আহমদ মুসা গাড়ি শাহ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্স-এর বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়াতেই গেট রুম থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে গেট খুলে দিল।
বিরাট লোহার গেট , এ গেটের পাশ দিয়ে ছোট একটি দরজা। পায়ে চলা লোকেরা ও পথে যাতায়াত করে। গেট এর মাথাটা মিনারাকৃতি, পাথরের তৈরি। মিনারাকৃতির মাঝখানে পাথরের প্লেটে খোদায় করে আরবি ভাষায় , লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ লেখা। গেটের ষ্টীলের নীল পাল্লায় অর্ধ চন্দ্র আঁকা।
উত্তর মাদ্রিদে ছোট একটা সবুজ টিলার উপর তৈরি শাহ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্সটি উঁচু প্রাচীর ঘেরা। একটাই গেট। গেট দিয়ে আহমদ মুসাদের গাড়ি প্রবেশ করল মসজিদ কমপ্লেক্সে।
লাল ইটের সুন্দর রাস্তা এগিয়ে গেছে কমপ্লেক্সর গাড়ি বারান্দার দিকে। রাস্তার দু’পাশে ফুলের বাগান। মসজিদ কমপ্লেক্স -বিল্ডিং এর চারিদিকে ঘিরে টিলা জুড়েই ফুলের বাগান। চারিদিকে বাগানের মধ্যে অনেকগুলো ছোট ছোট বাংলো সাইজের বাড়ি। ও গুলোতে প্রধান ইমাম, সহকারী ইমামগণ , মুয়াজ্জিনগণ এবং কমপ্লেক্সের কর্মচারীরা থাকেন।
টিলার শীর্ষ দেশে মূল্যবান সফেদ পাথরে তৈরি বাগান ঘেরা মসজিদ কমপ্লেক্সটির দৃশ্য অপরুপ। সৌদি সরকার স্পেন সরকারের অনুমতি নিয়ে টিলাটি কিনে মসজিদ কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করেছেন। খরচ হয়েছে ৫০ মিলিয়ন ডলার। সর্ব প্রথম বাদশাহ ফয়সল আকাঙ্খা ব্যক্ত করেন স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে এ ধরনের একটি মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণের। কিন্তু তিনি তার জীবদ্দশায় এ অনুমতি পাননি। পরবর্তীকালে তার স্বপ্ন সফল হয় এবং সৌদি সরকার বাদশাহ ফয়সলের নামেই এ মসজিদ কমপ্লেক্স এর নামকরণ করেন।
লাল ইটের রাস্তা ধরে আহমদ মুসাদের গাড়ি দিয়ে দাঁড়াল গাড়ি বারান্দায়। মসজিদের বিশাল প্রশস্ত সিঁড়ির নিচে গাড়ি বারান্দা। সিঁড়ি উঠে গেছে দু’তলার লাইব্রারিতে এবং তিনতলায় অবস্থিত মসজিদে। গ্রাউন্ড ফ্লোর জুড়ে বিশাল হল ঘর। দু’হাজার আসন বিশিষ্ট এই হল ঘর শুধু মাদ্রিদ নয়, স্পেনের মধ্যে সর্ববৃহৎ। হলের সামনে এবং দু’পাশে কমপ্লেক্সের অফিস কক্ষ সমূহ। এখানেই প্রধান ইমাম, সহকারী ইমামগণ, মুয়াজ্জিনদেরও অফিস। দু’তলার একপাশে লাইব্রারি এবং অন্য পাশে ইসলামিক স্কুল। এই স্কুলে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার যেমন ব্যবস্থা আছে, তেমনি কোরান , হাদিস, এবং ফেকাহ-এর উপর উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানকার শিক্ষকদের মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওভারসীজ এডুকেশন ফান্ড থেকে বেতন দেয়া হয়। লক্ষাধিক গ্রন্থ সম্বলিত লাইব্রেরীটিও স্পেনের একটি শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরীতে রূপান্তরিত। অঢেল পয়সা খরচ করে স্পেনসহ গোটা দুনিয়া থেকে দুর্লভ ও মূল্যবান বই জোগাড় করে এই লাইব্রেরী গড়ে তোলা হয়েছে। তৃতীয় তলা জুড়ে বিশাল মসজিদ , ৫ হাজার লোক এক সাথে এখানে নামায পড়তে পারে। তবে দুর্ভাগ্য , কয়েক শ’র বেশি লোক জুম্মার দিনেও এখানে হয় না। একে তো মুসলমান নেই বললেই চলে, অপরদিকে যাও আছে তারাও চিহ্নিত হবার ভয়ে মসজিদে আসে না। মসজিদকে কেন্দ্র করে যে ছোট মুসলিম কম্যুনিটি গড়ে উঠেছে তারাই এখানে নামায পড়ে। মসজিদের মুসল্লিদের মধ্যে বিদেশিদের সংখ্যাই বেশি। শুক্রবারের জামায়াতে মুসলিম দেশের কূটনীতিকরা আসেন। আর সব দিনই বিদেশী মুসলিম পর্যটকরা কিছু কিছু থাকেন। মসজিদ কমপ্লেক্সের প্রাচীরের বাইরে দিয়ে মার্কেট গড়ে তোলা হয়েছে। এই মার্কেট মসজিদের স্থায়ী আয়ের উৎসই শুধু নয়, শ’খানেক মুসলিম পরিবারের জীবিকার ব্যবস্থাও হয়েছে এর মাধ্যমে।
গাড়ি দাঁড়ালে প্রথমে নামল আহমদ মুসা। তারপর একে একে নামল যিয়াদ, জোয়ান এবং রবার্টও।
গাড়ি বারান্দার পরেই একটি করিডোর। করিডোরের বাঁ পাশে কাঁচের দেয়াল ঘেরা রিসেপশন কক্ষ। কক্ষে অনেকগুলো সোফা পাতা। একপাশে একজন লোক একটা ছোট টেবিলের পাশে বসে।
আহমদ মুসারা ঘরে প্রবেশ করতেই টেবিলে বসা লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
আহমদ মুসা সালাম গ্রহন করে তার দিকে এগুলো। রিসেপশনিস্ট দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, কি খেদমত করতে পারি আপনাদের?
‘শাইখুল ইসলামের সাথে আমাদের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে ৫ টায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অ্যাপয়েন্টমেন্টটা কে নিয়েছিলেন ?’
‘যিয়াদ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার একটু বসুন , আমি দেখছি।’ ‘ ঘড়ির দিকে চেয়ে টেলিফোন হাতে তুলে নিতে নিতে বলল রিসেপশনিস্ট। ঘড়িতে পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি।
টেলিফোনে কথা শেষ করে রিসেপশনিস্ট বলল, ‘স্যার শাইখুল ইসলাম স্যার তার অফিসে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তার পি, এস ছুটিতে আছেন, চলুন আমি পৌঁছে দেব।’
বলে রিসেপশনিস্ট ছেলেটি উঠে দাঁড়াল।
রিসেপশনিস্ট ছেলেটি আগে আগে চলল, পেছনে আহমদ মুসা, যিয়াদ , জোয়ান এবং রাবার্তো।
আঁকা-বাঁকা করিডোর ধরে আহমদ মুসারা এগিয়ে চলছিল। দু’পাশেই অফিস ঘর। গোটা কমপ্লেক্সে অফিস এই এক স্থানে। কিন্তু কোন অফিসে কোন লোক নেই। রিসেপশনিস্ট জানাল, অফিস সময় সকাল ৭টা থেকে ১ টা পর্যন্ত। ‘
আহমদ মুসা দেখল, সামনে একটা খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে একজন লোক তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে সে দাঁড়িয়ে যেন তাদেরই অপেক্ষা করছে।
রিসেপশনিস্ট বলল, ‘একজন মুয়াজ্জিন।’ ‘
‘কয়জন মুয়াজ্জিন?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘তিনজন।’
রিসেপশনিস্ট ছেলেটা সামনে ছিল।
সেই সালাম দিল মুয়াজ্জিন সাহেবকে।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, সালামের জবাব সুস্পষ্ট ভাবে শোনা যায় এমনভাবে উচ্চারিত হল না, মুয়াজ্জিন সাহেবের সব মনোযোগ যেন মেহমানদের দেখার কাজেই ব্যস্ত ছিল। আহমদ মুসা মনে মনে ভাবল, বেচারা এরা, বাইরের লোকের দেখা খুব কম পায় কিনা!
শাইখুল ইসলামের অফিসে তারা পৌঁছল।
আহমদ মুসারা বাইরে দাঁড়াল।
রিসেপশনিষ্ট দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরে খোদ শাইখুল ইসলাম উঠে এসে দরজায় আহমদ মুসাদের স্বাগত জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল।
শাইখুল ইসলাম দীর্ঘদেহী মানুষ। মাথায় সাদা পাগড়ী। গায়ে সাদা জামার উপর সোনালী রঙয়ের আরবীয় আলখেল্লা জড়ানো। লাল গায়ের রং। বয়স ৪০ থেকে ৫০ এর মাঝখানে হবে। সুন্দর বিন্যস্ত কালো দাঁড়ি। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। চোখে-মুখে তারুণ্যের একটা তেজ।
নাম শাইখুল ইসলাম ডঃ আবদুর রহমান আন্দালুসী। সেভিলের এক অখ্যাত শহরতলীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাদের পরিবারটি বাস করত উত্তরে পিরেনিজের পার্বত্য এলাকায়। উত্তর আফ্রিকায় হিজরতের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাদের পরিবার ক্রমে দক্ষিণে এগুতে থাকে। পরিবারটি সেভিলে এসে যখন বাস করছিল সেই সময় আবদুর রহমানের জন্ম হয়। ব্যবসায়-বাণিজ্যের সুযোগ হওয়ায় এবং জীবন-যাত্রা অনেকটা নিরাপদ দেখায় অবশেষে পরিবারটি সেভিলেই থেকে যায়। কিন্তু ছেলের মেধা দেখে আবদুর রহমানের পিতা আবদুর রহমানকে ১২ বছর বয়সে গোপনে মরক্কো পাঠিয়ে দেয়। প্রাথমিক শিক্ষা আবদুর রহমান মরক্কোয় লাভ করে। অত্যন্ত মেধাবী প্রমাণিত হওয়ায় মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি নিয়ে সেখানে পড়ার তার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আল-আজহার থেকে তিনি তাফসীর ও ফেকাহ শাস্ত্রে এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী ভাষায় উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন। তারপর মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি হাদীস শাস্ত্র ও দাওয়া বিষয়ে অধ্যায়ন করেন। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থানুকূল্যে তিনি অক্সফোর্ড থেকে ‘কনটেমপোরারী মিশনারী এ্যাকটিভিটিজ’ এর উপর ডক্টরেট লাভ করেন। মাদ্রিদে শাহ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্স তৈরী হবার পর মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় কমপ্লেক্সটি পরিচালনার সর্বময় দায়িত্ব দিয়ে তাকে মাদ্রিদে পাঠায়।
শাইখুল ইসলাম ডঃ আবদুর রহমান আন্দালুসী মেহমানদের বসিয়ে নিজে আসন গ্রহণ করে বললেন, ‘আগে পরিচয়টা হয়ে যাওয়া দরকার। যিয়াদ কে?’
‘আমি যিয়াদ বিন তারিক।’ বলল যিয়াদ।
‘সান অব দি গ্রেট তারিক বিন যিয়াদ।’ হেসে বলল শাইখুল ইসলাম।
সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল যিয়াদের মুখে।
‘এক অর্থে সবাই তো আমরা পূর্বসুরীদের সন্তান।’ বলল আহমদ মুসা।
শাইখুল ইসলাম তাকাল আহমদ মুসার দিকে। পবিত্রতা ও অসাধারণ প্রত্যয়ের দীপ্তিতে উজ্জ্বল তার মুখে শাইখুল ইসলামের চোখ দু’টি যেন আটকে গেল মুহূর্তের জন্যে। বলল শাইখুল ইসলাম আহমদ মুসার মুখে চোখ রেখেই, ‘সন্তান বটে, যোগ্য সন্তান নই।’
‘যোগ্য সন্তানের জন্যে যোগ্য পিতাও চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক ইয়ংম্যান, কিন্তু সন্তানের কি কোন দোষ নেই?’
‘আছে, সেটা কর্তব্য না করার। কিন্তু সর্বব্যাপি যে দুর্ভাগ্য তাদের ঘিরে ধরেছে এর জন্যে তারা দায়ী নয়।’
শাইখুল ইসলামের চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ ইয়ংম্যান, আসুন আমরা পরিচিত হই, তারপর আপনাদের কথা শুনব।’
যিয়াদ টেবিলের এক প্রান্তে বসেছিল। সেই-ই প্রথম পরিচয় দিতে এল। বলল, ‘আমি যিয়াদ বিন তারিক, আগেই জেনেছেন। আমি থাকি সিয়েরা নিবেদার পাহাড়ে। আমরা………’
যিয়াদকে থামিয়ে দিয়ে শাইখুল ইসলাম বললেন, ‘আপনি সেই যিয়াদ? ‘ব্রাদার্স ফর ক্রিসেন্ট’ এর যিয়াদ?’
‘জি, হ্যাঁ।’ বলল যিয়াদ।
শাইখুল ইসলামের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়াল যিয়াদের দিকে। আবার উষ্ণ হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া, তিনি আমার এক আশা আজ পূর্ণ করলেন। আমি আপনাকে কত যে খুঁজেছি। দুইবার লোক পাঠিয়েছি গ্রানাডায়, কিন্তু কোন সন্ধান তারা পায়নি।’
থামল শাইখুল ইসলাম। থেমেই আবার বলল, ‘জানেন, আপনাকে ‘ফ্যালকন’ বলে ডাকা হয়?’
‘জানি, তারা আমার উপর অনেক আশা করে, কিন্তু উপযুক্ত আমি নই।’
‘বশীর বিন মুগীরার পর আপনিই মানুষের মনে আশার আলো জ্বেলেছেন। কিছু করা যায়, এ চিন্তাও মানুষ হারিয়ে ফেলেছিল। আপনি হতাশার এই অন্ধকারে সাহসের একটা আলো প্রজ্বলিত করেছেন, যত ক্ষুদ্রই তা হোক।’
‘ধন্যবাদ শাইখ’ বলে যিয়াদের পাশে উপবিষ্ট জোয়ানের দিকে ইংগিত করে বলল, ‘ইনি জোয়ান ফার্ডিন্যান্ড। মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ বিজ্ঞানী। মুসলিম নাম ‘মুসা আবদুল্লাহ’।’
‘না, পরিচয় সম্পূর্ণ হলো না, ইউরোপীয় বিজ্ঞান পদক লাভ করেছে, এবার অনার্সে প্রথম না হয়ে দ্বিতীয় হয়েছে, মরিস্ক বলে’ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়েছে, বসত বাটিও হারাতে হয়েছে, সেই জোয়ান তো?’ গম্ভীর কন্ঠে বলল শাইখুল ইসলাম।
‘শাইখ দেখছি সবই জানেন।’ বলল যিয়াদ।
‘কোন সাহায্য কাউকে না করতে পারি, এটুকু খোঁজ না রাখলে আল্লাহর কাছে জি জবাব দেব?’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে শাইখুল ইসলাম হাত বাড়িয়ে দিল জোয়ানের দিকে। জোয়ানের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল, ‘তোমার আমি সন্ধান করেছি বৎস, কিন্তু নতুন ঠিকানা জানতে পারিনি। সন্ধান এখনও চলছে। খুব খুশী হলাম তোমার দেখা পেয়ে।’
‘ধন্যবাদ স্যার, আমাদের মত হতভাগ্যের কেউ এভাবে খোঁজ করতে পারে ভাবিনি। খুশী হলাম স্যার।’ বলল জোয়ান।
জোয়ানের পরেই বসে ছিল আহমদ মুসা।
যিয়াদ বলল, ‘শাইখুল ইসলাম স্যার, এবার আপনার সাথে এমন ব্যক্তির পরিচয় করিয়ে দেব যে, আপনি খুশী হবেন, খুব খুশী হবেন।’
‘কেন আপনাদের সাথে পরিচয়ে খুশী হইনি বুঝি!’ হেসে বলল শাইখুল ইসলাম।
‘জি না, শাইখ, এ খুশী ভিন্ন স্বাদের। এমন খুশীর মুহূর্ত কচিত কারো ভাগ্যে জোটে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ, বলুন মিঃ যিয়াদ।’ আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল শাইখুল ইসলাম।
‘ইনি আমাদের সম্মানিত ভাই, বিশ্বের মজলুম মুসলমানদের মহান বন্ধু, মহান নেতা আহমদ মুসা।’
শাইখুল ইসলামের চোখে-মুখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। বিস্ময়ের একটা প্রচন্ড জোয়ার গিয়ে তার চোখে-মুখে আছড়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্ত সে কথা বলতে পারলো না। রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে সে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তারপরেই সে লাফিয়ে উঠল আসন থেকে। বলল, ‘আহমদ মুসা! আহমদ মুসা!!
মিলে যাচ্ছে, আমি ফটোতে দেখেছি, থিক মিলে যাচ্ছে।’ বলে আসন থেকে ছুটে এল শাইখুল ইসলাম।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল।
শাইখুল ইসলাম এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আমার কি সৌভাগ্য! যাঁকে মদীনায় কাছে পেয়েও দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তাঁকে এভাবে এখানে দেখতে পাব, তা অসম্ভব একটা আশা। আল্লাহর অশেষ করুণা।’
আনন্দে আবেগে শাইখুল ইসলামের চোখ থেকে অশ্রু গড়াতে লাগল।
শাইখুল ইসলাম আহমদ মুসাকে অনেক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখলেন। তার এই আবেগের কাছে আহমদ মুসা বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, কি বলবে বুঝতে পারছিল না।
তারপর আহমদ মুসাকে বসিয়ে আসনে ফিরে গেল শাইখুল ইসলাম। বসে রুমালে চোখ মুছে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘জনাব, আপনি ফিলিস্তিন থেকে মিন্দানাওয়ের দিকে যাবার পথে মদিনা শরিফ গিয়েছিলেন। আমরা আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম, একটা সম্বর্ধনার আয়োজন করেছিলাম, কিন্তু সময় কম হওয়ায় সেটা বাতিল হয়ে যায়। আপনার দর্শন লাভের সৌভাগ্য আর হয়নি।’
‘আপনি বয়সে বড়, শিক্ষক তুল্য। এভাবে কথা বললে আমি বিব্রত বোধ করি জনাব।’ নরম কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘বয়স এবং পেটভরা নিস্ক্রিয় বিদ্যার কোন মূল্য আল্লাহর কাছে নেই জনাব আহমদ মুসা। মুজাহিদ হওয়া মুমিনের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। এই মুমিনরা আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী।’
‘কলম দিয়েও জিহাদ হয়, জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমেও জিহাদ হয়। আপনি সে জিহাদ করছেন।’
‘যখন চারদিক থেকে মজলুমের কান্না ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়, তখন সেটা কলমের জিহাদ আর জ্ঞান বিতরণের জিহাদের সময় নয় জনাব।’
‘ঠিক, তবে সুযোগ একটা বড় শর্ত। সুযোগ এলে আমি মনে করি কলমের যুদ্ধ যারা করছেন, তারা কলম নিয়ে বসে থাকবেন না অবশ্যই।’
‘এটাই আমাদের সান্ত্বনা জনাব, কিন্তু ভয় হয় এই সান্ত্বনায় থেকে আমরা পরকালীন মুক্তি পাব কিনা। থাক, আপনি বলুন, আপনি স্পেনে কিভাবে, কবে এসেছেন? গোটা বিষয়টা আমার কাছে এখনও স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।’
প্রশ্নের উত্তর দিল জোয়ান।
সে সংক্ষেপে আহমদ মুসার মাদ্রিদ বিমান বন্দরে নামার পর মারিয়ার ঘটনা থেকে শুরু করে যিঅদের মা ও স্ত্রীকে উদ্ধার পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করল।
শাইখুল ইসলাম ডঃ আবদুর রহমান আন্দালুসী মুর্তির মত বসে গোগ্রাসে গিলছিল কথাগুলো।
জোয়ানের কথঅ শেষ হওয়ার পরও কিছুক্ষন কথা বলল না শাইখুল ইসলাম। যেন কথাগুলো হজম করা এখনও তার শেষ হয়নি।
অবশেষে ধীরে ধীরে মুখ খুলল। বলল, ‘ইতিমধ্যেই এত কিছূ ঘটে গেছে! ইতিমধ্যেই দু’দুবার ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের বন্দীখানায় গেছেন তিনি?’
একটু থামল। গলাটা একটু পরিষ্কার করল শাইখুল ইসলাম। তারপর আবার শুরু করল, ‘জনাব আহমদ মুসা, দেখুন আপনি ক’দিন হলো এসেছেন, এর মধ্যেই পুরো সংঘাত শুরু হয়েছে শত্রুদের সাথে আপনার। কিন্তু আমি আজ দশ বছর এখানে, কেউ আমার গায়ে হাত দেয়নি। এর অর্থ কি? সত্যিই কি আমি পুরোপুরি ইসলামের উপর আছি?’
‘আপনার এই আবেগকে’, বলল আহমদ মুসা, ‘আমি শ্রদ্ধা করি জনাব। কিন্তু একটা জিনিস আপনাকে দেখতে হবে, আপনি যা করছেন সেই দায়িত্ব নিয়েই আপনি মাদ্রিদে এসেছেন আর আমি যে ধরনের কাজ নিয়ে এসেছি, সেই ধরনের কাজেই আমি জড়িয়ে পড়েছি।’
‘আমাকে এ দায়িত্ব দিয়েছে একজন মানুষ বা একটি সংস্থা। কিন্তু মুমিন হিসেবে আল্লাহর দেয়া কোন দায়িত্ব কি আমার উপর নেই?’
‘আছে।’ বলল আহমদ মুসা।, ‘কিন্তু সে দায়িত্ব বলে না খালি হাতে একা শত্রুর ব্যুহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে, বরং বলে শত্রুর উপর বিজয়ী হবার উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে।’
শাইখুল ইসলাম হাসল। বলল, ‘আপনার সাথে পারবো না আমি, আপনি আমার চেয়ে অনেক বেশী জানেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপনাকে রহম করুন, আল্লাহ আপনাকে আরও বরকত দিন। এখন বলুন, আপনি কি কাজ নিয়ে স্পেনে এসছেন, যে কাজের কথা আপনি বললেন।’
‘জনাব সেটা বলার জন্যেই এসেছি।’ বলে আহমদ মুসা একটু থামল। তারপর যুগোশ্লাভিয়ায় পাওয়া ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের দলিলে তেজষ্ক্রিয়ের মাধ্যমে শাহ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্সসহ স্পেনের সকল মুসলিম পূরাকৃর্তী ধ্বংস করার যে পরিকল্পনা রয়েছে তার বিবরণ দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘আমি এখানে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের হাতে বন্দী থাকা অবস্থায় তাদের সাথে কথায় নিশ্চিত হয়েছি, এ ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে।’
শুনতে শুনতে শাইখুল ইসলামের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। কপাল কুঞ্চিত হলো, তার সজীব ঠোঁট শুকিয়ে উঠল।
‘অর্থাৎ তারা স্পেন থেকে মুসলমানদের সকল স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলতে চায়।’ শুকনো কন্ঠে বলল শাইখুল ইসলাম।
‘জি হ্যাঁ, তাই। স্পেন থেকে সকল মুসলিম স্মৃতিচিহ্ন তারা মুছে ফেলতে চায়, সেই সাথে মুসলমানরো যেন স্পেনে আর কিছু না করতে এগিয়ে আসে, সে কথাও বলে দিতে চায়।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামল। আর কেউ কিছু বলল না। সবাই নিরব।
‘ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন’, উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলতে শুরু করল শাইখুল ইসলাম, ‘যদি শুরু হয়ে থাকে, তাহলে এই শাহ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্সসহ সবগুলো মুসলিম স্মৃতি সৌধে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের কাজ শুরু হেয় গেছে। আইম তো মনে করি মানুষও এখানে নিরাপদ নয়।’
‘জি হ্যাঁ, আমি যে কথা বলিনি। এই তেজষ্ক্রিয়ের প্রভাবে সংশ্লিষ্ট এবং আশে-পাশের লোকদের বংশ-বৃদ্ধি লেআপ পেয়ে যাবে এবং কালক্রমে নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মুসলিম কম্যুনিটি।’
বিস্ফোরিত হয়ে উঠল শাইখুল ইসলামের চোখ। বলল, ‘এত গভীর, এত জঘন্য ষড়যন্ত্র?’
একটু থামল। ঢোক গিলল। তারপর আবার বলল, ‘এখন এই অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা কিভাবে সম্ভব?’
‘এই পরামর্শের জন্যেই এসেছি জনাব। আমাদের জোয়ান পদার্থ বিজ্ঞানী। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের উপরই তার গবেষণা। সে বলছে, এই বিশেষ ধরনের তেজষ্ক্রিয় ডিটেক্টরে ধরা পড়ে না। এই ডিটেকশনের জন্যে দরকার ‘ম্যাটেরিয়াল এ্যানালঅইসিস’। কিন্তু স্পেনে এটা পারা যাবে না। মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যবস্থা কিছু আছে, কিন্তু ওখান থেকে কোন সহযোগিতা নেয়া নিরাপদ নয়। তাই ঠিক করেছি জোয়ানকে ইটালীয় ট্রিয়েষ্টে ডঃ আবদুস সালামের প্রতিষ্ঠিত গবেষনাগারে পাঠাব। আমি ফিলিস্তিনের মাহমুদ কে বলে দিলে সে ট্রিয়েষ্টে যোগাযোগ করে সহযোগিতা পাওয়ার ব্যবস্থা করবে। আমরা গ্রানাডা, কর্ডোভা, মালাগা থেকে স্যাম্পল পেলেই জোয়ানকে ট্রিয়েষ্টে পাঠাতে পারি।’
থামল আহমদ মুসা।
‘ডিটেকশন হওয়ার পর কি হবে?’ জিজ্ঞাসা করল শাইখুল ইসলাম।
‘তেজষ্ক্রিয়ের প্রকার-প্রকৃতি চিহ্নিত হবার পর এর প্রতিষেধক যোগাড় করতে হবে। এ ব্যাপারেও আমরা ট্রিয়েষ্টের সাহায্য পাব আশা করছি।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। কোত্থেকে স্যাম্পল আপনারা নেবেন, নেবার ব্যবস্থা করুন।’
‘ভিত্তি অংশ থেকে একটুকরো এবং বিল্ডিং এর উপরের অংশ থেকে এক টুকরো কংক্রিট হলেই চলবে। বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে শাইখুল ইসলাম ইন্টারকমে একজনকে নির্দেশ দিল আশফাক আমিনকে পাঠাও, সেই সাথে বলল, নাস্তা রেডী কিনা। ‘শুকরান’ বলে টেলিফোন রেখে দিল। ‘আশফাক আমিন কমপ্লেক্সের সিকিউরিটি অফিসার। তাকে বলে দিচ্ছি, এখনি দুই খন্ড কংক্রিট যোগাড় করে দেবে।’
‘ষড়যন্ত্রের বিষয়টা এবং আমাদের পরিচয় অন্য কাউকে এই মুহূর্তে আমরা জানতে দিতে চাই না জনাব।’ বলল আহমদ মুসা
‘এটাই ঠিক।’
ঘরে প্রবেশ করল সুঠাম দেহী এক যুবক।
‘আশফাক এস, কেমন আছ তুমি?’ স্নেহের স্বরে বলল শাইখুল ইসলাম।
‘ভাল আছি স্যার।’ বিনীত কন্ঠ আশফাকের।
‘তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে আশফাক। আমাদের বিল্ডিং এর ভিতের অংশ এবং বিল্ডিং এর উপরের কোন জায়গা থেকে এক খন্ড করে কংক্রিটের টুকরো যোগাড় করে দিতে হবে। পারবে না?’
‘পারব স্যার।’
‘ঠিক আছে আমরা নাস্তায় যাচ্ছি, তুমি ইতিমধ্যে চেষ্টা কর।
‘ঠিক আছে স্যার।’ বলে আশফাক পা বাড়াল যাবার জন্যে।
‘জনাব, আমি আশফাকের সাথে যেতে চাই।’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু নাস্তা..।’
‘ওঁদের নিয়ে আপনি যান, আমি এসে নাস্তা করব।’
শাইখুল ইসলাম ভাবল, আহমদ মুসার মত লোক বিনা প্রয়োজনে, বিনা কারনে কিছু করে না। বলল আশফাককে উদ্দেশ্য করে, ‘ইনি আমাদের অত্যন্ত সম্মানিত মেহমান, তুমি নিয়ে যাও সাথে। তোমাকে সাহায্য করবেন।’
আহমদ মুসা ও আশফাক শাইখুল ইসলামের ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
আগে চলছিল আশফাক, পেছনে আহমদ মুসা। আহমদ মুসা দেখল, যে পথ দিয়ে এ কক্ষে তারা এসেছিল সে কক্ষ দিয়েই তারা এগুচ্ছে।
সেই মুয়াজ্জিন সাহেবের দরজার সামনে দিয়ে এগুচ্ছিল আহমদ মুসারা। আহমদ মুসা দেখল, এবারও মুয়াজ্জিন সাহেব দরজায় দাঁড়িয়ে। দরজা বরাবর আসতেই মুয়াজ্জিন সাহেবই এবার সালাম দিল মনে হল, তাদেরই জন্যে সে দরজায় অপেক্ষা করছিল। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, আহমদ মুসারা আসছে তা সে জানল কি করে!
দুই টুকরো কংক্রিট যোগাড় করে ফিরছিল আহমদ মুসা এবং আশফাক আমিন রিসেপশন রুমের সামনে দিয়ে।
রিসেপশনিস্ট কান থেকে টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল, একটা ফোন স্যার, আপনাদের, খুব জরুরী।
‘টেলিফোন’ আমাদের নামে এখানে! মনে মনে চমকে উঠল আহমদ মুসা তবু ছুটল টেলিফোন ধরার জন্যে।
‘হ্যালো’ রিসিভার তুলে নিয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘আমি জোয়ানের বন্ধু’।’ ওপার থেকে ইংরেজী ভাষায় উত্তর এল। কন্ঠ শুনেই চিনতে পারলো জেনের গলা। বুঝতে পারল নাম গোপন রাখতে চাচ্ছে। আহমদ মুসাও বলল, আমিও জোয়ানের বন্ধু, তোমাকে চিনতে পেরেছি। জরুরী কিছু?
‘খুবই জরুরী’, ওখান থেকে আপনাদের কথা ওদেরকে কেউ জানিয়েছে, ওরা যাচ্ছে।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ বোন, চিন্তা করোনা। রাখি।’ বলে টেলিফোন রেখে দিয়ে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা। তার মুখ গম্ভীর, চিন্তা করছে। এখান থেকে আমাদের কথা কে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে জানাল! এই কথা শোনার সময় থেকেই বার বার তার সামনে ভেসে উঠছে ঐ মুয়াজ্জিনের মুখ।
‘কোন খারাপ খবর স্যার?’ বলল আশফাক আমিন।
আহমদ মুসা হেসে আশফাকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি যদি তোমাকে একটা হুকুম দেই পালন করবে?’
‘জি স্যার।’
‘চল, বলে আগে চলল আহমদ মুসা। পেছনে আশফাক।
সেই মুয়াজ্জিনের ঘরের সামনে দাঁড়াল আহমদ মুসা। আশফাকও তার পাশে এসে দাঁড়াল। ‘মুয়াজ্জিন সাহেব কি এখনো ঘরে?’ আশফাকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘দেখতে হবে।’ বলে আশফাক দরজায় নক করতে গেল।
আহমদ মুসা হাত তুলে তাকে নিষেধ করে বলল, ‘কি করতে হবে আগে শুন।’
‘কি করতে হবে, বলুন।’
‘মুয়াজ্জিন সাহেবের ঘর সার্চ করতে হবে।’
‘সার্চ করতে হবে, কেন?’ চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করল আশফাক।
এই সময় নাস্তা সেরে ফিরছিল শাইখুল ইসলাম এবং যিয়াদরা।
আশফাক ছুটে গেল শায়খুল ইসলামের কাছে। তাকে জানাল আহমদ মুসার কথা। শুনে শায়খুল ইসলামের চোখও বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে উঠল। ইশারায় ডাকল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা গেল।
‘কিছু ঘটেছে?’ জিজ্ঞাসা করল শাইখুল ইসলাম আহমদ মুসাকে।
‘ঘটেছে। বলব। মুয়াজ্জিন সাহেবের ঘরে কোন টেলিফোন আছে?’
‘না, নেই।’ বলল শাইখুল ইসলাম।
‘রিসেপশান ছাড়া নিচের তলায় আর কোথায় টেলিফোন আছে?’
‘আমার পি, এস, এর রুমে আছে এবং আমার রুমে আছে।’
‘আমার মনে হয়, মুয়াজ্জিন সাহেবের রুমে ওয়্যারলেস সেট আছে।’ এখনই সার্চ হওয়া দরকার।’
মুহুর্ত কয়েক আহমদ মুসার দিকে বিস্ময়ের সাথে চেয়ে থেকে আশফাককে বলল, ‘যাও উনি যা বলেছেন তা কর।’
আশফাক মুয়াজ্জিনের ঘরের দিকে চলে গেল।
সবাই ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল। ওখান থেকে মুয়াজ্জিন সাহেবের ঘরের দরজা দেখা যায়।
আশফাক মুয়াজ্জিনের ঘরে ঢুকার কয়েক মুহূর্ত পরেই কথা কাটাকাটির শব্দ পাওয়া গেল। তার পরেই দেখা গেল আশফাককে হাত উপরে তুলে পিছু হটে বাইরে আসতে। মুয়াজ্জিনের হাতে পিস্তল, উদ্যত আশফাকের বুক বরাবর।
মুয়াজ্জিন সাহেব বাইরে বেরিয়েই দেখতে পেল শায়খুল ইসলাম এবং আহমদ মুসাদের। দেখতে পেয়েই ডান হাতের পিস্তলটা আশফাকের দিকে উদ্যত রেখেই বাম হাতটা সে চোখের পলকে পকেটে ঢুকাল।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল, মুয়াজ্জিন নিশ্চয় দ্বিতীয় রিভলবার বের করতে যাচ্ছে, অথবা গ্রেনেড, নয়তো আরও বড় কিছু।
আহমদ মুসা আগেই রিভলবার বের করে নিয়েছিল। রিভলবার মুয়াজ্জিনের দিকে তুলে ধরে বলল, পকেট থেকে হাত বের করবেন না। মাথাগুড়ো হয়ে …
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই মুয়াজ্জিনের পিস্তল আশফাকের দিক থেকে বিদ্যুৎ গতিতে ঘুরে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাও তার কথা মুখে রেখেই রিভলবারের ট্রিগারে রাখা আঙুলে চাপ দিল। ছুটে যাওয়া গুলি গিয়ে মুয়াজ্জিনের ডান হাতটা বিদ্ধ করল, তার বিধ্বস্ত হাত থেকে পিস্তল খসে পড়ল। কিন্তু তার বাম হাত তবু পকেট থেকে বেরোলই। আশফাক তার উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু মুয়াজ্জিন অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সাথে পাশে দু’ধাপ সরে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই বাম হাতটি উপরে তুলল। তার হাতে গ্রেনেড। কিন্তু হাত নিচে নেমে আসার আগেই আহমদ মুসার দ্বিতীয় গুলি তার বাম বাহু ভেদ করল। গ্রেনেডটি তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল। কিন্তু বিস্ফোরিত হল না। সম্ভবতঃ পিন তখনও খোলা হয়নি।
মুয়াজ্জিন বসে পড়েছে।
বসে পড়েই সে তার বাম বাজুতে কাপড়ে ঢাকা কি একটা কামড়ে ধরেছে।
আঁতকে উঠল আহমদ মুসা। ছুটে গেল তার কাছে, কিন্তু ততক্ষনে ঢলে পড়েছে মুয়াজ্জিনের দেহ।’
আহমদ মুসা দেখল, প্রান নেই মুয়াজ্জিন সাহেবের দেহে। বাম বাহুর যে জিনিসটি সে কামড়ে ধরেছিল, সেটা পরীক্ষা করে দেখল, সায়নাইড ক্যাপসুল।
শায়খুল ইসলাম এবং অন্যান্যরাও এসে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসার পেছনে।
‘ধরা পড়তে না হয় এ জন্যে পটাসিয়াম সাইনাইডের ব্যবস্থাও রেখেছিল? তাহলে সে ‘সুইসাইড স্কোয়াডের’ লোক!’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল শায়খুল ইসলাম। একটা আতংক এসে তার মুখ ছেয়ে ফেলেছে।
‘জি জনাব, এ নিশ্চিতভাবেই ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্লানের সুইসাড স্কোয়াডের এজেন্ট।’ উঠে দাঁড়িয়ে বলল আহমদ মুসা।
শায়খুল ইসলাম কিছুই বলল না। তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে চোখে রাজ্যের আতংক ও উদ্বেগ নিয়ে।
‘আসুন জনাব মুয়াজ্জিন সাহেবের ঘরে আরও কিছু পাওয়া যাবে, বলে আহমদ মুসা পা বাড়াল মুয়াজ্জিন সাহেবের ঘরের দিকে।
পেছনে পেছনে শায়খুল ইসলাম সহ সবাই।
ঘরে বালিশের তলায় পাওয়া গেল ক্ষুদ্র অয়্যারলেস সেট। দেখেই বুঝল আহমদ মুসা, অয়্যারলেস সেট ক্ষুদ্র বটে, কিন্তু পাওয়ারফুল। হাতে নিয়ে সেটটির এ্যান্টেনা টেনে লম্বা করে বলল , শাইখুল ইসলাম এই ওয়্যারলেসটির মাধ্যমেই সে আমাদের আগমনের খবর বাইরে পাঠিয়েছে।’
মুয়াজ্জিন সাহেবের খাটিয়ার নিচে পাওয়া গেল একটি রেডিও রেকর্ডার। রেকর্ডার টি বিশেষ ধরনের। ২৪ ঘন্টা রেকর্ডার চললেও ভেতরের একটা ক্যাসেটই তা কভার করতে পারে।
আহমদ মুসা রেকর্ডার হাতে নিয়ে বিস্মিত হলো, রেকর্ডারটি তখনও চলছে।
‘কি রেকর্ড করছে রেকর্ডার?’ নিজের মনকে নিজেই প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘রেকর্ডার চলছে, কিছু রেকর্ড করছে জনাব।’ শাইখুল ইসলামের দিকে কথা কয়টি বলে আহমদ মুসা রেকর্ডারটির ‘রিভার্স’ বোতামটি টিপে দিল। কিছুদূর ব্যাকে নিয়ে প্লেয়ার স্টার্ট দিল আহমদ মুসা।
কিছুটা ফাঁকা, তারপরই শুরু হলো কথা। প্রথমেই কন্ঠস্বর শাইখুল ইসলামের। তিনি বলছেন, ‘আগে পরিচয়টা হয়ে যাওয়া দরকার, যিয়াদকে?’ তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলতে লাগল শাইখুল ইসলাম ও আহমদ মুসাদের মধ্যেকার কথোপকথনের রেকর্ড। মাঝখানে প্লেয়ার বন্ধ করে দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘চলুন আপনার টেবিলে কোথাও রেডিও ট্রান্সমিটার পাতা আছে।’
শাইখুল ইসলামের টেবিলে পরীক্ষা করে দেখা গেল টেবিলের পেন স্ট্যান্ডের পেন হোল্ডারের মেটালিক বোর্ডটাই একটি রেডিও ট্রান্সমিটার। আহমদ মুসা কলম স্ট্যান্ডটি ভেঙে ট্রান্সমিটারটি বের করে আনল। বলল, এই ট্রান্সমিটারের সাহায্যে শাইখুল ইসলামের অফিসের যাবতীয় কথা মুয়াজ্জিন রুপী ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের এজেন্টটি রেকর্ড করতো এবং প্রয়োজনীয় সব তথ্য সে পাঠিয়ে দিত ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের কাছে। আজকে আমাদের পরিচয়টা সে ওদের কাছে পাঠিয়েছে, জানিনা আমাদের সব কথা সে পাঠিয়েছে কিনা।
হতবুদ্ধি ও বিহব্বল হয়ে পড়েছিল শাইখুল ইসলাম। তার ভাবনা, এত বড় শত্রুকে পাশে নিয়ে সে চলেছে। তার সব কথা শত্রুরা জেনে ফেলেছে। এই মুয়াজ্জিন স্পেনের মিসরীয় দুতাবাসে আরবী অনুবাদকের কাজ করত তার আরবী জ্ঞান, কেরায়াত দেখে এবং মিসরীয় দুতাবাসের সুপারিশে তাকে মুয়াজ্জিন পদে নিয়োগ দেয়া হয়। শাইখুল ইসলামের মন বেদনায় ভরে গেল, কমপ্লেক্সের এতগুলো লোক এত দিনেও তার ষড়যন্ত্রের কিছুই ধরতে পারেনি, সামান্য সন্দেহও কারও মনে জাগেনি। সেই সাথে শ্রদ্ধায় নুয়ে গেল তার মন, আহমদ মুসা কমপ্লেক্সে পা দেবার সংগে সংগেই সে ধরা পড়ে গেল। মুখ একটু উপরে তুলে বলল শাইখুল ইসলাম আহমদ মুসার দিকে চেয়ে, আল্লাহর হাজার শুকরিয়া, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন। আল্লাহ আপনাকে বিস্ময়কর চোখ আর বিস্ময়কর বুদ্ধি দিয়েছেন। যাকে আমরা এক দশকেও ধরতে পারিনি, তাকে আপনি একবার দেখেই ধরে ফেললেন!’ বলবেন কি দয়া করে, কি দেখে আপনার সন্দেহ হয়েছিল?’
‘এখানে আসার পর ওর সাথে দু’বার ওর সাথে দেখা হয়েছে। দরজায় দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য ওর অপেক্ষা করা এবং তার দৃষ্টিকে আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। তার সম্পর্কে মনে একটা সন্দেহর সৃষ্টি হয়েছিল। তার উপর আশফাকের সাথে ফেরার পথে রিসিপশনে জোয়ানের সহপাঠি জেনের কাছ থেকে টেলিফোন পেলাম যে, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান আমাদের এখানে আসার খবর জানতে পেরেছে এবং এখানে ওরা আসছে, তখন আমি নিশ্চিত হলাম, ঐ মুয়াজ্জিনই খবর দিয়েছে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে।
‘ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান কি কমপ্লেক্সে আসছে ?’ মুখ কালো করে জিজ্ঞাসা করল শাইখুল ইসলাম।
‘আমি নিশ্চিত ওরা আসছে।’
‘পুলিশকে কি খবর দেব ?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল শাইখুল ইসলাম।
‘জানিনা, পুলিশ কি আপনাকে সাহায্য করবে, না ওদের সাহায্য করবে ? তাছাড়া মুয়াজ্জিন আহত হওয়া, মারা যাওয়ার কি ব্যাখ্যা দেবেন পুলিশকে। ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এই ঘটনা থেকে ফায়দা উঠানোর সুযোগ গ্রহন করবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে ?’ অসহায় কন্ঠ শাইখুল ইসলামের।
‘কমপ্লেক্সের ভিতরে কিছু ঘটুক আমরা চাইনা জনাব, আমরা চলে যাচ্ছি।’
একটু ম্লান হাসল শাইখুল ইসলাম। বলল, জনাব, আমি কমপ্লেক্স নিয়ে ভাবছি না, আপনাদের নিরাপত্তাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় এখন।’
একটু থামল শাইখুল ইসলাম। আবার বলল, ‘আপনারা চলে যাবেন কেমন করে, ওরা নিশ্চয় এতক্ষণে বে্রুবার পথ বন্ধ করে দিয়েছে।’
‘পথে পা দিলেই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে, আল্লাহর সাহায্য আসবে।’
‘একটা পথ আছে, মুখ উজ্জল করে বলল শাইখুল ইসলাম, ‘আমাদের পশ্চিম প্রচীরের মার্কেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের যে ষ্টোর আছে, তার সাথের প্রাচীরের ওপারের মার্কেট অফিসের যোগাযোগের জন্যে প্রচীরে একটা দরজা আছে। বাইরের থেকে সে দরজা দেখা যায় না। ঐ পথ দিয়ে গেলে কাকপক্ষিও টের পাবে না।’
আহমদ মুসার মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। বলল, ‘ঠিক আছে, যিয়াদ, জোয়ন এবং রবার্তো তোমরা ঐ পথে চলে যাও।’
‘আপনি ?’ বলল জোয়ান।
‘আমাকে সদর দরজা দিয়েই বের হতে হবে ?’
‘কেন ?’ বলল শাইখুল ইসলাম।
‘আমি ওদের টার্গেট, আমাকে বের হতে না দেখলে ওরা ভেতরে ঢুকে আমাকে খোঁজার জন্যে গোটা কমপ্লেক্স তছনছ করবে এবং আমার সাথে কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের যোগসাজস আছে বলে ধরে নেবে। এতে কমপ্লেক্সের ক্ষতি হবে।’
‘তাহলে আমরা সবাই একসাথে সদর গেট দিয়ে বেরোব।, বলল যিয়াদ।
‘যখন পথ আছে, তখন সবাই এক সাথে বিপদগ্রস্থ হয়ে লাভ নেই। তাছড়া এখানে কারা আমার সাথী, এটা আমি তাদের জানতে দিতে চাই না। কাজের এতে সুবিধা হবে।’
‘আপনার যুক্তি ঠিক, ’ বলল শাইখুল ইসলাম, ‘কিন্তু শত্রুর শক্তি সম্পর্কে না জেনে একা তাদের মুখোমুখি হওয়া কি ঠিক হবে ?’
‘বেশী পরিমাণ লোক দেখলে ওরা বেশী পরিমাণ সতর্ক ও আক্রমনাত্নক হবে। আর একা একজনকে দেখলে ওদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই একটা ‘অতি আত্নবিশ্বাসের’ ভাব সৃষ্টি হবে যা আমাকে সাহায্য করবে।’
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। শাইখুল ইসলামকে লক্ষ করে বলল, ‘জনাব ওদের যাবার ব্যবস্থা করুন। আমি এখুনি এখান থেকে বেরুতে চাই।’
শাইখুল ইসলাম সহ যিয়াদ, জোয়ান, রবার্তো সবাই উঠে দাঁড়াল। যিয়াদ, জোয়ান, রবার্তোর মুখ ভার। বুঝাই যাচ্ছে, আহমদ মুসার সিদ্ধান্তে ওরা সন্ত্মুষ্ট হয়নি।
আহমদ মুসা তার দু’হাত যিয়াদ ও জোয়ানের কাঁধে রেখে বলল ‘তোমরা মন খারাপ করো না। আমার কথা তোমরা নিশ্চয়ই বুঝেছ। আর চিন্তার কিছু নেই। ওরা জানে যে, ওদের ওঁৎ পেতে থাকার ব্যাপারটা আমরা জানি না, সুতরাং অপ্রস্তুত অবস্থায় ফাঁদে পা দেব কিন্তু আমি অপ্রস্তুত অবস্থায় যাচ্ছি না। অতএব ঘটনার নিয়ন্ত্রণটা আমার হাতে থাকবে।
শাইখুল ইসলাম আনন্দ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে। তার মনে বিস্ময়, প্রতিটি বিষয়ের দিকে আহমদ মুসার এত সূক্ষ্ণ দৃষ্টি। সাথীদের প্রতি তার এত দরদ এবং তাদের নিরাপত্তা্র প্রতি তাঁর এত সতর্কতা। পরিস্থিতির এমন চুলচেরা বিশ্লেষণ সে করে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলে শাইখুল ইসলাম বলল, ‘আল্লাহ আপনার সহায় হোন। এঁদের আমি নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আপনি বলুন, ‘আপনার সাথে আবার কবে দেখা হবে কিংবা কিভাবে যোগাযোগ হবে। আমাদেরকে চরম উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাতে হবে।’
‘সমানভাবে আমরাও উদ্বিগ্ন জনাব, আমরাই যোগাযোগ করব।’
বলে আহমদ মুসা সালাম দিয়ে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েই আবার ফিরল সে। শাইখুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের লোকেরা অবশ্যই আসবে, আপনাদের বিরক্ত করতে চাইবে। তাদের বলে দেবেন, আমরা এসেছিলাম, চলে গেছি, আমাদের কোন খোঁজ আপনারা জানেন না। বহু পর্যটক এমন আসে। তাদের খোঁজ রাখা আপনাদের দায়িত্ব নয়। আর ওরা ঐ মুয়াজ্জিনের খোঁজ অবশ্যই করবে। আপনি ওদের বলে দেবেন, আমি মুয়াজ্জিন সাহেবের সাথে একান্তে কি বলেছি, তারপর থেকে মুয়াজ্জিন সাহেব আর নেই। বলবেন, আমার সাথের লোকেরা দেয়াল টপকে পালিয়েছে, তারাই সম্ভবতঃ মুয়াজ্জিন সাহেবকে সাথে নিয়ে গেছে। ওরা বেশী ঝামেলা করলে, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে বিষয়টা জানাবেন। আপনাদের নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব সরকারের।’
শাইখুল ইসলামের মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। মনে হয় নিরাপত্তার এদিকটার কথা এতক্ষণে মাথায় আসেনি।
আহমদ মুসা আবার সালাম দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
শাইখুল ইসলাম আশফাক আমিনকে বলল, ‘তুমি ওঁর সাথে অন্ততঃ গেট পর্যন্ত যাও। কিছুর প্রয়োজন হলে তুমি দেখ।’
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তার সাথে আশফাক আমিনও।
সাথে চলতে চলতে আশফাক আমিন বলল, ‘জনাব জীবনে কখনও কোন বড় কাজ করিনি, আমি কি আপনার সাথী হতে পারি না?
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তোমার কাঁধে যে দায়িত্ব সেটা তো ছোট কোন কাজের দায়িত্ব নয়।’ তারপর একটু থেমে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘ওদের সাথে যত কম লোককে জড়িয়ে পারা যায়, যত কম লোককে ওদের সামনে হাজির করা যায়, ততই মংগল। এ ছাড়া তোমাকে সাথে নেয়ার ক্ষেত্রে আর কোন আপত্তি নেই।’
আশফাক আমিনের মুখ ম্লান হলো। তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় সে ক্ষুণ্ন হয়েছে বুঝা গেল।
আহমদ মুসা আশফাক আমিনের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘দেখ আমার মত তোমরা বিদেশী নও। তোমাদেরকে স্পেনে থাকতে হবে সুতরাং অপরিহার্য কোন প্রয়োজন ছাড়া ওদের কাছে চিহ্নিত হওয়া বোকামী বুঝলে। এই বোকামী আমি এড়াতে চাই।’
আশফাক আমিনের মুখ এবার উজ্জল হয়ে উঠল। বলল, ‘বুঝেছি জনাব। কিন্তু আপনি এতটা সামনে দেখে সিদ্ধান্ত নেন।’
গাড়িতে ওঠার আগে আশফাক আমিনের সাথে হ্যান্ডশেক করল আহমদ মুসা। আশফাক আমিনের মুখ শুকনো। সে আহমদ মুসার হাত না ছেড়ে বলল ‘জনাব এভাবে ভয়ংকর এবং শক্তিশালী শত্রুর মুখোমুখি হতে আপনার ভয় করে না?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘মৃত্যুর সেই সময় না এলে কেউ কাউকে বাঁচাতে পারে না, আর মৃত্যুর সময় না এলে কেউ কাউকে মারতে পারে বলে কি তুমি মনে কর?’
‘না, জনাব।’
‘তাহলে আর ভয় কিসের?’
বলে, আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট্ দিল।
আহমদ মুসার গাড়ি গেটের কাছে পৌঁছতেই গেট খুলে গেল।
খোলা গেট পেরিয়ে আহমদ মুসার গাড়ি একবার লাফিয়ে উঠে তীব্র বেগে চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা হিসাব আগেই কষেছিল। গেট থেকে সেক্রেটারিয়েট এভ্যুনুর দূরত্ব প্রায় দু’শ গজ। সবটা বিচার-বিবেচনা করে আহমদ মুসা নিশ্চিত হয়েছে, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এই দু’শ গজকেই তাদের অভিযানের জায়গা হিসাবে বেছে নিবে। তাদের ফাঁদটা কেমন হবে, সে কথাও ভেবেছে আহমদ মুসা। সে লা-গ্রীনজা থেকে মাদ্রিদে ফেরার পথে তাকে যেভাবে বন্দী করা হয়েছিল, আহমদ মুসার তা মনে পড়েছিল। সেই কৌশল ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এবারও গ্রহন করতে পারে বলে আহমদ মুসার মনে হয়েছে। গেট পেরিয়ে আহমদ মুসার গাড়ি যখন নিশ্চিন্তে সেক্রেটারিয়েট এভ্যুনুর দিকে এগুবে, তখন হঠাৎ তারা চারদিক থেকে আহমদ মুসাকে ঘিরে ফেলবে।
আহমদ মুসার গাড়ি এগুচ্ছিল ঝড়ের বেগে।
সেক্রেটারিয়েট এভ্যুনুতে পৌঁছার দুই-তৃতীয়াংশ পথ যখন এগিয়েছে, তখন আহমদ মুসা দেখতে পেল তার ডান, বাম ও সামনের দিক থেকে তিনটে গাড়ি তার দিকে ছুটে আসছে। ডান ও বাম দিকের গাড়ি দু’টো একটু পিছিয়ে পড়ার কারণে ওগুলো পেছন থেকে কোনাকুনি তার দিকে এগিয়ে আসছে। সম্ভবতঃ আহমদ মুসা এমন দ্রুত এগিয়ে আসার কারণেই তারা পিছিয়ে পড়েছে। আহমদ মুসার গাড়ি এমন পাগলা গতিতে তীব্র বেগে ছুটবে গেট থেকে বের হয়েই তা তারা ভাবতে পারেনি।
আহমদ মুসা বাম হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে পিং পং বলের মত দু’টা বস্তু বের করে ছুড়ে মারল তার গাড়ির পাশেই।
তারপর টেনিস বলের মত আরেকটা গোলাকার বস্তু পকেট থেকে বের করে একবার পেছনে তাকাল। দেখল. পেছনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঘন কালো ধোয়ার দেয়াল পেছনে অমাবস্যার রাত ডেকে এনেছে।
আহমদ মুসা সামনে তাকিয়ে দেখল গজ বিশেক দূরে সামনের গাড়িটি দাঁড়িয়ে পড়েছে। আহমদ মুসা গাড়ির গতি বিন্দুমাত্র না কমিয়ে, আরও কয়েক গজ এগিয়ে ডান হাতের টেনিস সাইজের বলটা সামনের মাইক্রোবাসটার লক্ষ্যে ছুঁড়ে মেরেই বাম হাতে স্টিয়ারিং ঘুড়িয়ে গাড়ি রাস্তা থেকে ডান’ দিকে নামিয়ে নিল এবং উঁচু-নিচু মাটির উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তীব্র বেগে সামনে এগিয়ে চলল। পাশ দিয়ে মাইক্রোবাসটি যখন অতিক্রম করছিল, দেখল বিশেষ ধরনের পাওয়ারফুল গ্রেনেডের বিস্ফোরণ মাইক্রোবাসটিকে টুকরো টুকরো করে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছে। শিউরে উঠল আহমদ মুসা। এই গ্রেনেডটাই মুয়াজ্জিন সাহেব ছুড়তে যাচ্ছিল শাইখুল ইসলাম ও আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে। তার ইচ্ছা পূরণ হলে শুধু তারাই নয়, আশে-পাশের ঘরগুলোও উড়ে যেত।
আহমদ মুসার গাড়ি এসে সেক্রেটারিয়েট এভ্যুনুতে উঠল। আহমদ মুসা চোখ ফিরিয়ে দেখল, স্মোক বোম্বের কাল ধোয়া গাড়ি বিস্ফোরণের জায়গা পর্য্ন্ত এসে পৌঁছেছে। গোটা এলাকাটাই কাল অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। মসজিদ কমপ্লেক্সের গেট পর্য্ন্ত দেখা যাচ্ছে না।
আহমদ মুসার গাড়ি সেক্রেটারিয়েট এভ্যুনু ধরে চলতে লাগল উত্তরে। তার লক্ষ্য সারিয়ার ভাই ফিডেল ফিলিপের বাড়ি।
আহমদ মুসারা মাদ্রিদে এসে এবার উঠেছিল রাবার্তোর ছোট বাড়িটাতে। কিন্তু জায়গাটা নিরাপদ মনে না করায় তারা গিয়ে ওঠে জোয়ানের বাড়িতে। ইচ্ছা করেই তারা গিয়ে ওঠে জোয়ানের বাড়িতে। ইচ্ছা করেই তারা এবার হোটেলে ওঠেনি। প্রত্যেক আবাসিক হোটেলেই ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এবং সরকারের লোকরা ঘুর ঘুর করে। পরে ফিডেল ফিলিপ জানতে পেরে আহমদ মুসাকে তার বাড়িতে নিয়ে এসেছে। বাড়িটা বড় নিরাপদ। তার উপর টেলিফোন থাকায় আহমদ মুসা খুব আপত্তি না করেই চলে এসেছে। কিন্তু জোয়ান যিয়াদকে আসতে দেয়নি। কিন্তু তারা চারজন তিন জায়গায় থাকলেও প্রতিদিন সকালে ফিডেল ফিলিপের বাসায় এসে তারা সকলে নাস্তা করে। তারপর শলা-পরামর্শ্ করে দিনের কাজ ঠিক করে।
কিছুদূর এগোনোর পর আহমদ মুসা পেছন ফিরে দেখল কেউ অনুসরণ করছে কিনা। না, পেছনে কোন গাড়ি নেই নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা। ভাবল, গাড়ি দু’টা নিশ্চয় বিস্ফোরিত গাড়িটা নিয়ে ব্যস্ত। কয়জন লোক ছিল গাড়িটাতে? নিশ্চয় কেউ বেঁচে নেই। ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার। ষড়যন্ত্রকারীদের জিঘাংসা আগুনে পুড়ে কত লোক এইভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সামনে প্রসারিত চোখ দু’টি আহমদ মুসার বেদনায় ভারি হয়ে উঠল।
গাড়িটি তখন সেক্রেটারিয়েট এভ্যুনু পেছনে ফেলে ফিলিপ স্কোয়ার ধরে ছুটে চলছিল।
৩
ইটালীর ক্ষুদ্র নগরী ট্রিয়েষ্টে পৌঁছে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ডঃ আবদুস সালামের পৃথিবী খ্যাত বিজ্ঞান গবেষণাগার ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স’ খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না জোয়ানের। গবেষণাগারটি দাঁড়িয়ে আছে আড্রিয়াটিক সাগরের শান্ত কূলে। দক্ষিণ মুখী গবেষণাগারটির সর্ব্ দক্ষিনে বহিঃপ্রাচীর ঘেষে দাঁড়ানো ছোট্ট মসজিদটির জায়গায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে দিগন্ত বিস্তৃত আড্রিয়াটিকের অবারিত বুক।
ট্রিয়েষ্ট শহরটাই অদ্ভুত সুন্দর লেগেছে জোয়ানের। যুগোশ্লাভ সীমান্তের গা ঘেষে দাঁড়ানো ট্রিয়েষ্টের তিন পাশই সাগরে ঘেরা। আড্রিয়াটিকের নীল জ্বলে ভাসমান ট্রিয়েস্টের তিন পাশই সাগরে ঘেরা। আড্রিয়াটিকের নীল জ্বলে ভাসমান ট্রিয়েষ্ট যেন একটা সফেদ রাজ হংস। জোয়ান ভাবল, বিজ্ঞানী আবদুস সালাম শুধু জটিল পদার্থ্ বিজ্ঞান নিয়েই চর্চা করতেন না, তিনি মনে মনে কবিও ছিলেন। না হলে ইটালির সব বাদ দিয়ে প্রায় যুগোশ্লাভ সীমান্তে এসে সাগর-বাসী ট্রিয়েষ্টকে তিনি বাছাই করলেন কেন।
জোয়ান ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স’ এর মসজিদের ছায়ায় দাঁড়িয়েছিল। দুনিয়ার একটি শ্রেষ্ঠ পদার্থ্ বিজ্ঞান গবেষণাগারের সাথে মসজিদ দেখে জোয়ান বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিল। জোয়ান এর আগে ট্রিয়েষ্টে আসেনি, ইউরোপের অন্যান্য জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞান-গবেষনাগারে ঘুরে বেড়িয়েছে, কিন্তু কোথাও গীর্জা দেখেনি, মসজিদ দেখেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে তার বিস্ময় কেটে গেছে। তাঁর মনে হয়েছে, নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ডঃ আবদুস সালাম শুধু তো দুনিয়ার একজন শীর্ষ্ বিজ্ঞানী নন, তিনি মুসলমানও। এবং নামে মাত্র মুসলমান তিনি নন। তিনি ইসলামের বিধান সমূহ নিষ্ঠার সাথে পালন করেন এবং ভালোবাসেন তিনি ইসলামকে, মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে। তিনি চান ইসলাম ও মুসলামদের গৌরবময় যুগ আবার ফিরে আসুক। পশ্চিমের বিজ্ঞানের যে দান, সে দান মুসলামনরা ভিক্ষুকের মত হাত পেতে গ্রহণ করায় বিজ্ঞানী আবদুস সালাম দারুণভাবে বেদনা বোধ করেন, অপমান বোধ করেন। জোয়ানের মনে পড়ল ডঃ আবদুস সালামের একটা বিখ্যাত বক্তৃতার কথা সে বক্তৃতার উপসংহারে বিজ্ঞানী আবদুস সালাম বলেছেন-
‘জ্ঞান সৃষ্টির এই অভিযানে আমাদের অংশ গ্রহণ করা সম্বন্ধে আমি যে এই আবেগ পূর্ণভাবে সুপারিশ করছি তার কারণ কি? এটা কেবল এ জন্য নয় যে, জানবার আগ্রহ দিয়ে আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন, এটা এ জন্যও নয় যে আজকের অবস্থায় জ্ঞানই শক্তি এবং প্রয়োগিক বিজ্ঞানে তা বস্তুগত উন্নতির প্রধান অস্ত্র; বরং এটা এজন্যে যে, আন্তর্জাতিক সমাজের সদস্য হিসাবে যারা জ্ঞান সৃষ্টি করেন তারা আমাদের জন্যে- অব্যক্ত কিন্তু তবু অস্তিত্বশীল- যে ঘৃণার চাবুক রেখে দেন তা আমি অনুভব করি।
আমার এখনো মনে আছে কয়েক বছর আগে কোনো ইউরোপীয় দেশের পদার্থ্ বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী একজন বিজ্ঞানী আমাকে বলেছিলেন, ‘সালাম, আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে, ঐ সব জাতিকে রক্ষা করা, সাহায্য করা এবং বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্য, সে দেশ যারা মানুষের জ্ঞান ভান্ডারে বিন্দুমাত্র কিছু সৃষ্টি করেনি বা দেয়নি?’ এবং যদিও সে বিজ্ঞানী এ কথা বলেননি তবু যখনই আমি কোন হাসপাতালে প্রবেশ করি তখনই আমার আত্মমর্যাদা বিরাটভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়। এটা দেখে যে, আজকের প্রায় প্রতিটি শক্তিশালী জীবনরক্ষাকারী ওষুধ সৃষ্টি হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের অথবা আরব দেশের অথবা ইসলামী দেশের আমাদের কারো কোন অবদান ছাড়াই।……………… আমরা সংখ্যায় কম, পৃথকভাবে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু, আমরা সকলে উম্মত উল ইলমে একত্রিত হলে তা আর হবে না। চুড়ান্ত বিচারে এ ধরণের একটি সত্যিকারের ইসলামী কমনওয়েলথ তৈরি করা এবং সেখানে বিজ্ঞানের পূনর্জাগরণ সম্ভব করা আমাদের উপরেই নির্ভর করে। আমি আপনাদের কাছে জামাল আব্দুন নাসের যা বলেছিলেন তার পূনরাবৃত্তি করছি, ‘অহংকারের সঙ্গে এবং আত্ম-মর্যাদার সঙ্গে উঠে দাঁড়ান। ১৯৪৬ সালে কেম্ব্রিজে আমি যখন এক ছাত্র হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম, তখন আমার সমসাময়িক বৃটিশ ছাত্রদের চেয়ে আমার বয়স বেশী ছিল, তাদের চেয়ে আমি বেশী বিজ্ঞান জানতাম। কিন্তু, নিউটন, ম্যাক্সওয়েল, ডারউইন, ডিরাকের জাতির অংশ হওয়ায় তাদের এক ধরণের অহংকার ছিল। আপনারা মনে করুন যে আপনাদের অতীতে ইবনে হাইথাম, ইবনে সীনার মত কতো মানুষ ছিল। ……………… আপনারা যৌথ ইসলামী বিজ্ঞান কমনওয়েলথের জন্য আপনাদের প্রতিষ্ঠান, প্রকল্প ও কর্মসুচীর সাহসিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করুন……।
ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি এমন দরদ যে বিজ্ঞানীর, তার বিজ্ঞান-গবেষণাগারে মসজিদ থাকবেই, উপসংহার টানল জোয়ান।
মসজিদের ছায়ায় বসে জোয়ান অপেক্ষা করছিল আব্দুল্লাহ জুবায়েরের। ডঃ আব্দুল্লাহ জুবায়ের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিজ্ঞান ও কারিগরি মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারী। তিনি ইন্টার ন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিক্যাল ফিজিক্স (আই সি টি পি)- এর উপদেষ্টা পরিষদের একজন প্রভাবশালী সদস্য। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তার বিজ্ঞান বাজেটের প্রায় এক চতুর্থাংশ চাদা হিসেবে দেয় ডঃ সালামের এই বিজ্ঞান কেন্দ্র আই সিটিপি’কে। আই সিটিপি’র এখন সবচেয়ে বড় ডোনার দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। জোয়ান যাতে আই সিটিপি থেকে তার কাজ ভালভাবে করে নিতে পারে এ জন্য ফিলিস্তিন সরকার খোদ আব্দুল্লাহ জুবায়েরকে পাঠিয়েছে ট্রিয়েস্টে।
আহমদ মুসা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মাহমুদকে বলে আগেই এসব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে রেখেছেন।
সেদিন শাহ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্স থেকে ফিরেই আহমদ মুসা যিয়াদ ও জোয়ানকে নিয়ে মাদ্রিদস্থ ফিলিস্তিন দূতাবাসে গিয়েছিল।
স্পেনের মাদ্রিদে যে ফিলিস্তিন দূতাবাস আছে, আহমদ মুসার সে কথাটা মনে হয়নি। শাহ ফয়সাল কমপ্লেক্স থেকে ফিডেল ফিলিপের বাসায় ফিরে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের সাথে জরুরী যোগাযোগের কথা ভাবছিল। কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। টেলিফোনে কথা বলতে গেলে সব কথা স্পেন সরকার শুধু নয়, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের কানেও কথাটা পৌঁছে যাবে। সমস্যার সমাধান হিসেবে ফিডেল ফিলিপই কথাটা প্রথম স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, আপনার এ্যামবেসী মানে ফিলিস্তিন এ্যামবেসী মাদ্রিদে থাকতে আপনি এত চিন্তা করছেন।
সংগে সংগেই আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার মুখ। গাইড থেকে টেলিফোন নাম্বার খুঁজে নিয়েছিল ফিলিপ।
টেলিফোনে রাষ্ট্রদূতকে পেয়ে তার কাছে আহমদ মুসা নিজের পরিচয় দিতেই সে আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিল। তারপর সে কিছুক্ষণ আবেগের আতিশয্যে কথা বলতে পারেনি। অনেকক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, জনাব, আমি আবু সাবের, আপনার একজন নগন্য কর্মী।
আহমদ মুসা আবু সাবেরকে চিনতে পেরেছিল। সংগ্রামকালে প্রচার বিভাগের কর্মী ছিল সে।
কোন কথা শুনেনি, সংগে সংগেই গাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছিল আবু সাবের। সে গাড়িতে চড়েই আহমদ মুসা, যিয়াদ ও জোয়ান ফিলিস্তিন এ্যামবেসিতে গিয়েছিল।
এ্যামবেসীর অয়্যারলেসে আহমদ মুসা কথা বলেছিল ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট তার প্রিয় সহকর্মী মাহমুদের সাথে। মাহমুদও আবু সাবেরের সঙ্গী আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিল এবং সেই সাথে তুলেছিল একরাশ অভিযোগ। বলেছিল, আপনি কোনই যোগাযোগ রাখছেন না। আমরা শুধুই আপনার পিছনে ছুটছি, ধরতে পারছি না। আমরা খোজ পাওয়ার পর ককেশাসে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম আপনি বলকানে। বলকানে আপনার খোঁজ যখন পেলাম, তখন আপনি পাড়ি জমিয়েছেন স্পেনে, স্পেনের দূতাবাসকে নির্দেশ দিলাম আপনাকে খুঁজে বের করার জন্য। অবশেষে আজ পেলাম আপনাকে। আপনার কাছে কোন অপরাধ করেছি মুসা ভাই যে, আপনার সাথে সম্পর্ক রাখার অধিকার আমাদের থাকবে না?
মাহমুদের শেষ কথাগুলো অভিমানে ভারী হয়ে উঠেছিল।
আহমদ মুসার ঠোঁটে স্নেহের হাসি ফুটে উঠেছিল। উত্তরে বলেছিল, ভাইটি, আজ কিন্তু আমি নিজে খোজ করে তোমার দূতাবাসে এসেছি। প্রয়োজন হলে এক মুহুর্তও যে দেরী করব না তোমাদের কাছে আসতে সে পরিচয় তো তুমি পেলে। আর শোন ঘটনার শ্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, ইচ্ছা করলেও পারি না তোমাদের খোজ নিতে। তোমার এমিলিয়া কেমন আছে?
‘তাঁকেই জিজ্ঞাসা করুন, মুসা ভাই’। বলে মাহমুদ টেলিফোন দিয়েছিল এমিলিয়াকে।
এমিলিয়া কেঁদে ফেলেছিল। কথা বলতে পারেনি অনেকক্ষণ। শেষে বলেছিল, আপনি নিরুদ্দেশ হয়ে থাকতে পারেন, এমন করে বোনদের ভুলে থাকতে পারেন ভাবিনি। তাই কষ্ট লাগে। আয়েশা আলিয়েভার কাছে সব শুনেছি। বড় কষ্ট লাগে ভাবীর জন্য। আপনি শুধু মানুষকে কষ্ট দিতে পারেন। দায়িত্বের কাছে হৃদয় বৃত্তির কি কোনই মুল্য নেই?
আহমদ মুসা এমিলিয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিল, ‘এমিলিয়া, আমি অব্যাহত এক যুদ্ধে জড়িয়ে আছি। যুদ্ধক্ষেত্রের ধর্ম অনুসারে অনেক স্বাভাবিক দাবী এখানে অস্বাভাবিকভাবে পদদলিত হয়।’
এমিলিয়াকে সান্তনা দিয়ে আহমদ মুসা কথা বলেছিল মাহমুদের সাথে। বলেছিল স্পেনে মুসলমানদের নতুন বিপদের কথা, বলেছিল ডঃ সালামের বিজ্ঞান গবেষণাগারের সাহায্যের প্রয়োজনের কথা। মাহমুদ বলেছিল, স্পেনের ভাইদের এই প্রয়োজন পূরণকে আমি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেব। আব্দুল্লাহ জুবায়েরকে আপনি জানেন। ওকেই আমি পাঠাচ্ছি ট্রিয়েস্টে যাতে কোন সমস্যা না হয়। তারপর খুঁটি-নাটি ব্যাপার নিয়ে মাহমুদের সাথে আহমদ মুসার আরো অনেক আলাপ হয়েছিল। একঘন্টা আলোচনার পর কথা শেষ করতে গিয়ে মাহমুদ কেঁদে ফেলেছিল। দু’টি কথা শেষে বলেছিল, ‘ এক; আপনার একটু বিশ্রামের জন্য আমি আপনার কাছে দরখাস্ত করছি, দুই; ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আপনার, আপনার কোন কাজে যদি এ রাষ্ট্র না লাগে তাহলে কষ্ট পাই।’
মাহমুদের কথার জবাব দিতে গিয়ে আহমদ মুসা গম্ভীর কন্ঠে বলেছিল, বিশ্রামের কথা বলছ মাহমুদ! তুমি জান মুসলমানরা একটা মিশনারী জাতি এবং তারা একটা বিপ্লবী কর্মী দল। গোটা দুনিয়ার মানুষকে পথ দেখানো দূরে থাক, আমরা নিজেরাই আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। এই যখন অবস্থা, তখন বিশ্রামের চিন্তা তুমি আমি করতে পারি কি করে মাহমুদ। কথা সেদিন শেষ হয়েছিল এভাবেই।
জোয়ান ট্রিয়েস্টে গিয়ে কিভাবে আব্দুল্লাহ জাবেরের দেখা পাবে তার দিন, ক্ষণ, স্থান সব ঠিক করে দিয়েছিল ফিলিস্তিন এ্যামবেসীই।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই জোয়ান মসজিদের ছায়ায় দাঁড়িয়েছিল।
জোয়ান তার রিস্টওয়াচের দিকে তাকাল। দেখল, বেলা ১১টা বাজতে যাচ্ছে।
চঞ্চল হয়ে উঠল জোয়ান। ঠিক ১১ টায় তার আসার কথা।
হাত ঘড়ির দিকে তাকাল জোয়ান।
ঠিক এগারটা বাজে।
উৎসুক চোখ জোয়ান মেলে ধরল সামনে। চোখ তুলতেই তার চোখ গিয়ে পড়ল এগিয়ে আসা দীর্ঘকায়, সুঠামদেহী লোকের উপর। ধোপদুরস্ত ইউরোপীয় পোশাক, কিন্তু লাল আরবী চেহারা। সেই যে আব্দুল্লাহ জাবের কিছু মাত্র সন্দেহ রইল না জোয়ানের।
বেশ দূরে থাকতেই হাসিমুখে সালাম দিল লোকটি।
জোয়ান সালাম গ্রহণ করেই বলল, নিশ্চয় জনাব আব্দুল্লাহ জাবের।
‘হ্যাঁ, আপনি নিশ্চয় ভাই জোয়ান ওরফে মুসা আব্দুল্লাহ।’
হ্যান্ডশেক করে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরল।
‘মুসা ভাই কেমন আছেন?’ বলল জোয়ান।
‘কতদিন তাঁর কথা শুনিনি। আপনার কাছ থেকে অনেক গল্প শুনব।’
‘আহমদ মুসা ভাইকে আপনারা এত ভালবাসেন?’ সেদিন দেখলাম, দূতাবাসের সবাই তাঁর জন্যে পাগল। কেন এত ভালবাসা?’
‘আপনার সাথে তার পরিচয় কতদিন?’
‘মাস হয়নি।’
‘আপনি তাকে ভালবাসেন না?’
‘অবশ্যই।’
‘কেন তাকে ভালবাসেন?’
জোয়ান একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘মানুষের প্রতি তার অপূর্ব ভালবাসা, সাথীদের প্রতি তাঁর অবিশ্বাস্য মমতা দেখে।’
‘তাঁর সাথে যারা মিশেছেন, সবাই এই একই জবাব দেবেন। তিনি এমন এক নেতা, যাঁর সাথে কেউ দু’দিন কাটালে সারাজীবন তাঁর সাথে থাকতে চাইবে। সাথীদের সুখ-সুবিধা, নিরাপত্তার দিকে তাঁর যত নজর, তার একাংশও নিজের জন্যে তিনি করেন না। সাথীদের তিনি নিরাপদ পক্ষপুটে রেখে সব বিপদ, সব ঝুঁকি তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। এমন নেতার জন্যেই তো জীবন দেয়া যায়। তাই তো পাগল সবাই তাঁর জন্যে।’
‘এমন বিস্ময়কর চরিত্র কি করে সৃষ্টি হলো?’
‘ইসলামে নেতার চরিত্র এটাই। ইসলামের স্বর্ণযুগে এটাই ছিল নেতার চরিত্র। শুধু স্বর্ণযুগে কেন, চরিত্র, মানুষের প্রতি ভালবাসা দিয়েই তো ইসলাম জগত জয় করেছে।’
‘মাফ করবেন হিংস্রতার ইতিহাসও তো আছে।’
‘আপনি পরবর্তীকালের কিছু নাম মাত্র খলীফা, রাজা-বাদশাহদের কথা বলছেন। কিন্তু তাঁদের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস নয়। এ কথা ঠিক মুসলিম সাম্রাজ্য তারা সংহত করেছেন, সংরক্ষণ করেছেন, শাসন করেছেন, কিন্তু তাঁদের দেখে মানুষ ইসলাম গ্রহন করেনি। মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি, শাহ মখদুম, শাহ জালালের মত মুজাহিদ মিশনারীদের দেখে। যাঁরা ছিলেন মানুষের কাছে মোমের মত কোমল, আর অত্যাচারের মূলোতপাটনে ছিলেন সিংহের মত সংগ্রামী।’ থামল আব্দুল্লাহ জাবের। থেমেই বলল, ‘চলুন ওঁরা অপেক্ষা করছেন।’ তারা পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল।
চলল তারা গবেষণা প্রতিষ্ঠান আই, সি, টি, পি’র গেটের দিকে।
আই সি টি পি’র (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স)-এর পরিচালক ডঃ নূর আব্দুল্লাহর অফিস।
রাত তখন নয়টা। ডঃ নূর আবদুল্লাহ তার টেবিলে তার রিভলভিং চেয়ারে বসে। তার চোখ-মুখ লাল, উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে।
ডঃ নূর আবদুল্লাহ আফগান বংশোদ্ভুত। দুই পুরুষ ধরে ইতালীর নাগরিক। একজন কৃতি পদার্থ বিজ্ঞানী সে। যত নিষ্ঠা ও মমতা দিয়ে ডঃ আবদুস সালাম এই পদার্থ বিজ্ঞান গবেষনাগার গড়ে তুলেছিলেন তৃতীয় বিশ্বের অবহেলিত বিজ্ঞানীদের জন্যে, ডঃ নূর আবদুল্লাহ আজ ততটা মমতা ও নিষ্ঠা দিয়েই কেন্দ্রটি পরিচালনা করছেন। তার পরিচালনায় কেন্দ্রটি আজ তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞানী বিশেষ করে মুসলিম বিজ্ঞানীদের জন্যে এক ‘স্বর্গভূমি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডঃ আবদুল্লাহ জাবের ধীর পায়ে ডঃ নূর আবদুল্লাহর অফিসে প্রবেশ করল।
ডঃ আবদুল্লাহ জাবেরকে দেখেই ডঃ নূর আবদুল্লাহ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল এবং উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ডঃ জাবের সর্বনাশ হয়ে গেছে, স্যাম্পুলগুলোর তেজস্ক্রিয় বিশ্লেষণের রিপোর্ট এবং স্যাম্পুল ল্যাবরেটরী থেকে হারিয়ে গেছে।
‘হারিয়ে গেছে?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল ডঃ আবদুল্লাহ জাবের।
‘হারিয়ে গেছে মানে টেবিল থেকে উধাও হয়েছে। মাগরিব নামাযের ব্রেকে বিজ্ঞানী তৌফিক আল বিশারা বাইরে এসেছে। ফিরে গিয়ে রিপোর্ট এবং স্যাম্পুল কিছুই পায়নি।’
‘অবিশ্বাস্য ঘটনা।’
‘তুমি অবিশ্বাস্য বলছ, আমি তো আতংক বোধ করছি।’ মুখ কালো করে বলল ডঃ নূর আবদুল্লাহ।
‘রিপোর্ট ও স্যাম্পুল উধাও হয়েছে, কিন্তু কম্পিউটারে তো সবই আছে। অন্ততঃ এই ক্ষতিটা থেকে বাঁচা যাবে।’
শুকনো হাসি ফুটে উঠল ডঃ নূর আবদুল্লাহর ঠোঁটে। বলল, ‘বিজ্ঞ চোর সে দরজাও বন্ধ করে গেছে। কম্পিউটারের সে ডিস্ক একদম সাদা, সব মুছে দিয়ে গেছে। অথবা ডিক্স বদলে আসলটা নিয়ে গেছে।’
ডঃ আবদুল্লাহ জাবের ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে। তার চোখে নেমে এলো অন্ধকার। তার চোখে ভেসে উঠল আহমদ মুসার মুখ। আহমদ মুসা তাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছিল, সে দায়িত্ব সে পালন করতে পারলো না। মানসিক দিক দিয়ে মুষড়ে পড়ল ডঃ আবদুল্লাহ জাবের।
ডঃ নূর আবদুল্লাহও তার চেয়ারে বসে পড়ল। মলিন এবং বিস্ময় তার চেহারা। বলল সে, দুঃখিত ডঃ জাবের, এ ধরনের ঘটনা আমাদের গবেষণা কেন্দ্রে এই প্রথম। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
‘কাউকে সন্দেহ করেন, যে এই কাজ করতে পারে?’
‘কাকে সন্দেহ করব, সবাই তো আমরা এখানে এক।’
‘ঘটনা যখন ঘটেছে, কেউ অবশ্যই তা ঘটিয়েছে। অনুসন্ধানে তা বেরোবেই। দরকার হলে গোয়েন্দা ফার্মের সাহায্য নিতে হবে। সেটা পরে হবে। কিন্তু রিপোর্ট যে জরুরী, এর জন্যে তো অপেক্ষা করা যাবে না।’
‘মিঃ জোয়ানের কাছে কি বাড়তি কোন স্যাম্পুল আছে?’
‘জানি না। ওর কাছে তাহলে যেতে হয়, তাছাড়া ঘটনাও তার জানা দরকার।’
দু’জনেই উঠল।
বেরুল অফিস থেকে।
চলল দু’জন জোয়ান যেখানে থাকে সেদিকে। জোয়ান থাকছে আই সি টি পি’র রেস্ট হাউজে, গবেষণা কমপ্লেক্সের বাইরে সাগরের তীরে।
রেস্ট হাউজ এক তলা সাগর থেকে উঠে আসা উঁচু এক টিলার উপর নির্মিত। চারদিকে ফুলের বাগান। মাঝখানে সুন্দর ছবির মত রেস্ট হাউজটি।
রাত তখন ৮টা ৩০ মিনিট।
জোয়ানের সাথে কথা বলছিল ডঃ আবদুল্লাহ জাবের এবং ডঃ নূর আবদুল্লাহ।
রিপোর্ট এবং স্যাম্পুল হারানোর কথা শুনে জোয়ানের মুখ কাগজের মত সাদা হয়ে গেল। বলল, বাড়তি কোন স্যাম্পুল আমার কাছে নেই।
ডঃ আবদুল্লাহ জাবের এবং ডঃ নুর আবদুল্লাহর তখন বিব্রতকর অবস্থা। তাদের কারও মুখে কোন কথা নেই।
কথা বলল জোয়ানই আবার। বলল, মাদ্রিদের সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি থেকে একদল ছাত্র-শিক্ষক এসেছে স্টাডি ট্যুরে। ওরাই এটা ঘটিয়েছে।
ডঃ নুর আবদুল্লাহ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, ওরা? কেন করবে? জানবে কি করে ওরা?
‘ওরা এসেই জানতে পেরেছে আমি এসেছি। ওদের কেউ একজন এখানে আছে। সেই সব জানিয়েছে।’ বলল জোয়ান।
‘এসব কথা আপনি কি করে জানলেন মিঃ জোয়ান?’ বলল ডঃ আবদুল্লাহ জাবের।
‘সন্ধ্যায় এসে আমার ঘরে একটা চিঠি পেয়েছি। ঐ স্টাডি টিমে আমার এক বান্ধবী আছেন, তিনিই আমাকে জানিয়েছেন।’
বলে জোয়ানের বালিশের তলা থেকে চিঠি বের করল। পড়ল চিঠিটিঃ
জোয়ান,
‘মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্টাডি ট্যুরে এসেছে একদল ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক। সব ওরা জানতে পেরেছে। তোমাদের পরিকল্পনা ওরা ব্যর্থ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র এঁটেছে। তুমিও ওদের টার্গেট। আমি চিন্তিত। সাবধানে থেকো, রাতে কোথাও সরে থাকতে চেষ্টা কর। তোমার সাথে দেখা করা নিরাপদ নয়। কিছু জানলে এইভাবে চিঠি দিয়ে জানাব। গবেষনা কেন্দ্রে এবং বাইরেও ওদের লোক আছে। খুব শক্তিশালী এরা। আবার বলছি, সাবধানে থেকো।
তোমার – ‘জেন’
চিঠি শুনতে শুনতে ডঃ নুর আবদুল্লাহর চোখে-মুখে উদ্বেগ-আতংক ফুটে উঠল। চিঠি পড়া শেষ হলে সে বলল, ‘গবেষণা কেন্দ্রের কেউ তাদের সাথে থাকবে কেন? কি সম্পর্ক তাদের সাথে? বিদেশী ওরা, দু’একদিনের স্ট্যাডি ট্যুরে এসেছে মাত্র।’
‘স্ট্যাডি ট্যুরে কোন শিক্ষক এসেছে, তা জেন লিখেনি। লিখলে বুঝতে পারতাম। তবে যারা এসেছেন তাদের মধ্যে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের কেউ অবশ্যই আছে এবং তিনি সব কলকাঠি নাড়ছেন। ইটালিতে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান আছে। ট্রিয়েষ্টেও অবশ্যই থাকবে এবং তাদের কাউকে তারা আই সি টি পি’তে রাখবে সেটাও স্বাভাবিক।’ বলল জোয়ান।
চোখ বুজে আছে ডঃ নুর আব্দুল্লাহ। ভাবছে সে।
জোয়ান থামলেও কিছুক্ষন কথা বলল না ডঃ নুর আবদুল্লাহ। পরে ধীরে ধীরে চোখ খুলে বলল, ‘ভেবে পাচ্ছি না, আমার গবেষণা কেন্দ্রে এমন কে আছে যে গবেষণা কেন্দ্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে?’
ডঃ আবদুল্লাহ জাবের কিছু বলার জন্যে মুখ খুলছিল। এই সময় দরজার ওপর শব্দ হলো।
ডঃ আবদুল্লাহ জাবেরের আর কথা বলা হলো না প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল জোয়ানের দিকে। জোয়ানের পড়া চিঠির কথা তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল।
জোয়ানের মুখ শুকনো। সে কোন কথা বলতে পারছে না।
আবার নক হলো দরজায়।
ডঃ নুর আবদুল্লাহ উঠল। বলল, জোয়ান তুমি একটু আড়ালে দাঁড়াও। আমি দেখছি কে ওখানে।
ডঃ নুর আবদুল্লাহকে আর এগুতে হলো না। দরজায় এসে দাঁড়ালো কালো ফেল্ট হ্যাট ও কালো ওভার কোটে আবৃত একজন আগন্তুক।
‘কে আপনি?’ জিজ্ঞাসা করল ডঃ নুর আবদুল্লাহ।
দরজা দিয়ে এক ঝলক আলো গিয়ে পড়েছিল আগন্তুকের উপর।
আগন্তুক ডঃ নুর আবদুল্লাহর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাঁর মাথার ফেল্ট হ্যাটটি খুলে ফেলল।
এবার আগন্তুকের পুরো মুখটার উপর নজর পড়ার সাথে সাথে ডঃ আবদুল্লাহ জাবের ‘মুসা ভাই’ বলে চিৎকার করে উঠে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল আগন্তুককে।
ডঃ আবদুল্লাহ জাবের আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরেই ঘরে নিয়ে এল এবং ডঃ নুর আবদুল্লাহকে দেখিয়ে বলল, ইনি ডঃ নুর আবদুল্লাহ আই সি টি পি’র পরিচালক।
আহমদ মুসা হ্যান্ডশেক করল ডঃ নুর আবদুল্লাহর সাথে।
আড়াল থেকে বেরিয়ে জোয়ান আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসাকে এইভাবে আবির্ভুত হতে দেখে বিস্ময়ে তার নির্বাক অবস্থা।
জোয়ানের দিকে চোখ পড়তেই আহমদ মুসা তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, খুব অবাক হয়েছ না?
‘শুধু অবাক নয়, আমার চোখকে এখনও বিশ্বাস করতে মন চাইছে না।’ বলল জোয়ান।
সবাই বসল।
আহমদ মুসা ও জোয়ান পাশাপাশি।
তাদের মুখ দরজার দিকে
তাদের পাশের সোফায় বসল ডঃ আবদুল্লাহ জাবের এবং ডঃ নুর আবদুল্লাহ।
‘তোমার এখানে যাত্রা করার একদিন পর’, বলতে শুরু করল আহমদ মুসা, ‘জেনের কাছ থেকে একটা চিরকুট পেলাম। চিরকুটটিতে লেখা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্ট্যাডি-ট্যুর ট্রিয়েস্টে যাচ্ছে। বাধ্য হয়েই আমাকে যেতে হচ্ছে। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত বলে আগে কাউকে জানাতে পারিনি। বাসায় জোয়ানকেও পাইনি, খালাম্মাকেও পাইনি। শুনলাম জোয়ান মাদ্রিদের বাইরে। তাকে কিছুই বলা হলো না। আপনি দয়া করে তাকে জানাবেন।’ জেনের চিরকুটটি পড়েই আমার মনে হলো ট্রিয়েস্টে কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ভাবলাম, সব ক্রোধের শিকার হবে তুমি। সংগে সংগেই আমি ফিলিপকে বললাম আমি ট্রিয়েস্টে যাব। কিন্তু সোজা পথে তো আমার আসার উপায় ছিল না। ফিডেল ফিলিপের সাথে পিরেনিজ পার হলাম তারপর বাসক এলাকার মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ ফ্রান্সের পোর্ট ভেন্ড্রেস হয়ে ট্রিয়েস্ট এলাম।’
একটু থামল আহমদ মুসা।
সোফায় একটু নড়ে-চড়ে বসে আবার মুখ খুলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা।
এই সময় দু’টি ছায়া মুর্তি বিড়ালের মত নিঃশব্দে এসে খোলা দরজায় দাঁড়াল। তাদের হাতে উদ্যত স্টেনগান। একটি স্টেনগানের নল জোয়ানের বুক বরাবর উদ্যত। অন্যটি ঘুরছে অন্যান্যদের উপর দিয়ে।
আহমদ মুসা বিস্মিত হলো না। শুধু ভাবল, ঘটনা তার চিন্তার চেয়েও দ্রুত ঘটল।
আগন্তুক দু’জনের টার্গেটের ধরন দেখে আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, সে তাদের টার্গেট নয়। জোয়ানের উদ্দেশ্যেই এসেছে।
আপনারা কে? কি চান এখানে? ওদের উদ্দেশ্যে বলল আহমদ মুসা।
কোন উত্তর দিল না ওরা। ওদের পাথরের মত মুখে কোন পরিবর্তন হলো না। জোয়ানকে লক্ষ্য করে উদ্যত স্টেনগানের ট্রিগারে আঙুলের চাপটা আরও বাড়তে লাগল।
শংকিত আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, এরা পেশাদার খুনি, খুন করার জন্যেই এরা এসেছে।
ওদের মনোযোগটা কিভাবে অন্যদিকে আকৃষ্ট করা যায়, কিভাবে কিছুটা সময় নেয়া যায় এ চিন্তায় আহমদ মুসা যখন ব্যস্ত, তখন পর পর দু’টি গুলীর শব্দ হলো। আর তার সংগে সংগেই দরজায় দাঁড়ানো স্টেনগানধারী দু’জন দরজার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা ছুটে গেল দরজায়। বাইরে আলো-অন্ধকারে ঘেরা বাগান কিছুই দেখা গেল না। আহমদ মুসা দৃষ্টি ফেরাল লোক দু’টির দিকে। ওদের দু’জনেরই মাথায় গুলী লেগেছে।
আহমদ মুসা ঘরের মধ্যে ফিরে এল।
জোয়ান এবং ডঃ আবদুল্লাহ জাবের বিমুঢ়। ডঃ নুর আবদুল্লাহর মুখ কাগজের মত সাদা। ভয় ও আতংকে সে আড়ষ্ট।
আহমদ মুসা ডঃ আবদুল্লাহ জাবেরকে বলল, এদিকে ঘটনা এতদুর গড়িয়েছে?
তারপর জোয়ানের দিকে ফিরে বলল, সব কি প্রকাশ হয়ে গেছে? অবস্থা সম্পর্কে কতটা জান?
জোয়ান কোন জবাব দিল না। জেনের চিঠিটা আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
আহমদ মুসা চিঠি পড়ে মুখ তুলতেই ডঃ আবদুল্লাহ জাবের বলল, আজ সন্ধায় ল্যাবরেটরী থেকে তেজস্ক্রিয় বিশ্লেষণের রিপোর্ট এবং স্যাম্পুল দুইই হারিয়ে গেছে। এমনকি কম্পিউটার ডিস্কের রেকর্ডও মুছে ফেলা হয়েছে অথবা সেটাও চুরি হয়ে গেছে।’
‘ওরা জানতে পারার পর এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক। ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান আট-ঘাট বেঁধেই কাজ করে।’
বলে আহমদ মুসা বসল। তারপর ডঃ নুর আবদুল্লাহর দিকে চেয়ে বলল, জনাব রেস্ট হাউজে কি আপনাদের গার্ড আছে।
‘আছে, গেটে একজন। কিন্তু তার কাছে কোন আগ্নেয়াস্ত্র থাকে না।’
আহমদ মুসা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল চোখ বন্ধ করে। তারপর বলল, জোয়ান, জেন গুলী ছুড়তে জানে?’
‘জানে। সে খুব ভাল পিস্তল শুটার। এ্যামেচার রিভলবার শুটিং–এ গত তিন বার ধরে সে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসছে।’
‘তাহলে জেনই আজ আমাদের বাঁচাল। তার গুলীতেই এ দু’জন মরেছে।’
‘জেনের গুলীতে?’ লাফিয়ে উঠল যেন জোয়ান। বলল, ‘কেমন করে বুঝলেন? জেন হলে তো এখানে আসতো।’
‘উত্তর খুবই সহজ। ডঃ নুর আবদুল্লাহ এবং আবদুল্লাহ জাবের দু’জনই এখানে। বাইরে জেন ছাড়া তো আমাদের আর কোন সাহায্যকারী নেই। আর জেন এখানে এল না কেন? জেন সময় নষ্ট না করে ফিরে গেছে তার আবাসস্থলে। যাতে সে সন্দেহের শিকার না হয় এ জন্যে এটাই তার করণীয় ছিল।’
জোয়ানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা ডঃ নুর আবদুল্লাহর দিকে চেয়ে বলল, ডক্টর আপনাকে কি কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারি?’
‘যে কোন সাহায্য, যে কোন সহযোগীতার জন্যে আমি প্রস্তুত আছি। আমাদের এই দুর্দিনে আল্লাহ আপনাকে সাহায্যকারী হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমার আজ মনে হচ্ছে, যারা আজকের ডকুমেন্টটি চুরির মত বিশ্বাস ঘাতকতা করল, সে আরও সর্বনাশ করেছে আরও মূল্যবান তথ্য পাচার করেছে নিশ্চয়।’ বলল ডঃ নুর আবদুল্লাহ।
ধন্যবাদ, বলল আহমদ মুসা,’ এখন বলুন আপনার বিজ্ঞানীদের দেশ ও ধর্মীয় পরিচয় কি?’
‘থিয়োরিক্যাল রিসার্চে আমাদের বিজ্ঞানীদের সংখ্যা একচল্লিশ, আর ল্যাবরেটরীতে আমাদের পরীক্ষণ বিজ্ঞানীর সংখ্যা দশ’। থিয়োরিক্যাল রিসার্চের বিজ্ঞানীদের জন্যে ল্যাবরেটরীতে ঢোকা নিষিদ্ধ। তাদের জন্যে অবশ্য আলাদা ল্যাবরেটরী আছে। পরীক্ষণ বিজ্ঞানীদের একজন ভারতীয়, ৭ জন বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে এসেছে, আর অবশিষ্ট দু’জনের একজন ইতালীয়, একজন নরওয়ের।’
‘আমাদের পরীক্ষণটি কার টেবিলে ছিল’?
‘গবেষণা কেন্দ্রের সিডিউল অনুসারে এই দায়িত্বটা লেবানিজ ও ভারতীয় বিজ্ঞানীর গ্রুপে পড়েছিল। তারা এটা গ্রহনও করেছিল। কিন্তু একদিন পরে তারা জানায়, লেবানিজ বিজ্ঞানী ছুটিতে যাচ্ছেন তাই সময়ের মধ্যে এ পরীক্ষণ তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। এরপর এ দায়িত্ব গিয়ে পড়ে একজন পাকিস্থান ও একজন সৌদি বিজ্ঞানী গ্রুপের উপর। এদের টেবিল থেকেই খোয়া গেছে রিপোর্ট, স্যাম্পুল এবং কম্পিউটার রেকর্ড।’
‘দয়া করে কি বলবেন কারও প্রতি কোন প্রকার সন্দেহ আপনার হয়?’
‘সবাই আমার কাছে সমান।’
‘ঠিক ‘কোন সময় ডকুমেন্টগুলো হারায়?’
‘যখন পাকিস্থানী ও সৌদি বিজ্ঞানী দু’জন মাগরিবের নামাজ পড়তে যায়’।
‘অন্য সবাই কি নামাজ পড়তে গিয়েছিল?’
‘নামাজের বিরতি হলে, মুসলিমরা প্রায় সকলেই নামাজে যায়, দু’একজন ব্যাতিক্রম আছে’।
‘আপনি কি খোঁজ নিয়েছেন, নামাজের সময় কোন গ্রুপ কাজ করছিল কিনা?’
‘লেবানিজ ও ভারতীয় বিজ্ঞানী দু’জন কাজ করছিল’।
‘কেন ভারতীয় বিজ্ঞানী ছুটিতে যায়নি?’ বিষ্ময়ের সাথে বলল আহমদ মুসা।
‘ছুটি নিয়েছিল কিন্তু একদিন পরেই বাতিল করে’।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। বলল ‘বিরতির সময় ল্যাবরেটরী কি বন্ধ হয়?’
‘না’।
‘কাজ শেষে ফেরার সময় বিজ্ঞানীদের কাগজপত্র তল্লাশি হয়? তারা হাতে করে কোন কাগজ-পত্র নিয়ে যেতে পারে?’
‘বিধি-নিষেধ আছে। ল্যাবরেটরী থেকে খালি হাত ও খালি পকেটে বেরুতে হবে। চোখ রাখা হয় চেক করা হয় না।’
‘লেবানিজ বিজ্ঞানীর নাম কি?’
‘দাউদ ইমরান।’
‘সে মুসলমান?’
‘মুসলমান।’
‘সে মুসলমান এটা তার বায়োডাটা থেকে জানেন, না তার ফ্যামিলি ব্যাক-গ্রাউন্ড আপনাদের জানা আছে?’
‘বায়োডাটা থেকে জানি।’
‘সে কি নিয়মিত নামাজ পড়ে?’
‘জামায়াতে সে নিয়মিত নয়, তবে একা পড়ে নেয় বলে জানি।’
‘মাফ করবেন, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি, আজ বিজ্ঞানীদের যাবার সময় তাদের উপর চোখ রাখার দায়িত্ব কার ছিল?’
‘সিকুরিটি অফিসার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় থাকতে পারেননি। আর হারানোর বিষয়টা নিয়ে আমরা ব্যস্ত ছিলাম।’
‘এমন অসুস্থ হয়ে হঠাৎ না আসার রেকর্ড তার আছে?’
‘মনে পড়ে না।’
‘দাউদ ইমরান কোথায় থাকেন?’
‘খুব কাছেই একটা রেসিডেন্সিয়াল কলোনি আছে, সেখানে তিনি থাকেন।’
‘তিনি বাইরে থাকেন কেন?’
‘তিনি লেবানিজ নাগরিক, কিন্তু অনেক দিন বাস করছেন ইটালিতে। ঐ কলোনিতে তিনি একটি বাড়িও কিনেছেন।’
‘আপনাদের আর কোন বিজ্ঞানী বাইরে থাকেন?’
‘না।’
‘জনাব আমি দাউদ ইমরানের বাড়িতে যেতে চায়।’
‘কেন?’ ডঃ নুর আবদুল্লাহর কন্ঠে বিস্ময়।
‘এসব ঘটনার মূলে কে বা কারা আছে সেটা জোয়ানের বান্ধবি জেন জানে। কিন্তু তার কাছে যাওয়া তার জন্যে নিরাপদ নয়। আমার মনে হচ্ছে দাউদ ইমরান দ্বিতীয় ব্যক্তি যার কাছে কিছু জানা যেতে পারে।’
‘আপনি নিশ্চিত?’
সন্দেহটাকে কখনও নিশ্চিত বলা যায় না।’
আমি গবেষণা কেন্দ্রের শৃঙ্খলা, শান্তি ও সুনাম নিয়ে চিন্তিত।’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল ডঃ নুর আবদুল্লাহ।
‘আমিও এটা নিয়ে চিন্তিত জনাব। আমি এমন কিছু করব না যা আপনাকে এবং আমাদের এই প্রিয় গবেষণা কেন্দ্রকে বিপদে ফেলবে।’
ডঃ নুর আবদুল্লাহ কিছু বলল না। তার দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। সে দৃষ্টিতে আস্থার আলো আছে। আহমদ মুসাই আবার কথা বলল। বলল সে, লাশ দুটোকে আমি মনে করি সাগরে ডুবিয়ে দেয়া দরকার। পুলিশের ঝামেলায় যাওয়া ঠিক হবেনা।’
ডঃ নুর আবদুল্লাহ এবং ডঃ আবদুল্লাহ জাবের দু’জনেই আহমদ মুসার কথায় সায় দিল। এবং ‘ডঃ নুর আবদুল্লাহ বলল, সব ব্যবস্থা আমি করছি।
‘ধন্যবাদ’, ‘দয়া করে দাউদ ইমরানের বাড়ির লোকেশানটার বিবরন দিন যাতে আমি চিনতে পারি।’ ডঃ নুর আবদুল্লাহকে বলল আহমদ মুসা।
‘কাউকে সাথে দেব?’
আমরা চারজন ছাড়া এ খবর কেউ জানবে না।’
‘তাহলে আমি সাথে যেতে পারি। কিন্তু আপনি ওখানে গিয়ে কি করতে চান?’
‘ওখানে কি ঘটবে আমি বলতে পারি না। তবে আমি একজন আগন্তুক হিসাবে যাব। বলব, সে লেবানিজ। আমি ফিলিস্তিনি। বেকার। তার খোজ পেয়ে আসলাম তার সাথে দেখা করতে।’
একটু থামলো আহমদ মুসা। থেমেই আবার শুরু করলো, ‘আমি আপনাকে সাথে নেব না। আপনি মানে আই সি টি পি। আই সি টি পি’কে যতটা সম্ভব অপ্রীতিকর ঘটনা থেকে দুরে রাখা দরকার।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ডঃ আবদুল্লাহ জাবের বলল, আমি আপনার পুরানো কর্মী। আমি সাথে যাব।’
‘তুমি আমার পুরানো সাথী বটে, কিন্তু এখন তুমি ফিলিস্তিন রাষ্টের একজন দায়িত্বশীল। তুমি ধরা পড়লে কেলেংকারী হবে। আরেকটা কথা আমি ইচ্ছা করলে তো জোয়ানকেও সাথে নিতে পারি। তা নিতে পারছি না। আমার পরিকল্পনায় দ্বিতীয় জনের স্থান নেয়।’
ডঃ নুর আবদুল্লাহ দাউদ ইমরানের বাড়ির লোকেশানের একটা স্কেচ একে ফেলেছিল। ওটা তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা স্কেচটাতে ভালভাবে নজর বুলিয়ে পকেটে রেখে দিয়ে বলল, ‘আমি তাহলে চলি, খোদা হাফেজ।’
আহমদ মুসা খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে।
দাউদ ইমরানের কলোনিটি সহজেই খুজে পেল আহমদ মুসা। বাড়িটি খুজে পেতে খুব কষ্ট হলো না। বাড়ির গেটে বাড়ির নম্বর প্লেট জ্বলজ্বল করছে লিওন সাইনে। তবে গেটে মালিকের নাম লেখা নেয়।
গেটে তালা দেওয়া নেয় আহমদ মুসা দেখলো। একটা হুক দিয়ে গেট এটে দেয়া আছে।
বাড়ির দিকে তাকালো আহমদ মুসা। নিচের তলা অন্ধকার। উপর তলায় একটা ঘরের জানালা দিয়ে আলোর রেশ পাওয়া যাচ্ছে।
আহমদ মুসা হুক খুলে গেট দিয়ে প্রবেশ করলো। গেট থেকে কংক্রিটের একটা রাস্তা আহমদ মুসাকে একটা খোলা দরজায় নিয়ে গেল। দরজার পরেই একটা হলঘর।
আহমদ মুসা প্রবেশ করল ঘরে। অন্ধকার ঘর। অন্ধকারে যতটুকু বুঝল তাতে ঘরটাকে ড্রইং রুম বলেই মনে হলো। ড্রইং রুম থেকে দোতলায় উঠার সিড়ি।
আহমদ মুসা সিঁড়ির দিকে এগুলো। দোতলায় আলো দেখা গেছে, দোতলায় উঠবে সে।
সিঁড়িতে এক পা তুলতেই ঠান্ডা শক্ত কিছু এসে মাথার পেছনটা স্পর্শ করল। আহমদ মুসা মাথা ঘুরাতে যাচ্ছিল। সংগে সংগেই পেছন থেকে একটা ভারী কন্ঠ বলে উঠল মাথা গুড়ো হয়ে যাবে, চল উপরে। আহমদ মুসা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল। পেছনে লোকটিও। তার রিভলবারের নলটি মাথা থেকে একটুও নড়ল না।
সিঁড়ি দিয়ে তারা উঠে এল দোতালার ড্রইং রুমে। সেখানে আরও দু’জন বসেছিল।
তাদেরকে ঐভাবে ঢুকতে দেখে বসা দু জনের একজন বলে উঠল, কি সাঙাত? এ চিড়িয়া কে, কোথায় পেলে একে?
বাড়ীতে প্রবেশ করেছিল, যেন ওর বাড়ি। এখন চিড়িয়াকে দেখতে হবে।
বলে রিভলবারধারী লোকটি ডানহাতে রিভলবার ধরে বামহাতে আহমদ মুসাকে সার্চ করতে লাগল। বসা দুজনও উঠে এল। তারাও সাহায্য করল সার্চ করতে।
কিন্তু, খুচরো কিছু কয়েন ও টাকা ছাড়া আহমদ মুসার পকেটে তারা তেমন কিছু পেল না।
বসা থেকে উঠে আসা একজন বলল, এ শূন্য চিড়িয়ারে, শুধু পণ্ডশ্রম হল।
রিভলবারধারী লোকটি রিভলবার পকেটে ফেলে আহমদ মুসার সামনে এসে বলল, কে তুমি বাড়ীতে ঢুকেছিলে কেন?
আহমদ মুসা বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় বলল, আমি দাউদ ইমরানের কাছে এসেছি।
‘দাউদ ইমরানকে চেন?’ রিভলবারধারী লোকটিই বলল।
‘চিনি না, তার নাম শুনেছি। আই সি টি পি’তে চাকুরী করেন।
‘কেন তার কাছে এসেছ?
তিনি লেবাননী……
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই ড্রইং রুমের টেলিফোনটি বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সোফা থেকে উঠে আসা দীর্ঘবপু তীরের মত ঋজু নেড়ে লোকটি বলল, ওকে একটা ঘরে আটকে রাখ। কথা আদায় করতে হবে, তার আগে কিছু করা যাবে না।
রিভলবারধারী লোকটিই দাউদ ইমরান। সে আবার রিভলবারটি হাতে তুলে নিয়ে আহমদ মুসাকে সামনের দিকে ইংগিত করে বলল, চল।
আহমদ মুসা চলতে শুরু করল। চলতে চলতে ভাবল, টেলিফোন আসাটা তার জন্য আশীর্বাদ হয়েছে। তা না হলে আরও কত প্রশ্ন আসত, উত্তরে মিথ্যার মালা গাথা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছে, শুরুতেই এদের সাথে সংঘাত বাধানো যাবে না। আসল টার্গেট তেজস্ক্রিয় রিপোর্ট ও স্যাম্পুল উদ্ধার। ওগুলো উদ্ধার না হলে তাদের এ মিশন ব্যর্থ হয়ে যাবে এবং ক্ষতির পরিধি আরও বাড়বে। সংঘাতে যাওয়ার আগে জানতে হবে ওগুলো কোথায়। আহমদ মুসা খুশী হল, সে ঠিক জায়গায় এসেছে। বিজ্ঞানী দাউদ ইমরানের হাতে রিভলবার অর্থ তাকে সন্দেহ তাদের যথার্থ হয়েছে। সে একজন মীরজাফর, আত্মবিক্রয় করেছে শত্রুর কাছে।
আহমদ মুসাকে একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকিয়ে দরজা লক করে দিয়ে দাউদ ইমরান চলে গেল।
ঘরটি ছোট। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল। দেয়ালের সাথে তৈরী দামী কাঠের বুক সেল্ফ। তিনদিকে ঘুরানো। সেল্ফে ছড়ানো-ছিটানো কিছু বই আছে। কিন্তু সেল্ফের বেশীরভাগই খালি। টেবিলের উপরও দু’টি বই পড়ে আছে। টেবিলের সাথে একটা চেয়ার ছাড়াও পাশে একটা ইজি চেয়ার পাতা।
আহমদ মুসা টেবিলের বই হাতে নিয়ে দেখল বিজ্ঞানের বই। সেল্ফ থেকেও কয়েকটা বই টেনে দেখল বিজ্ঞানের বই।
আহমদ মুসা বুঝল দাউদ ইমরানের স্টাডি রুম এটা। আহমদ মুসা চেয়ারে বসল।
টেবিলের তিনটি ড্রয়ার।
ড্রয়ার খুলল আহমদ মুসা। প্রথম ড্রয়ারে কয়েকটা সাদা প্যাড, পেন্সিল ও কলম পড়ে আছে।
দ্বিতীয় ড্রয়ারে কয়েকটা জার্নাল পাওয়া গেল। বিজ্ঞান সাময়িকীর সাম্প্রতিক কয়েকটা সংখ্যা। এগুলো ঘাটতে গিয়ে একটা হিব্রু ম্যাগাজিনের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা।
হাতে তুলে নিল ম্যাগাজিনটা। ফিলিস্তিনে থাকাকালে হিব্রু শিখেছিল আহমদ মুসা।
ম্যাগাজিনটির নাম ‘দি ট্রুথ’। ইহুদিবাদী আন্দোলনের বিশ্ব-বিখ্যাত পত্রিকা।
আহমদ মুসা চমকে উঠল, দাউদ ইমরান হিব্রু জানে? কেন জানে? বিজ্ঞানী বলে কি?
‘দি ট্রুথ’এর সাম্প্রতিক সংখ্যা ওটা। তাহলে দাউদ ইমরান কি ম্যাগাজিনটা নিয়মিত পড়ে? ভাবল আহমদ মুসা।
ম্যাগাজিনটার পাতা উল্টাতে লাগল আহমদ মুসা। লক্ষ্য সংখ্যাটিতে কি আছে দেখা।
পাতা উল্টাতে গিয়ে ম্যাগাজিনের মধ্যে চারভাজ করা একটা কাগজ পেল আহমদ মুসা।
ম্যাগাজিনটা টেবিলে রেখে চার ভাজ করা কাগজটি খুলল সে। একটা চিঠি হিব্রু ভাষায় লেখা।
‘প্রিয় ডেভিড’ সম্বোধন দিয়ে চিঠির শুরু। সম্বোধন পড়েই শিউরে উঠলো আহমদ মুসা। ‘দাউদ’ আসলে ‘ডেভিড’। ইহুদী সে। তবে হিব্রু জানা এজন্যই কি?
চিঠিটা পড়তে শুরু করল আহমদ মুসা।
“প্রিয় ডেভিড,
তোমার রিপোর্ট প্রতিমাসেই আমরা ঠিকঠাক পেয়েছি। সবকিছুই আমরা জানতে পেরেছি। আমরা এখানে মনে করছি, আইসিটিপি আমাদের জন্য হুমকী হয়ে উঠেছে। মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্র ওর যেভাবে বাড়ছে এবং মুসলিম বিজ্ঞানীদের ওটা আশ্রয় ও ট্রেনিং দিচ্ছে, তাতে, আমাদের সিদ্ধান্ত, আইসিটিপি আর চলতে দেয়া যায় না। তুমি এ মাসেই তিনটি স্টিল কন্টেইনার পাবে। এগুলো তুমি আইসিটিপি’র সুনির্দিষ্ট তিনটি স্থানে মাটির তলায় গেড়ে দেবে। মাটি চাপা দেয়ার আগে কনটেইনারের লাল বোতামে চাপ দিয়ে ছিদ্রপথগুলো খুলে দেবে এরপর তোমার মিশন ওখানে শেষ।
আগামী দু’মাসের মধ্যেই তোমাকে আইসিটিপি এবং ট্রিয়েস্ট ছাড়তে হবে।
তোমার একান্ত
‘আইজাক’
রুদ্ধশ্বাসে চিঠি পড়ে শেষ করল আহমদ মুসা। বুক কেপে উঠল তার। সর্বনাশা যে রাহুগ্রাস ঘিরে ধরেছে স্পেনের শাহ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্স এবং মুসলিম ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্নগুলো, সেই রাহুগ্রাস গ্রাস করতে আসছে সমগ্র তৃতীয় বিশ্ব ও মুসলিম জাহানের গর্বের ধন ও আশা-ভরসার কেন্দ্র আইসিটিপি’কে। ইহুদীরা আইসিটিপি ধ্বংস এবং এখানে কার্যরত মুসলিম ও তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞানীদের বিনাশ করতে চায়।
আহমদ মুসা দ্রুত চিঠির তারিখের দিকে চোখ বুলাল। দেখল, এখন থেকে দেড় মাস আগের তারিখ। অর্থাৎ, ডেভিড ওরফে দাউদ তেজস্ক্রিয় পূর্ণ কন্টেইনার তিনটি অনেক আগেই পেয়ে গেছে এবং তা সে স্থাপনও করেছে আইসিটিপির মাটির তলায়। আবার বুকটা কেপে উঠল আহমদ মুসার। আহমদ মুসা উঠে দাড়ালো।
‘দাউদ ইমরান তাহলে………’ভাবল আহমদ মুসা, ইহুদী এবং ইহুদী এজেন্ট। দিনের পর দিন এই বিজ্ঞান কেন্দ্রের সকল তথ্য পাচার করেছে সে ইহুদীদের কাছে। অবশেষে বিজ্ঞান কেন্দ্র এবং বিজ্ঞানীদের বিনাশ করে সে চলে যাচ্ছে। যাবার আগে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি করল তেজস্ক্রিয় রিপোর্ট এবং স্যাম্পল চুরি করে।
‘দাউদ ইমরান যত পাপ করেছে, ওকে পালাতে দেয়া যাবে না।’ ভেবে চলল আহমদ মুসা, আমাদের তেজস্ক্রিয় রিপোর্ট উদ্ধার করতে হবে, সেই সাথে গবেষণা কেন্দ্রের কি কি ক্ষতি করেছে তাও জানতে হবে।
হাত দু’টো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠল আহমদ মুসার। দরজার দিকে এগুলো সে। দরজা লক করা।
আহমদ মুসা তার সব সময়ের সাথী লেসার কাটার বের করে নিল জুতার সোল থেকে।
লকের কী হোলে লেসার বীম প্রয়োগ করে লক গলিয়ে হাওয়া করে দিল।
খুলে ফেলল দরজা।
এ স্টাডি রুম থেকে করিডর দিয়ে অল্প কিছু এগুলেই ড্রয়িং রুম যেখানে ওদেরকে বসে থাকতে দেখে এসেছে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা পা টিপে টিপে এগুলো ড্রয়িং রুমের দিকে।
ড্রইং রুম থেকে একজনের কন্ঠ শোনা যাচ্ছিল। আহমদ মুসা উকি দিয়ে দেখল, সেই দীর্ঘ দেহ তীরের মত ঋজু টাক মাথা লোকটি টেলিফোনে কথা বলছে। আহমদ মুসা কান পাতল।
‘না, ওদের দু’জনকে কোথাও পাওয়া যায়নি। টেলিফোনে বলছিল
টাক মাথা লোকটি, ‘লোক পাঠানো হয়েছিল রেস্ট হাউজে। কেউ সেখানে নেই, সেই রুমটিও বন্ধ। আমরা সন্দেহ করছি, ওরা নেই।’ সেই কক্ষের দরজা এবং বাহিরটা পানি দিয়ে ধোয়া দেখা গেছে, আর সেখানে তাজা রক্তের গন্ধ পাওয়া গেছে।’ একটু থামল লোকটি। সম্ভবত: কথা শুনে নিয়ে আবার সে বলল, ‘ কি জানি আমরা বুঝতে পারছি না। জোয়ান ঐ ঘরে একা ছিল। এমন কিছু ঘটার কথা নয়, কিন্তু ঘটেছে।’ থেমে ওপারের কথা শোনার পর আবার সে বলল, ‘না, গবেষণা কেন্দ্রের কারো পক্ষে এ ধরনের কিছু করা সম্ভব নয়। নিশ্চয় তৃতীয় কোন পক্ষ জড়িত হয়েছে।
‘হ্যাঁ ডেলিগেশন আজ রাতেই মাদ্রিদে ফিরে যাচ্ছে। আজ রাতেই আমরা চলে আসছি। দাউদ গোছ-গাছ করছে।’
‘ও, কে, বায়।’
টেলিফোন রেখে লোকটি পাশের করিডোর দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেল। আহমদ মুসা অনুমান করল দাউদের বেডরুম এ দিকেই হবে।
আহমদ মুসা সবে দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমের দিকে পা তুলতে যাবে, এমন সময় পেছনে পায়ের শব্দ শুনল, একদম পেছনেই।
সংগে সংগে আহমদ মুসার মাথা গাছ থেকে পড়া পাকা ফলের মত ঝুপ করে নিচের দিকে পড়ে গেল, আর দু’টি পা তার উপরে উঠে ধনুকের মত বেঁকে তীব্র বেগে ছুটে গেল পেছনের দিকে।
পেছনের লোকটির হাতের রিভলবারটা সবে উপরে উঠতে যাচ্ছিল। এই সময় সামনে ভোজবাজির মত দৃশ্য দেখে মুহূর্তের জন্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। এরই মধ্যে আহমদ মুসার জোড় পায়ের লাথি এসে লোকটির হাত সমেত বুকে তীব্র বেগে আঘাত হানল। হাত থেকে রিভলবার ছিটকে পড়ে গেল, সেও করিডোরের মেঝেতে সটান চিৎ হয়ে আছড়ে পড়ল্
আহমদ মুসার পা দু’টি মাটি স্পর্শ করতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
দেখল, লোকটি সেই দীর্ঘদেহী লোকটির সাথী। এরও মাথা নেড়ে। লোকটির ডান হাতের পাশেই রিভলবারটি।
আহমদ মুসা ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটির উপর।
লোকটি রিভলবার হাতে তুলে নিতে পারল না। হাতের ধাক্কা খেয়ে রিভলবারটি আরেকটু সরে গেল।
আহমদ মুসা লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েই তার ডান হাতের একটা ঘুষি চালাল লোকটির বাম চোখের উপরে কানের পাশের নরম জায়গাটায়। সেই সাথে লোকটির উঁচু করা মাথাটাও ভীষণভাবে আঘাত খেল মেঝের সাথে। লোকটি জ্ঞান হারল।
আহমদ মুসা লোকটির রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে ভারি গলায় বলে উঠল, রিভলবার ফেলে দাও। এক মুহূর্ত দেরী করলে মাথা গুড়ো হয়ে যাবে।
আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গেই হাত থেকে রিভলবার ছেড়ে দিল এবং ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, সেই দীর্ঘদেহী লোকটি আহমদ মুসার মাথা লক্ষ্যে রিভলবার তুলে স্থির দাঁড়িয়ে গজ দুয়েক দুরে।
আহমদ মুসা ঘুরতেই লোকটি বলে উঠল, তুমি যে বড় ঘুঘু হবে, তা আমাদের আগেই বোঝা উচিত ছিল। কোন সাধু লোক এত রাতে এভাবে কারও বাড়িতে প্রবেশ করে না।
একটু থামল লোকটি, তারপর রিভলবার নাচিয়ে নাচিয়ে বলল, বুঝেছি তুমিই আমাদের দু’জনকে হত্যা করেছ রেস্ট হাউজে। তোমাকে এখনি কুকুরের মত গুলি করে মারতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু তা করব না। জানতে হবে তুমি কে?
বলে সে মেঝেয় পড়ে থাকা অজ্ঞান লোকটির দিকে ইংগিত করে বলল, নাও ওকে, বেডে পৌছে দাও।’
আহমদ মুসা সুবোধ বালকের মত তার হুকুম তালিম করল। আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়াল লোকটির মাথার কাছে। তারপর নিচু হয়ে দু’হাত লোকটির বগলের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে লোকটিকে তুলতে লাগল।
চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনাটা।
আহমদ মুসা অজ্ঞান লোকটিকে বুক বরাবর তুলেই বিদ্যুৎ গতিতে ছুড়ে দিল সামনের দীর্ঘবপু লোকটিকে লক্ষ্য করে।
শেষ মুহূর্তে লোকটি বুঝতে পেরেছিল। গুলিও করেছিল আহমদ মুসার মাথা লক্ষ্যে। কিন্তু আহমদ মুসা অজ্ঞান লোকটিকে ছুড়ে দেয়ার জন্য পেছন দিকে ঝুকতে গিয়ে অনেক খানি নিচু হয়েছিল। আর ছোড়ার বেগে অজ্ঞান লোকটিই বেশ উচুতে উঠেছিল। গুলী এসে আঘাত করল অজ্ঞান লোকটিকেই।
গুলী খাওয়া অজ্ঞান লোকটি গিয়ে আছড়ে পড়ল দীর্ঘবপু লোকটির উপর। দু’জনেই ছিটকে পড়ল মেঝের উপর।
আহমদ মুসা দ্রুত ছুটে গিয়ে লোকটির হাত থেকে ছিটকে পড়া রিভলবারটি তুলে নিল।
তারপর ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল, দীর্ঘবপু লোকটি পকেট থেকে আরেকটি রিভলবার হাতে তুলে নিয়েছে। রিভলবারের নলটি দ্রুত ছুটে আসছে আহমদ মুসার দিকে। ভিজে গেছে লোকটির বুক গুলীবৃদ্ধ অজ্ঞান লোকটির লাল রক্তে। তার চোখ দু’টিই রক্তের মত লাল। খুনি হয়ে উঠেছে সে।
আহমদ মুসার রিভলবার তাকে সুযোগ দিল না। উদ্গিরণ করল। লোকটি মাথা তুলেছিল গুলী করার জন্যে। গুড়ে হয়ে গেল তার সে মাথা।
গুলী করার পর আহমদ মুসা মুহূর্তকাল চিন্তা করল। দাউদ কোথায়। গুলীর শব্দ শোনার পর তার তো বের হবার কথা। বেড় রুমে কি সে নেই।
কোন দিকে যাবে যখন চিন্তা করছে সে সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। কেউ যেন দ্রুত উপরে উঠে আসছে।
আহমদ মুসা একটু সরে গিয়ে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়ালো। পায়ের শব্দে বুঝল লোকটি সিঁড়ি থেকে উপরে উঠে এসেছে। করিডোরের মুখে ড্রয়ইরুমের প্রান্তেই পড়ে ছিল ওদের দু’জনের লাশ। সিঁড়ি থেকে উঠে ড্রইংয়ে পা দিলেই যে কেউ তা দেখতে পাবে।
আহমদ মুসা আড়াল থেকে উঁকি দিল। দেখল, রিভলবার হাতে দাউদ আতংক-বিহবল দৃষ্টিতে লাশ দু’টির দিকে তাকিয়ে। তার রিভলবারটি উদ্যত, কিন্তু কোন টার্গেটে নয়। আহমদ মুসা এক ঝটকায় বেরিয়ে এল দেয়ালের আড়াল থেকে। দাউদ ইমরানের দিকে রিভলবার উদ্যত করে বলল, রিভলবার ফেলে দাও ডেভিড। ইহুদী স্পাই সেজেছ বিজ্ঞানী। তোমার খেলা এবার সাঙ্গ।
দাউদের চোখ দু’টি জ্বলে উঠল। সে রিভলবার ফেলে দিল না। বিদ্যুৎ গতিতে তা ঘুরে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার রিভলবার রেডি ছিল দাউদের রিভলবার ধরা হাত লক্ষ্যে গুলী করল সে।
দাউদের রিভলবার ধরা হাত ঘুরে এসে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে আর উঠতে পারল না। তার গুলীবিদ্ধ হাত থেকে রিভলবার খসে পড়ল। বা হাত দিয়ে ডান হাত চেপে ধরে সে বসে পড়ল।
আহমদ মুসা এসে দাউদের সামনে দাঁড়াল। বলল, মি: ডেভিড তোমার কৃর্তির সবই আমি জানি। এখন বল, সেই স্যাম্পুল এবং তেজস্ক্রিয় রিপোর্টটি কোথায় রেখেছ?
‘কে আপনি, সে রিপোর্টের সাথে আপনার কি সম্পর্ক?’ হাতের যন্ত্রণায় মুখ বাঁকা করে বলল দাউদ।
‘আমি কে তা জেনে তোমার কোন প্রয়োজন নেই, আমি যা জিজ্ঞেস করেছি, তার জবাব দাও।
‘ওসবের সাথে আমার কি সম্পর্ক? আমি কিছু জানি না।’
‘দেখ মনে করো না ঐ তথ্যটা আমার খুবই দরকার এবং ঐ তথ্যের জন্যে তোমার মাথায় এখনও গুলী করিনি। আমি জানি ওগুলো কোথায়।’
‘কেন তাহলে বাঁচিয়ে রেখেছেন?’
‘তুমি যা পাপ করেছ তার বিচার হতে হবে, শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান কেন্দ্র ধ্বংসের জন্যে তেজস্ক্রিয় সেট পেতেছ বিজ্ঞান কেন্দ্রের মাটির তলায়।’
দাউদের চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। বলল, ‘আপনি কে?’
‘বলেছি, আমার পরিচয় দিয়ে তোমার কাজ নেই।’
‘তেজস্ক্রিয় রিপোর্ট কোথায় আপনি জানেন?’
‘হ্যা জানি, ওটা স্পেন থেকে শিক্ষা সফরে আসা দলের দলনেতার হাতে।’
আবার দাউদের চোখে একরাশ বিস্ময় ফুটে উঠল।
বসতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, উঠে দাঁড়াও, তোমার ফার্স্ট এইড বক্স কোথায় বের কর।’
দাউদ উঠে দাঁড়াল।
চলতে শুরু করল তার বেড রুমের দিকে। আহমদ মুসা তার পিছে পিছে।
বেড় রুমের থাক থেকে ফার্স্ট এইড বক্স বের করে আনল দাউদ। তারপর আহমদ মুসার নির্দেশে সে বাক্সটি খুলল এবং আহমদ মুসার নির্দেশেই সে ওষুধে তুলা ভিজিয়ে হাতের ক্ষতের উপর তা চাপিয়ে দিল।
দাউদের ডান হাতের গোড়ার দিকটা সহ হাতের ঐ অংশটা একদম বিধ্বস্ত হয়েছে।
আহমদ মুসা হাতের রিভলবার পাশে সরিয়ে রেখে দাউদের ক্ষতস্থানে আরও কিছু তুলা লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল।
আহমদ মুসা যখন ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছিল, তখন দাউদের একবার মনে হয়েছিল, বাম হাতের এক ঘুসি দিয়ে তার শত্রুকে কুপোকাত করতে পারে। কিন্তু পরক্ষনেই সে ভেবেছিল, লোকটি সোজা নয়। ইহুদি এজেন্সি ইরগুন জাই লিউমি’র বিশ্বখ্যাত দুই দুর্ধষ্য যোদ্ধাকে সে এইমাত্র হত্যা করেছে। আর নার্ভটা তার ভয়ানক রকম শক্ত না হলে হাত খালি করে এভাবে শত্রুর কাছাকাছি সে আসতো না।
যত্নের সাথে ব্যান্ডেজ বাঁধা দেখে দাউদের মনে আবার প্রশ্ন জাগল, শত্রুর ভাল-মন্দের দিকে মনোযোগী এই লোকটি কে? এমন শত্রুকে সে তো কোনদিন দেখেনি।
কিছু বলতে যাচ্ছিল দাউদ, তার আগে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে ফার্স্ট এইড বক্স থেকে দু’টুকরো সিল্কের কর্ড তুলে নিল। এক টুকরো দিয়ে দাউদের দু’টি হাত পিছ মোড়া করে বেঁধে ফেলল।
‘আহত লোককেও ভয় করেন?’ বলল দাউদ।
‘না ভয় নয়। ঝামেলা এড়াতে চাই।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল চলুন।
‘কোথায়?’
‘নিচে আপনার গাড়িতে।’
দাউদকে নিয়ে আহমদ মুসা নিচে নেমে এল। গাড়ি বারান্দাতেই দাঁড় করানো ছিল দাউদের গাড়ি। চাবিও ছিল গাড়ির সাথেই।
আহমদ মুসা গাড়ির পেছনের লাগেজ কেবিনটা খুলে সেখানে ঢুকিয়ে দিল দাউদকে। তারপর মুখে রুমাল পুরে দিয়ে লাগেজ কেবিন লক করে ফেলল।
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল আহমদ মুসা।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
জেনরা অর্থাৎ স্পেন থেকে আগত শিক্ষা সফরের লোকরা কোথায় উঠেছে আহমদ মুসা জানে। জোয়ান কোথায় উঠেছে, কোথায় তাকে পাওয়া যাবে, সেটা খোঁজ করতে গিয়েই সে জানতে পারে গবেষণা কেন্দ্রের গেটম্যানের কাছ থেকে যে, স্পেন থেকে শিক্ষা সফরে আসা একটি টিম উঠেছে গবেষণা কেন্দ্র থেকে একটু পুবে সাগর-তীরের ‘সি-কুইন’ নামক মোটেলে।
আহমদ মুসা অনুমানেই ধরে নিল মোটেলটি কোথায় হবে।
আড্রিয়াটিকের বেলাভূমি। বেলা ভূমির প্রান্ত ঘেঁষে এগিয়ে গেছে প্রশস্ত একটি পাকা রাস্তা। সেই পাকা রাস্তার উত্তর পাশ ঘেষে মোটেলের সারি। প্রত্যেক মোটেলের প্রবেশ গেটে মোটেলের নাম। রাতে লিওন সাইনের আলোতে তা জ্বলজ্বল করছে। রাস্তা থেকে তা পরিস্কার পড়া যায়।
আহমদ মুসা তিনটি মোটেল পেরিয়েই সামনের মোটেলটার লিওন সাইনে ‘সি কুইন’ নাম দেখতে পেল।
প্রধান রাস্তা থেকে একটা অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তা বেরিয়ে মোটেলের গাড়ি বারান্দায় গিয়ে ঠেকেছে।
‘সি কুইনের’ গাড়ি বারান্দায় আগে থেকেই একটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসার গাড়ি গিয়ে সেই গাড়ির পাশে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা নামল গাড়ি থেকে। গাড়ি থেকে নেমে দেখল, একজন লোক দু’টো ব্যাগ ও একটি সুটকেশ ভেতরের দিক থেকে এনে দাঁড়িয়ে থাকা মাইক্রবাসে উঠাতে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা বুঝল, শিক্ষা সফরের দলটি তাহলে যাবার জন্যে তৈরী হচ্ছে।
আহমদ মুসা দ্রুত ঢুকে গেল ভেতরে।
ঢুকেই পেল রিসেপশন কাউন্টার। সেখানে একজন লোক বসে।
‘স্পেনের শিক্ষা সফরে আসা দলটির দলনেতা কত নম্বরে।’ স্পেনীয় ভাষায় জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ঐ তো উনি আসছেন, চলে যাবেন উনি এখনি।’
আহমদ মুস ফিরে তাকাল রিসেপশনিস্ট–এর ইংগিত লক্ষ্য করে। দেখল, একজন মধ্য বয়সী লোক এগিয়ে আসছে। তার হাতে একটা ব্রিফকেস। লোকটির দু’পাশে এবং পেছনে কয়েকজন। তাদের মধ্যে জেনও।
জেন আহমদ মুসাকে দেখে ফেলেছে। আহমদ মুসাকে থেকে জেনের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। তার চোখ দু’টি বড় বড় হয়ে উঠেছে।
কিন্তু আহমদ মুসার চোখে সামান্য কোন পরিবর্তনও এল না। যেন কোনদিনই সে জেনকে দেখেনি।
জেনও নিজেকে সামলে নিয়েছে। কিন্তু তার মনটা থর থর করে কাঁপছে। সে জানে, আহমদ মুসা বিনা কারণে আসেনি, কি ঘটে কে জানে। সে মনে মনে প্রার্থনা করল, হে ঈশ্বর, তুমি ন্যায়ের পথে সংগ্রামী আহমদ মুসাকে, মজলুম জোয়ানকে সব বিপদ থেকে নিরাপদ কর।
ওরা এগিয়ে এলে আহমদ মুসা দু’ধাপ সামনে এগিয়ে দলনেতা লোকটির মুখোমুখি হয়ে বলল, গুড নাইট, আপনি কি শিক্ষা সফর টিমের দলনেতা?’
‘হ্যাঁ, আপনি কে?’
‘আমাকে চিনবেন না, আপনাদের কথা শুনে এলাম। আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই।’
‘আমাকে? আমি তো যাবার জন্যে বেরিয়েছি। চলুন গাড়িতে বসে শুনব আপনার কথা।’
‘সবাই কি চলে যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ যাচ্ছে, রাত দু’টার প্লেনে। আমার একটু কাজ আছে। তাই আগে বের হচ্ছি। যাচ্ছি এক বন্ধুর বাসায়।’
‘আপনি মি…।’
‘আমি অধ্যাপক ভিলারোয়া।’
হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল তাদের মধ্যে।
তারা হাঁটছিল গাড়ি বারান্দার দিকে।
মিঃ ভিলারোয়ার পাশাপাশি হাঁটছিল স্কিন হেডেড একজন লোক। বয়স হবে পঁয়ত্রিশের মত। লোকটি শুরু থেকেই আহমদ মুসাকে দেখে ভ্রুকুচকে ছিল।
আহমদ মুসাও তাকে লক্ষ্য করছিল।
গাড়ি বারান্দায় পৌঁছে স্কিন হেডেড লোকটি আহমদ মুসা যে গাড়ি নিয়ে এসেছিল, সে গাড়ির দিকে তাকিয়েই ফিরে দাঁড়াল আহমদ মুসার দিকে। লোকটির চোখে তখন ক্রুর দৃষ্টি। বলল সে, এই গাড়িতেই আপনি এসেছেন?
লোকটি পকেটে হাত দিয়েছে।
আহমদ মুসার হাত আগে থেকেই পকেটে। বলল, হ্যাঁ, গাড়ি আমিই এনেছি।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই লোকটির হাত বেরিয়ে এসেছে পিস্তল সমেত। আহমদ মুসারও।
আহমদ মুসা হিসেবটা আগেই সম্পূর্ণ করেছিল। দু’জনের হাতে রিভলবার বেরিয়ে আসলে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যে কোন একজনকে মরতেই হবে। আহমদ মুসা রিভলবার বের করেছিল সিদ্ধান্ত নিয়েই। সুতরাং স্কিন হেডেড লোকটি রিভলবার বের করে যে সময়টা সিদ্ধান্ত নিতে ব্যয় করেছে, সে সময়ে আহমদ মুসার বুলেট গিয়ে তার বুকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল।
ঢলে পড়ল তার দেহ মিঃ ভিলারোয়ার পায়ের কাছে।
কি ঘটে গেল বুঝে নিয়ে সবাই যখন আহমদ মুসার দিকে চোখ তুলল, তখন দেখল আহমদ মুসার রিভলবারটি মিঃ ভিলারোয়ার দিকে স্থিরভাবে উদ্যত। নিহত লোকটির পিস্তলটিও তখন আহমদ মুসার বাম হাতে।
‘মিঃ ভিলারোয়া আপনার স্যুটকেশ এবং দু’টি ব্যাগ মাইক্রোবাসে উঠেছে, ওগুলো এই মুহূর্তে আমার গাড়িতে তুলে দিতে বলুন। এক মুহূর্ত দেরী করলে আপানা মাথা এবার গুড়ো হবে।
কাঁপছিল মিঃ ভিলারোয়া। সংগে সংগেই কিছু দূরে দাঁড়ানো বেয়ারাকে নির্দেশ দিল স্যুটকেশ ও ব্যাগ দু’টো আহমদ মুসার গাড়িতে তুলে দিতে।
বেয়ারা মুহূর্তকাল দেরী না করে নির্দেশ পালন করল।
আবার মুখ খুলল আহমদ মুসা। বলল, ‘মিঃ ভিলারোয়া আমার গাড়িতে উঠুন।’
মিঃ ভিলারোয়ার কম্পন বেড়ে গেল। কথা বলতে চেষ্টা করেও পারল না।
জেন মিঃ ভিলারোয়ার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। সকলের মধ্যে সেই মাত্র স্বচ্ছন্দভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যেত, তার চোখে-মুখে ভয়ের যে ভাবটা ছিল তা এখন নেই। সেই মুখ খুলল, তাকে কোথায় নিয়ে যাবেন?
‘ভয় নেই ম্যাডাম, ওঁর কোন ক্ষতি হবে না। আমাদের চুরি করা জিনিস উদ্ধার হলেই ওঁকে ছেড়ে দেব।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার তাঁর রিভলবার নাচিয়ে বলল, মিঃ ভিলারোয়া আমি এক আদেশ দু’বার করি না।’
মি:ভিলারোয়া কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে গাড়িতে চড়ল। আহমদ মুসা গিয়ে গাড়িতে উঠে গাড়িতে স্টার্ট দিল। ড্রাইভিং সিটের পাশেই বসেছিল অধ্যাপক ভিলারোয়া।
আহমদ মুসার গাড়ি যখন প্রধান রাস্তায় উঠে চলতে শুরু করেছে, তখন দূরে বিপরীত দিক থেকে একটি পুলিশের গাড়িকে দ্রুত ‘সি-কুইনের’ দিকে আসতে দেখা গেল।
কিছু দুর চলার পর আহমদ মুসার গাড়ির আলো নিভিয়ে দিল তারপর রাস্তা থেকে গাড়িকে সাগরের বেলাভূমিতে নামিয়ে নিল এবং একটি ঝোপের আড়ালে গিযে দাঁড়াল।
‘মি: ভিলারোয়া, গবেষণা কেন্দ্র থেকে আপনারা যে স্যাম্পুল ও তেজস্ক্রিয় রিপোর্ট চুরি রেছেন, সেটা বের করে দিন। এখনই আপনি ছাড়া পাবেন। আর যদি মিথ্যা বলে হয়রান করেন, তাহলে আপনার কি পরিণতি হবে তা দেখেছেন।’ ধীর, কিন্তু শক্ত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আমি ওগুলো চুরি করিনি, ওরাই ওগুলো আমাকে গছিয়েছে স্পেনে বয়ে নেবার জন্যে। আমার ব্রীফকেসে ওগুলো আছে। দিয়ে দিচ্ছি।’ কাঁপা গলায় বলর মি: ভিলারোয়া।
মি: ভিলারোয়া মুখে কথা বলার সাথে সাথে ব্রিফকেস খুলে ভেতর থেকে একটা ইনভেলাপ ও একটি প্লাস্টিক থলে আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিল।
আহমদ মুসা গাড়ির ভেতরের লাইট অন করে ওগুলো পরীক্ষা করে পকেটে রেখে দিল।
‘ধন্যবাদ মি: ভিলারোয়া, আপনার কোথায় যেন যাবার কথা ছিল? যাবেন সেখানে?’
‘আমি জানি না, সাথের ঐ লোকটিই নিয়ে যাচ্ছিল।’
‘তাহলে এখন মটেলে যাবেন?’
‘জি।’
আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিল।
চলতে শুরু করল গাড়ি।
‘তেজস্ক্রিয় রিপোর্ট এবং স্যাম্পুল দিয়ে আপনি কি করতেন?
জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘আমার দায়িত্ব ছিল শুধু বহন করা। মাদ্রিদে পৌছলেই ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের মি: ভাসকুয়েজের লোক এসে এসব নিয়ে যাবার কথা।’
রাস্তায় উঠে আহমদ মুসা গাড়ির আলো নিভিয়ে দিয়েছিল। ‘সি-কুইন’ মটেলের সামনে রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করাল আহমদ মুসা।
‘দু:খিত মি: ভিলারোয়া আপনাকে একেবারে মটেলে পৌছে দিতে পারলাম না। পুলিশ ঝামেলা করবে।’ বলল আহমদ মুসা।
গাড়ি থামতেই মি: ভিলারোয়া বুঝে নিয়েছিল, তাকে এখানেই নামতে হবে।
‘ধন্যবাদ’ বলে গাড়ি থেকে স্যুটকেশ, দু’টি ব্যাগ ও ব্রিফকেস নিয়ে নেমে পড়ল মি: ভিলারোয়া।
গাড়ি স্টার্ট নিল আহমদ মুসার। তার গাড়ি গবেষণা কেন্দ্রের দিকে।
তার গাড়ি দাঁড়াল গিয়ে গবেষণা কেন্দ্রের রেস্ট হাউজের গেটে। গাড়ি দাঁড়াতেই গেট রুমের জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল গেঁটম্যান।
‘ড: নুর আব্দুল্লাহ ভেতরে আছেন?’
‘চলে গেছেন।’
‘একা?’
‘না, মেহমানদের সমেত।’
‘কোথায়, ওর বাসায়?’
‘জি হ্যাঁ।’
‘বাসা কোথায়?’
‘কমপ্লেক্সের ভেতরে, গবেষণা কেন্দ্রের পাশেই।’
‘ধন্যবাদ।
বলে আহমদ মুসা তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। কমপ্লেক্সের গেট সে চেনে।
গেটের সামনে গাড়ি পৌছতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল গেট খোলা। ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল রাত ১২টা। এ সময় তো গেট খোলা থাকার কথা নয়।
গেটের মুখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ল আহমদ মুসা।
গেটের একটা পাল্লা পুরো খোলা, আরেকটা পাল্লা অর্ধ খোলা। গেটরুম শূণ্য।
আহমদ মুসা অবাক হলো গুরুত্বপূর্ণ এই গেটের অবস্থা দেখে। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, অস্বাভাবিক কিছু তো ঘটে যেতে পারে! একবার হামলা ব্যর্থ হয়েছে, আরেকটা হামলা তো আসতে পারে! দাউদের বাড়ির ঘটনা ইতিমধ্যে তারা জানতেও পারে। সতর্ক হয়ে উঠল আহমদ মুসা।
সে পা বাড়াবে ড: নুর আবদুল্লাহর বাড়ির দিকে যাবার জন্যে এমন সময় সে দেখতে পেল কমপ্লেক্সের দিক থেকে দুটো হেডলাইট এগিয়ে আসছে।
আহমদ মুসা দ্রুত গেট রুমের একটা থামের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।
এগিয়ে আসা গাড়িটি গেটের কাছাকাছি এসে স্পিড কমিয়ে দিয়ে দু’বার হর্ন বাজাল। হর্ন শুনেই আহমদ মুসা বুঝল ওটা ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা ইরগুন জাই লিউমি’র সংকেত। নিশ্চিত হলো ওটা দাউদের দলের গাড়ি।
হর্ন বাজানোর কয়েক মুহূর্ত সব চুপচাপ। তার পরেই গাড়ি থেকে একটা হাত বেরিয়ে এল। আর সংগে সংগেই ক্রিকেট বলের মত গোলাকার একটা বস্তু ছুটে গেল আহমদ মুসার গাড়ির লক্ষ্যে। গোলাকার বস্তুটি সরাসরি গিয়ে আঘাত করল আহমদ মুসার গাড়িতে। সংগে সংগেই প্রচন্ড বিষ্ফোরণ। টুকরো টুকরো হয়ে গেল আহমদ মুসার গাড়ি।
এগিয়ে আসা গাড়িটি মুহূর্তের জন্যে থেমে গিয়েছিল। আবার নড়ে উঠল।
আহমদ মুসার কাছ থেকে গাড়ির দূরত্ব পাঁচ’ছ গজের মত। আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিল গাড়ি থামাতে হবে। নিশ্চয় কোন অঘটন ঘটিয়ে ফিরে যাচ্ছে শক্রুর গাড়িটি।
গোলাকার সেই বস্তু অর্থাৎ গ্রেনেডটি ছোঁড়া হয়েছিল ড্রাইভারের সিট থেকে। সে জানালা খোলা।
আহমদ মুসা রিভলবার তুলে গুলী করল ড্রাইভারের আবছা অবয়বটা লক্ষ্য করে।
একটা চাপা আর্তনাদ ভেসে এল। একবারই মাত্র। তারপর গাড়িটা একটু বেঁকে গিয়ে থেমে গেল।
গাড়ির মাথাটা বেঁকে এল গেট রুমের দিকেই। নিকটতর হলো গাড়িটা এবং গাড়ির দু’পাশটা এখন আহমদ মুসার চোখের সামনে। আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল এই অযাচিত সাহায্যে।
গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে একজন হাত উঁচু করে গেট রুম লক্ষ্যে গুলী করতে করতে গাড়ির ওপাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা এরই অপেক্ষা করছিল রিভলবার বাগিয়ে। লোকটির মাথা উঁচু হবার সাথে সাথেই ট্রিগার টিপল আহমদ মুসা ওর মাথা লক্ষ্যে।
মাথাটা আর ওর উঠল না দেহটা তার খসে পড়ল গাড়ির দরজাতেই।
আর কেউ বেরুল না গাড়ি থেকে। গুলীও এল না।
আহমদ মুসা ভাবল, গাড়িতে শত্রু পক্ষের কেউ থাকতে পারে। আহমদ মুসা আড়াল থেকে বের হওয়ার অপেক্ষা করতে পারে।
এই সময় আহমদ মুসা কমপ্লেক্সের দিক থেকে কয়েকজনকে আসতে দেখল। সেই সাথে ভেতর থেকে গাড়ির দরজায় ধাক্কা দেয়ার শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা বুঝল শত্রু পক্ষের কেউ নেই। নিশ্চয় কাউকে ওরা বন্দী করে এনেছিল তারাই বের হবার চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসা ছুটে গেল গাড়ির দিকে।
গাড়ির কাঁচে ডার্ক শেড দেয়া। বাইরে থেকে কিছুই দেখা গেল না।
আহমদ মুসা সামনের গেট দিয়ে লাশ ডিঙিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। তার হাতে তখন উদ্যত রিভলবার।
‘মুসা ভাই দরজা খুলে দিন, আমরা বাঁধা।’ জোয়ানের কণ্ঠ। আহমদ মুসা দ্রুত দরজা অন-লক করে দিয়ে বাইরে এসে দরজা খুলে দিল্
প্রথম বেরিয়ে এল জোয়ান, তারপর একে একে ড: নুর আবদুল্লাহ এবং ড: আবদুল্লাহ জাবের। তাদের সকলকেই পিছমোড়া করে বাঁধা।
এই সময় গবেষণা কেন্দ্রের নিরাপত্তা কর্মীসহ অন্যান্য লোকজন এসে পড়ল। তারা বাঁধন খুলে দিল সকলের।
বাঁধন খুললেই ড: নুর আবদুল্লাহ এসে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ঠিক সময়ে আপনি এসে না পড়লে কি যে হতো! আপনি আমাদের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
আহমদ মুসার মাথায় তখন অন্য চিন্তা গবেষণা কেন্দ্রের ভেতরে এসব হত্যাকান্ড ও ঘটনার একটা ব্যাখ্যা গবেষণা কেন্দ্রকে দিতে হবে।
চিন্তা করে নিয়ে আহমদ মুসা ডঃ নূর আব্দুল্লাহকে বলল, জনাব পুলিশ ষ্টেশনে খবর দিতে হবে। বলতে হবে আজ গবেষণাগার থেকে একটা গবেষণা রিপোর্ট চুরি হওয়ার পর এসব ঘটনা ঘটেছে। আপনারা কিডন্যাপ হবার পর যা ঘটেছে তার বাইরে আপনারা কিছুই জানেন না। সামনের গাড়ী ধ্বংস হবার পর ওদের গুলীতেই এ’ দু’জন মরেছে। পরে কমপ্লেক্সের লোকজন আপনাদের উদ্ধার করেছে।
গবেষণা কেন্দ্রের সিকুরিটি চীফও আহমদ মুসার কথাগুলো শুনছিল। বলল, অর্থাৎ আমাদের শুধু একটা বিষয়ই গোপন করতে হবে, সেটা হলো, এ দু’জন আপনার হাতে নিহত হওয়া।
‘কারণ আমি সাক্ষ্য দেবার জন্য ইটালীতে থাকতে পারবো না, এ কারণেই।
‘ঠিক আছে জনাব, বলল সিকুরিটি চীফ।
সিকুরিটি চীফ ইসমত আবেদিন তুর্কি বংশোদ্ভূত একজন ইটালীয় মুসলিম। ইটালীয় আর্মির একজন অবসর প্রাপ্ত কর্ণেল। ট্রিয়েস্টেই তার বাড়ি। পুলিশ ও প্রশাসন মহলে তার পরিচিতি ব্যাপক।
‘মিঃ ইসমত আপনিই আমার পক্ষ থেকে পুলিশ স্টেশনে ডাইরি করুন। সব আপনি শুনলেন, অন্য সব বিষয় আপনি জানেন। যে ভাবে লিখতে হয়, লিখবেন।
কথা শেষ করে ডঃ নুর আব্দুল্লাহ বলল, দারোয়ান কোথায়? পালালেও সে তো এতক্ষণ আসার কথা।
‘আমি দেখছি স্যার। বলে ইসমত আবেদিন গেট রুমের দিকে গেল।
গেট রুমের ভিতরে গিয়ে সে চিৎকার করে উঠল, এখানে পড়ে আছে, কে যেন তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেছে।
‘ও যেভাবে আছে সে ভাবেই থাক’। বলল আহমদ মুসা।
ইসমত আবেদিন ফিরে এলো।
তার গ্যারেজ থেকে গাড়ী নিয়ে চলল পুলিশ স্টেশনে।
‘জনাব আপনার সাথে আমার অত্যন্ত জরুরি আলাপ আছে, এখনি সে আলাপ করতে হবে। ডঃ নূর আব্দুল্লাহকে বলল আহমদ মুসা।
‘চলুন আমার বাসায় ফেরা যাক’।
বলে ডঃ নূর আব্দুল্লাহ যাবার জন্যে পা তুলতে তুলতে বলল, অন্যান্য লোকদের লক্ষ্য করে। গেটটা এভাবেই থাকবে, তোমরা এখানেই থাক, সব যেমন আছে, তেমনই থাকবে।
ডঃ নূর আব্দুল্লাহ, ডঃ আব্দুল্লাহ জাবের, জোয়ান এবং আহমদ মুসা পাশাপাশি হেঁটে চলল, ডঃ নূর আব্দুল্লাহর বাড়ীর দিকে।
ডঃ নূর আব্দুল্লাহর বৈঠকখানায় বসে আহমদ মুসা রেষ্ট হাউজ থেকে যাবার পর দাউদের বাড়িতে পৌছা, দাউদের হাতে তার বন্দী হওয়া, ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার চিঠিটি থেকে দাউদের প্রকৃত পরিচয় ও তার কুকৃর্তির সব ঘটনা জানা, বন্দী দশা থেকে মুক্ত হওয়া, দু’জন ইহুদী গোয়েন্দাকর্মীকে হত্যা, দাউদকে আহত করা, দাউদকে গাড়ীর লাগেজ কেবিনে পুরে মটেল ‘সি কুইন’ যাওয়া সেখানকার ঘটনায় আরেক ইহুদী গোয়েন্দা কর্মীকে হত্যা এবং অধ্যাপক ভিলারোয়াকে ধরে নিয়ে যাওয়া এবং তার কাছ থেকে ‘তেজস্ক্রিয় রিপোর্ট ও স্যাম্পুল উদ্ধার করা, প্রভৃতি সব ঘটনা বলা শেষ করে বলল, কমপ্লেক্সের গেটে যা ঘটল তা তো আপনারা দেখছেন।
ঘটনা শুনার পর কেউ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলনা। ডঃ নূর আব্দুল্লাহর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সম্ভবতঃ গবেষণা কেন্দ্র ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়ের শিকার হওয়ার কথা শুনে। কিছুক্ষণ পর ভাঙা গলায় বলল, আমাদের গবেষণা কেন্দ্রেও ওরা সেই ভয়াবহ তেজস্ক্রিয় পেতেছে। আমাদের সব তথ্য দাউদ পাচার করেছে ইহুদী সংস্থার কাছে। দাউদ তাহলে ইরগুন জাই লিউমি’র গোয়েন্দা কর্মী ডেভিড ইমরান।
বলে অনেক্ষণ মুখ নিচু করে থাকল ডঃ নূর আব্দুল্লাহ। যখন মুখ তুলল, দেখা গেল তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। কাঁপা গলায় বলল, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আহমদ মুসা, আপনি সবার বহু সাধের এ গবেষণা সংস্থাকে অবশেষে বাঁচাবার একটা ব্যবস্থা করেছেন। আমি বিজ্ঞানী ডঃ সালামের এ পবিত্র আমানতের হেফাজত করতে পারিনি। আমি যথেষ্ট সতর্ক ছিলাম না। আমার বুঝা উচিত ছিল মুসলিম জগৎ ও তৃতীয় বিশ্বের উন্নতির একটা গুরুত্বপূর্ণ সোপান এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার চেষ্টা অনেকেই করবে।
ডঃ নূর আব্দুল্লাহর শেষের কথা আবেগে ভেঙে পড়ল। আহমদ মুসা দাউদের কাছে লিখা ইরগুন জাই লিউমি’র চিঠিটি ডঃ নূর আব্দুল্লাহর হাতে দিতে দিতে বলল, অতীত এখন অতীত ডঃ নূর আব্দুল্লাহ। আমাদের এখন বর্তমান নিয়ে ভাবতে হবে। আল্লাহর অশেষ প্রশংসা যে তিনি ওদের ষড়যন্ত্র অবশেষে হাতে-নাতে ধরিয়ে দিয়েছেন।
দাউদ তাহলে ও গাড়ীটার লাগেজ কেবিনে ছিল, বিস্ফোরণে তাহলে সেও শেষ হয়ে গেছে। চিঠিতে নজর বুলাতে বুলাতে বলল ডঃ নূর আব্দুল্লাহ।
‘জি হ্যাঁ, এটাই ঘটেছে। যদিও তার এ পরিণতি আমি চাইনি। আমি বন্দী করে নিয়ে এসেছিলাম এজন্যেই যে, তার কাছ থেকে আরও কথা পাওয়া যাবে। কিন্তু সে সুযোগ হলো না।
আহমদ মুসা কথা শেষ করে পকেট থেকে তেজস্ক্রিয় রিপোর্ট বের করে ডঃ নূর আব্দুল্লাহর হাতে দিয়ে বলল, রিপোর্ট কি বলছে দয়া করে বলুন।
রিপোর্টের উপর চোখ বুলাতে বুলাতে ডঃ নূর আব্দুল্লাহর কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠল, বিষণ্ণ হয়ে উঠল তার মুখ। সে রিপোর্টটি ডঃ আব্দুল্লাহ জাবেরের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, দুঃসংবাদ জনাব আহমদ মুসা। বিশেষ তেজস্ক্রিয় বিষের কোন এ্যান্টিডোজ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। যেখানে তেজস্ক্রিয় পোতা আছে তা খুজে বের করে তাকে তুলে ফেলা অথবা সে কমপ্লেক্স বা বিল্ডিং ছেড়ে সরে যাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
শুনে আহমদ মুসার মুখেও চিন্তা ও শংকার ভাব ফুটে উঠল, বলল, মাদ্রিদের মসজিদ কমপ্লেক্স না হয় ছেড়ে দিয়ে বাঁচা গেল, কিন্তু স্পেনের কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, সেভিল প্রভৃতির শত শত অমূল্য মুসলিম স্মৃতি চিহ্নগুলোকে আমরা বাঁচাব কেমন করে। এতগুলো স্থান থেকে তেজস্ক্রিয়ের স্থান খুঁজে বের করা এবং তা তুলে ফেলা কি সম্ভব! আহমদ মুসার কন্ঠে অসহায় ও ভেঙে পড়া সুর।
আহমদ মুসার মত জোয়ানের মুখও অন্ধকার হয়ে উঠেছে। ভেঙে পড়েছে উভয়েই। কোন ঘটনায় জীবনে আহমদ মুসা এভাবে ভেঙে পড়েনি।
‘মুসা ভাই আপনার কন্ঠে সাহসের সুর, আশার আশ্বাস বানী শুনতে আমরা অভ্যস্ত। আপনি ভেঙে পড়লে আর কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।
একটু থামল ডঃ আব্দুল্লাহ জাবের। থেমেই আবার শুরু করল, সব ব্যাপারেই আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করেছেন। এ ব্যাপারেও নিশ্চয় করবেন। যেমন তিনি সাহায্য করলেন আমাদের গৌরবের এ গবেষণাগারকে। আল্লাহ আপনাকে ট্রিয়েস্টে এই কাজের জন্যেই এনেছিলেন। আল্লাহ আপনাকে স্পেনে নিয়ে এসেছেন সাফল্য দিবেনই আল্লাহ আপনাকে।
আবেগে ভারী হয়ে উঠেছে ডঃ আব্দুল্লাহ জাবেরের কন্ঠ।
‘ডঃ নূর আব্দুল্লাহ, ডঃ জাবের আমি এবং জোয়ান এই রাতে এখনই আমরা স্পেন যাত্রা করতে চাই। বলল, আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আহমদ মুসা বলল, ‘দোয়া করুন আপনারা, স্পেনের অবস্থা গুরুতর। জোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হওয়া সত্বেও মরিসকো হওয়ার কারনে শিক্ষার পথ তার রুদ্ধ হয়ে গেছে। এই পরিচয় প্রকাশ হওয়ায় অনেককে জীবন দিতে হচ্ছে। এ সবের মোকাবেলায় আল্লাহ যেন আমাদের সাফল্য দান করেন।
‘আবার বলছি মুসা ভাই, আল্লাহ আপনাকে সফল করবেন। এই সাফল্য আপনার হাতে আসবে বলেই আল্লাহ আপনাকে স্পেনে নিয়ে গেছেন। বলল, ডঃ আব্দুল্লাহ জাবের।
আল্লাহ সাফল্য দান করেন কতকগুলো শর্তে। ঈমানের দূঢ়তা এবং যোগ্যতা তার মধ্যে অন্যতম। এগুলো না থাকলে তো আল্লাহর সাহায্য আসবেনা, এখানেই ভয় জাবের।
‘আল্লাহ সব সাহায্যেরই মালিক’। বলল, ডঃ জাবের।
আমার একটা কথা। বলল ডঃ নূর আব্দুল্লাহ।
‘বলুন’, বলল, আহমদ মুসা।
‘মিঃ জোয়ান একটি বিরাট বিজ্ঞান প্রতিভা, তার মেধাকে আমরা আমদের গবেষণা কেন্দ্রের কাজে লাগাতে চাই।
আমি খুশি হব এটা হলে। তুমি কি বল জোয়ান?
‘আপনি যা নির্দেশ করবেন, তাই করব।’
‘ঠিক আছে জোয়ান আসবে, তবে ওকে আমাদের আর একটু দরকার আছে। বেশী সময় নয়। দু’একমাস পরেই সে আসতে পারবে।’
‘জোয়ান তুমি একটা ফরম নিয়ে যাও। পুরণ করে দু’চার দিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দিও।’ বলল ডঃ নুর আব্দুল্লাহ।
‘ধন্যবাদ।’ বলল জোয়ান।
ডঃ নুর আবদুল্লাহ উঠে গিয়ে দু’টি ফরম এনে জোয়ানের হাতে দিল।
‘দু’টি কেন?’ জোয়ান বলল।
‘রাখ, দরকার হতেও পারে।’
আহমেদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমরা এখনি যেতে চাই।’
জোয়ানও উঠে দাঁড়াল।
‘এখনি যাবেন?’ বলল ডঃ নুর আবদুল্লাহ।
‘এখনি মানে এই মুহূর্তে।’
বলে আহমদ মুসা হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল ডঃ নুর আবদুল্লাহর দিকে।
ডঃ নুর আবদুল্লাহ ও ডঃ জাবেরের সাথে হ্যান্ডশেক করে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসা।
পরে তার পেছনে বেরিয়ে এল জোয়ানও।
ড্রইং রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল ডঃ নুর আবদুল্লাহ এবং ডঃ আবদুল্লাহ জাবের।
বাগানের ভেতর দিয়ে লাল সুড়কির রাস্তা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আহমদ মুসা ও জোয়ান।
‘কোন পথে ওঁরা যাবেন, গাড়ি লাগবে কিনা, কিছুই জিজ্ঞাসা করা হলো না। ডাকি ওঁদের…।’
বলে সামনে পা চালাতে গেল ডঃ নুর আবদুল্লাহ।
ডঃ আবদুল্লাহ জাবের তাকে হাত দিয়ে বারণ করে বলল, ‘ডেকে লাভ হবে না। একটা পরিকল্পনা উনি নিশ্চয় করেছেন কোন প্রয়োজন হলে নিজেই বলতেন।’
‘তবু…।’
‘লাভ হবে না। নিজের পায়ে ভর করে স্বাধীনভাবে উনি চলবেন, এটাই ওঁর নিয়ম। কাউকে কষ্ট না দিয়ে যতটা সম্ভব নিজেই কষ্ট করবেন, এটাই ওঁর রীতি।’
‘তাই তো উনি সবার এত প্রিয়, তাই তো উনি এতবড় বিপ্লবী।’
‘হ্যাঁ, তাই।’
এগিয়ে চলছিল দু’জন রাত সাড়ে বারটায় শীতল নিরবতার মাঝে মৃদু স্পন্দন তুলে।
আহমদ মুসা ও জোয়ান যখন গবেষণা কেন্দ্রের এলাকা পেরিয়ে রাস্তায় উঠল, তখন পুলিশের দু’টি গাড়ি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল আই সি টি পি’ কমপ্লেক্সের দিকে।
আহমেদ মুসা একবার সেদিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে নিক্ষেপ করল।
‘কেন তাড়াতাড়ি চলে এলাম জান জোয়ান, ডঃ নুর আবদুল্লাহ যাতে সহজেই বলতে পারেন, গবেষণা কেন্দ্র থেকে চুরি করা একটা দলিলকে কেন্দ্র করে দু’দলের সংঘাতের ফল এসব ঘটনা, হত্যা কাণ্ড।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দু’দল প্রমাণ হবে কি করে?’
‘দু’টো গাড়ির মুখো-মুখি সংঘাত। তাছাড়া মিঃ ভিলারোয়া এর জীবন্ত সাক্ষ্য হবেন। এক পক্ষ তাকে তেজস্ক্রিয় ও স্যাম্পুল দিয়েছিল, অন্য পক্ষ তার কাছ থেকে সেগুলো কেড়ে নিয়েছে। আমি মনে করি, মিঃ ভিলারোয়াকে পুলিশ আপাততঃ ছাড়ছে না।’
‘তাহলে জেনদের কি হবে?’
‘ওদের চলে যেতে অসুবিধা হবে না, কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে মাত্র।’
‘ওকে আমরা টেলিফোন করতে পারি না, শেষ খবরটা নিতে পারি না?
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, তোমার উদ্বেগ বুঝতে পারছি জোয়ান। কিন্তু এ সময় বাইরের কোন টেলিফোন জেনকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। এমনিতেই সে ভয়ানক কাজ করে বসে আছে।’
রেস্ট হউজের দু’জন লোক নিহত হওয়ার ঘটনা মনে পড়ল জোয়ানের। আহমদ মুসা বলেছিল, সে দু’জন জেনের গুলীতেই মরেছে। জেনের শান্ত, সুন্দর, সরল মুখটা ভেসে উঠল জোয়ানের চোখে। জেন জোয়ানের জন্যে এতবড় ঝুঁকি নিল। জেনের কাছে সে এতবড়। কোন ভাবে জানাজানি হলে ওর যে কি হবে। বোকার মত পিস্তলটা আবার সাথে রাখেনি তো। মনটা অস্বস্তিতে ভরে গেল জোয়ানের। একটা বোবা আতংক এসে তাকে ঘিরে ধরল। তার মনে হলো, তার জেনের নিরাপত্তার চেয়ে বড় যেন তার কাছে এখন আর কিছু নেই।
বলল জোয়ান, ‘জেনের যদি কোন বিপদ ঘটে যায়?’
‘আমি সেটা চিন্তা করেছি জোয়ান। কিন্তু আমরা তার সাথে যোগাযোগ করি কিংবা তাকে সেখানে থেকে সরিয়ে আনি- যাই করি আমরা তাকে ঘিরে, তাতে সে বেশী সন্দেহের শিকার হবে।’
থামল। ‘একটু ভাবল আহমেদ মুসা, তারপর একটু হেসে বলল, তোমার জেনের জন্যে এটুকু করতে পারি, সে ট্রিয়েস্ট ছাড়ার আগে আমরা ট্রিয়েস্ট থেকে যাব না।’
‘সেটা কিভাবে? আমরা তো ট্রিয়েস্ট ছাড়ছি।’
‘আমরা যাচ্ছি বোটে। বোটে বসে আমরা যত খুশী অপেক্ষা করতে পারি।’
‘কার বোট?’
‘ও তুমি জান না। আমি ভেনিস থেকে বোট নিয়ে এসেছি ঝামেলায় যাতে না পড়তে হয় এ জন্যে। বোট ফিডেল ফিলিপের এক ভেনিসীয় বন্ধুর। তার বন্ধুটি আবার মুসলমান। সুতরাং বলতে পার বোটটি আমাদেরই।’
‘আমরা কি আবার ভেনিসে যাব?’
‘হ্যাঁ, বোটে ভেনিস। ভেনিস থেকে ফ্রান্সের ‘মার্শেল’ হয়ে দক্ষিণ ফ্রান্সের ‘তুলুজ’। তুলুজ থেকে সড়ক পথে ফ্রান্স পেরিয়ে বাসক এলাকা দিয়ে পিরেনিজ পর্বত পার হয়ে স্পেনে।’
‘আপনি এ পথেই বুঝি এসেছেন? আপনি ইউরপের এই অঞ্চলে নতুন। নাগরিকত্বের ঝামেলা আছে। আপনি কি করে একা এলেন?’
‘ফিলিপ আমাকে স্পেনের অত্যন্ত বৈধ একটা পাসপোর্ট করে দিয়েছে। আর একা তো নই। আমার সাথে আবদুর রাহমান সপ্তম এসেছে, সে বাসক গেরিলার একজননেতা, মুসলমান। ফ্রান্স, ইটালী, ইত্যাদি তার কাছে বৈঠকখানার মত।’
‘কোথায় সে?’
‘বোটে।’
কোন কথা এল না জোয়ানের তরফ থেকে।
একটা ট্যাক্সি দেখে ডেকে নিল আহমেদ মুসা।
উঠে বসল দু’জন গাড়িতে।
ছুটে চলল গাড়ি ট্রিয়েস্টের ‘বিনোদন বন্দরের’ দিকে। ওটা ট্রিয়েস্টের শুধু নয়, গোটা দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অত্যন্ত লোভনীয় পর্যটন কেন্দ্র। ওখানেই রাখা আছে আহমেদ মুসার বোট।
৪
ট্রিয়েস্ট থেকে বের হওয়ার চতুর্থ দিন মধ্যরাতে আহমদ মুসারা তুলুজ বিমান বন্দরে পৌঁছাল। অথচ সিডিউল অনুসারে দ্বিতীয় দিন মধ্যরাতে তাদের তুলুজে পৌঁছার কথা ছিল। ট্রিয়েস্টে তাদেরকে দেখা করতে হয়নি। সকালেই তারা মটেল ‘সি-কুইন’- এর রিসেপশনে টেলিফোন করে জানতে পেরেছিল, শুধু অধ্যাপক ভিলারোয়া ছাড়া সবাই রাতের প্লেনেই মাদ্রিদ রওনা হয়ে গেছে। আহমেদ মুসাদেরকে দু’দিন কাটাতে হয়েছে ভেনিসে।
আহমদ মুসারা ভেনিসে পৌঁছেছিল বুধবার বিকেলে। শুক্রবার পর্যন্ত তাদেরকে ভেনিসে থাকতে হয়েছে। ফিলিপ ও আবদুর রহমান সপ্তম এর বন্ধু ইব্রাহিম আলফনেসা কিছুতেই আহমেদ মুসাকে ছাড়তে রাজী হয়নি। তার যুক্তি ছিল, শুক্রবার বাদ জুমা গুরুত্বপূর্ণ দু’জন খৃস্টানের ইসলাম গ্রহণের অনুষ্ঠান আছে, এ অনুষ্ঠানে আহমদ মুসাকে হাজির থাকতেই হবে।
আপত্তি কিছু করলেও লোভ জেগেছিল আহমদ মুসার মনে। ভেনিসের মসজিদে জুমা পড়া যাবে, এখানকার মুসলমানদের সাথে সাক্ষাৎ হবে, সবচেয়ে বড় লাভ হবে দু’জন ভাইয়ের ইসলাম- গ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে পারা।
সুতরাং ইব্রাহিম আলফনেসার যুক্তিতে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আহমদ মুসা সেদিন আলাপ করছিল আলফনসোর ড্রইংরুমে বসে।
আহমদ মুসা কি সিদ্ধান্ত নেবে না নেবে ভাবছিল সেই সময় ঘরে প্রবেশ করেছিল একটি মেয়ে। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নামানো তার স্কার্ট জুতার প্রান্ত কোন ছুঁই ছুঁই করছে। গায়ে কোট। মাথায় রুমাল, চোখের প্রান্ত পর্যন্ত নামানো।
ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে মেয়েটি ইব্রাহিম আলফনসোকে বলেছিল, ‘একটা সুখবর আব্বা’।
‘আমার মেয়ে আয়েশা। ভেনিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে’। মেয়েটিকে দেখিয়ে বলেছিল আলফনসো।
কথা শেষ করেই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেছিল আলফনসো, ‘তুমি বুঝি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলে?’
‘জি, হ্যাঁ’।
‘তুমি তো এঁদের চিন না’।
‘চিনি না, আম্মার কাছে শুনলাম’।
‘কি শুনলে?’
‘ইনি সেই আহমদ মুসা’। আহমদ মুসার দিকে ইংগিত করে বলল মেয়েটি।
‘কোন আহমদ মুসা?’ একটু হেসে জিজ্ঞাসা করল আলফনসো।
‘যিনি মুসলমানদের জর্জওয়াশিংটন, যিনি মুক্ত করেছেন ফিলিন্তিন, মিন্দানাও, মধ্য এশিয়া, ককেশাস ও বলকানের মুসলমানদের?’
‘জর্জওয়াশিংটনের সাথে তুলনা কি মিলল, মা?’
‘ঠিক মেলে না, জর্জওয়াশিংটন একটা সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাত্র। কিন্তু ইনি একটা সার্বিক মুক্তি আন্দোলনের নির্মাতা ও সাফল্যদানকারি। ইনি সর্বোচ্চ সেনানায়ক, আবার সর্বনিম্ন সৈনিকও। ইনি যা আদেশ করেন, প্রথমে তিনি তা পালন করতে সামনে অগ্রসর হন। জর্জওয়াশিংটন শুধু ছিলেন মাথার ব্যক্তি, এমন মাথা ও মাটির ব্যক্তি ছিলেন না?’
আলফনসোর মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছিল। তার জায়গায় এসেছিল বিস্ময়। মেয়ের দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আলফনসো বলেছিল, ‘এত কথা এমন কথা তুমি জানলে কি করে, শিখলে কোত্থেকে মা?’
তখনই উত্তর দেয় নি আয়েশা। একটুক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর বলেছিল, ‘আপনাকে বলিনি আব্বা, আমরা ‘ইয়ুথ সোসাইটি ফর ইউরোপিয়ান রেনেসা’ নামে একটি সংগঠন করেছি। ছেলে ও মেয়েদের জন্যে এর দু’টি ভিন্ন ভিন্ন উইং আছে। দু’টো উইং স্বাধীনভাবে কাজ করে। প্রতি সপ্তাহে আমরা স্ট্যাডি সার্কেলে বসি। আমরা দু’টো কাজ করি, এক, ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস ও ইতিহাস শিক্ষা করি আমরা, দুই, দেশ-বিদেশের সমস্যা নিয়ে আমরা আলোচনা করি, কোন দেশে মুসলমানদের কি সমস্যা সে তথ্য আমরা যোগাড় করি এবং বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম সংস্থা সংগঠনকে আমরা সাধ্যমত বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, কাটিং, স্লিপিং পাঠিয়ে সাহায্য করি। এই সূত্রেই আমরা জনাব আহমদ মুসা সম্পর্কে জেনেছি’।
‘এ সোসাইটি কি তোমার ভেনিস কেন্দ্রিক?’
‘না আব্বা। এ সোসাইটি প্রথম গঠিত হয় জার্মানির মিউনিখ শহরে। ইসলাম গ্রহণকারী একজন জার্মান তরুণ ইঞ্জিনিয়ার এই সোসাইটি গঠনের উদ্যোক্তা। এই ইঞ্জিনিয়ার সৌদি আরবে পাঁচ বছর ছিলো একটি পারমাণবিক প্রকল্পে এবং সেখানেই ইসলাম গ্রহণ করেন। এখন এই সোসাইটি গোটা মধ্য ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের ইটালিতেই আছে ২০টি কেন্দ্র’।
আয়েশা থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠেছিল, ‘বোন, তোমাদের কাজের মতই তোমাদের সোসাইটির নামটা সুন্দর। কিন্তু বলত, ‘আজকের সমৃদ্ধ ও সুন্দর ইউরোপ তার রেনেসাঁরই ফল, আবার ইউরোপে রেঁনেসা কেন?’
আয়েশার মুখে এক টুকরো সলজ্জ হাসি ফুটে উঠেছিল। বলেছিল সে, জনাব এর উত্তর আপনি জানেন, তবু বলছি, ইউরোপের সে রেনেসাঁ ইউরোপকে সমৃদ্ধি দিয়েছে এবং সমৃদ্ধিজাত সৌন্দর্য্য দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই সমৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধিজাত সৌন্দর্য্য নিয়ে তারা কোন পথে চলবে, কোন পথে চললে তাদের আত্মার পরিতৃপ্তি আসবে, কোন পথে চললে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে আনবে তাদের সার্বিক মংগল, সেই ব্যাপারে ইউরোপ আজ ভীষণ অন্ধকারে। এই অন্ধকারে তাদের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে, জীবন হয়ে উঠেছে ক্লান্তিকর। মহত্তর ও মংগলতর অতি-জীবনিক একটি লক্ষ্যের অভাবে তাদের জীবন ও সমৃদ্ধি সবই অর্থহীন হয়ে পড়ছে। আমাদের রেনেসাঁ ইউরোপকে এই জীবন-বিনাশী অবস্থার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যেই। আজ একমাত্র ইসলামেই আছে এই রেঁনেসার শক্তি’।
‘ধন্যবাদ বোন। তুমি যে মহত্তর ও মংগলতর অতি-জীবনিক একটা লক্ষ্যের কথা বললে সেটা কি?’
সেই সলজ্জ হাসি আবার ফুটে উঠেছিল আয়েশার মুখে। বলেছিল, ‘মাফ করবেন, আমার কথা আমি পরিষ্কার করতে পারিনি। অতি-জীবনিক বলতে বুঝাতে চেয়েছি জীবন-পরপারের অর্থাৎ পরকালীন জীবনের মহত্তর, উচ্চতর লক্ষ্যের কথা’।
‘অর্থাৎ আমাদের এই জীবনের স্বস্তি ও সুখকে এবং অর্থ-প্রাচুর্যের অর্থময়তাকে তুমি পরকালীন জীবন-মুখী মহত্তর ও উচ্চতর লক্ষ্যের সাথে সম্পৃক্ত করেছ। এর ব্যাখ্যা তুমি কিভাবে করবে’। বলেছিল আহমদ মুসা।
আয়েশার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল। বলেছিল সে, ‘সব বিষয় আমি ভালভাবে বুঝিনি। আমি যেটুকু বলতে পারব তাহলো, এই জীবনটাই যদি শেষ হয়, এই জীবনের পর যদি আর কিছু না থাকে, তাহলে অর্থ-প্রাচুর্য-সমৃদ্ধি সবকিছু সত্ত্বেও জীবনে এক সময় হতাশা এসে দাঁড়ায়, সবকিছু অর্থহীন হয়ে পড়ে। যেমন, যে কোন সময় মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে, আর মৃত্যুর সাথে সাথেই যদি সব শেষ হয়ে যায়, তাহলে জীবনের এত আয়োজন কেন, এর প্রয়োজন কি! এ থেকেই আসে জীবনে বিশৃঙ্খলা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা। যার একটা প্রকাশ হলো, অস্বাভাবিক ধরণের ভাব-প্রবণতা, নেশাগ্রস্ততা। এটা হলো একদিক। আরেকটা দিক হলো, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ করতে ভোগও প্রয়োজন, ত্যাগও প্রয়োজন। প্রয়োজন ভোগ ও ত্যাগের ভারসাম্য। কিন্তু পরকালীন জীবন যদি না থাকে, সেখানে যদি পুরস্কারের নিশ্চয়তা এবং শান্তির যদি বিষয় না থাকে তাহলে মানুষ অব্যাহতভাবে ত্যাগ করে যাবে কেন, স্বেচ্ছাচারিতা অন্যায় ও অবিচার থেকে স্বেচ্ছায় বিরত থাকবে কেন? সুতরাং আমাদের এই জীবনের সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি পরকালীন জীবনের উচ্চতর ও মহত্তর প্রতিশ্রুতি ও পুরস্কারের সাথে সম্পৃক্ত’।
আহমদ মুসার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। ভেনিসে বসে ইউরোপীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন ইউরোপীয় তরুণীর কন্ঠে এই কথাগুলো শুধু অপরূপ নয়, অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল আহমদ মুসার কাছে। বলেছিল আহমদ মুসা, ‘ধন্যবাদ বোন, এত শিখলে কোথায়, স্ট্যাডি সার্কেলে?’
‘স্ট্যাডি সার্কেলে এবং বই পড়ে’।
‘কি বই?’
‘সাইয়েদ কুতুব ও আবুল আ’লার তাফসীর, তাদের জীবনী এবং আরও অনেকের বই’।
‘কোথায় পাও?’
‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বই আছে’।
‘কিনেছে ওরা?’
সোসাইটির মাধ্যমে আমরা পরিকল্পনা করেছি, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চেষ্টার মাধ্যমে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েই এই সব বই কিনিয়ে নেব। আমরা তাই করেছি। এখন অন্ততঃ মধ্য ইউরোপের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রয়োজনীয় সব বই পাওয়া যায়’।
‘তোমাদের সোসাইটির কথা আমাকে বিস্মিত করেছে বোন। তোমরা অনেক-অনেক এগিয়েছ। আমার মনে হচ্ছে কি জান, ইউরোপের তোমরাই হবে আজকের বিশ্বে ইসলামের সবচেয়ে সুদক্ষ বাহিনী’।
‘ধন্যবাদ। কালকে আমাদের জোনাল সম্মেলন। ভেনিসেই। আপনাকে পেলে সেটা হবে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার চেয়েও বড় বিস্ময়। আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি আমি’।
আয়েশার আব্বা আলফনসো চট করে বলে উঠেছিল, ‘ওদের প্লেন আজ রাতেই, চলে যেতে চাচ্ছেন ওরা’।
আয়েশা ছোট চঞ্চলা মেয়ের মত উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘না আব্বা, ওঁদের যাওয়া হবে না কিছুতেই, যেতে দেব না। আহমদ মুসার উপর আমাদেরও অধিকার আছে। ইউরোপের প্রতিও ওঁর দায়িত্ব আছে’।
‘বল তুমি ওঁকে’। বলেছিল আলফনসো।
আহমদ মুসা সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। গম্ভীর কন্ঠে বলেছিল, ‘স্পেনে ফেরার কেন আমার এত তাড়া তা আপনারা জানলে দেরী করতে আমাকে বলতেন না। ওখানে মুসলমানদের অবশিষ্ট চিহ্নটুকুর উপর ভয়াবহ আঘাত আসছে, যে দীপ শিখাটুকু মাদ্রিদে জ্বলে উঠেছে, তাও নিভে যাওয়ার মুখে। আমরা একটা সাহায্যের জন্যে গিয়েছিলাম ট্রিয়েষ্টে ডঃ সালামের গবেষণা কেন্দ্রে। কিন্তু সে সাহায্য সম্ভব নয়। এখন কঠিণতর পথে আমাদের এগুতে হবে। প্রতিটি মুহূর্ত এখন আমার কাছে অসহ্য রকম দীর্ঘ মনে হচ্ছে।’
থামল আহমদ মুসা।
গোটা ড্রইং রুমে নেমে এসেছে গাম্ভীর্য। আয়েশার মুখেও একটা বেদনা ও শংকার ভাব ফুটে উঠেছে। কারও মুখে কোন কথা নেই।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলেছিল, ‘তবু আমি থাকব দু’দিন ভেনিসে। জনাব আলফনসোর কথায় আমি দূর্বল হয়েছিলাম। আর আয়েশার কথায় আমি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি।’
আয়েশার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। ছুটে চলে যাচ্ছিল ভেতরে, সম্ভবতঃ তার মাকে সুখবরটি জানাবার জন্যেই। দু’পা গিয়েই ফিরে দাঁড়িয়েছিল আয়েশা। বলেছিল তার আব্বাকে লক্ষ করে, ‘আপনাকে যে সুখবর জানাতে এসেছিলাম সেটা হলো, শুক্রবারে দু’জন ছাড়াও আরো কয়েকজন ইসলাম কবুল করতে পারে।’
কথা শেষ করেই আয়েশা ছুটছিল ভেতরে।
আলফনসো বলে উঠেছিল, ‘শুন আয়েশা, এ খবর কার কাছ থেকে শুনলে, তুমি?
কিন্তু কে কার কথা শুনে। আলফনসো’র কথা শুরু হতে হতেই আয়েশা ভেতরে।