দূরের কোন একটি পেটা গড়িতে ঢং ঢং করে ১২টা বেজে গেল। ধীরে ধীরে একটা কালো রং এর গাড়ী এসে অন্ধকারে দাঁড়ানো বাড়ীটির গেটে এসে থামল। কালো পোশাক দেহ ঢাকা এক ছায়ামূর্তি গাড়ী থেকে নেমে এল।
ঠক্ ঠক্ ঠক্। বন্ধ জানালার শক্ত কবাটে ধীরে ধীরে তিনটি শব্দ হল।
ছায়ামূর্তিটি বাড়ীটির সম্মুখের বাগানটি পেরিয়ে নীচের তলার একটি বন্ধ জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। ছায়ামূর্তিটির তর্জ্জনী আবার শব্দ করল বন্ধ জানালার গায়ে – ঠক্ ঠক্ ঠক্।
ধীরে ধীরে এবার জানালার একটি পাল্লা খুলে গেল ভিতরে জমাট অন্ধকার। অন্ধকারের ভিতর থেকে একটি হাত বেরিয়ে এল, ছায়ামূর্তিটি সে হাতে তুলে দিল ভাজ করা এক টুকরো কাগজ। সঙ্গে সঙ্গে জানালাটি আবার বন্ধ হয়ে গেল। জানালাটি বন্ধ করে দিয়েই কর্ণেল মাহমুদ দোতলার ব্যালকনিতে উঠে এল। আকাশ থেকে একটি বড় উল্কা পিন্ড খসে পড়ল। মনে হল উল্কাটি যেন সামনের ২২তলা দালানটির ছাদের উপর এসে নামল। ব্যালকনি থেকে ডি,বি, রোড়ের মোড় পর্যন্ত দেখা যায়। মাহমুদ দেখলো কাল গাড়ীটি ছোট রাস্তা পেরিয়ে ডি,বি, রোডে গিয়ে পড়ল। গাড়ীটির পিছনে রক্তাভ আলো দু’টি ক্রমে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। মাহমুদ সেখানে থেকে দৃষ্টি ফিরাতে গিয়েও পারল না। দেখল ছোট রাস্তা পেরিয়ে আর একটি গাড়ী গিয়ে ডি,বি, রোডে পড়ল।
চমকে উঠল মাহমুদ। বিদ্যুৎ খেলে গেল মনে -অনুসরণ। তর তর করে সে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। গ্যারেজ থেকে গাড়ী বের করে খোলা দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল। ডি,বি, রোডে যখন কর্ণেল মাহমুদের গাড়ী বেরিয়ে এল, তখনও দীর্ঘ পথের প্রান্তে অনুসরণকারী গাড়ীটির পিছনের রক্তাভ আলো দেখা যাচ্ছে। কর্ণেল মাহমুদের ছোট্টগাড়ীটি তীব্র গতিতে ছুটে চলল। সামনের অনুসরণকারী গাড়ীটির স্পীড ছিল মাঝারী গোছের। অল্প সময়ের মধ্যেই কর্ণেল মাহমুদের গাড়ীটি অনুসরণকারী গাড়ীটির দুশো গজের মধ্যে এসে পড়ল। কিছুক্ষণ চলার পর সামনের গাড়ীটির স্পীড হঠাৎ বেড়ে গেল। কর্ণেল মাহমুদও তার গাড়ীর স্পীড বাড়িয়ে দিল। মাহমুদ বুঝতে পারল সামনের অনুসরণকারী গাড়ীটি তাকে সন্দেহ করেছে। মাহমুদ ভেবে খুশি হল যে গাড়ীটি হয়তো এবার সামনের সাইমুমের গাড়ীটির অনুসরণ পরিত্যাগ করে অন্য পথ ধরবে। কারণ দু’দিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার পরিস্থিতি সে সৃষ্টি হতে দিবে না, কিন্তু অল্পক্ষণেই ভুল ভেঙ্গে গেল মাহমুদের। সে দেখলো সমান গতিতে গাড়ীটি সামনের গাড়ীটির অনুসরণ করে যাচ্ছে। সামনের অনুসরণকারী গাড়ী থেকে মাহমুদরে গাড়ীর দুরত্ব কমপক্ষে দু’শ গজের মত। আর সে গাড়ী থেকে তার সামনের গাড়ীটির দূরত্ব কমপক্ষে একশত গজ। এ সময় গাড়ীর রিয়ারভিউ এ চোখ পড়তেই চমকে উঠল মাহমুদ, দেখলো পিছন থেকে পাশাপাশি জ্বলন্ত চোখের মত দু’টি অগ্নিপিন্ড তার দিকে ছুটে আসছে। মুহূর্তে মাহমুদের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে পারল সামনের অনুসরণকারী ‘মোসাদের’ (ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা) গাড়ীটি বেতারে চতুর্দিকে খবর পাঠিয়েছে। পিছনের মত সামনে থেকেও হয়তো অনুরূপভাবে গাড়ী তাদের দিকে ছুটে আসছে। মুহূর্তে তার করণীয় ঠিক করে নিল কর্ণেল মাহমুদ। দেখতে দেখতে গতি নির্দেশক গাড়ীর কাঁটা ৫০ থেকে ৯০ এ গিয়ে পৌঁছল। মোসাদের গাড়ী সাইমুমের যে গাড়ীটি অনুসরণ করছিল, তা একই গতিতে চলছিল। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তেলআবিবের সাইমুম প্রধান কর্ণেল মাহমুদরে গাড়ী মোসাদের গাড়ীটির সমান্তরালে গিয়ে পৌঁছল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কর্ণেল মাহমুদরে গাড়ী থেকে একটি ডিম্বাকৃতি বস্তু তীব্র বেগে ছূটে গিয়ে মোসাদের গাড়ীটিকে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড বিষ্ফোরণের শব্দ হল। ততক্ষণে কর্ণেল মাহমুদের গাড়ী তার সহকর্মীটির গাড়ীর সমান্তরালে গিয়ে পৌঁছল। কর্ণেল মাহমুদ একবার পিছনে ফিরে দেখল, মোসাদের গাড়ীটিতে আগুন জ্বলছে। পিছনের অনুসরণকারী গাড়ীটিও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। কর্ণেল মাহমুদ ও তার সহকর্মীর গাড়ী পাশাপাশি সমান গতিতে এগিয়ে চলছে। সামনেই ভিক্টোরী স্কোয়ার। এখানে পশ্চিম দিক থেকে হায়কল এভিনিউ উত্তর দিক থেকে গোলান রোড এবং পূর্ব থেকে ডি,বি, রোড এসে মিশেছে। হায়কল এভিন্যুকে দক্ষিণ পার্শ্বে এবং গোলান রোডকে পূর্ব পার্শ্বে রেখে ইসরাইলীরা এখানে গড়ে তুলেছে স্বাধীন ও সার্বভৌম ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্টার স্মারক স্তম্ভ। স্মৃতি স্মারক কেন্দ্রটিতে স্মরক স্তম্ভ ছাড়াও আছে সুপরিকল্পিতভাবে সাজান সুন্দর বাগান, বিশ্রামাগার, পাঠাগার এবং জাতীয় ইতিহাসের এক প্রদর্শনী কেন্দ্র। সর্বসাধারণের জন্য এ কেন্দ্রটি সর্বদা উন্মুক্ত থাকে।
কর্ণেল মাহমুদের গাড়ী ভিক্টোরী স্কোয়ারে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তার নজরে জড়ল পশ্চিম দিক থেকে চারটি অগ্নি গোলক ছুটে আসছে। উত্তর দিকে গোলান রোডের দিকে তাকিয়েও একই দৃশ্য নজরে পড়ল কর্ণেল মাহমুদের। কর্ণেল মাহমুদ মুহূর্তের মধ্যে তার কর্তব্য স্থির করে নিল। গাড়ীর ডান দিকের দরজা খুলে চলন্ত গাড়ী থেকে ছিটকে নেমে পড়ল সে। তারপর চোখের নিমিষে ভিক্টোরী স্কোয়ারের পাঁচিল টপকে সে ভিতরে ঢুকে পড়ল। কর্ণেল মাহমুদের চালকহীন গাড়ীটি প্রায় গজ পঞ্ঝাশেক দুরে গিয়ে এক লাইট পোষ্টের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উন্টে গেল। কিছু দূর গিয়ে কর্ণেল মাহমুদের সহকর্মীর গাড়ীটিও থেমে গেল। ইতিমধ্যে তিন দিক থেকে মোসাদের গাড়ী ভিক্টোরী স্কোয়ারে এসে পড়েছে। এই সময় গাঢ় কাল সামনের রাস্তাঘাট আচ্ছন্ন হয়ে গেল। মোসাদের কুকুরদের কাচকলা দেখিয়ে তার সহকর্মীও সরে পড়তে পেরেছে বলে কর্ণেল মাহমুদ একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কর্ণেল মাহমুদ ভিক্টোরী পার্কের আরও অভ্যন্তরে ঢুকে গেল। সে জানত মোসাদের লোকেরা কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা ভিক্টোরী পার্ক চষে ফেলবে। তার আগেই পার্ক থেকে সরে পড়তে হবে। কর্ণেল মাহমুদ সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে উত্তর দিকে এগুচ্ছিল, এমন সময় পাশের বিশ্রামাগার থেকে ধ্বস্তাধ্বস্তি তারপর নারী কন্ঠের চাপা চীৎকার শুনতে পেল সে। দ্রুত সে ওদিকে এগুলো। দেখতে পেল একটি নগ্ন প্রায় নারী দেহের উপর একটি লোক চেপে বসেছে। নারীটি মুক্তি পাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছে। কর্ণেল মাহমুদ কক্ষে প্রবেশ করল। পায়ের শব্দ থেকেই লোকটি উঠে দাঁড়িয়েছে। মাহমুদের দিকে নিবদ্ধ চোখ দু’টি তার হিংস্রতায় জ্বলছে। মাহমুদকে লক্ষ্য করে সে বলল, বেরিয়ে যা কুকুর, নইলে… উত্তেজনায় সে কথা শেষ করতে পারল না।