আহমদ মুসার গাড়ী ছুটছে গ্রানাডা হাইওয়ে ধরে দক্ষিণে মিত্রালীর দিকে। ড্রাইভিং সিটে যিয়াদ বিন তারিক।
কিন্তু গন্তব্যস্থল তাদের মিত্রালী নয়।
গ্রানাডা হাইওয়ে যেখানে গোয়াদেলফো নদী অতিক্রম করে মিত্রালীর দিকে এগিয়ে গেছে, সেখানে গোয়াদেলা নামে ছোট শহর গড়ে উঠেছে। এখান থেকে যিয়াদ বিন তারিকদেরকে নদী পথে যেতে হবে তাদের প্রধান ঘাঁটিতে নিবেদার জংগলে যেতে হলে। এই শহরকে লক্ষ্য করেই ছুটছে মুসার গাড়ি।
ড্রাইভিং সিটে যিয়াদ বিন তারিক। আহমদ মুসা তার পাশের সিটে। আর ওরা তিনজন বসেছে পেছনের সিটে।
দু’পাশে পাহাড়, উঁচু-নিচু টিলা। এর মধ্যে দিয়েই এঁকে-বেঁকে এগিয়ে গেছে গ্রানাডা হাইওয়ে।
মাঝারি গতিতে এগিয়ে চলছিল যিয়াদের গাড়ি।
কথা বলে উঠল যিয়াদ। বলল, ‘মোটামুটি আপনার সব খবরই পত্রিকায় আসে। আপনি আর্মেনিয়ায় এসেছেন, আর্মেনিয়া থেকে বলকানে গেছেন তাও আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু আপনার স্পেনে আসার খবর এখনও প্রকাশ হয়নি।’
‘সরকার ও সাংবাদিকরা এখনও জানার কথা নয়। প্রথমবার যখন ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যানের হাতে পড়ি, ওরা আমাকে চিনতে পারেনি। কিন্তু দ্বিতীয়বার বন্দী হবার পর ভাসকুয়েজ আমাকে চিনতে পারে। মনে হয় তারা সাংবাদিকদের জানায়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাকে চেনার পর ওরা তো সাংঘাতিক ক্ষেপে যাবার কথা।’ বলল যিয়াদ।
‘আমি যে রাতে বেরিয়ে আসি, তারপর দিন সকালেই আমাকে হত্যা করা কিংবা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ছিল।’
‘বিক্রি করা, কোথায়?’
‘ওরা এক মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আমাকে আমেরিকান ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যানের কাছে বিক্রি করেছিল। সেদিন সকালেই আমাকে আমেরিকার পথে আকাশে উড়তে হতো।’
‘আল্লাহর হাজার শোকরিয়ে যে তা হয়নি। আপনাকে কোথায় রেখেছিল? কিভাবে বেরুলেন? এটা প্রচলিত আছে যে, ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যানের হাতে পড়া মানে শেষ হয়ে যাওয়া।’
‘সে অনেক কাহিনী, পরে বলব।’
একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘মিন্দানাও, মধ্য এশিয়া সরকার অনেক দূরে, ফিলিস্তিন সরকারের সাথে কোন সময় তোমরা যোগাযোগ করনি? তারা তো আনন্দের সাথেই তোমাদের সাহায্য করতো।’
‘দূতাবাসের সাথে আমরা যোগাযোগ করেছি। তারা আমাদের একটা ডেলিগেশনকে আমন্ত্রণ করেছে। কিন্তু কিভাবে যাওয়া হবে এটা ঠিক হয়নি এখনও। তবে সৌদি দূতাবাস এই ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নিয়েছে।’
‘মুসলমানদের বিভিন্ন ব্যাপারে সৌদি আরব তো সাহায্য করে থাকে।’
‘আমরা যোগাযোগটা খুব সম্প্রতি করেছি। মানবিক সাহায্য আমরা পেয়েছি। মসজিদ ও মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংস্কার, নির্মাণ, ব্যবহার এখনও এখানে নিষিদ্ধ। সৌদি সরকার চেষ্টা করছে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিয়ে নেবার জন্যে। সেটা সম্ভব হলে একটা বড় কাজ হবে।’
কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসা থেমে গেল, উৎকর্ণ হয়ে উঠল।
সামনে দূরে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। ঐ গাড়ি থেকেই হর্ন শোনা গেছে।
আহমদ মুসাকে উৎকর্ণ হতে দেখে যিয়াদও সতর্ক হয়ে উঠেছিল।
‘সামনের গাড়িটা ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যানের যিয়াদ।’ বলল আহমদ মুসা।
সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার তখন চারদিকে। সূর্য বেশ আগে ডুবেছে। কিন্তু উন্মুক্ত প্রান্তর বলেই
অন্ধকারটা গাঢ় হয়নি।
বলতে বলতেই গাড়িটা সামনে এসে গেল। গাড়িটা মাইক্রোবাস।
আহমদ মুসা গাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিল। লক্ষ্য নাম্বারটা দেখে নেয়া।
ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যানের গাড়িটা চলে গেল।
‘আপনি কি করে জানলেন ওটা ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যানের গাড়ি?’ বলল যিয়াদ।
‘ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যান কয়েকটা নির্দিষ্ট কোডে হর্ন বাজায়।’
সামনে আরেকটা হেড লাইট তীব্র বেগে এগিয়ে আসছে। যিয়াদ সেদিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন
কন্ঠে বলল, ‘মুসা ভাই, ওটা ‘ব্রাদার্স ফর ক্রিসেন্ট’-এর গাড়ি। কিন্তু এ সময় এ দিকে কেন?’
ভ্রু কুঁচকে গেল আহমদ মুসার। তার মনের সুপ্ত সন্দেহটা এবার শতকণ্ঠে কথা বলে উঠল। আহমদ মুসা দ্রুত কন্ঠে বলল, গাড়ি ঘুরিয়ে নাও যিয়াদ।
যিয়াদ একবার অবাক ও উদ্বিগ্ন চোখে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার নির্দেশ পালন করল। এ সময় সামনের গাড়িটাও এসে পড়ল। আগেই সংকেত দিয়েছিল যিয়াদ। গাড়িটা এসে দাঁড়াল যিয়াদের পাশে।
গাড়ি থেকে নামল যিয়াদের ছোট ভাই জায়েদ। কেঁদে উঠল। বলল, আম্মা ও ভাবীকে কিডন্যাপ করেছে।
যিয়াদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বাধা দিয়ে বলল, ‘যিয়াদ আমি সব বুঝেছি, তুমি এ সিটে এস, আমাকে ড্রাইভিং সিট দাও।’
বিনা বাক্যব্যয়ে যিয়াদ সরে এল, আহমদ মুসা গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল। আহমদ মুসা জানালা দিয়ে জায়েদকে লক্ষ্য করে বলল, আমাদেরকে যদি হারিয়ে ফেল, তাহলে গ্রানাডার দক্ষিন গেটে দাঁড়াবে।
বলে আহমদ মুসা স্টার্ট দিল গাড়িতে। দেখতে দেখতে গাড়ির গতি ১৩৯ কি.মি. তে গিয়ে উঠল। ঝড়ের বেগে চলছে গাড়ি। গতির চাপে গাড়ি থর থর করে কাঁপছে।
যিয়াদের উদ্বিগ্ন চোখ আহমদ মুসার দিকে। আঁকা-বাঁকা রাস্তায়, তার উপর রাতের বেলায় এই গতি বেগ। কিন্তু যিয়াদ দেখল, আহমদ মুসা খেলনার মত ঘুরিয়ে নিচ্ছে গাড়ি প্রতিটি বাঁকে। গাড়ি যেন নিজেই প্রান পেয়েছে, নিজেই পথ দেখে নিখুঁত ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল যিয়াদের মন, চোখটাও তার ভারি হয়ে উঠল। আজ এই মুহূর্তে এমন গতিবেগই তো দরকার। আহমদ মুসা সন্দেহ করেছে ঐ মাইক্রোবাসকে। ওটা তো অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যিয়াদের চোখের সামনে ভেসে উঠল অসুস্থ মা আর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী’র ছবি। হৃদয় তার বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পাঠ করল সে, ‘আল্লাহই যথেষ্ঠ, তিনিই অভিভাবক এবং তিনিই সাহায্যদাতা।’ তারপর সে চোখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। দেখল, তার মুখ প্রশান্ত, সেখানে কোন উদ্বেগের চিহ্ন নেই। মনে অনেক সান্ত্বনা পেল যিয়াদ। আজ তার ভীষণ বিপদের দিনে আল্লাহর বান্দাহদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিটি তার পাশে রয়েছে।
গাড়ি স্টার্ট দেয়ার পর আহমদ মুসা একটি কথাও বলেনি। মাঝখানে সে একবার ঘড়ি দেখেছে। আরেকবার ঘড়ির দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, এই গ্রনাডা হাইওয়ে ছাড়া গ্রানাডায় পোঁছার বিকল্প কোন পথ আছে যিয়াদ?
‘জি না, নেই।’
‘হিসেব অনুযায়ী আমরা গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সময় মাইক্রোবাস থেকে ১৬ মিনিট পেছনে ছিলাম। ১২ মিনিট এসেছি। মাইক্রোবাস যদি রাস্তা না বদলায়, কিংবা স্পিড যদি না বাড়িয়ে থাকে, তাহলে আর চার মিনিট পড় মাইক্রোবাসের পেছনের আলো আমরা দেখতে পাব।’
যিয়াদ, আবদুল্লাহ, জোয়ান, রবার্তো সকলেই আহমদ মুসার হিসেব শুনে বিস্মিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।
‘আমরা কোথায় এসেছি যিয়াদ?’
‘ফেজ আল্লাহু আকবর পাহাড় আমরা পার হয়ে এসেছি মুসা ভাই।’
‘তাহলে গ্রানাডা আর পাঁচ মাইল?’
‘জি।’
‘তাহলে মনে হচ্ছে গ্রানাডার গেটের মাইল খানেকের মধ্যে ওদের সাক্ষাৎ আমরা পাব।’
‘যায়েদদের গাড়ি দেখতে পাও আবদুল্লাহ?’ পেছন ফিরে জিজ্ঞাসা করল যিয়াদ।
‘না, পাঁচ মিনিট পর থেকে ওদের আর দেখা যাচ্ছেনা। মনে হচ্ছে অনেক পেছনে পড়েছে।’ বলল আবদুল্লাহ।
গ্রানাডার দক্ষিন গেট তখন আহমদ মুসার গাড়ি থেকে সিকি মাইলেরও কম। এই সময় একটি গাড়ির পেছনের পেছনের দু’টি লাল আলো আহমদ মুসাদের চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে উঠল। আহমদ মুসা আরও কিছুটা এগুনোর পর বলল, এটাই সেই মাইক্রোবাস। যখন গ্রানাডার গেটে মাইক্রোবাসটি, তখন তার নাম্বার স্পষ্ট হয়ে উঠল। আহমদ মুসা বলল, এবার নিশ্চিত কন্ঠে, ‘নাম্বারও মিলে গেছে যিয়াদ। আমরা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের গাড়িটা পেয়ে গেছি।’
মাইক্রোবাসটি নগরীর ভেতরে ঢুকে গেল।
আহমদ মুসার গাড়ি তাকে অনুসরণ করল।
সন্ধ্যা তখন ৭টা।
দু’পাশে ব্যস্ত বিপনী। মাঝখানে প্রশস্ত রাস্তা। গ্রানাডার নতুন অংশ এটা।
গাড়ির স্পিড অনেক কমে গেছে। গজ দশেক দূর থেকে মাইক্রোবাসটিকে অনুসরণ করছে আহমদ মুসা। রাস্তায় ভীড় কম।
নগরীতে ঢোকার পর একই রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছিল তারা। যিয়াদ জানাল, এ রাস্তার নামের অর্থ ডি-টেন্ডেলা সার্কুলার রোড। ফার্ডিন্যান্ডের সেনাপতি অধিকৃত গ্রানাডার প্রথম গভর্নরের নাম অনুসারেই এ রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। এ রাস্তাটি নগরীর সবচেয়ে বড় রাস্তা, গোটা গ্রানাডাকে চক্রাকারে বেষ্টন করে আছে।
রাস্তা নগরীর একদম পশ্চিম প্রান্তে। মাইক্রোবাসটি ডি-টেন্ডেলা সার্কুলার রোড থেকে নেমে প্রাচীর ঘেরা দু’তলা একটা বাড়ির গেটে গিয়ে তাঁগাল। দাঁড়িয়ে হর্ন দেয়ার কয়েক মুহূর্ত পরে গেটটি খুলে গেল। মাইক্রোবাসটি ভেতরে ঢুকে গেল। রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আহমদ মুসারা দেখল এটা।
মাইক্রোবাসটি যখন ভেতরে ঢুকে গেল এবং গেটটি আবার বন্ধ হয়ে গেল বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল যিয়াদের। এক অশুভ আশংকায় গোটা গা কাঁটা দিয়ে উঠল তার।
আহমদ মুসা বোধ হয় টের পেল ব্যাপারটা। যিয়াদের কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনার স্বরে বলল, ‘ভেব না যিয়াদ, আল্লাহ আছেন।’
যিয়াদ মুখ ফিরিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। ভেতর থেকে একটা উচ্ছ্বাস উঠে মুহূর্তের জন্যে তার কন্ঠকে রুদ্ধ করে দিল। তার ঠোঁট কাঁপল।
আহমদ মুসা যিয়াদের চিন্তার মোড় অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যে বলল, ‘শহরের এই এলাকা তুমি চেন যিয়াদ?’
‘জি হ্যাঁ।’ গলা পরিষ্কার করে বলল যিয়াদ।
‘কমার্শিয়াল এলাকা মনে হচ্ছে, তাই কি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু লোকজন কম কেন?’
‘মাগরিবের পর থেকেই এখানে মার্কেটে লোক কমতে থাকে, এটাই গ্রানাডার নিয়ম।’
আহমদ মুসা মাইক্রোবাসটি যে বাড়িতে ঢুকল, সেদিকে চেয়ে বলল, বাড়িটিতে কোন সাইনবোর্ড
নেই, একে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের অফিস মনে কর?’
‘অফিস এবং বাসা দুই-ই হতে পারে।’
আহমদ মুসা পেছন দিকে ফিরে জোয়ানকে বলল, ‘তোমর পিস্তলটা আমাকে ধার দাও জোয়ান।’
বলে আহমদ মুসা নিজের পিস্তলটা বের করল। পরীক্ষা করল ছয়টি গুলিই আছে।
জোয়ান তার পিস্তলটি বের করে আহমদ মুসার হাতে দিল। আহমদ মুসা সে পিস্তলটি পরীক্ষা করে
হাঁটুর নীচে প্লাস্টিক টেপ দিয়ে বেঁধে রাখল।
তারপর যিয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার কাছে পিস্তল আছে নিশ্চয়?’
‘জি হ্যাঁ।’
‘আমরা, মানে আমি আর তুমি, এখন এ বাড়িতে প্রবেশ করব। তুমি রেডি?’
‘জি হ্যাঁ।’ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল যিয়াদের। যিয়াদের দুর্বলতা কেটে গেছে দেখে খুশী হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা পেছন দিকে আবদুল্লাহর দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি এসে ড্রাইভিং সিটে বস। আমরা না ফেরা পর্যন্ত এ ক্ষুদ্র দলটির নেতা তুমি।’
আহমদ মুসা ‘বিসমিল্লাহ’ বলে নামল গাড়ি থেকে। ওদিকে যিয়াদও নেমে পড়ল।
শুকনো মুখে ড্রাইভিং সিটে এসে বসল আবদুল্লাহ। জোয়ান ও রবার্তোর মুখ উদ্বেগ-উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে।
মেইন রোড এবং ঐ বাড়িটির মাঝখানের এই জায়গায় কোন আলো নেই। বাড়িটির গেটের আলোও শেডে ঢাকা। সুতরাং মধ্যবর্তী স্থানটি বেশ অন্ধকার।
বাড়িটিও অন্ধকারের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে। গেটের শেডে ঢাকা আলোটি ছাড়া প্রাচীরের আর কোথাও আলো নেই।
বাড়ির চারদিক ঘুরে দেখলো আহমদ মুসা ও যিয়াদ। ছোট্ট একটা টিলার উপর বাড়িটা। পাচীরের ভেতর গাছ-গাছড়া আছে। প্রাচীরটাও ৭ ফুটের বেশী উঁচু হবে না। আহমদ মুসা লাফ দিয়ে উঠে প্রাচীরের মাথাটাও পরীক্ষা করলো, না বিদ্যূতায়িত করার মত কোন তারের ব্যবস্থাও নেই। অনেকটা বিস্ময়ের সাথেই আহমদ মুসা বলল, ‘অফিসের নিরাপত্তার ব্যপারে খুব তো চিন্তা করেনি ক্লু-ক্ল্যাক্স- ক্ল্যান?’
‘ওদের গায়ে কেউ হাত দিতে পারে এটা ওরা মনে করে না মুসা ভাই, অন্ততঃ কর্ডোভা, গ্রানাডা, সেভিল সহ আন্দালুসিয়া অঞ্চলের ক্ষেত্রে ওদের এটা বদ্ধমুল ধারণা।’
‘শত্রুর অতিরিক্ত আত্ন-বিশ্বাস থাকাটা ভাল।’
বাড়ির পেছন দিকে প্রাচীরের অন্ধকার মত এক জায়গায় এসে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বাড়ির পেছনে প্রাচীরের ভেতর এলাকায় মাত্র দু’টি আলো।
দাঁড়ানোর পর আহমদ মুসা যিয়াদকে বলল, ‘তুমি আমার কাঁধে উঠে ভেতরটা দেখ।’
বলে আহমদ মুসা বসে পড়ল।
যিয়াদ দ্বিধা করতে লাগল আহমদ মুসার কাঁধে পা রেখে উঠতে।
‘আমার নির্দেশ যিয়াদ, দেরী করো না।’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গে যিয়াদ নির্দেশ পালন করল।
ভেতরটা দেখে আহমদ মুসার কাঁধে বসে ফিসফিস করে বলল, ঠিক আমাদের সোজা প্রাচীরের নিচে দু’জন প্রহরী একটা পাথরে বসে গল্প করছে। স্টেনগান তাদের পাশে রাখা।
‘তুমি প্রাচীরের মাথা ধরে ঝুলে থাক। আমি প্রাচীরে উঠার পর তুমি উঠবে।’ বলল আহমদ মুসা।
যিয়াদ আহমদ মুসার কাঁধ থেকে প্রাচীরে ঝুলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসা একটু দৌড় দিয়ে এসে প্রাচীরের গায়ে লাফ দিয়ে উঠে প্রাচীরের মাথা ধরে তাতে উঠে বসল এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রাচীর থেকে গজ দু’য়েক দূরে পাথরের উপর বসে গল্পরত দু’জন প্রহরীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
শেষে মুহুর্তে প্রহরী দু’জন টের পেয়েছিল কি ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের সাবধান হবার সুযোগ দিল না।
আহমদ মুসা পাখির মত দু’হাত মেলে ঝাপটে ধরার মত করে ওদের ঘাড়ের উপর পড়ল। বসা অবস্থায়ই দু’জন প্রহরী মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
পড়েই আহমদ মুসা পিস্তল বের করে নিয়েছে হাতে। প্রহরী দু’জন ভূমি শয্যা থেকে উঠার চেষ্টা করছিল। আহমদ মুসা উঠে বসে ওদের দিকে পিস্তল তুলে বলল, যেমন আছ তেমন থাক, উঠার চেষ্টা করলে মাথা গুড়িয়ে দেব।
প্রহরী দু’জন মিট মিট করে আহমদ মুসার দিকে চাইল, উঠার আর চেষ্টা করল না।
যিয়াদও লাফিয়ে পড়ল আহমদ মুসার পাশেই। আহমদ মুসা যিয়াদকে বলল, ওদের জামা ছিঁড়ে ওদের মুখে পুরে দাও, পিছমোড়া করে ওদের হাত-পা বেঁধে ফেল।’
বলে সে পকেট থেকে সরু প্লাস্টিক কর্ড বের করে দিল।
বাঁধা হয়ে গেলে আহমদ মুসা ও যিয়াদ দু’জনে ওদেরকে টেনে নিয়ে পাশেই গাছের নিচে অন্ধকারে রেখে দিল।
বাড়িটির পেছনের এ অংশটায় অনেকগুলো গাছ।
আহমদ মুসা ও যিয়াদ গাছের ছায়া ধরে গুটি গুটি বাড়ির দিকে এগুলো।
বাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তারা। শেষ গাছটার যে অন্ধকার তারা অতিক্রম করেছে, তা পার হলেই তারা বিল্ডিং এর গোড়ায় পৌঁছে যাবে। এ সময় পেছনে পায়ের শব্দ শুনে বিদ্যুৎ বেগে ফিরল আহমদ মুসা। তার চোখে পড়ল তাদের উপর দু’টি দেহ ঝাঁপিয়ে পড়ছে গাছ থেকে ফল পড়ার মত করে আহমদ মুসা টুপ করে বসে পড়ল।
ঝাঁপিয়ে পড়া লোকটি আহমদ মুসার মাথার উপর দিয়ে মাটির উপর আছড়ে পড়ল। লোকটির দুই উরু এসে আঘাত করেছিল আহমদ মুসার মাথায়। আহমদ মুসাও পড়ে গিয়েছিল। লোকটির দুই পা আহমদ মুসা তার দুই কাঁধের উপর পেল।
আহমদ মুসা পা দু’টি শক্ত হাতে ধরে মোচড় দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মোচড়ের ফলে লোকটি উপুড় হওয়া থেকে চিৎ হতে পারল। লোকটি তার হাত থেকে পড়ে যাওয়া পিস্তল তুলে নেবার জন্যে মাটি হাতড়াচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে সে সুযোগ না দিয়ে দুই পা ধরে জোরে ঘুরাতে শুরু করল। কয়েকটা ঘুরান দিয়ে পাশের গাছের গুড়ির উপর আঁছড়ে ফেলে দিল। একটুও নড়লনা। জ্ঞান হারিয়েছে লোকটি। তারপর আহমদ মুসা পিস্তল কুড়িয়ে নিয়ে মনোযোগ দিল যিয়াদের দিকে। দেখল, যিয়াদ ও অন্য লোকটি তখনও একে অপরকে কাবু করার চেষ্টা করছে। যিয়াদ শেষ পর্যন্ত লোকটি বুকে উঠে বসে তাঁর গলা টিপে ধরল , কিন্তু লোকটি পাশে পড়ে থাকা পিস্তলটি হাতে পেয়ে গেল।
আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে তার হাতের উপর পা চাপা দিয়ে পিস্তলটি কেড়ে নিল। তারপর বলল , যিয়াদ তুমি ওকে ছেড়ে দাও।
ছেড়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকটি স্প্রিং এর মত উঠে দাঁড়িয়ে কোমর থেকে একটা ছুরি বের করল।
আহমদ মুসা বিদ্যুৎ বেগে বাঁ হাত দিয়ে ছুরি সমেত তাঁর হাতটা ধরে ফেলে ডান হাতে বাঁট দিয়ে আঘাত করল তাঁর কানের পাশে নরম জায়গাটায়। লোকটি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল।
লোকটির হাত থেকে কেড়ে নেয়া পিস্তলটি যিয়াদের হাতে তুলে দিয়ে আহমদ মুসা বলল , আল্লাহর হাজার শোকর যে গোলাগুলি এখনও হয়নি , ভেতরে শত্রুরা তাহলে সতর্ক হয়ে যেত।
বিল্ডিংটির গোড়ায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা দেখল, নিচের সবগুলো জানালা বন্ধ। শুধু একটা জানালার ফোকর দিয়ে আলোর রেশ পাওয়া যাচ্ছে। আর উপরে দু’তলায় দু’টি জানালা খোলা। আলো জ্বলছে ঘরে। একাধিক মানুষের কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে ঘর থেকে।
নিচের যে জানালা থেকে আলোর রেশ পাওয়া যাচ্ছে , ধীরে ধীরে এসে জানালার কাছে দাঁড়াল দু’জন। কাঠের জানালা ভেতর থেকে বন্ধ। দু’জনে কান পাতল জানালায়। ভেতর থেকে নারী কণ্ঠের কান্না শুনতে পেল তারা, সেই সাথে ভারী কন্ঠস্বরঃ ‘চল সুন্দরী, উপরে সবাই অপেক্ষা করছে , সেখানে তোমাকে নিয়ে মহোৎসব। চল ম্যাডাম সাহেবা, তুমি দেখবে চল’।
কথা বন্ধ হলো। ভেতর থেকে চিৎকার শুনা গেল।
আহমদ মুসা যিয়াদের কাঁধে হাত রেখে বলল, এ সময় তোমাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে যিয়াদ। ওদেরকে উপরে নিয়ে যাচ্ছে। চল, আর দেরী করা যায়না।
বাড়ির সামনেটা পশ্চিম দিকে। আহমদ মুসারা বাড়ির দক্ষিণ পাশ ঘুরে বাড়ির সামনের দক্ষিণ-উত্তর প্রসারিত বারান্দার দক্ষিণ প্রান্তে এসে দাঁড়াল।
বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ফুলের বাগান। দক্ষিণ দিক থেকেও গ্রাউন্ড ফ্লোরের বারান্দায় উঠার সিঁড়ি আছে।
বারান্দার এ প্রান্ত থেকে দোতালায় উঠার সিঁড়ির দূরত্ব দশ গজের বেশী হবেনা। সিঁড়িতে উঠার মুখে স্টেনগানধারী প্রহরী।
আহমদ মুসা ও যিয়াদকে বারান্দায় দেখে ভ্রু কুঁচকালো প্রহরী।
আহমদ মুসা যেন বেড়াতে এসেছে। এমন ভঙ্গিতে তর তর করে বারান্দার সিড়ি দিয়ে উঠে বারান্দা দিয়ে চলতে লাগল। তার ডান হাতটি প্যান্টের পকেটে। আহমদ মুসার পেছনে যিয়াদ।
আহমদ মুসাদের অগ্রসর হতে দেখে স্টেনগান তুলল প্রহরী। বলল, তোমরা যেই হও আর এক পা’ এগুলে……
প্রহরীর কথা শেষ হতে পারলো না। আহমদ মুসার পকেট থেকে বেরিয়ে এল রিভিলবার চোখের পলকে। গুলী করল আহমদ মুসা। প্রহরীর কপাল গুড়ো করে দিল গুলিটা।
গুলী করেই ছুটল আহমদ মুসা। তুলে নিল প্রহরীর স্টেনগান। তারপর এক দৌড়ে লাফিয়ে উপরে উঠল সিঁড়ি দিয়ে। তিন লাফে সে দোতালার বারান্দায় উঠে গেল। যিয়াদও তার পেছনে পেছনে উঠে এসেছে।
দোতালার মাঝখানের ঘরে দু’টি জানালা দিয়ে আলো দেখেছে আহমদ মুসা। কথাও শোনা গেছে সেখান থেকে। আহমদ মুসা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখল- সিঁড়ির বাঁ পাশে একটা বদ্ধ দরজার পরেই একটা দরজা খোলা দেখা যাচ্ছে।
আহমদ মুসা স্টেনগান বাগিয়ে ছুটল দরজার দিকে। অর্ধেক পথটা গেছে এমন সময় দু’জন লোক দরজায় বেরিয়ে এল। তাদের হাতেও স্টেনগান, কিন্তু ব্যারেল নামানো। আহমদ মুসাকে দেখেই ওরা ত্বড়িৎ গতিতে ভেতরে ঢুকে গেল।
দরজায় গিয়ে আহমদ মুসা একটু উঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। তার সাথে যিয়াদও।
তারা ঘরে ঢুকতেই হো হো করে হেসে উঠল ছ’ফুট লম্বা একজন লোক। সে যিয়েদের মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে। তার রিভলবারের নলটা যিয়াদের মায়ের মাথায় ঠেসে আছে।
ঘরে আরও চারজন লোক, তারা ঐ লোকটির পেছনে দাঁড়িয়ে। যিয়াদের স্ত্রী জোহরা যিয়াদের মা’র হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁপছে সে। যিয়াদের মা’র মুখ ফ্যাকাশে।
লোকটি হাসি থামিয়ে বলল, জানতাম যিয়াদ তুমি আসবে। শুন তোমরা , আমি তিন পর্যন্ত গুনব। এর মধ্যে যদি তোমরা হাত থেকে স্টেনগান ফেলে হাত তুলে না দাঁড়াও, তাহলে প্রথমে মরবে তোমার মা, পরে তোমার স্ত্রী। আর শুন যিয়াদ, গ্রানাডার ক্লু-ক্ল্যাক্স -ক্ল্যান চীফ আলফনসো এক কথা দুই বার বলে না।
গুনতে শুরু করল লোকটি। দুই পর্যন্ত যেতেই আহমদ মুসা স্টেনগান ফেলে দিয়ে হাত তুলে দাঁড়াল। তারপর যিয়াদের দিকে মুখ ফিরিয়ে আহমদ মুসা একটু বড় করেই বলল, ‘ফেলে দাও যিয়াদ আমরা হেরে গেছি।’
যিয়াদের মুখ রক্তহীন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু আহমদ মুসার মুখে কোনই ভাবান্তর নেই, তার মুখ দেখে মনে হলো কিছুই ঘটেনি।
যিয়াদ স্টেনগান ফেলে দিয়ে দু’হাত উপরে তুলল।
এবার আলফনসো রিভলবার বাগিয়ে যিয়াদের মা’র আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তার রিভলবারের নল যিয়াদ ও আহমদ মুসার দিকে। হো হো করে উৎকট শব্দে হেসে উঠল আলফনসো। বলল, এই গর্দভরা, এই কুকুর দু’টোর পকেটে কি আছে দেখে বের করে নে। দরজার সামনেই দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসারা। স্টেনগান বাগিয়ে দু’জন ছুটে এল। তারা পকেট সার্চ করে আহমদ মুসার পকেট থেকে দু’টো রিভলবার এবং যিয়াদের পকেট থেকে একটি পিস্তল বের করল।
‘ওদের নিয়ে আয় ঘরের মাঝখানে। নাটক এখনি শুরু করব।’ বলল আলফনসো।
আহমদ মুসাদের নিয়ে যেতে হল না। আহমদ মুসাই যিয়াদকে হাত ধরে নিয়ে ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। ঘরের চারদিক ঘিরেই সোফা সাজানো।
ঘরের পশ্চিম পাশে সোফা ও দেয়ালের মাঝখান দিয়ে যাতায়াত প্যাসেজ। চারজন স্টেনগানধারী সেই প্যাসেজে গিয়ে দাঁড়াল। চারজনেরই স্টেনগান আহমদ মুসার দিকে উদ্যত।
আবার আলফনসোর সেই হাসি। হাসির হো হো রবে গম গম করে উঠল ঘর। চিৎকার করেই সে বলল, যিয়াদ তুমি শুধু নও, তোমার মা শুধু নয়, তোমার স্ত্রীও আমার হাতের মুঠোয়। আজ আমাদের মহোৎসব। আর নিবেদায় তোমরা যে খেলা শুরু করেছ তার আজ ইতি। তুমি প্রথমে দু’চোখ মেলে দেখবে তোমার স্ত্রীর ভাগ্য। নব বধু, ভালই জমবে মহোৎসবটা। তারপর তোমাদের টুকরো টুকরো করে নিবেদার জংগলে ছড়িয়ে আসা হবে।
থামল আলফনসো। সে দাঁড়িয়ে আছে উত্তর পাশের বিশাল সোফাটার সামনে।
আহমদ মুসা ও যিয়াদ এসে দাঁড়িয়েছে উত্তর মুখী হয়ে মেঝের ঠিক মাঝখানে। তাদের পুব পাশে মেঝের উপর বসেছিল যিয়াদের মা ও তার স্ত্রী।
যিয়াদরা ঘরের মাঝখানে আসার পর যিয়াদের মা ও যিয়াদের স্ত্রী এসে জড়িয়ে ধরেছে যিয়াদকে। এটা দেখেই আকাশ ফাটা হাসি হেসে আলফনসো ঐ কথাগুলো বলল।
আলফনসো থামার পর আহমদ মুসা বলল, দেখ আলফনসো তুমি নিরস্ত্র নারীর আড়ালে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষা করেছ, বীরত্ব তোমার মুখে শোভা পায় না।
‘কথা বলছ তুমি কে? আলফনসোকে বীরত্ব শেখাতে এসেছ ?’
‘নারীকে যারা কিডন্যাপ করে, বীরত্ব তাদেরকে শেখাতেই হবে আলফনসো।’ আহমদ মুসার মুখে বিদ্রুপের হাসি।
যিয়াদ, যিয়াদের মা এবং জোহরার দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। তার ভাবনাহীন মুখ, ঐ ধরনের কঠোর উক্তি এবং মুখে এক ধরনের হাসি দেখে তাদের মুখে ভয়, বিস্ময় দুই-ই ফুটে উঠল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই গর্জে উঠল আলফনসো। ছুটে এল সে আহমদ মুসার সামনে। রিভলবারের বাঁট দিয়ে সে আঘাত করল আহমদ মুসার মাথায়।
আহমদ মুসা প্রস্তুত ছিল এর জন্যে। সে মাথা দ্রুত সরিয়ে নিল একদিকে হেলে। তবু কপালের এক পাশে আঘাতের একটা অংশ এসে পড়লই। কেটে গেল কপালের বাঁ পাশটা। ঝরঝর করে রক্ত বেরিয়ে এল। মুখের বাঁ পাশটা রক্তে ধুয়ে গেল।
রক্ত দেখে সম্ভবত খুশী হল আলফনসো। পশ্চিম দিকে দেয়াল বরাবর প্যাসেজে দাঁড়ানো স্টেনগানধারীদের কিছু নির্দেশ দেয়ার জন্যে ওদিকে ফিরল আলফনসো। সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসা পশ্চিম দিকে এক ধাপ এগিয়ে বাঁ হাত দিয়ে গলা পেঁচিয়ে বুকের সাথে প্রচন্ড শক্তিতে চেপে ধরল আলফনসোকে , আর একই সময়ে ডান হাত দিয়ে আলফনসোর হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নিল আহমদ মুসা। রিভলবার কেড়ে নিয়েই আহমদ মুসা পরপর চারটা গুলী করল। স্টেনগান ধারী চারজন পাকা ফলের মত পরপর টপ টপ করে ফ্লোরে পড়ে গেল।
গোটা ঘটনা ঘটতে পাঁচ সেকেন্ডের বেশী লাগল না। আলফনসো ও স্টেনগানধারীরা ব্যাপারটা বুঝে উঠার আগেই সব শেষ হয়ে গেল।
চারটি গুলী শেষ করার পর আহমদ মুসা ধাক্কা দিয়ে আলফনসোকে ফেলে দিল। পড়ে গিয়েই আলফনসো টলতে টলতে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। তার হাতে রিভলবার। এর মধ্যেই সে পকেট থেকে একটি রিভলবার বের করে নিয়েছে। উপরে উঠছিল তার রিভলবার সমেত হাত।
আহমদ মুসা তাকে আর সুযোগ দিল না। রিভলবার তুলে গুলী করল তার উঠে দাঁড়ানো মাথা লক্ষ্য করে।
আলফনসো গোড়া কাটা গাছের মত হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। লাল কার্পেট তার লাল রক্তে ডুবে গেল।
যিয়াদ, যিয়াদের মা ও তার স্ত্রী ঘটনা দেখে যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। চিন্তার চেয়ে দ্রুত ঘটে গেল ঘটনা। ঘটনা ঘটনার চেয়ে তা বুঝতেই তাদের দেরী হচ্ছে যেন।
আহমদ মুসা আলফনসো গুলী করার পর যিয়াদের দিকে ফিরল।
যিয়াদ বোবা বিস্ময় নিয়ে আহমদ মুসার দিকে একবার চেয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। আনন্দে কেঁদে ফেলল যিয়াদ। আনন্দের অশ্রু যিয়াদের মা এবং জোহরার চোখেও।
‘সব প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যিয়াদ। চল আমাদের দ্রুত বেরুতে হবে।’ যিয়াদের পিঠ চাপড়ে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসারা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নামল বারান্দায়। সিঁড়ির গোড়ায় প্রহরীটি পড়ে আছে, বারান্দা তার রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
আহমদ মুসারা বারান্দা থেকে নেমে এল গাড়ি বারান্দায়।
গাড়ি বারান্দায় সেই মাইক্রোবাসটি তখনও দাঁড়িয়ে।
গাড়ির দরজা খোলা গাড়ির চাবীটি তার কি হোলে লাগানো।
আহমদ মুসা যিয়াদকে বলল, তুমি ওঁদের নিয়ে পেছনে উঠো , আমি ড্রাইভিং সিটে বসছি।
আহমদ মুসা গেট নিয়ে ভাবছিল। সেখান থেকে কোন প্রতিরোধ আসবে নাকি। স্টেনগানটা পাশে রেখেছে আহমদ মুসা। গাড়ি পৌঁছল গেটে, কিন্তু কেউ বেরুল না। গাড়ি দাঁড় করিয়ে আহমদ মুসা নামল স্টেনগান নিয়ে। গেট রুমে গিয়ে দেখল, গেট রুম শুন্য। পালিয়েছে তাহলে গেটম্যান।
গেটরুমের দেয়ালে সুইচ বোর্ড দেখল আহমদ মুসা। ‘OPEN’ চিহ্নিত সুইচ টিপে দিয়ে গাড়িতে ফিরে এল আহমদ মুসা।
খোলা দরজা পথে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা। এসে দাঁড়াল অপেক্ষমান তাদের গাড়িটির কাছে। সঙ্গে সঙ্গে ও গাড়ি থেকে নেমে এল আবদুল্লাহ, জোয়ান এবং রবার্তো। নামল আহমদ মুসা এবং যিয়াদ।
আহমদ মুসার গোটা মুখমন্ডল, রক্তাক্ত দেখে আৎকে উঠল জোয়ান, রবার্তো এবং আবদুল্লাহ। জোয়ান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, আপনি ভালো আছেন তো মুসা ভাই? ওরা ভাল আছেন ?
আহমদ মুসা হেসে বলল, ‘চিন্তা করো না, আল্লাহর অপার সাহায্য আমরা পেয়েছি। সবাই আমরা ভালো আছি।’
একটা দম নিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘রবার্তো তুমি ড্রাইভ করবে যিয়াদের গাড়িটা, উঠো। আর আবদুল্লাহ তুমি মাইক্রোবাস ড্রাইভ করবে। আমি ও জোয়ান তোমার সাথে মাইক্রোবাসে উঠছি।’
সবাই গাড়িতে উঠার পর দুই গাড়ি একসাথে যাত্রা করল। আগে যিয়াদের গাড়ি , পেছনে মাইক্রোবাসটি।
গাড়ি চলছে, আহমদ মুসা সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে। পাশে জোয়ান , সে উশখুশ করছিল। শেষে সে জিজ্ঞেস করেই বসল, ‘কি ঘটল মুসা ভাই ?’
‘বুঝেছি, তোমার তর সইছে না, কিন্তু এখন নয়, চল ধীরে সুস্থে বলব। ছয় ছয়টা মানুষকে মারতে হয়েছে, বড় খারাপ লাগছে। কি করব, উপায় ছিল না।’
‘ছয়জন!’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল জোয়ান।
‘যিয়াদ ভাইয়ের মনটাও বড় নরম, প্রানহানী তিনিও সইতে পারে না।’ বলল আবদুল্লাহ।
‘তবু সইতে হয় ভাইয়া, অশান্তি, অন্যায়ের রাজত্ব-পিড়িত পৃথিবীতে এটাই এখন নিয়ম।’
ওদিকে যিয়াদের গাড়িতে যিয়াদের মা জোহরার উরুতে মাথা রেখে গাড়ির সিটে শুয়ে পড়েছে। আর জোহরা গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে মাথাটা যিয়াদের কাঁধে রেখে নিরবে অশ্রুপাত করছে, আনন্দের অশ্রু, ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন থেকে বাঁচার অশ্রু, নতুন জীবন লাভের অশ্রু।
ধীরে ধীরে মাথাটা একটু তুলে যিয়াদের মা বলল, ‘যিয়াদ, ও ছেলেটা কে? আল্লাহর ফেরেস্তার মত কোত্থেকে এল ও? এমন নির্ভয়, এমন দু:সাহসী, বাজের মত এমন ক্ষীপ্র, কুশলী আমাদের কেউ আছে যিয়াদ?’
‘আছে আম্মা, উনি গোটা দুনিয়ার মুসলমানদের গর্ব, যেখানেই মুসলমানদের বিপদ সেখানেই তিনি। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহই তাঁকে পাঠিয়েছেন। চলুন আম্মা, বলব সব।’‘
রাত মাত্র ৮টার মত তখন। কিন্তু গ্রানাডার পথ প্রায় জনশূন্য। বিপনী কেন্দ্রগুলোর দরজা বন্ধ।
ফাঁকা পথ দিয়ে দ্রুত এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসাদের দু’টি গাড়ি পাশাপাশি।
২
মাদ্রিদের শাহ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্স এবং স্পেনের মুসলমানদের ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্নগুলো ধীর তেজস্ক্রিয়তার মাধ্যমে ধ্বংস করার যে জঘন্য ষড়যন্ত্র ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এঁটেছে, তার বিবরণ শেষ করে আহমদ মুসা থামল।
আহমদ মুসা কথা শেষ করলেও কেউ কোন কথা বলল না। যিয়াদ বিন তারিক, যিয়াদেও সহকারী আহমদ আব্দুল্লাহ, জোয়ান ও রবার্তো কারও মুখেই কোন কথা নেই। বিস্ময় ও উদ্বেগ তাদের সকলকেই আচ্ছন্ন করেছে।
‘ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান সরকারের যোগ সাজসে এটা করছে বলে কি আপনি মনে করেন মুসা ভাই?’ যিয়াদই প্রথম মুখ খুলল।
‘এ প্রশ্ন নিয়ে আমি চিন্তা করেছি, কিন্তু সরকারের যোগসাজস থাকতে পারে বলে আমার মনে হয়নি দু’টো কারণে। এক, নতুন শাসনতন্ত্রের অধীনে সরকার কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিশেষ বৈরীতা এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছে, দুই, স্পেনের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটা প্রধান অবলম্বন হলো পর্যটন। আর পর্যটন খাতের আয়ের সিংহ ভাগ আসে মুসলিম ঐতিহাসিক স্থানগুলো থেকে। এগুলো নষ্ট হলে স্পেন প্রতিবছর কোটি কোটি ডলারের আয় থেকে বঞ্চিত হবে। সুতরাং উভয় কারণেই আমার বিশ্বাস স্পেন সরকার এ ষড়যন্ত্রের সাথে থাকতে পারে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তবে এ রকম একটা কিছু হলে ক্ষতি নেই, এ ধরনের লোকের সংখ্যাই প্রশাসনে বেশী। আর এই ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সাথে সহযোগীতা করতে পারে, এমন লোকও প্রশাসনে কম নেই।’ বলল রবার্তো।
‘সুতরাং এ ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা লাভের কোন আশা নেই। উপরন্তু যারা সরকারকে এ ব্যাপারে বলবে, তাদের কন্ঠরুদ্ধ হবার সম্ভাবনা ষোল আনা।’ বলল জোয়ান।
‘ঠিক বলেছ জোয়ান, সরকারকে বললে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। আমরা নিজেরাই এগুতে চাই। তার আগে জোয়ান তোমার কি মত, ষড়যন্ত্রের প্রকৃতি সম্পর্কে, তুমি তো বিজ্ঞানী।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বিল্ডিং ধ্বংসের বিস্ফোরক তো বানানোই হয়েছে। তাত্বিকভাবে তেজস্ক্রিয় বানানোও সম্ভব যা নিরবে ধীরে ধীরে কোন বিল্ডিংকে ভেতর থেকে শেষ করে দেবে। নিশ্চয় রুশরা এমন অস্ত্র গোপনে তৈরী করেছে শ্যাবোটাজ কাজের জন্যে।’ বলল জোয়ান।
‘এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে আমরা লড়াই কিভাবে করব? রিমেডী তোমার মতে কি আছে এর?’
‘প্রথমে তেজস্ক্রিয়কে চিহ্নিত করতে হবে, তারপর প্রয়োজন এর বিশ্লেষণ। বিশ্লেষণের পর এর এ্যান্টিডোট পাওয়া যাবে মুসা ভাই। যদি তেজস্ক্রিয় আণবিক হয়, যদি এর কোন আণবিক এ্যান্টিডোটের পাওয়া না যায়, সেক্ষেত্রে এ্যান্টিম্যাটার এ্যান্টিডোটের প্রয়োজন হবে।’
‘শুনেছি, তোমার মৌলিক গবেষণা আছে এ্যান্টিম্যাটার বিজ্ঞানের উপর। তোমার ইউরোপীয় বিজ্ঞান একাডেমির পুরস্কারও এই গবেষণার উপর। বলত, এ্যান্টিম্যাটার গবেষণা কতটা এগিয়েছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘থিয়োরিটিক্যাল গবেষণার উল্লেখযোগ্য কিছু বাকি নেই। এখন গবেষণা চলছে এর বহুবিধ ব্যবহার নিয়ে। ছোট ছোট বিষয়ে এর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ছিল আমার গবেষণার বিষয়।’
‘কি রেজাল্ট পেয়েছ জোয়ান আমি জানি না।।’
‘নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে পরমানুর মত সবক্ষেত্রেই একে ব্যবহার করা যাবে, কিন্তু ফল পাওয়া যাবে পরমানুর চেয়ে কমপক্ষে দশগুণ বেশী।’
‘ষড়যন্ত্র যদি সত্যি হয়, তাহলে জোয়ান তোমার কাজ অনেক বেড়ে যাবে। তোমার মত বিজ্ঞানীকে পেয়ে আমরা খুশী জোয়ান।’
‘মুসা ভাই, আগের জোয়ানের সবকিছু আমি ত্যাগ করেছিলাম। বই-পুস্তক, সার্টিফিকেট নোট, সব আমি পুড়িয়ে ফেলেছি। আমি ভেবেছিলাম, স্পেনে একজন মরিস্কোর জীবনে এ সবের কোনই মূল্য নেই, কোনই কাজে আসবে না। এখন যেন আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, জোয়ান তার অতীতকে কাজে লাগাতে পারে, তার অতীতের কিছু মূল্য আছে। আমার সব শক্তি সব মেধা আমি আমার জাতির জন্যে বিলিয়ে দেব মুসা ভাই।’ জোয়ানের শেষের কথাগুলো আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল।
আহমদ মুসা জোয়ানের কাছে এগিয়ে তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, আমরা তোমার প্রতিভাকে নষ্ট হতে দেব না জোয়ান। এই স্পেন মুসলিম বিজ্ঞানীদের চারণ ক্ষেত্র ছিল। তারা অন্ধকার ইউরোপকে পথ দেখিয়েছে, শিক্ষিত করেছে, তাদের জীবনে রেনেসাঁ এনেছে। তারপর আমাদের হাতের সে আলো নিভে গিয়েছিল। আমরা চাই, তোমার হাতে সে আলো আবার জ্বলে উঠুক।
জোয়ান আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলে উঠল, ‘স্পেনে আমাদের সেদিন কি আসবে মুসা ভাই?’
আহমদ মুসা ঘরের জানালা দিয়ে আসা উদীয়মান সূর্যের সোনালী বর্ণচ্ছটার দিকে চেয়ে বলল, ইতিহাসের মোড় ঘুরছে জোয়ান। বহু শতাব্দী আমরা, ঔপনিবেশিক শাসনে নিস্পিষ্ট হয়েছি, মার খেয়েছি চূড়ান্ত। মার খেতে খেতে মৃত্যুভয় আমাদের চলে গেছে। সেই সাথে আমরা ইতিহাস থেকে এই শিক্ষা নিচ্ছি যে, আমাদের শক্তির উৎস আমাদের আদর্শ- ইসলাম। সেখান থেকে আমাদের বিচ্যুতিই রাজনৈতিকভাবে আমাদের দুর্বল করেছিল, সাংস্কৃতিকভাবে অন্তঃসারশূণ্য করে তুলেছিল, যার ফলে স্বাধীনতা আমাদের হাত থেকে খসে পড়েছিল। এই দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাসের মোড় ঘুরছে আজ। তুমি জোয়ান, রবার্তো, যিয়াদ ও তার সাথীরা এবং তোমাদের মত বিশ্বের আরো লাখো তরুণ ইতিহাসের মোড় ঘুরানোর কাজে রত আজ। সকালের এই সূর্যের মতই আমি নিশ্চিত, ইতিহাস মানবতার জন্যে সুদিন নিয়ে আসছে।
এই সময় বাইরে একাধিক লোকের কন্ঠ শোনা গেল। যিয়াদ চট করে বাইরে চলে গেল।
মিনিটখানেক পরে ফিরে এসে বলল, আমাদের জংগল সীমান্তের দু’টি চৌকিতে দু’জন লোক ধরা পড়েছে। তাদের কাছে পিস্তল পাওয়া গেছে।
‘এমন ঘটনা আগে ঘটেছে?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘ঘটেনি।’
আহমদ মুসা ভ্রু কুঞ্চিত করল। বলল, ‘নিয়ে এস তো দু’জনকে।’
চোখ বাঁধা দু’জন লোককে ঘরে নিয়ে আসা হলো।
‘চোখ খুলে দেবে না?’ যিয়াদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘চোখ না খুলাই এখানকার নিয়ম মুসা ভাই, বন্দীখানায় ঢুকানোর পরই শুধু ওদের চোখ খুলে দেয়া হবে।’
‘ভাল ব্যবস্থা যিয়াদ।’
একটু থেমে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় ধরা পড়েছে এরা?’
‘জংগল সীমান্তের দু’চৌকিতে দু’জন ধরা পড়েছে।’ বলল যিয়াদ।
‘দু’চৌকিতে দু’জন? এক চৌকিতে নয়?’
‘জি না।’
আহমদ মুসা পাশ থেকে ছড়ি তুলে নিয়ে চোখ বাধা লোক দু’টির গায়ে খোঁচা দিয়ে বলল, তোমাদের আর সাথীরা কোথায়?
‘আর কেউ নেই।’ তাদের দু’জনের একজন বলল।
আহমদ মুসা যিয়াদের কানে কানে কথা বলল। যিয়াদ উঠে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর একটা ম্যাপ নিয়ে ঘরে ঢুকল। তারপর জংগল সীমান্তে চৌকি দু’টির অবস্থান দেখিয়ে দিল।
আহমদ মুসা ম্যাপটার দিকে একবার ভাল করে নজর করে মুখ ফেরাল লোক দু’টির দিকে। তাদের শরীরে সেই আগের মত ছড়ির খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, মিথ্যা কথা বলছ তোমরা, তোমাদের আরও ছয়জন সাথী আছে। কোথায় তারা?
‘না কেউ আর নেই।’ আগের মত উত্তর দিল ওদের একজন।
‘দেখ মিথ্যা কথা আমরা পছন্দ করি না, ওদের পেলে কিন্তু তোমাদের প্রাণদন্ড হবে।’ কঠোর কণ্ঠে উচ্চারণ করলল আহমদ মুসা।
ওরা কোন জবাব দিল না।
‘শুধু মুখের কথায় ওদের কথা বের হবে না। ওদরে নিয়ে যেতে বল যিয়াদ। আপাদমস্তক ওদের সার্চ করতে বল, জুতা পর্যন্ত।’
চোখ বাধা দু’জনকে নিয়ে গেল যিয়াদের দু’জন লোক।
ওরা বেরিয়ে যেতেই আহমদ মুসা বলল, ‘যিয়াদ আমারদ অনুমান মিথ্যা না হলে আরও ছয়জন লোক জংগলে প্রবেশ করেছে, খুঁজে বের করার নির্দেশ দাও।’
‘মুসা ভাই, জংগলে এমনভাবে পাহারা বসানো যে, কেউ জংগলে ঢুকলে ধরা পড়বেই। তবু একবার তাগিদ দিয়ে আসছি ভাল ভাবে খোঁজ করার জন্য।’ বলে যিয়াদ বেরিয়ে গেল।
যিয়াদ যখন ফিরে এল, তখন তার সাথে ঘরে ঢুকল যারা চোখ বাঁধা দু’জনকে নিয়ে গিয়েছিল তাদের একজন। সে সার্চ করে পাওয়া জিনিসগুলো আহমদ মুসার সামনে রাখল। ওদের কাছ থেকে পাওয়া মানিব্যাগ, কলম, চাবীর রিং, লাইটার ইত্যাদির মধ্যে লাইটার আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
লাইটারটি হাতে তুলে নিতেই লাইটারের এক পাশে মাছের চোখের মত ছোট স্বচ্ছ, উজ্জ্বল একটা জ্বলজ্বলে চোখ আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ভাল করে দেখার জন্যে কাছে নিয়ে আসতেই অষ্পষ্ট ব্লিৎস ব্লিৎস শব্দ তার কানে গেল। আহমদ মুসা চমকে উঠল লাইটারটা কি তাহলে অটোমেটিক মুভি ক্যামেরা ও ট্রান্সমিটার দুই ভুমিকাতেই কাজ করছে।’ অন্য লাইটারটাও দেখল আহমদ মুসা। একই লাইটার একই ব্যবস্থা। আরও ভালভাবে উল্টে-পাল্টে দেখল আহমদ মুসা। অত্যন্ত পাওয়ারফুল ট্রান্সমিটার আহমদ মুসা তা দেখেই বুঝতে পেরেছে।
আহমদ মুসা ট্রান্সমিটার দু’টি জোয়ানের হাতে তুলে দিয়ে বলল, জোয়ান ক্যামেরা এবং ট্রান্সমিটার দেখ। এখনও মেসেজ রিলে করছে।
ঘরের সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। বিস্মিত চোখে জোয়ান হাতে তুলে নিল লাইটারটি।
আহমদ মুসা হেলান দিয়ে চোখ বুজল। চিন্তা করছে সে। ট্রান্সমিটারটা অন কেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে কি মেসেজ সে রিলে করছে? দুই ট্রান্সমিটারের একই অবস্থা। তাহলে এই ট্রান্সমিটারের এটাই সিস্টেম। বাহকের কাছে এটা সব সময় খোলা থাকবে কিন্তু কেন? কি মেসেজ এরা ট্রান্সমিট করে? হঠাৎ আহমদ মুসার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
এ সময় জোয়ান বলল, এর ব্লিৎস, এর সাইজ ও গ্লাভেটি থেকে বুঝা যাচ্ছে কমপক্ষে ১০০ বর্গমাইল সীমার পথে এ সংকেত পাঠাতে পারে।
এ সময় দ্রুত ঘরে ঢুকল আব্দুল্লাহ। বলল, অয়ারলেসে খবর এসেছে, আরও ছয়জন ধরা পড়েছে। ওদের নিয়ে আসছে।
সবাই স্তম্ভিত চোখে তাকাল- আব্দুল্লাহর দিকে নয়, আহমদ মুসার দিকে। মনে তাদের একটা প্রশ্নই বড় হয়ে উঠেছে, ছয়জনের কথা আহমদ মুসা কি করে বলল।
‘আহমদ মুসা ভাই, ওদের সাথী আরও থাকতে পারে অনুমান করলেন ঠিক আছে, কিন্তু সংখ্যাটা কি করে বললেন?’ বলল যিয়াদ।
‘মুসা তখন অন্য চিন্তায় ব্যস্ত। তার কপাল কুঞ্চিত। মুখটা শক্ত। যিয়াদের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘গোয়াদেল ফো তীরের তোমাদের এ ঘাটিটা সরবরাহ ঘাটি তাই না? মূল ঘাটিটা এখান থেকে আরও কতদূরে?
‘হ্যাঁ মুসা ভাই, এটা আমাদরে সরবরাহ ঘাটি। মূল ঘাটিটা আরও পুবে, বনের আরও গভীরে, ৪০ মাইল দূরে তো হবেই। কিন্তু কেন জিজ্ঞাসা করছেন মুসা ভাই?’ যিয়াদের কণ্ঠে কিছুটা উদ্বেগ।
‘আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, বলল আহমদ মুসা, ‘তাহলে আটজন অনুপ্রবেশকারী চর এখানে একত্রিত হবার কয়েক ঘন্টার মধ্যে অথবা রাতের অন্ধকারে এই ঘাটি আক্রান্ত হবে। আকাশ পথে আসতে পারে, নদী পথে আসতে পারে, বোমা ফেলতে পারে, ছত্রীও নামতে পারে। এখানে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের বিমান আছে যিয়াদ?’
‘ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের নেই, চার্চের আছে বিমান এবং হেলিকপ্টার দুই-ই।’
‘ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এবং চার্চের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, তাই না?’
‘জি।’ বলল যিয়াদ।
‘তাহলে শুন, অনুপ্রবেশকারী ছয়জনকে এখানে নিয়ে এস। আর তোমাদের লোক-জন, মাল-সামান সব মূল ঘাটিতে স্থানান্তরিত কর এখনি।’
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু কলল, ঐ ছয়জন এলে, ওদের কাছেও ছয়টি ট্রান্সমিটার পাওয়া যাবে, মোট ৮টি ট্রান্সমিটার হবে। এই ৮টি ট্রান্সমিটার ঘাটিতে রেখ, ৮ জন অনুপ্রবেশকারীকেও অন্য কোথায় নিয়ে আটকে রাখতে পার।’
‘৮টি ট্রান্সমিটার এখানে থাকবে কেন মুসা ভাই?’ বলল যিয়াদ।
‘ওরাই তো সংকেত দাতা, ওরাই পথ বাতলাচ্ছে। ওদের যদি সাথে নাও, তাহলে যেখানে, নিয়ে যাবে, সেখানেই যাবে ওদের আক্রমণ।’
‘৮টি ট্রান্সমিটার একত্র হওয়া আক্রমণের শর্ত কেন?’ বলল জোয়অন।
‘ওদের পরিকল্পনা হলো, ৮জন অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ে তোমাদের ঘাটিতে আসবে, অথবা ধরা না পড়লে ওরাই তোমার ঘাটি খুঁজে নেবে। উভয় ক্ষেত্রেই তারা একত্রিত হচ্ছে। এক অবস্থান থেকে ৮টি ট্রান্সমিটারের সংকেত যখন ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্যানের কাছে যাবে, তখন ওরা বুঝবে এটাই যিয়াদের ঘাটি। যেখানে যিয়াদ ও তার লোকজন আছে এবং আছে আহমদ মুসা। এরপরেই তাদের আক্রমণ।’
যিয়াদ, জোয়ান, রবার্তো, আহমদ আব্দুল্লাহ সবার বিস্মিত দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। তাদের সবার মুখ হা হয়ে গেছে। এতক্ষণে ব্যাপারটা তাদের কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে। তাদের কারও মুখে কোন কথা নেই।’
কথা বলল প্রথম জোয়ান। বলল, বুঝেছি মুসা ভাই, ট্রান্সমিটারগুলো আসলে ‘পথ ইন্ডিকটের’ বা ‘পথ নির্দেশক’। ওরা যে পথ দিয়ে যাবে, সে পথটা অংকিত হয়ে যাবে রিসিভিং স্ক্রীনে। সব পথ অবস্থানে এসে একত্রি হবে, সেটাকেই ওরা ধরে নেবে ঘাটি। এ জন্যেই বিভিন্ন পথ দিয়ে ওরা পাঠিয়েছে ওদের এজেন্টদের। কিন্তু মুসা ভাই আপনি দয়া করে বলুন, দু’জন অনুচরকে দেখে আপনি কেমন করে বুঝলেন আরও আছে এবং তারা ছয়জন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘খুবই সোজা ব্যাপারটা। স্বাভাবিক নিয়মে অনুপ্রবেশকারীরা যে ক’জনই আসুক, এক সাথে আসার কথা। কিন্তু দু’জনকে পাওয়া গেল একটা ব্যবধানে। তখনই আমার মনে হলো, অনুরূপ ব্যবধানে আরও অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। ম্যাপে ঐ অঞ্চলের বন-প্রান্তের অবশিষ্ট অংশটা পরিমাপ করে দেখলাম আরও ছয়জনের জায়গা আছে। এ থেকেই আমি ছয়জনের ব্যাপারটা অনুমান করেছি।’
‘ধন্যবাদ মুসা ভাই, এই জন্যেই আপনি আহমদ মুসা। আল্লাহ তার অশেষ নেয়ামতকে আপনার উপর ঢেলে দিয়েছেন। আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া।’ বলে যিয়াদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বেশি কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল। বলল, এক ঘন্টার মধ্যেই এ ঘাটি ভ্যাকেন্ট করা হবে মুসা ভাই, আর আপনারাও আধা ঘন্টার মধ্যেই রওনা হচ্ছেন। তবে মুসা ভাই, এই ঘাটিকে আমরা ওদের জন্যে, মরণ ফাঁদ বানাতে চাই, আপনার মত কি?’
আহমদ মুসা একটু ভেবে বলল, তোমার পরিকল্পনা কি?
‘আমরা ঘাটি খালি করে ওদের আসার সুযোগ করে দিতে চাই, তারপর ওদের চারদিক থেকে আক্রমণ করব। কাউকে পালাতে দেব না।’ বলল যিয়াদ।
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কথা বলল না। তার কপাল কঞ্চিত। ভাবছে সে। বলল, ‘যিয়াদ শত্রুর উপর আঘাত হানার এটা একটা লোভনীয় সুযোগ সন্দেহ নেই। কিন্তু যুদ্ধটা নিজের মাটিতে যতটা এড়ানো যায়, তত ভাল। এতবড় ঘটনা যদি এখানে ঘটে, তাহলে শুধু ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান নয় সরকারও গোটা জংগল এলাকাকে টার্গেট করবে। গোটা জংগল এলাকাকে বিধ্বস্ত করতে এগিয়ে আসবে। আর এখানকার হত্যাকান্ডকে গোটা দুনিয়ার কছে সে অজুহাত হিসেবে পেশ করবে। আমাদের এ আশ্রয়টা এ ধরণের বিপর্যয়ের স্বীকার হোক আমরা তা চাই না।
যিয়াদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, আপনাকে ধন্যবাদ মুসা ভাই, আপনি ঠিক বলেছেন। আমরা এভাবে চিন্তা করিনি। এখন আমরা কি করব? অনুপ্রবেশকারীদের এখানে না আনলেই ভাল হতো না?
‘দু’জন তো আগে এসেই গেছে। জায়গাটা ওদের কাছে ডিটেক্টেড হয়ে গেছে। এখন যদি ওদের মেরে ও ফেল, তাহলেও ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এখানে আসবে ওদের সন্ধানে। সুতরাং দু’জন যখন এসে গেছে, তখন সবাইকে এখানে আনাই ভাল। এতে ওরা বুঝবে গোটা জংগলে এটাই তোমাদের একমাত্র ঘাটি। আরেকটা কথা, ওরা যখন ঐ ভাবে জংগলে সার্বিক অনুসন্ধান শুরু করেছে, তখন তোমাদের ঘাটির সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত ওরা সন্ধান চালাবেই। সুতরাং একটা ঘাটির পতন ঘটিয়ে যদি ওদের অনুসন্ধান বন্ধ করা যায় এবং অন্যসব ঘাটি রক্ষা করা যায় সেটাই ভাল।’
‘তাহলে এখন আমাদের কি করণীয় মুসা ভাই?’ বলল যিয়াদ।
‘বন্দীরা কি জানতে পেরেছে, আমরা ঘাটি খালি করছি?’
‘যেখানে ওদের রাখা হয়েছে, কিছুই জানা ওদের পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘ঠিক আছে। তাহলে ওদের এটা বুঝতে দাও যে তোমাদের পরিবার-পরিজন তোমরা বন্দর-নগর মিত্রালীতে ট্রান্সফার করছ। আচ্ছা শত্রুরা কোন পথ দিয়ে কখন আসছে তা জানার কি ব্যবস্থা রেখেছ?’
‘ওরা আকাশ, জল, স্থল, যেদিক দিয়েই আসুক, আমাদের এলাকার সীমান্ত অতিক্রম করলেই আমরা জানতে পারব।’
‘তাহলে চিন্তা নেই, আমরা যখন দেখব ওরা ঘাটির দিকে এগুচ্ছে, তখন আমরা অবশিষ্টরা ঘাটি ছেড়ে চলে যাব। বন্দীদের আমরা বুঝতে দেব যে, ঘাটিতে আক্রমণ আসছে এ জন্যে আমরা সরে পড়ছি।’
‘কেন বন্দীদের আমরা শেষ করে যাব না?’ বলল আহমদ আব্দুল্লাহ, যিয়াদের সহকারী।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ’আত্মসমর্পণকারীদের মুসলমানরা হত্যা করে না এবং তাদের উপর নির্যাতনও করে না। ওদের সরিয়ে নিয়ে আমরা বন্দী করে রাখতে পারি। কিন্তু তার চেয়ে ওদের ঐভাবে চলে যাবার সুযোগ দেয়ার মধ্যেই কল্যাণ আছে। ওরা বুঝবে, বন্দীদের রাখার উপযুক্ত জায়গা আমাদের নেই।’
‘শত্রুরা আমাদের কি দুর্বল ভাববে না?’ বলল রবার্তো।
‘আমরা যে পর্যায়ে আছে, সে সময় শত্রু আমাদের সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝিতে থাকা ভাল। আমি চাই, এই জংগলে ‘ব্রাদার্স ফর ক্রিসেন্ট’ (বি এফ সি) এর শক্তি সম্পর্কে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান নিরুদ্বেগ বোধ করুক। তাতে তোমাদের আসল যে কাজ তাতে সুবিধা হবে। ‘থামল আহমদ মুসা।
যিয়াদ, আহমদ আব্দুল্লাহ, জোয়ান, রবার্তো সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
যিয়াদ জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, মুসা ভাই, মুসলমানদের জন্যে আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন। আজ আপনি আমাদের মাঝে না থাকলে শত শত বছর ধরে যে জংগল এলাকাকে আমরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে গড়ে তুলেছি, তা এবং তার সাথে আমরাও বিপর্যয়ের মুখে পড়তাম।’
আহমদ মুসা যিয়াদের পিঠ চাপড়ে বলল, যখন যেখানে যা করার আল্লাহই করেন, শুধু প্রয়োজন তার বান্দারা যার যখন যেটা দায়িত্ব তা আন্তরিকতার সাথে পালন করা।
আহমদ মুসা, যিয়াদসহ সবাই উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে এল তারা ঘর থেকে। হাঁটতে হাঁটতে আহমদ মুসা বলল, ’আর কতক্ষণে ঐ ছয়জন এসে পৌছবে?’
‘আরও কয়েক ঘন্টা লাগবে।’ বলল যিয়াদ।
‘সবদিক বিচারে রাত ছাড়া বোধ হয় ওরা আসছে না।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথাই ঠিক।
রাতে আসল ওরা। রাত বারটায়।
ঠিক রাত বারটায় কয়েকটা ক্ষুদ্রাকার শব্দহীন পরিবহন বিমানে করে ছত্রীসেনা নামানো হলো। ওরা তিন দিক থেকে ঘাটিটাকে ঘিরে ফেলল। সামনে থাকল নদী।
আরো আধা ঘন্টা পর ঠিক রাত সাড়ে বারটার দিকে তিনটা গানবোট নিঃশব্দে ভিড়ল ঘাটির ঘাটে এসে। গানবোটের কামানের নলগুলো ঘাটির দিকে তাক করা।
এমন শব্দহীন পরিবহন বিমান এবং গানবোট স্পেনীয় ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের নেই। আমেরিকার ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এসব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাদের স্বার্থ আহমদ মুসা কে হাতে পাওয়া, আর স্পেনীয় ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের স্বার্থ তাদের সহযোগীতার এই সুযোগ নিয়ে ‘ব্রাদারস ফর ক্রিসেন্ট’ এর ঘাটি ধ্বংস করা। এই অপারেশন পরিচালনার জন্যে মাদ্রিদ থেকে স্বয়ং ভাসকুয়েজ এসেছে এবং তিনি পরিচালনা করছেন এই অভিযান।
গান বোটের অপারেশন কক্ষে বসে ভাস্কুয়েজ। তার হাতে ওয়াকিটকি। ঘাটির তিন দিক ঘিরে পূর্বেই মোতায়েন হওয়া ছত্রীসেনাদের সাথে কথা বলছে ভাসকুয়েজ। কথা শেষ করে ওয়াকিটকির এন্টেনা গুটিয়ে নিয়ে পাশে বসা সিনাত্রা সেন্ডোকে বলল, বুঝলে সেন্ডো, একটা কাকপক্ষিও পালাতে পারেনি। পালাবে কি করে! পরিকল্পনা দেখতে হবে তো! ওরা আমাদের আটজন লোককে ধরে নিশ্চয় আনন্দে বগল বাজাচ্ছে, কিন্তু ব্যাটারা জানেনা, ওরা তো টোপ, ধরা পড়ার জন্যেই পাঠানো হয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা হান্ড্রেড পারসেন্ট সফল।’
‘কিন্তু ওরা কেউ সাড়া দিচ্ছে না।পাহারা নিশ্চয় থাকার কথা। তারা কিছু বলছে না কেন? শিকার…।’ কথা শেষ করতে পারলো না সেন্ডো। তার কথার মাঝখানেই ভাসকুয়েজ বলে উঠল, ’রাখ তোমার কথা। খবর দিয়েছে, এক নম্বর, দুই নম্বরসহ সবাই ঘাটিতে আছে।’
মিঃ ভাসকুয়েজ থামল। একটা সিগারেট ধরাল। তারপর আবার শুরু করল, আমার সৈন্যেরা তিন দিক দিয়ে ক্লোজ হয়ে ঘাটির দিকে আসছে। আর অল্পক্ষণের মধ্যেই ওরা ঘাটিতে ঢুকে পড়বে। সব ব্যাটাকে মরতে হবে, নয় তো ধরা দিতে হবে। এবার আহমদ মুসাকে হাতে পাওয়ার পর আর দেরী নয়, সঙ্গে সঙ্গে ভোঁ আমেরিকায়।’
‘আহমদ মুসা ভীষণ ধড়িবাজ স্যার, কার্ডিনাল হাউজের মরণপুরী থেকে কি করে পালাল দেখেছেন তো স্যার?’ বলল সেন্ডো।
কার্ডিনাল হাউজ থেকে আহমদ মুসার পালাতে পারার ঘটনা ভাসকুয়েজের কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মত বেদনাদায়ক। এই অপমান ও পরাজয় সহ্য করতে পারে না সে। সেন্ডোর কথায় ভাসকুয়েজ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, ’তোমার মত গর্দভের চিন্তা সব সময় নিচের দিকে, কোন বড় চিন্তা তো তোমার নেই।’
‘ইয়েস স্যার, ঘাটিটা এত চুপচাপ কিনা তাই বলছিলাম ওরা ভীষণ ধড়িবাজ…।’ কথা শেষ না করেই থামল সেন্ডো।
‘তুমি কোন খবরই রাখ না সেন্ডো, ওরা সকলে শেষ রাতে উঠে নামায পড়ে, তাই ওরা একটু আগেই ঘুমায়।’
ভাসকুয়েজের ওয়াকিটকি কথা বলে উঠল, স্যার, ঘাটি খালি, কাউকেই দেখছি না। একটা ঘরে বন্দী অবস্থায় আমাদের আটজনকে পাওয়া গেছে।’
ভাসকুয়েজের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।
‘স্যার আমি একটু দেখি, বলে উঠে দাঁড়াল সেন্ডো। সে গান বোট থেকে ঘাটিতে নেমে গেল। তার দু’পাশে দু’জন প্রহরী উদ্যত স্টেনগান হাতে।
আধা ঘন্টা পরে সেন্ডো তাদের বন্দী আটজন লোক সহ ফিরে এল। ভাসকুয়েয এক দৃষ্টিতে তাকাল তাদের সেই আটজনের দিকে। হুংকার দিয়ে বলল, তোমরা কি খবর পাওনি যে, আহমদ মুসা, যিয়াদ সহ সবাই আছে?’
আটজনের একজন বলল, ’জি স্যার আমি খবর দিয়েছিলাম সন্ধ্যায়। তখন ওরা ছিল। সন্ধ্যার পর ওরা বেরিয়ে গেছে। সে খবর আমরা জানিয়েছি গ্রানাডা অফিসে।’
‘কোথায় গেছে ওরা?’ বলল ভাসকুয়েজ।
‘ওদের কথাবার্তায় শুনেছিলাম, সকালের দিকে ওরা পরিবার পরিজন মিত্রালীতে পাঠিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যার পর ওরাও মিত্রালীর দিকে গেছে বলেই আমাদের মনে হয়েছে।’ বলল সেই লোকটি।
এদের কথা ঠিক। এদেরকে এই ইম্প্রেশন দেবার জন্যেই আহমদ মুসারা মটর বোট চালিয়ে প্রথমে পশ্চিম দিকে চলে যায়।পরে ইঞ্জিন বন্ধ করে বৈঠা টেনে তারা ফিরে আসে এবং পুব দিকে ৪০ মেইল দুরের গভীর জংলের ঘাটির দিকে চলে যায়।
‘তোমাদের নিয়ে গেল না?’ বলল সেন্ডো।
‘চলে যাবার সময় আমাদের এসে বলেছে, আরও কয়েক ঘন্টা তোমরা থাক, তোমাদের বন্ধুরা আসছে, তোমাদের নিয়ে যাবে।’ আটজনের অন্য একজন জানাল।
‘ওরা জানলো কি করে যে আমরা আসছি ?’ হুংকার দিয়ে উঠল ভাসকুয়েজর গলা।
‘আমরা কেউই জানতামনা যে আপনারা আসছেন।’ বলল আটজনের একজন।
ভাসকুয়েজ ক্রদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো সেন্ডোর দিকে। সেন্ডো বলল, ‘স্যার আমারও একই প্রশ্ন ওরা এই তথ্য জানলো কি করে ?’
‘আমাদের গ্রানাডা অফিসটা অপদার্থ। ওখানেই কোন মরিসকো লুকিয়ে আছে মনে হয়। চল ফিরে চলো গ্রানাডা। জাহান্নামে পাঠাবো সবাইকে।’
ভাসকুয়েজ অন্য কক্ষে চলে যাবার জন্য পা বড়াতে বাড়াতে বলল, গোটা ঘাটি ভাল করে সার্চ করো সেন্ডো। কিছু পাও কিনা দেখ তারপর জ্বালিয়ে দাও শয়তানের আড্ডাটা।
ভাসকুয়েজ ঢুকে গেল তার বিশ্রাম কক্ষে। বন্ধ হয়ে গেল তার কক্ষের দরজা।
সেন্ডো উঠে দাঁড়াল। সবাইকে নিয়ে এগুলো গানবোট থেকে ঘাটিতে নামার জন্যে।