পরদিন সকাল।
বিধ্বস্ত ঘাটি থেকে ৪০ মাইল পূবে সিয়েরা নিবেদার পাদদেশে একটি পুরানো গ্রাম, পুরানো জনপদ। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সিয়েরা নিবেদার একটি ঝরনা। ঝরনাটা মাইল খানেক গিয়েই পড়েছে গোয়াদালেজ নদীতে।
এই পুরানো গ্রামের মাঝখানে একটা টিলার উপর কাঠের দোতলা বাড়ি। এই বাড়িটা যিয়াদ বিন তারিকের। এটাই ‘ব্রাদারস ফর ক্রিসেন্টে’ এর প্রধান দফতর। বাড়িটা ঘিরেই গড়ে উঠেছে সুন্দর জনবহুল একটা গ্রাম।
যিয়াদের বাড়িটা সবুজ জলপাই কুঞ্জে ঢাকা। টিলার গা বেয়ে দ্রাক্ষার বাগান।
বাড়িটার সামনে টিলায় এক প্রান্তে মসজিদ। মসজিদে কোন মিনার নেই। উড়োজাহাজের নজর থেকে গোপন রাখার জন্যই এই ব্যাবস্থা। মিনারের বদলে ছাদে উঠে আজান দেয়া হয়।
ভোরের নামাজ শেষে আহমদ মুসা মসজিদের ছাদে উঠেছিল। তার সাথে যিয়াদও।
চারদিকের নৈস্বর্গিক দৃশ্যে অভিভূত হয়েছিল আহমদ মুসা। তার পাশে দাঁড়িয়ে যিয়াদ। তাদের সামনে ঝরনা। ঝরনার ওপারে পাহাড়, পাহাড়ের ওপারে একটা দুর্গম উপত্যকা।
যিয়াদ ওদিকে তাকিয়ে বলেছিল, ওই পাহাড়ের পারে ঐ যে উপত্যকা ওটাই ফ্যালকন অব স্পেন বশির বিন মুগীরার শেষ রণক্ষেত্র। গ্রানাডা পতনের পর বিদ্রহী মুসলমানরা এই পাহাড়, এই বনাঞ্চলেই সংঘবদ্ধ হয়েছিল বশির বিন মুগীরার নেতৃত্বে। বেশ কয়েকটা যুদ্ধে ফার্ডিল্যান্ডের বাহিনী পরাজিত হয়েছিল বশির বিন মুগীরার কাছে। বশীর বিন মুগীরার শেষ রণাঙ্গন ছিল এই উপত্যকা। এই যুদ্ধে মারাত্নকভাবে আহত হন বশির বিন মুগীরা। তাকে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে আনা হয়েছিল ঐ পাহাড়ের পাদদেশের একটা গ্রামে। মুসলিম স্পেনের শেষ মুজাহিদকে ওই গ্রামেই সমাহিত করা হয়। তাঁর আকাঙ্খা ছিলো, তাঁর শেষ শয্যা যেন রণক্ষেত্রেই হয়। আজও স্পেনের সব মুসলমানের গৌরবের তীর্থ ক্ষেত্র তাঁর কবর গাহ। যাবেন না মুসা ভাই আপনি সেখানে?
আহমদ মুসার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল। বলল সে, ওখানে আহমদ মুসা যাবে না তো কে যাবে যিয়াদ। তিনি শুধু আমার প্রেরণা নন, তিনি আমার কাছে গৌরবজনক দৃষ্টান্ত।
যিয়াদ তারপর দক্ষিণ মুখি হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। দূরবীনটা আহমদ মুসার হাতে দিয়ে বলেছিল, দেখুন গোয়াদেলেজ নদী যেখানে সাগরে পড়েছে, সেখানে দেখুন ছোট্ট একটা নগরী, আদ্রা। সে সময় এখানে কোন নগরী ছিলো না। ছিল জংগল ঘেরা একটা ঘাটি। বশির বিন মুগীরার পরিবারের অসহায় কয়েকজন নারী অশ্রু জলে ভেসে নৌকায় উঠে স্পেন ত্যাগ করেছিল। জাবালুত তারিক আমাদের গৌরবের, কিন্তু এই সাগরতীর আমাদের কাছে কান্নার। ওখানে দাঁড়ালে উপকূলে আছড়ে পড়া স্বচ্ছজলকে মনে হয় সেই অসহায়া নারীদের উপছে পড়া চোখের জল। বিষাদের ঐ তীরটায় আমরা কেউই যায় না মুসা ভাই। ঐ তীর আমাদের লাঞ্ছনার প্রতীক, অযোগ্যতার প্রতীক, সব হারানোর প্রতীক।
কাঁদছিল যিয়াদ।
চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল আহমদ মুসারও। মসজিদের ছাদ থেকে নেমে আহমদ মুসা এবং যিয়াদ, পেছনে পেছনে জোয়ান এবং রবার্তো, সেই ঝরনা পাড়ি দিয়ে সেই পাহাড় ডিঙিয়ে গিয়েছিল সেই উপত্যকায় এবং সেই গ্রামে।
বশির বিন মুগীরার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রান্তরের দিকে চোখ তুলে আহমদ মুসার মনে হয়েছিল, সে যেন দেখতে পাচ্ছে বশির বিন মুগীরাকে। পরাজয় যখন আসন্ন, নিশ্চিত, সাথীরা যখন বিধ্বস্ত- বিশৃঙ্খল, যখন ঘোড়ার লাগাম টেনে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে পেছনের দিকে ছোটার কথা, তখন বশির বিন মুগীরার ঘোড়া শত্রু ব্যুহ ভেঙে ঢুকে যাচ্ছে শত্রুর ভেতরে। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত বশীর জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ছে ঘোড়ার পিঠ থেকে।
বশীর বিন মুগীরার কবরটি সাধারণ। সবুজ মাটির উপর কবর। চারদিকে পাথর পুতে একটা সীমারেখা দাঁড় করানো হয়েছে মাত্র। কবরের শিয়রে একটা মিনার তুলেছিল মুসলমানেরা। স্পেনের খৃষ্টান বাদশাহ দ্বিতীয় ফিলিপ সেটা ভেঙে দেয়। এখনও সে মিনার ভাঙা ভিতটি দাঁড়িয়ে। ভিতের পাথরটির গায়ে একটা খোদাই করে লেখা এখনও জ্বল জ্বল করছে, ‘মুসলিম স্পেনের আশার শেষ প্রদীপটি এখানে ঘুমিয়ে।’
আহমদ মুসার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল। সত্যিই শেষ প্রদীপটি এখানে শান্তিতে ঘুমিয়ে। বশীর বিন মুগীরার কবরটি ঘন ঝোপে ঢাকা। প্রকৃতির নিবিড় স্নিগ্ধ পরশে ঘুমিয়ে আছে শহীদ।
হাত তুলেছিল আহমদ মসা। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেছিল আল্লাহর কাছে, ’একদিন এই প্রান্তরে যে পতাকা ভূ-লুন্ঠিত হয়েছিল, তা কি আবার বীরদর্পে উড়বে না স্পেনের আকাশে? আল্লাহ সে সুদিন দাও স্পেনের জন্যে।’
যিয়াদ, জোয়ান ও রবার্তো পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমিন।
ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই ওরা ফিরে এসেছিল যিয়াদের বাড়িতে।
আজ ওরা মাদ্রিদ যাচ্ছে।
এবার জোয়ান ও রবার্তোর মত যিয়াদও আহমদ মুসার সাথী হচ্ছে।
যেহেতু যিয়াদরা বিপদে তাই আহমদ মুসা তাকে সাথে নিতে চায়নি। কিন্তু যিয়াদ তা মানতে রাজী হয়নি, এমনকি যিয়াদের মা চেয়েছে যিয়াদ আহমদ মুসার সাথী হোক।
আহমদ মুসা এবং জোয়ান ও রবার্তো প্রস্তুত হয়ে বসে আছে যিয়াদের পারিবারিক ড্রয়িং রুমে, বাড়ির ভেতরের অংশে।
যিয়াদ ড্রয়িং রুমে ঢুকে বলল, আম্মা এসেছেন মুসা ভাই।
ড্রয়িং রুম ও ভেতরের ঘরের মধ্যে তখন ভারী পর্দা। পর্দার ওপারে চেয়ারে এসে বসেছে যিয়াদের মা ফাতিমা এবং যিয়াদের স্ত্রী জোহরা। যিয়াদের মা’র দীর্ঘাঙ্গী আরবীয় লাল চেহারা, জোহরাও তাই।
‘আম্মা, আমরা বিদায় চাচ্ছি, আমরা এখনি মাদ্রিদ যাত্রা করছি।’
পর্দার দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।
যিয়াদের মা বলল, ‘যিয়াদের কাছে সব শুনেছি বাবা। আমি তোমাকে নিষেধ করতে পারবো না। কিন্তু খুব খুশি হতাম যদি তুমি আরও কটা দিন আমাদের মাঝে থাকতে।’
‘আমিও খুশি হতাম আম্মা, মহান স্মৃতি বিজড়িত এখানকার বন ও পাহাড়ের এলাকা আমাকে যেমনটা আকর্ষণ করেছে, তেমনটা স্পেনের আর কিছুই আমাকে করেনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বাবা, ফিরে আসবে না তুমি আবার ?’ বলল যিয়াদের মা।
‘বলতে পারবো না আম্মা, ঘটনা আমাকে কোথায় নিয়ে যায় বলতে পারি না।’
‘কোরআন শরীফে আছে, ঈমানের উপর মানুষ যখন অটলভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আল্লাহ মুমিনদের সাহায্যের জন্যে ফেরেশতা পাঠান। তুমি ফেরেশতার মতই আমাদের মাঝে এসেছ। তুমি আমার ছেলের মত। কিন্তু অভিজ্ঞতা ও দায়িত্বে তুমি আমাদের নেতা। তোমাকে কি জিজ্ঞাসা করতে পারি না, আমাদের অন্ধকার রাতের অবসান কবে হবে ? আমাদের পলাতক জিন্দেগীর ইতি কবে ঘটবে ?’ বলল যিয়াদের মা আবেগ জড়িত কন্ঠে।
‘এই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, স্পেনের মুসলমানদের জীবনে একটা পরিবর্তন আসছে। আগের জায়গা পৌঁছাতে হলে আমাদের আবার শূন্য থেকে কাজ শুরু করতে হবে।’
‘এই কাজে তুমি থাকবে না বাবা?
‘এ প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারবো না আম্মা। কোন ডাকে আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে বলতে পারি না।’
‘আমি যিয়াদের কাছে সব শুনেছি। এমন অনিশ্চিত জীবন তো হতে পারে না বাছা, কোন ঠিকানায় তো তোমাকে দাঁড়াতে হবে।’
‘গোটা দুনিয়ার মুসলমানরা এখন যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবস্থান করছে। চারিদিকে তাদের হাহাকার, আর্তনাদ, আর মুক্তির আকুলতা। এই যুদ্ধ ক্ষেত্রে দাঁড়াবার অবকাশ কোথায় আম্মা?’
যিয়াদের আম্মা কেঁদে উঠল। বলল, ’আচ্ছা ! দুনিয়ার সব মুসলমান যদি এভাবে ভাবতো ! আল্লাহ তোমাকে, শতায়ু করুন বাবা।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, সব মুসলিম মা যদি আপনার মত হত , তাহলে ঘরে ঘরে জন্ম হতো তারিক বিন যিয়াদদের, ঘুচে যেত আমাদের দুঃখের অমানিশা।’
থামল আহমদ মুসা। একটু থেমেই আবার বলল, ‘আমাদের এবার যেতে দিন আম্মা।’
‘সম্মানিত ভাইজান , আপনার কাছে আমাদের ঋণ শোধ হবার মত নয়। দোয়া ছাড়া আমাদের দেবার কিছু নেই।’ ‘ কথা বলল জোহরা , যিয়াদ এর স্ত্রী।
‘বোন , মুসলমানরা কাজ করে আল্লাহর জন্য, ঋণ যদি দেয় সেটা তাকেই দেয়। মুসলমানদের মধ্যে কোন ঋণের বাঁধন নেই। আসি বোন, আসি আম্মা।’ ‘ বলে আহমদ মুসা সামনে বা বাড়াল।
তার সাথে জোয়ান ও রবার্টও।
পরে বের হয়ে এল যিয়াদ। চারজন বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। বাড়ির সামনে চত্বরে দাঁড়িয়ে চারটি ঘোড়া। ওরা এগুলো ঘোড়ার দিকে। জোয়ান হাঁটছিল আহমদ মুসার পাশাপাশি।
‘মুসা ভাই , আপনি যে বললেন স্পেনে শূন্য থেকে কাজ শুরু করতে ববে, সত্যিই কি ?’ বলল জোয়ান।
‘কেন হতাশ হচ্ছ ?’
‘হতাশ নয় , ভাবছি দীর্ঘ পথের কথা।’ ‘
‘ইসলামে বিজয়ের কোন সংক্ষিপ্ত পথ নেই জোয়ান। ইসলাম প্রথমে বিপ্লব আনে মানুষের মনে। ব্যক্তির মানসিক বিপ্লব , মনের পরিবর্তন ছাড়িয়ে পড়ে তার কাজ -কর্মে , পাল্টে দেয় তার জীবন পদ্ধতি। ব্যক্তির এই পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ইসলাম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিপ্লব সংঘটিত করে। এই বিপ্লবের পথটা অবশ্যই দীর্ঘ হতে বাধ্য। ‘
‘স্পেনের জন্য এই পথটা হবে কষ্টের।’ ‘ বলল যিয়াদ।
‘মহানবী (সঃ) – এর পথ -পরিক্রমার চেয়ে কষ্টের নয় নিশ্চয় যিয়াদ।’ ‘
‘ঠিক বলেছেন মুসা ভাই, আমার ভুল বুঝতে পারছি।’ ‘
ঘোড়ার কাছে পৌঁছে গেল সবাই।
চলতে শুরু করল চারটি ঘোড়া।
তাদের গন্তব্য পশ্চিমে গ্রানাডা -মিত্রালি হাইওয়ের পাশে অলিভা শহর। ওখানে আছে রবার্তোর গাড়ি।
পশ্চিমে ঢলে পড়েছে সূর্য।
সন্ধ্যার মধ্যে ৬০ মাইল দূরে অলিভায় তাদের পৌছতে হবে। দুর্গম পাহাড়ি পথ।
চার ঘোড়া সওয়ার তাদের চলার গতি বাড়িয়ে দিল।