আহমদ মুসা মেয়েদের ইয়ুথ সোসাইটি ফর ইউরোপিয়ান রেনেসাঁর জোনাল সম্মেলনে গিয়েছিল। ঈদের আনন্দ এসেছিল সেদিন ঐ সম্মেলনে। প্রথমে ছিল বক্তৃতা। পনের মিনিটেই তার কথা শেষ করেছিল আহমদ মুসা। তারপর শুরু হয়েছিল প্রশ্নোত্তর। আড়াই ঘন্টা চলেছিল প্রশ্নোত্তরের আসর। এই আড়াই ঘন্টায় ইসলামের গত চৌদ্দশ’ বছরের ইতিহাস, মুসলমানদের আজকের সমস্যা-সম্ভাবনার কোন প্রধানদিকই বাদ যায়নি। আহমদ মুসা ধৈর্যের সাথে সকল প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। খুব খুশী হয়েছিল সে ইউরোপীয় বোনদের আগ্রহে। অনুষ্ঠান শেষে আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে সোসাইটির পক্ষ থেকে ভেনিস শাখার সভানেত্রী আয়েশা বলেছিল, ‘সোসাইটির জীবনে আজ ঐতিহাসিক দিন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ অনুগ্রহ আছে আহমদ মুসার উপর। তিনি যেখানে পা দেন, সেখানেই সোনার ফসল ফলে, মুসলমানদের জীবনের অন্ধকার কেটে গিয়ে আসে সোনালী দিন তার এই আগমন আমাদের মাঝে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের এক পরিকল্পনার ফল আমরা মনে করি। তাঁর কথা, তাঁর শিক্ষা এবং তাঁর উৎসাহ দান আমাদের সোসাইটিকে নতুন জীবন দান করবে, আমাদের বহুদূর এগিয়ে নিবে। তাঁর কাছে আমাদের দাবী, ইউরোপ বঞ্চিত, ইউরোপের মানুষ বঞ্চিত, মুসলিম বিশ্ব ইউরোপের প্রতি নজর দিক। ইউরোপের মান অনুসারে উ্পযুক্ত ও যথেষ্ট ইসলামী সাহিত্য এখনও সৃষ্টি হযনি। ইংরেজীতে, ফরাসী ভাষায় কিছু আছে, ইউরোপের অনেক জাতীয় ভাষায় ইসলামী সাহিত্য শূণ্যের কোঠায়। যোগ্য মুসলিম মিশনারীর সংখ্যাও বলা যায় শূণ্যের অংকে এই বিষয়গুলোর দিকে আমরা আমাদের মহান ভাই-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। জোর দিয়েই আমরা তাকে বলতে চাচ্ছি, ইসলামী আন্দোলনগুলো যে পরিশ্রম, যে কষ্ট, যে ত্যাগ ও কোরবানী মুসলিম দেশগুলোতে করছে, তা যদি তারা ইউরোপের জন্যে করে, তাহলে হাজারগুণ বেশী ফল তারা লাভ করবে। আমরা আশা করছি, ইউরোপের এই আকুল কণ্ঠ তাঁর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে যাদের কাছে পৌঁছা দরকার তাদের কাছে নিশ্চয় পৌঁছবে। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের মহান ভাই-এর দীর্ঘ জীবন ও সব ক্ষেত্রে কামিয়াবী প্রার্থনা করছি। আর প্রার্থনা করছি, ইউরোপও যেন তাঁকে পায়।’
আহমদ মুসাকে ভেনিসের আবু আলী সুলাইমান মসজিদে নামায পড়াতে হয়েছিল।
ভেনিসের এই আবু আলী সুলাইমান মসজিদটি এ্ই নামের পুরানো মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপর নতুনভাবে নির্মিত হয়েছে। এই অপরূপ সুন্দর মসজিদ কমপ্লেক্সটিতে রয়েছে একটা বাজার, একটা শিক্ষালয়, একটা বড় সম্মেলন কেন্দ্র, একটা লাইব্রেরী।
এই আবু আলী সুলাইমান মসজিদের একটা ইতিহাস আছে।
তখন পঞ্চদশ শতকের শেষ দশক। তুরস্কে খলিফার আসনে তখন দিগ্বীজয়ী সুলাইমান। সমগ্র ভূমধ্যসাগর তার নৌবহরের দখলে। ইটালীর উপকূল ও বহু নগরী তাঁর কব্জায়। রোমের মত ভেনিস তখন খৃষ্টান প্রতিরোধের দুর্ভ্যেদ্য দূর্গ। এই দুর্ভেদ্য দূর্গে সুলাইমানের মুসলিম নৌবহর প্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু প্রবেশ করেছিল ইসলাম প্রচারক আবু আলী সুলাইমান। তাঁর হাতে ছিল কোরআন, আর তাঁর পিঠের ছোট্ট পুটুলিতে ছিল শুকনো রুটি। সৌম্যদর্শন, মৃদুভাষি ও দয়ালু হৃদয় আবু আলী সুলাইমান ছিল ভেনিসবাসীদের কাছে এক বিস্ময়। যে ভেনিসবাসীরা জানত মুসলমানরা যুদ্ধ, হত্যা ও নিষ্ঠুরতার প্রতীক, সেই ভেনিসবাসীরা একটা ভিন্ন চিত্র দেখল আবু আলী সুলাইমানের মধ্যে। তাঁর নম্রতা, ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের কাছে দাঁড়ালে হিংসা-বিদ্বেষ কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যায়। ভীষণ স্বভাবের অপরাধীরা তাঁর সংস্পর্শে এলে গলে খাঁটি সোনা হয়ে যায়। তখন চারদিকের রণ-উন্মাদনা ও রণ-ডংকার মধ্যে তিনি যেন শান্তির এক ছায়াদার বৃক্ষ।
আবু আলী সুলাইমান তার বাসের স্থান নির্দিষ্ট করেছিলেন ভেনিসের এক প্রান্তে এক ছোট্ট-শান্ত স্রোতস্বীনির তীরে। খুব শীঘ্রই স্থানটি ধনী-নির্ধন সকলের দর্শন গাহ হয়ে উঠল। তিনি সকলকে বলতেন, স্রষ্টা যেভাবে চান সেভাবে না চলার কারণেই মানুষের মনে, সমাজে, দেশে-সবটা জুড়ে আসে অশান্তি। সব আচরণের জন্যে স্রষ্টামূখী না হয়ে স্বেচ্ছাচারী হওয়াই মানবতার জন্যে সবচেয়ে বড় অপরাধ। তিনি মানুষকে জানালেন, ইসলাম শুধু মানুষের নয়, কুকুর, ঘোড়ার মত পশুদেরও নিরাপত্তা বিধান করে, তাদের সুখ-দুঃখের কথা ভাবে।
আবু আলী সুলাইমানের ক্ষুদ্র কুটিরের সামনে গড়ে উঠে মসজিদ। সেখান থেকে উচ্চারিত হতে থাকে মুয়াজ্জিনের আযান দিনে পাঁচবার। এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন, তিন থেকে চার-এইভাবে ধীরে ধীরে নামাজিতে ভরে উঠে মসজিদ। গড়ে উঠে ভেনিসে একটি মুসলিম সমাজ। আবু আলী সুলাইমান শীঘ্রই শাসকদের কোপ দৃষ্টিতে পড়েন। বলা হলো আবু আলী সুলাইমান তুরস্কের সুলতান দিগ্বীজয়ী সুলাইমানের চর। একদিন ফজরের সময় নামাযীরা গিয়ে দেখল, আবু আলী সুলাইমানের রক্তাক্ত ও নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে আছে মসজিদে জায়নামাযের উপর। তীন্ক্ষধার ছুরির আঘাতের পর আঘাতে তার দেহ বিকৃত হয়েছে, কিন্তু মুখ ভরা ছিল পবিত্র হাসি, যেমন তিনি হাসতেন ঠিক তেমনি। সে দৃশ্যের দিকে চেয়ে মানুষ ডুকরে কেঁদে উঠেছিল।
তারপর ভেনিসের মুসলমানরা মসজিদের নামকরণ করে আবু আলী সুলাইমান মসজিদ। আবু আলী সুলাইমান মরলেও মানুষ তার নামকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করে এইভাবে।
কিন্তু ভেনিসের দূর্বল সংখ্যালঘু মুসলমানরা শেষ পর্যন্ত তা পারেনি। আবু আলী সুলাইমানকে যেমন হত্যা করা হয়, তেমনি মসজিদটিকেও, প্রায় একশ’ বছর পরে, ধ্বংস করা হয় এবং সেখানে গড়ে তোলা হয় গীর্জা।
কিন্তু ঊনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই গীর্জাটি পরিত্যক্ত হয়, কোন উপাসক সেখানে আর যেত না রোববারের নির্দিষ্ট প্রার্থনা সভায়। সেখানে গড়ে উঠে ক্লাব, পরে রেস্তোঁরা। স্থানটি কিন্তু পরিচিত ছিল সব সময় ‘হোলি আবু আলী সুলাইমান’ বলেই।
অনেক পরে ভেনিসের মুসলমানরা স্থানটি কেনার উদ্যোগ নেয়। সিদ্ধান্ত নেয় পুরানো বুনিয়াদের উপর আবু আলী সুলাইমান মসজিদটি পূনঃনির্মাণের। কিন্তু অনেক টাকা প্রয়োজন। কোথায় সে টাকা। অবশেষে মক্কার রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামী সাহায্যে এগিয়ে আসে। স্থানটি কেনার জন্যে অর্থ সাহায্য দেয়। তারপর সৌদি সরকারের অর্থ সাহায্যে গড়ে উঠে সুন্দর, সুদৃশ্য আবু আলী সুলাইমান মসজিদ কমপ্লেক্স।
এই কাহিনী আহমদ মুসা শুনেছিল আগেই। যখন সে আবু আলী সুলাইমান মসজিদে প্রবেশ করেছিল, তার স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠেছিল আবু আলী সুলাইমানের সব কাহিনী। একা এক মানুষ আবু আলী এসেছিলেন এই ভেনিসে- দেশ ছেড়ে, আত্মীয় স্বজন, পরিবার-পরিজন সব ছেড়ে! কিসের টানে তিনি এসেছিলেন এই বিদেশ- বিভূই-এ! মানুষের প্রতি ভালবাসার টানে, তাদেরকে মুক্তির পথ দেখাবার উদগ্র বাসনায়। নিজেদের সমস্ত সুখ-শান্তি বিসর্জন দানকারী এই মহান ত্যাগি ব্যক্তিদের চেষ্টার কারণেই ইসলামের আলো বিশ্বের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই মহান অগ্রজদের কথা স্মরণ করতে গিয়ে আহমদ মুসার চোখ দু’টি ঝাপসা হয়ে উঠেছিল অশ্রুতে।
ইমাম সাহেবের অনুরোধে আহমদ মুসাকেই জুম্মার খোতবা দিতে হয়েছিল।
বিরাট মসজিদ। এক পাশে ছেলেরা, আরেক পাশে মেয়েরা। ভরে গিয়েছিল মসজিদ। শুধু ভেনিস নয়, আশ-পাশ থেকে যারা টেলিফোনে খবর পেয়েছিল তারাও ছুটে এসেছিল। প্রায় তিন হাজারের মত মুসল্লি হাজির হয়েছিল। অধিকাংশই যুবক ও তরুণ।
খোতবায় আহমদ মুসা বলেছিল, ইসলাম প্রচলিত অর্থের কোন ধর্ম নয়। জাগতিক জীবনে মানুষ যাতে ক্ষতি ও অন্যায়-অবিচার থেকে বাঁচতে পারে, সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে এবং পরকালে যাতে চিরন্তন শান্তির জীবন লাভ করতে পারে ইসলাম তারই একক একটি প্রাকৃতিক বিধান। আহমদ মুসা বলেছিল ইসলাম কিভাবে এসেছিল কিভাবে বিজয় লাভ করেছিল এবং কিভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী। এই কথা বলতে গিয়ে সে স্মরণ করেছিল খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর কথা, শাহজালালের কথা, এক আবু আলী সুলাইমানসহ হাজারো শহীদি আত্মার কথা। বলতে গিয়ে আবেগে তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেঁদে উঠেছিল মসজিদের প্রতিটি মুসল্লি। অশ্রু গড়িয়েছিল তাদের চোখ থেকে অঝর ধারায়। তারপর আহমদ মুসা বলেছিল মুসলমানদের আদর্শ-বিচ্যুতি কি করে সেই সোনালী দিনের ইতি ঘটাল, স্বার্থপরতাজাত অনৈক্য কি করে তাদের পতন ঘটাল সেই কাহিনী। আত্মবিনাশের সেই মর্মন্তুদ কাহিনী আবার মুসল্লিদের চোখ সজল করে তুলেছিল। এরপর আহমদ মুসা বলেছিল, পতনের শেষতল থেকে মুসলমানরা আবার উঠে আসছে, পৃথিবীকে পথ দেখাবার দায়িত্ব নিয়ে যে জাতির উত্থান, সেই মুসলিম জাতি সেই দায়িত্ব গ্রহণের জন্যে আবার আজ এগিয়ে আসছে। স্বার্থপরতাজাত অনৈক্য যে মুসলিম জাতির একদিন পতন ঘটিয়েছিল, জীবন দেয়ার মত চুড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করে তারা আজ ঐক্যকে আবার সংহত করছে। মানবতার কল্যাণে এবং মহৎ উদ্দেশ্যে জীবন দেবার সংখ্যা যে জাতির মধ্যে ক্রমবর্দ্ধমান হারে বাড়ে, সে জাতির উত্থান কেউ রোধ করতে পারে না, সে জাতির বিশ্ব-নেতৃত্ব ঠেকিয়ে রাখতে পারে না কেউ। মুসলমানদের আবার বিশ্ব-নেতৃত্ব লাভ অবধারিত। আমি দুর দিগন্তে সে সোনালী দিনের স্বর্ণরেখা দেখতে পাচ্ছি। আহমদ মুসার এ শেষ কথাগুলো আনন্দে উজ্জ্বল করে তুলেছিল মুসল্লিদের মুখগুলোকে। আহমদ মুসা উপসংহারে বলেছিল, সে সোনালী দিনে পৌছার জন্যে সংগ্রামের এক কঠিন পথ এখনও আমাদের পাড়ি দিতে হবে।
জুম্মার নামাযের পর শুরু হয়েছিল ইসলাম গ্রহণ করতে আসা লোকদের ইসলামে দীক্ষা দানের অনুষ্ঠান।
কথা ছিল দু’ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণের। একজন ভেনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আরেকজন তরুণ ব্যবসায়ী। কিন্তু ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছিল সাতে। এদের পরের পাঁচজনের মধ্যে তিনজন সরকারী চাকুরে, দু’জন ব্যবসায়ী। সবাই বয়সে যুবক। সকলের মধ্যে প্রবীণ একমাত্র ভেনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাঁর বয়স পঞ্চাশ। পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক তিনি। উল্লেখ্য, তাঁকে নিয়ে এ পর্যন্ত ভেনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক ইসলাম গ্রহণ করলেন।
সকলের অনুরোধে আহমদ মুসাই ওঁদের সকলের ইসলাম গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিল।
অনুষ্ঠান ও দোয়া শেষে আহমদ মুসা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে আলোচনা করেছিল কয়েকজনের সাথে।
প্রবীণ অধ্যাপক জোস ওরতেগা, মুসলিম নাম আহমদ হাসান’কে আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করেছিল, ইসলামের কোন জিনিসটি আপনাকে আকৃষ্ট করেছিল সবচেয়ে বেশী’।
‘কোন একটা দিককে আমি চিহ্নিত করতে পারবো না। জীবন সম্পর্কে ইসলামের টোটাল দর্শনটাই আমাকে আকৃষ্ট করে’। বলেছিল অধ্যাপক ওরতেগা।
‘আকৃষ্ট হওয়ার বিষয়টা কি ছিল?’
‘তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত’ এর বিশ্বাস সম্মিলিতভাবে যে অপূর্ব ও ভারসাম্যপূর্ণ বিধানের জন্ম দিয়েছে সেটা’।
কথার মাঝখানে একটু হেসেছিল অধ্যাপক ওরতেগা। তারপর আবার শুরু করেছিল, তাওহিদের বিশ্বাস মানুষকে সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং সকল প্রকার দাসত্ব থেকে মুক্ত করে এক স্বাধীন মানুষে পরিণত করে, যেখানে উপরে এক আল্লাহ ছাড়া তার উপরে আর কেউ থাকে না। আর রেসালত সেই আল্লাহর খলিফা অর্থাৎ প্রতিনিধির মর্যাদায় অভিসিক্ত করে, আর তাকে দেয় স্রষ্টার দেয়া জীবন পরিচালনার সংবিধান। আখেরাতের বিশ্বাস ‘মানুষকে দেয় সকল কৃতকর্মের জওয়াবদিহীর সদাজাগরুক ভয় এবং পরকালের চিরন্তনী জীবনে সৎ জীবনের জন্যে পুরস্কারের নিশ্চয়তা এবং অসৎ জীবনের জন্যে শাস্তির প্রবল ভীতি। জাগতিক জীবনকে সুখ ও শান্তিপূর্ণ করার জন্যে মানুষের এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ জীবন অপরিহার্য’।
আহমদ মুসা অধ্যাপক ওরতেগার কথা শুনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছিল। বলেছিল, অধ্যাপক ওরতেগার এই উপলব্ধি যদি ইউরোপের জাগ্রত বিবেকের কাছে আমরা পৌঁছাতে পারি, তাহলে আমি মনে করি ইউরোপে পরিবর্তনের এক বিপ্লব ঘটে যাবে। মুসা বিন নুসায়েরের যে বিজয় অভিযান অষ্টম শতাব্দীতে ফ্রান্সের দক্ষিণ সীমান্ত পিরেনিজ পর্বতমালায় এসে থেমে গিয়েছিল, সে বিজয় আমরা ইউরোপে সম্পূর্ণ করতে পারবো। সমর শক্তি যা সেদিন পারেনি, ইসলামের আদর্শের শক্তি তা পারবে।
তরুণ-তরুণীর দল যারা হাজির ছিল সে সমাবেশে, তারা আনন্দে তকবীর দিয়ে উঠেছিল। তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের এক স্বপ্ন।
আহমদ মুসা তরুণ যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল সেদিন তাদের সাথেও আলোচনা করেছিল, তাদের উপলব্ধির সাথে পরিচিত হবার জন্যে।
একজন তরুণ বলেছিল, আমি কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু কম্যুনিষ্ট অর্থনীতি ও তার সাম্যবাদ অবাস্তব ও ব্যর্থ প্রমানিত হবার পর আমি হতাশায় ভুগছিলাম। সে সময় আমি ‘ইয়ুথ সোসাইটি ফর ইউরোপিয়ান রেনেসা’ আয়োজিত একটি সেমিনারে উপস্থিত হয়েছিলাম। সে সেমিনারে একজন বক্তা বলেছিলেন, ‘শাসন দন্ড উচিয়ে বন্টনের সাম্যতা বিধানের মধ্যে শুধু অবাস্তবতা নয়, এক ধরণের নিপীড়নও বিদ্যমান রয়েছে। ইসলাম এই ধরণের সাম্যতা নয়, আইনের সাম্যতা বিধানে অত্যন্ত কঠোর এবং আপোষহীন। এখানে একজন দুর্বলতম সাধারণ লোকের অভিযোগে রাষ্ট্র প্রধানকেও আসামীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াতে হয়। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন সাধারণ লোক রাষ্ট্র প্রধানকেও রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কৈফিয়ত তলব করতে পারে। ইসলাম মানুষের স্বাধীন আয়-ব্যয়ের উপর এমন নৈতিক ও আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং আয় ও ব্যয়কারীকে এমন দায়িত্বরোধে উজ্জীবিত করে যার ফলে সম্পদ অব্যাহতভাবে বিতরণশীল হয়ে ওঠে এবং এই সমাজে ধনী হওয়া যেমন কঠিন, তেমনি গরীব থাকাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই কল্যাণ-সমাজে রাষ্ট্র প্রধানের ভাতা বা বেতন সাধারণ মানুষের অংশের চেয়ে বেশী হতে পারে না। আর এই কল্যাণ সমাজে শুধু মানুষ নয়, কুকুরও যদি না খেয়ে থাকে তার জন্যে আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহীর ভয়ে রাষ্ট্র প্রধান ভীত থাকে’। এই কথাগুলো আমার সামনে অজানা এক জগতের দ্বার খুলে দেয় এবং আমাকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, আমি ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করতে বাধ্য হই। ধীরে ধীরে আমার কাছে প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, মানবতার জন্যে স্বাভাবিক ও শান্তিময় জীবনের একমাত্র পথ ইসলাম। তার পরেই আমি ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি’।
‘আপনার পরিবার থেকে কোন বাধা আসেনি?’ আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করেছিল আহমদ মুসা।
‘আসেনি। বরং আব্বা খুশী। তার বয়স একশ’ তিন বছর, একজন গোঁড়া ক্যাথলিক তিনি। তিনি খুশী হয়েছেন কারণ আমি ধর্মদ্রোহী কম্যুনিজম থেকে ধর্মের দিকে আসছি। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘ইসলামই তোমাদের জন্যে উপযুক্ত। ধর্মগুলোর মধ্যে মাত্র ইসলামই তোমাদের দাবী পূরণ করতে পারে’।
আহমদ মুসার প্রশ্নের জবাবে আরেকজন যুবক বলেছিল, ‘ইসলামের নামায আমাকে প্রথম আকৃষ্ট করে। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে একটা মসজিদের কাছাকাছি আমি থাকতাম। আসা-যাওয়া কালে প্রায়ই এক সাথে মুসলমানদের নামায পড়তে দেখতাম। অনেক সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও দেখেছি। মুসলমানদের নামাযের মধ্যে গণতন্ত্র, সাম্যতা ও স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যের চুড়ান্ত প্রকাশ আমি দেখি। আরেকটা জিনিস আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। সেটা হলো, দিনে পাঁচবার নামায। এই ভাবে দিনে পাঁচবার কেউ যদি তার প্রভুর সামনে দাঁড়ায়, তাহলে নিঃসন্দেহে সে সৎ ও সুন্দর জীবনের অধিকারী হবে। এই অনুভূতি থেকেই ইসলামকে জানার ব্যাপারে আমি আগ্রহী হই। ইয়ুথ সোসাইটি ফর ইউরোপিয়ান রেনেসাঁ’ এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করে’।
আহমদ মুসা ঐ দিনই বিকেলে ‘ইয়ুথ সোসাইটি ফর ইউরোপিয়ান রেনেসাঁ’র ছেলেদের শাখার এক আঞ্চলিক সম্মেলনে যোগদান করেছিল।
এই দিনই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আহমদ মুসারা ভেনিস ছেড়েছিল। তাদেরকে বিমানে তুলে দিতে এসেছিল একদল যুবক। আর এসেছিল ইব্রাহিম আলফনসো এবং আয়েশা।
বিমানের গ্যাংওয়েতে প্রবেশের আগে আহমদ মুসা শেষ বিদায় সম্ভাষণ জানাবার জন্যে ফিরে দাঁড়িয়েছিল। ফিরেই দেখতে পেয়েছিল আয়েশা একদম পেছনেই। তার নীলচোখ ভরা জল।
‘কাঁদছ আয়েশা তুমি?’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘আর দেখা হবে না কোন দিন?’ বলেছিল আয়েশা।
‘জীবন পায়ে চলা পথের মত, কেউ তো নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারে না আয়েশা?’
‘পথিক কি ফেরেনা তার ফেলে আসা পথে আর?’
‘ফেরে বোন, আবার ফেরেও না।’
‘তাহলে বোনরা কি হারিয়ে যাবে, ভাইদের জীবন থেকে?’ অসহ্য এ অনুভূতি।’
আয়েশার চোখটা ভিজে উঠেছিল।
‘না মা, এমন ভাবছ কেন? তুমিই না বলেছ, ইউরোপের দাবী আছে ওর প্রতি? ওকে আসতেই হবে।
‘পরিচিত ভাই-বোনদের কাছে ফিরে আসতে আমারও ইচ্ছে করে, কিন্তু এ ওয়াদা কোথাও করতে পারিনি।’
‘ক্ষণিকের এমন স্মৃতি বেদনাদায়ক।’ চোখ মুছে বলল আয়েশা।
‘তবু এমন হাজারো ঘটনা জীবনের চলার পথে ঘটবেই।’
‘মনকে আল্লাহর জন্যে প্রস্তুত করেননি কেন?’
‘মানুষ তাহলে বোন মানুষ হতো না।’
‘তাহলে কি আল্লাহ চান বোনরা ভায়ের জন্য এভাবে কাঁদবে?’
‘অর্ধেক বললে ভাইরাও কাঁদবে বোনের জন্যে, মা কাঁদবে সন্তানের জন্যে, সন্তান কাঁদবে মায়ের জন্যে। এই মমতার বাঁধনেই তো মানব সমাজ বাঁধা।’
দরজায় যাত্রীর ভীড় বেড়ে গিয়েছিল। আহমদ মুসা ইব্রাহিম আলফনসোর দিকে চেয়ে বলেছিল, ‘আসি জনাব, সবাইকে আমার সালাম বলবেন।’
তারপর আয়েশার দিকে চেয়ে বলেছিল, ‘আসি বোন।’
আয়েশার ঠোট কাঁপছিল। কিন্তু কোন শব্দ বেরোয়নি। তার ভেজা চোখে করুন এক দৃষ্টি। আহমদ মুসার অন্তরের কোথায় যেন মোচড় দিয়ে উঠেছিল। এমনভাবে বিদায় জানাবার মত তার কোন বোন নেই। বোনরা এমন মমতাময় হয় ভাইদের প্রতি! তাদের অশ্রু-জলে এমন ভাবেই কি সিক্ত হয়ে উঠে ভায়ের চলার পথ!
আহমদ মুসার মমতা-বুভুক্ষ হৃদয় বেদনায় চিনচিন করে উঠেছিল।
একটা আবেগ যেন বুক থেকে ঠেলে উপরে উঠতে চাইছিল।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল!
লম্বা পা ফেলে চলতে শুরু করেছিল সে গ্যাংওয়ে ধরে।
গ্যাংওয়েতে ঢোকার পথে দরজায় দাঁড়ানো একজন লোক বিষ্ফারিত চোখে দেখছিল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা চলে যেতেই সে জিজ্ঞাসা করেছিল ইব্রাহিম আলফনসোকে, ‘কে ইনি?’
‘আহমদ মুসা।’ বলেছিল আলফনসো।
‘ঠিক বলেছেন।’
‘আপনি চেনেন তাকে?’
‘না মানে ছবি দেখেছি। উনি কোথায় যাচ্ছেন?’
‘ফ্রান্সের তুলুজ।’
শুনেই লোকটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। প্রবেশ করেছিল পাশের একটি কক্ষে। হাতে তুলে নিয়েছিল টেলিফোন।
‘আব্বা, ওর নাম বলে তুমি ঠিক করনি। লোকটিকে আমার ভাল মনে হলো না।’ বলেছিল আয়েশা।
‘ঠিক বলেছ মা, হঠাৎ বলে ফেলেছি।’
আয়েশার চোখে উদ্বেগ।
চোখ তখনও তার ভেজা অশ্রুতে।
তারা বাপ-বেটি দু’জন ঘুরে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেছিল বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে। বাইরে লবীতে অন্যেরা অপেক্ষায় ছিল।