পা আর চলে না, তবুও এগোচ্ছিলাম, কারণ তখন আর কোনো উপায় ছিল না। ভয় যা হচ্ছিল, তো খোদাই জানেন। এর উপর সম্মুখে রাস্তার পার্শ্বে গভর্নমেন্টের মরা কাটবার (Post mortem) ঘর।
এমন সময় দেখতে পেলাম, দুটি লোক অপর দিক থেকে আসছে। ভাবলাম এরা এখনই আমায় অতিক্রম করে চলে যাবে। আমি যে অবস্থায় আছি, সেভাবেই এগোতে হবে। আর উপায় কী?
একজন জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কে?” আমি উদাসীনভাবে বললাম–”পথিক!” পা টেনে টেনে হাঁটছিলাম, তা সে লক্ষ্য করেছিল। বললে, “এত রাতে একা একা–এখনও অনেক পথ বাকি।”
আমি ভীতকণ্ঠে বললাম, “তা হলে, আর কী করি? কোনো উপায় দেখি না”।
এমন সময় লোকটি বললে, “আমি তো আপনাকে চিনি, (কী একটা স্থানের নাম করে সে বলল) দু’বছর আগে আপনি অমুক স্থানে আমাকে বিড়ি খেতে দিয়েছিলেন–কেমন, না?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ!” একটা বন্ধুর দেখা পেয়েছি বলে আমার মনটি একটু আশান্বিত হয়ে উঠলো।
সে বললো, “চলুন, নিকটেই রাস্তার ধারে বাড়ি। রাত্রিতে আমার বাড়ি থাকবেন। ভোরে উঠেই রওয়ানা হবেন। কী মহাবিপদ আপনার যে, এ অবস্থায় এই রাত্রিতে আপনি একা এতদূরে চলেছেন।” আমি লমিতো হয়ে বললাম, “আমার হাঁটবার ক্ষমতা নেই; বেশি দূরে হলে কী করে যাবো?”
সে বললে, “আচ্ছা, তা হলে নিকটেই এক বাজার আছে, সেখানে কোনো দোকান ঘরে আপনাকে শুয়ে রেখে দি, প্রাতে উঠে চলে যাবেন।” আমি দ্বিরুক্তি না করে ফিরলাম। কিছু দূরে হেঁটেই একটা বাজার পাওয়া গেল। বাজারের সবাই দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কৃষক প্রত্যেক দোকানীকে আমার কথা জানিয়ে আশ্রয় চাইল। কেউ অপরিচিত লোককে স্থান দিতে স্বীকৃত হল না। অগত্যা কৃষক বন্ধুটি আশ্বাস দিয়ে বললে, “অনেক দূরে হেঁটে এসেছেন, আর কিছুদূর গেলেই আমার বাড়ি। একটু কষ্ট করে আস্তে আস্তে চলুন।” অগত্যা স্বীকৃত হলাম।
অনেক কষ্টে তার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। সে আমায় অতি উত্তম খাদ্যসামগ্রী দিয়ে আহার করালে এবং উৎকৃষ্ট বিছানা দিয়ে আমাকে শুয়ে রাখলে। এই কৃষকের কথা যতবারই ভাবি, ততবারই আমার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠে।
ভাবি, তার সঙ্গে আর কোনো দিনও দেখা হবে না, তার কোনো উপকার করি নাই। নিঃস্বার্থ প্রেমের পরিচয় মানুষ খোদার ভাবে অভিভূত হয়েই দেয়।
মানুষের একদিক পশুর অন্যদিক তার খোদাময় প্রভাত-সৌন্দর্যের মতো নির্মল, মধুর জননীর বুকের মতো সরল। খোদায়ীভাবে মনুষ্য মনুষ্যের নমস্য।
নিরক্ষর মানুষের মধ্যে আমরা অনেক সময় আশ্চর্য ত্যাগ ও মহত্ত্বের পরিচয় পাই, সেরূপ মহত্ত্ব শিক্ষিত লোকেরাও দেখাতে পারেন না। আমরা এখানে পল্লীগ্রামের একটা সামান্য মানুষের দৃষ্টান্ত দিতে চাই যার হৃদয়ের বিশালতা অনেক মানুষের ঈর্ষার বিষয় হতে পারে। মাগুরা মহকুমার হাজীপুরের জরদার বংশের তমিজুদ্দীন জরদার নিজ জীবনে প্রায় ৮ হাজার টাকার সম্পত্তি ক্রয় করেন। এর মধ্যম ভ্রাতা তার একমাত্র শিশুপুত্রকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তমিজুদ্দীনের হাতে সমর্পণ করে এর পূর্বেই অকালে প্রাণ ত্যাগ করেন। তমিজুদ্দীনের আর একটি ভ্রাতা ছিলেন তিনি সর্বকনিষ্ঠ। জীবনের সঞ্চিত সমস্ত ধনই এই কনিষ্ঠ ভ্রাতার হাতে তিনি রাখতেন এবং তার হাত থেকে খরচ হত। তমিজুদ্দীন ভ্রাতাকে এতই স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন যে, তিনি খরচের বা রাশি রাশি জমান টাকার কোনো হিসাবই রাখতেন না। এত করেও তমিজুদ্দীন শেষ জীবনে নিঃস্ব অবস্থায়, বিনা চিকিৎসায় প্রাণত্যাগ করেন। মৃমতো মধ্যম ভ্রাতার পুত্রকে তিনি আপন অর্জিত ভূসম্পত্তির শ্রেষ্ঠ অংশ দান করে যান। আপন পুত্রদ্বয়কে সংসারের জমান টাকার কিছুই দেন নাই, স্থাবর সম্পত্তির অতি সামান্য অংশই এরা পেয়েছিল। এই উদার হৃদয় ব্যক্তি নিরক্ষর ছিলেন; তার ত্যাগ ও মহত্ত্ব শিক্ষিত লোকদেরও বিস্ময় উৎপাদন করে।
মনুষ্য যখন মহত্ত্বের পরিচয় দেয়, তখন আর সে মানুষ থাকে না। তখন খোদায়ি ভাব তার মাঝে প্রকাশ পায়। জগতের সমস্ত হীনতা অতিক্রম করে মানুষ তখন মহাগৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হয়।
.
০৭. স্বভাব-গঠন
বাক্যবাগীশ, কথায় চতুর ও তার্কিক হওয়া খুব সহজ, কিন্তু তিল তিল করে নিজের স্বভাবকে গঠন করে তোলা বড় কঠিন। প্রত্যেক মানুষের শ্রেষ্ঠ কাজই হচ্ছে নিজের স্বভাবকে গঠন করে তোলা।
ইহাই মানুষের কাছে শ্রেষ্ঠ কাজ, মানুষের কাছে ইহা অপেক্ষা আল্লাহর বড় আদেশ আর নাই। এই পরম আদেশের উপর যারা কথা বলে, তারা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী। মনুষ্য আপন স্বভাবকে খোদার অনুযায়ী গঠন করে তুলবে, এই-ই খোদার উপাসনা। নিজের স্বভাবকে পরিবর্তন না করে, আল্লাহ্ আল্লাহ্ করবার কোনো সার্থকতা নাই। যে আল্লাহকে ভালোবেসেছে, সেই আপন স্বভাবকে সংযত করেছে, মিথ্যা পরিহার করেছে, খোদার জীবনকে ভালোবেসেছে, পশুকে আঘাত করতেও সে থমকে ভেবেছে।
খোদার জন্য যে তর্ক করে, তার মূল্য খুব কম। ইসলাম শ্রেষ্ঠ এই কথা বলবার জন্য যে মহাআস্ফালন করে, তারও মূল্য খুব কম। যে মিথ্যা পরিহার করে, আপন স্বভাব গঠন করে, সেই প্রকৃত খোদা-ভক্ত, সেই পরম শান্তিতে আছে, সেই মুসলমান। মুসলমানের অর্থ তর্ক নয়, আস্ফালন নয়, এর অর্থ নীরবে নিজকে গঠন করে তোলা। ইসলাম মানে কাজ–বাক্য নয়।