালক এবং তিনিই আমার সব কাজের বিচারক হবেন।
মেয়েটির মুখ হা হয়ে উঠল। লোকটি যে একদম গীর্জার ফাদারের মত কথা বলছে। কিন্তু গীর্জার ফাদাররা তো রক্তপাত করে না। কে এই বিচিত্র চরিত্রের চরিত্রের লোকটি।
একটু সময় নিয়ে মেয়েটি মুখ খুলল। ফিরে এল তার প্রসংগে। বলল, জনাব মন্ট্রেজু আমার যেতে হবে, জানি না আমার দাদির…….
মেয়েটির কন্ঠ ভারি হয়ে উঠেছিল। কথা শেষ না করেই সে থেমে গেল।
মিঃ সেভেন, আমাদের গন্তব্য তো মুরেট, মন্ট্রেজু এই একই রাস্তায় না? আহমদ মুসা একটু ঘাড় কাত করে পেছনে লক্ষ্য করে বলল।
আবদুর রহমান সপ্তমকে আহমদ মুসা বাইরের লোকদের সামনে তার নামে না ডেকে মিঃ সেভেন বলে।
জি হ্যাঁ। বলল আবদুর রহমান।
মুরেটে হল্ট করা কি আমাদের জন্য অপরিহার্য?
মোটেই না। আমরা শুধু ওখানে রাত কাটাতে চেয়েছিলাম।
আমরা তাহলে এখন সোজা মন্ট্রেজু যেতে পারি। ওকেও পৌছে দেয়া গেল, আমরা ওর গাড়িতে অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারলাম।
এটাই বেটার হবে। বলল আবদুর রহমান সপ্তম।
আমি এখানকার রাস্তা ঘাট কিছুই চিনি না। তুমি আমাকে গাইড কর, এখন আমরা গেরোনে হাইওয়েতে উঠব। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।
মেয়েটির চোখ মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। জীবনের আশাই যেখানে সে ছেড়ে দিয়েছিল, সেখানে শুধু মুক্তি পাওয়াই নয়, রাতেই মন্ট্রেজুতেও সে যেতে পারছে। কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল তার মন পাশে বসা লোকটির প্রতি। সে তাকে সাক্ষাত জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করেছে। জীবনের ভয় সে করে না। কিন্তু গুন্ডাদের হাতে পড়লে জীবনের চেয়েও মুল্যবান জিনিস তাকে হারাতে হতো।
অনেক ধন্যবাদ আপনাদের।
মেয়েটি রাস্তা বাতলে দিল। মিনিট পাচেকের মধ্যেই আহমদ মুসার গাড়ি উঠে এল গেরোনে হাইওয়েতে।
এবার ছুটল গাড়ি দক্ষিণ দিকে গেরোনে হাইওয়ে ধরে। একদম রাস্তার ধার বরাবর প্রবাহিত দক্ষিণ ফ্রান্সের একটা বড় নদী গেরোনে। এই নদীর নাম অনুসারেই হয়েছে রাস্তার নাম। গেরোনে নদী নেমে এসেছে পিরোনিজ পর্বতমালা থেকে। পিরেনিজ-অভ্যন্তরের ছোট্ট দুর্গম নগরী ভেল্লা পর্যন্ত হাইওয়ে ও নদী এক সাথেই গেছে। ভেল্লা স্পেনের উত্তর সীমান্তের উপর দাড়ানো ছোট্ট পার্বত্য শহর। এই শহরের অদূরে দুর্গমতর এক উপত্যকায় আবদুর রহমান সপ্তমের বসতি।
রাতের গেরোনে হাইওয়ে।
একদম ফাকা।
তীরের মত ছুটছে আহমদ মুসার গাড়ি।
ঐ গুন্ডারা আপনাদের কিডন্যাপ করেছিল কেন? মৌনতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করল মেয়েটি।
আমরা ওদের চিনি না, মতলব কি তাও জানি না। আগে থেকেই ফাদ পেতে বসেছিল ওরা। বলল আহমদ মুসা।
ওদের গল্প থেকে বুঝেছি, ভেনিস বিমান বন্দর থেকে কেউ ওদের টেলিফোন করেছিল। ওদের গল্পে এও বুঝেছি, সাংঘাতিক একজনকে ওরা ধরতে যাচ্ছে। সেই সাংঘাতিক লোক কে? আপনি?
তোমার তাই মনে হয় আমাকে?
মেয়েটির মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলো। বললো, হ্যাঁ।
কেন?
সাংঘাতিক না হলে ওভাবে চারজন ভীষণ গুন্ডা কি মরত?
সাংঘাতিক শব্দ কিন্তু কদর্যে ব্যবহৃত হয়। আমি কিন্তু ওদের হত্যা করিনি, ওদের হাত থেকে আমরা আত্মরক্ষা করেছি।
সরি। আমি সাংঘাতিক বলতে শক্তি বুঝিয়েছি।
আহমদ মুসা উত্তরে কিছু বলল না।
চলছিল গাড়ি ঝড়ের বেগে।
মাফ করবেন, আপনি কে? আপনারা কে? মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল।
পরিচয় জিজ্ঞাসা না করলেই খুশী হতাম মি….। তোমার নাম যেন কি?
আমি ডোনা জোসেফাইন। আপনার নাম?
বললাম তো জিজ্ঞাসা না করলেই খুশী হতাম। সংক্ষেপে, এ, এম, বলতে পার আমাকে। তোমার আব্বা কি রাষ্ট্রদূত স্পেনে?
জি হ্যাঁ।
তুমি তোমার আব্বার সাথে থাক না?
ছিলাম প্রাইমারী লেভেল পড়া পর্যন্ত।
কোন কোন দেশ তুমি দেখেছ?
কায়রো, রিয়াদ ও আংকারার কথা মনে আছে।
তোমার আব্বা মুসলিম দেশেই তো বেশী ছিলেন দেখছি?
হ্যাঁ, আমার আব্বা সারাসিনিক স্ট্যাডিজ-এ ডক্টরেট নিয়েছেন।
তোমরা কি খৃষ্টান?
বলছি, কিন্তু আপনার এ, এম, এর অর্থ কি?
ঠিক এই সময় সামনে অল্প দূরে রেড সিগন্যাল স্টিক জ্বলে উঠতে দেখা গেল।
প্রত্যেক গাড়িতেই এ ধরনের সিগন্যাল থাকে। বিপদে পড়লে এটা দিয়ে সংকেত দেয়া হয়।
হেড লাইটের আলোতে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, দুজন লোক পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে। একজনের হাতে রেড সিগন্যাল। তাদের পাশেই রাস্তার এক ধারে একটা গাড়ি পার্ক করা।
রেড সিগন্যাল দেখার সাথে সাথেই ডোনার মুখ শুকিয়ে উঠেছিল। বলল, আজকেই কাগজে পড়েছি হাইওয়েতে রাতের বেলা ডাকাতি হচ্ছে, কিডন্যাপ হচ্ছে। কিডন্যাপ করে রেখে বড় অংকের টাকা দাবী করছে।
ভয় নেই ডোনা, ওরা তো সংখ্যায় খুব বেশী দেখছিনা।
বলে আহমদ মুসা বাম হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করে নিল এবং বলল, ডোনা, জোয়ান, আবদুর রহমান তোমরা মাথা নিচু রাখ। মতলব ওদের খারাপ হলে নিশ্চয় ওরা গুলী করবে।
আহমদ মুসা গাড়ির গতি একটুও স্লো করলো না। সে পরীক্ষা করতে চাইল, ওরা সত্যিই বিপদগ্রস্থ কেউ কিনা। বিপদগ্রস্থ হলে সিগন্যাল দেখানো এবং চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই করবে না। আর যদি ডাকাত-হাইজাকার হয় ওরা, তাহলে গাড়ি না দাড়াতে দেখলে নিশ্চয় গাড়ির টায়ার ফাটাবার চেষ্টা করবে।
তাই হলো। আহমদ মুসার গাড়ি যখন দাঁড়ানোর ভাব দেখালো না এবং দাঁড়ানো লোক দু’টি যখন পয়ঁতাল্লিশ ডিগ্রি এ্যাংগেলে এল, তখন দু’জনই দ্রুত রিভলবার বের করল।
আহমদ মুসা একটু অপেক্ষা করছিল। ডান হাতে পিস্তল তার রেডি ছিল। ওরা পিস্তল হাতে তুলে নেয়ার সাথে সাথে আহমদ মুসা গুলী করল পরপর দু’টি।
ওদের পিস্তল উঠে আসছিল আহমদ মুসার গাড়ি লক্ষ্যে। কিন্তু লক্ষ্যে উঠে আসার আগেই গুলী খেয়ে দু’জন পড়ে গেল রাস্তায়।
একই গতিতে গাড়ি ছুটছিল। গুলী করার সময় মনোযোগটা টার্গেটের দিকে শিফট হবার পরও গাড়ির মাথাটা একটুও কাঁপেনি। বাম হাতটা নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে গাড়িটাকে।
গাড়িটা ওদের ছাড়িয়ে এগিয়ে চলে এল।
পেছন থেকে জোয়ান বলল, মুসা ভাই, গাড়ি থেকে আরও তিনজন বেরিয়ে এসেছে। ছুটছে এ দিকে।
পর মুহূর্তেই গুলীর তিনটি শব্দ পাওয়া গেল। প্রায় এক সাথেই। সম্ভবতঃ হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া শিকারের লক্ষ্যে তিনটি গুলী ছুড়ে ব্যর্থতার জ্বালা জুড়াবার চেষ্টা করেছিল ওরা।
‘গুলী খাওয়া দু’টির খবর কি জোয়ান?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘দু’জন মাটি থেকে আর ওঠেনি।
ডোনা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে। সবিস্ময়ে সে ভাবছিল, কি অদ্ভুত লোক! কত কঠিন কাজ সে কত সাধারণভাবে করে ফেলে! এত বড় বিপদের সে মোকাবিলা করল, তার মুখে চিন্তার কোন ছায়াও পড়েনি। গোটা ব্যাপারটাই তার কাছে যেন ছিল একটা খেলার মত। এমন নার্ভ, গুলীর এমন নিশানা তার কাছে রূপ কথার মত লাগছে। রূপ কথার মত এই যে লোক, সে নিশ্চয় অসাধারণ কেউ হবে।
আহমদ মুসার দিকে অপলক চেয়ে ডোনা বলল, দয়া করে কি বলবেন আপনি কে? ওঁ আপনাকে ‘মুসা ভাই’ বলেছে, আপনার নাম এ, এম, এর অর্থ কি? এম এর অর্থ ‘মুসা’ ধরে নিলাম, কিন্তু ‘এ’-এর অর্থ?
‘ধন্যবাদ ডোনা, খুব বুদ্ধিমতি তো তুমি। আবিস্কার করেই ফেলেছ নামটা। ‘এ’-এর অর্থ ‘আহমদ’।
‘অর্থাৎ আপনি, ‘আহমদ মুসা’। মুসলমান?’
‘কায়রো, রিয়াদ ও আংকারায় তো তুমি মুসলমান দেখেছ, তাই না?’
‘দেখেছি। কিন্তু মুসলমানদের খুব ভয় করি ওরা নাকি খুব ঝগড়াটে জাতি। তিন’শ বছর ধরে আমাদের বিরুদ্ধে ক্রসেড করেছে।’
‘ডোনা, ক্রসেড হয়েছিল কোথায় বলত?’
‘ফিলিস্তিন অঞ্চলে।’
‘ঐ অঞ্চলে কাদের বাস?’
‘মুসলমানদের।’
‘তাহলে ক্রসেড করতে মুসলমানরা এসেছিল, না খৃষ্টানরা গিয়েছিল?’
একটু ভাবল। হাসল ডোনা। বলল, বুঝেছি, বলতে চাচ্ছেন, খৃষ্টানরাই ক্রসেড করতে গিয়েছিল মুসলিম ভূ-খন্ডে। এবং দায়ী খৃষ্টানরাই।’
‘আমি বলতে চাচ্ছি না ডোনা, ইতিহাস বলে এটা। খৃষ্টানরা অমূলক এক উম্মাদনা আর কুৎসিত এক রক্ত পিপাসা নিয়ে অন্যায় এক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল মুসলমানদের উপর। সে সময় খৃষ্টানরা ধর্মের নামে যা করেছে, তার চেয়ে অধর্মের কাজ আর নেই ইতিহাসই এটা বলছে।’
’আমি ইতিহাস জানি না। আব্বা এ বিষয়টা ভাল বলতে পারবেন। তিনি বলেন, কায়রো, আংকারার মত জায়গায় সাধারণভাবে যে সব মুসলমান দেখ, ওরা ইসলামের ধ্বংসাবশেষ।’
‘অর্থাৎ?’
‘আব্বা বলেন, কোন নগরীর বিক্ষিপ্ত সামান্য ধ্বংসাবশেষ দেখে যেমন সেই নগরীর পূর্ণাংগ ছবি আঁকা যায় না, তেমনি ঐসব মুসলামানের সমাজ ও জীবন দেখে ইসলামের পূর্ণ রূপ কল্পনা করা যায না।’
‘তোমার আব্বা ঠিকই বলেছেন, ইসলামকে নিশ্চয় তিনি জানেন। তবে কি জান, ইসলাম কিন্তু আল-কোরআন, হাদীসে রসূল (সঃ)-এর মাধ্যমে অবিকৃত অবস্থায় বর্তমান আছে, বিকৃত হয়েছে ঐ মুসলমানরা। এই বিকৃতিকে সংশোধনের কাজও কিন্তু চলছে।’
‘আপনাকে দেখে এটাই মনে হচ্ছে। একমাত্র বাপ-মার’র কাছ ছাড়া আজকের এই সময়ের মত এমন নিরাপত্তা বোধ আর কখনও করিনি। আমার জীবনে ‘বোন’-এর সম্মানজনক সম্বোধন দিয়ে কেউ আমাকে ডাকেনি।’
ডোনার কণ্ঠ গম্ভীর শোনাল।
‘ইসলাম সকল মানুষকে ভাই ও বোনের মধুর সম্পর্কে এক সাথে বেঁধে দিয়েছে।’
ডোনা একটা ভাবল। একটু পর বলল, ‘আমার ভাবতে ভাল লাগছে, এমন পবিত্র সম্পর্ক যেখানে, সে সমাজে শান্তি ও সকলের নিরাপত্তা আসা আমার মনে হয় খুব সহজ।’
ডোনার কথাটা স্বগতোক্তির মত শোনাল। তার দৃষ্টি প্রসারিত ছিল সামনে।
আহমদ মুসাও আর তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না। তারও দৃষ্টি সামনে প্রসারিত।
বাইরে রাতের নিঃশব্দ প্রহর।
দু’পাশে অন্ধকারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের অন্তহীন শ্রেণী।
এরই মাঝে মসৃণ পাথুরে পথ বেয়ে শোঁ শোঁ এক শব্দ তুলে তীর বেগে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার গাড়ি।