বাড়ীর ফটক খুলে গেল। মাহমুদ কিছু বলার আগেই ছুটে গিয়ে গাড়ী বারান্দায় দাঁড়াল।
মেয়েটি গাড়ী থেকে নেমেই গাড়ীর পাশ ঘুরে এসে দরজা খুলে দিল।
মাহমুদ গাড়ী থেকে বেরিয়ে মেয়েটির দিকে আর এক পলক তাকিয়ে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, এবার আসি।
মাহমুদ যাবার উদ্যোগ করতেই মেয়েটি পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, দয়া করে একটু বসবেন, অন্ততঃ এক কাপ চা খাবেন চলুন। আমার জরুরী কাজ আছে, ক্ষমা করুন আমাকে। বলল মাহমুদ।
মেয়েটি এক মুহূর্ত থামল। তারপর ধীরে গম্ভির কন্ঠে বলল, আপনি যে উপকার আমার করেছেন সে ঋণ অপরিশোধ্য। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের … মাহমুদ বাধা দিয়ে বলল, মানুষের প্রতি মানুষের যে দায়িত্ব, তার বেশিকিছু আমি করিনি। বলেই মাহমুদ গেটের দিকে পা বাড়াল।
– শুনুন, আপনার পরিচয় দয়া করে কি বলবেন? মেয়েটির কন্ঠে এবার অনুনয়ের সুর।
মাহমুদ ফিরে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বলল, আমরা সামান্য ব্যক্তি, দিবার মত কোন পরিচয় আমাদের নেই। তবে বেঁচে থাকলে দেখা হবে, এখন আসি।
ডেভিড বেনগুরিয়ানের গেট পেরুবার আগেই মাহমুদ একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ১ টা। মাহমুদের মন আনচান করে উঠল। কিছুক্ষণ আগের পাওয়া চিঠিটি তার এখনও পড়া হয়নি। জরুরী কোন সংবাদ বা নির্দেশ তাতে থাকতে পারে। চলতে চলতেই মাহমুদ বাম পকেট থেকে চিঠিটি বের করে একবার তাতে চোখ বলাল। সাইমুমের সাংকেতিক অহ্মরে লেখাঃ
“আগামী সতের তারিখে ওসেয়ান কিং জাহাজে ইসরাইলের জন্য ইউরেনিয়াম, হেভিওয়াটার ও অন্যান্য আনবিক গবেষণার বহু মূল্যবান মাল মসলা আসছে। জাহাজটি রাত নয়টায় জাফা বন্দরে ভিড়বে। রাত এগারটায় জাহাজে প্রীতিভোজের অনুষ্ঠান।’’
চিঠি পড়ে মাহমুদ মনে মনে তারিখ গুনল। আজ পনের তারিখ, হাতে সময় মাত্র দু’দিন। মাহমুদ গেটে আসতেই গেটম্যান গেট খুলে দিয়ে স্যালুট করে দাঁড়াল।
৫
সূর্য তখনো উঠেনি। রক্তিম পূর্বাকাশ। মাহমুদ কোরআন পড়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর ড্রেসিং রুমে প্রবেশ করে, কিছুক্ষণ পর ধনী ইহুদী ব্যবসায়ীর সাজ পরে বেরিয়ে এল এবং পশ্চিমের ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
জাফা বন্দরে মাহমুদের এটি একটি নতুন আস্তানা ভূমধ্যসাগরের তীরে পাঁচতলা এই বাড়ী। ইজি চেয়ারে অর্ধশায়ীত মাহমুদ পলকহীন দৃষ্টিতে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশির দিকে চেয়ে ছিল। দূরে পশ্চিম দিগন্তে একটি জাহাজের চিমনি দেখা যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে পশ্চিম দিগন্তে তা মিলিয়ে গেল। জাহাজটির সাথে যেন মাহমুদের মনটিও ছুটে গেল দীগন্ত পেরিয়ে জীব্রালটার অতিক্রম করে। জিব্রালটার – জাবালুৎ তারিকের কথা মনে পড়তেই মাহমুদের মন ছুটে গেল চৌদ্দ শ’ বছর আগের একটি ঘটনার দিকে। সিপাহসালার তারিক সাতশ’ সৈন্য নিয়ে শত্রু অধ্যুষিত স্পেনের মাটিতে নামলেন। তারপর পুড়িয়ে দিলেন ফেরবার একমাত্র উপায় নৌযানগুলো। তাদের সামনে রইল সুসজ্জিত অগণিত শত্রু সৈন্য আর পেছনে তরঙ্গ – বিক্ষুব্ধ সমুদ্র। আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় সম্পর্কে কি দৃঢ় প্রত্যয়। মুসলিম সিপাহসালার তারিকের এ আত্মপ্রত্যয় অবাস্তব ছিল না। শীঘ্রই সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক মুসলমানদের হেলালী নিশান স্পেনের সীমানা পেরিয়ে ফ্রান্সের প্রান্তদেশ পারেনিজ পর্বতমালার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ইসলামের জয় বার্তা ঘোষনা করল। শুধু কি তাই? মুসা আর তারিককে যদি দামেস্কের দরবারে ফিরিয়ে না আনা হতো, তাহলে ‘ওয়াশিংটন আরভিং এর ভাষায়, ‘‘আজ প্যারিস ও লন্ডনের গীর্জাসমূহে ক্রসের বদলে হেলালী নিশানই শোভা পেত।’’ এই ভূমধ্যসাগরের প্রতিটি ইঞ্চি স্থানে একদিন মুসলমানদেরই হুকুম চলত। কিন্তু আজ? মাহমুদের মন বেদনায় ভরে যায়, যে স্পেনকে মুসলমানরা আট শত বছর ধরে গড়ে তুলল আপন করে, সেই স্পেনে আজ মুসলমানদের সাক্ষাত মিলে না। তারা বিধ্বস্ত ও বিতাড়িত। কিন্তু কেন এই পতন? ইতিহাস মুসলমানদের দুর্বলতা আত্মকলহকেই এর জন্য দায়ী করেছে। কিন্তু এই আত্মকলহ আর দুর্বলতা এল কোত্থেকে? সে কি আদর্শচ্যুতি থেকে নয়? মাহমুদের মনে পড়ে যায় একজন লেখকের কথা, ‘‘মুসলমানরা আপন উসূল এবং ইসলামী জোশ হতে যখন দূরে সরে পড়ল, তখন খোদা তাদের এ নিয়ামত কেড়ে নিলেন। এরই ফলে আবার একদিন খৃষ্টান শক্তি সেই বিজয়ী মুসলমানদের উত্তরাধিকারীদেরকে এসব দেশ হতে এমনই ভবে বের করে দিল যে, সে সব দেশের মুসলমানদের নামের আর কোন চিহ্নই থাকল না।’’ পূর্বসুরীদের ভুল কি আমরা শুধরে উঠতে পেরেছি? মাহমুদ ভেবে চলে। যদি পারতাম, তাহলে ক্ষুদ্র ইসরাইলের হাতে এমন করে আমরা মার খাব কেন? আফ্রিকা আর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা এমনই করে নির্যাতীতই বা হতে থাকবে কেন? মধ্য এশিয়া, ফিলিপাইন, সাইপ্রাস, ইরিত্রিয়া, চাঁদ, নাইজেরিয়া, মোজাম্বিক প্রভৃতি দেশের মজলুম মানুষের আমানুষিক দুর্দশা মাহমুদের মনকে ভারি করে তুলে। প্রশ্ন জাগে তার মনে, এদের মুক্তি কত দূরে? মুসলিম তরুণরা কি জাগবে না? তারা কি এগিয়ে আসবে না মজলুম মানুষের মুক্তির জন্য? আমাদের চেষ্টা কি বৃথা যাবে?
এই সময় ধীর পায়ে নাস্তা নিয়ে সেখানে প্রবেশ করল আফজল। আফজল এই বাড়ীর প্রহরী, দারোয়ান, রাধুনী, পরিবেশক সবকিছু। পায়ের শব্দে মাহমুদের চিন্তা সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। মাহমুদ পিছনে ফিরে আফজলকে দেখে মৃদু হেসে বলল, আজকে নাস্তা খুব সকাল সকাল মনে হচ্ছে না?