তারপর গাড়ি ছেড়ে দিল। মাহিলাটির হাতে একটা পোটলা ছিল, খুব সম্ভব তাতে কতকগুলি দামি গহনা ছিল। পুলিশ যুবকটি তাকে লক্ষ্য করে বসেই আছেন। ২/৪ স্টেশন যেতেই একটা লোক হঠাৎ গাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে মহিলার সঙ্গে ভারি আলাপ শুরু করে দিলো। এমন কি কয়েক মিনিটের আলাপে মহিলাটি যে তার অনেক জন্মের মা, এই কথা প্রকাশ করে ফেলল। পুলিশ-যুবক লোকটির সব কথা লক্ষ্য করেছেন। তারপর এক স্টেশনে এসে লোকটি মহিলাটিকে লক্ষ্য করে বলল, “আপনি যেখানে যাবেন, আমিও সেখানে যাব। আজ গরিব সন্তানের বাড়িতে বিশ্রাম করুন, কাল আপনাকে একেবারে নিজে গিয়ে বাসায় রেখে আসব।” ভদ্রমহিলা হচ্ছেন এক উঁকিলের বউ, শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করে রাগের মাথায় এক কাপড়ে স্বামীর কাছে যাবে বলে বেরিয়ে এসেছে; বেরিয়ে যখন পড়েছে তখন আর উপায় নাই। পথে এসে অন্তরে তার বিলক্ষণ ভয় হয়েছে। লোকটির কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে, সেখানেই নেমে পড়ল, পুলিশ-যুবকটিও সেখানে নেমে পড়লেন। নেমে পড়েই তিনি মহিলাটিকে আটকে রাখবার জন্যে টিকেট কলেকটরকে বললেন, “এই মহিলাটির কাছে টিকেট নাই, একে আটক করুন।” জুয়াচোর লোকটি তাকে মহাবিপদে ফেলবার চেষ্টা করছিলো তা সে বুঝতে না পেরে কাঁদতে লাগল। সেই বদমায়েশ লোকটি ইত্যবসরে সরে পড়েছিল। মহিলাটি তখন আরও বেশি করে হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগল। পুলিশ যুবক তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “আপনার কোনো ভয় নাই।” তার স্বামীর ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে, যুবক তৎক্ষণাৎ সেখানে একটি টেলিগ্রাম করে দিলেন। তারপর মহিলাটিকে গার্ড সাহেবের জিম্মা করে বললেন, “এর জন্যে আপনি দায়ী, কোনো বিপদ হলে আপনাকে সেজন্য জবাবদিহি করতে হবে।” গন্তব্যস্থানের স্টেশন মাস্টারের কাছেও তিনি একটা তার করে দিলেন, মাহিলাটিকে যেন সযতে স্টেশনে অপেক্ষা করবার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয় এবং তার স্বামী উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত যেন তিনি তাকে আপন হেফাজতে রেখে দেন।
এর কয়েক দিন পরেই ভদ্রমহিলার স্বামী ‘বেঙ্গল’ পত্রিকায় এক দীর্ঘ প্রবন্ধে এই কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনাটি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন, সহৃদয় পুলিশ যুবকটির সাহায্য না পেলে তার যে কী বিপদ হত, তা চিন্তা করাও কঠিন।
মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বের পরিচয় দেবার সুযোগ পুলিশ কর্মচারীদের যেমন আছে তেমন আর কারো নাই।
দুর্বলের যারা রক্ষক, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে যাদের জীবন, তারা কি লোভের সম্মুখে বিচলিত হবেন? শুধু অবস্থা ভালো করে কি হবে? মনুষ্যত্বের কাছে আর কি অধিকতর গৌরবের বিষয় আছে?
কয়েক বৎসর আগে একজন লোককে একটা জাল টাকা নিয়ে কলিকাতার এক মিঠাইওয়ালার দোকানে গিয়ে কিছু মিঠাই চাইতে দেখেছিলাম। দোকানদার মিষ্টান্নগুলি একটা পাতায় বেঁধে লোকটির হাতে দিয়েছে, আর ডান হাতে টাকা ধরেই চিৎকার করে বলে উঠল–শয়তান! পাজী’–আরও অনেক অশ্লীল ভাষায় সে গাল দিল। গোলমাল শুনে,আমি এগিয়ে গিয়ে শুনতে পেলাম, পথিক সবিনয়ে বলছে, “ওটি জাল টাকা তা আমি জানি নে, তুমি মাফ কর। আমার কাছে আর পয়সা নাই। তোমার মিঠাই তুমি ফিরিয়ে নাও।” মিঠাইওয়ালা বললে, “তোমার ছোঁয়া জিনিস আর ফিরিয়ে নেবো না–পয়সা ফেলো, নইলে জুতো খাবে।” পথিক ভারি অপ্রস্তুত হল! তার হাতে সত্য সত্যই আর পয়সা ছিল না। টাকাটি জাল তা পথিক জানত বলেই মনে হল, অভাবগ্রস্ত বলে ক্ষুধায় কাতর হয়ে মিঠাইওয়ালাকে ফাঁকি দিতে চেয়েছিল। তার চোখে-মুখে অপরাধীর দীনতা, আমি দেখতে পেলাম। এমন সময় হঠাৎ একটি ভদ্রলোক এসে তার পকেট হতে পয়সা তুলে মিঠাইওয়ালার দাম চুকিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে সে স্থান ত্যাগ করলেন। অপরাধী লোক। তার আন্তরিক কমতোজ্ঞতা কিছুতেই চেপে রাখতে পারল না; সে ভদ্রলোকের পেছনে পেছনে ছুটল, আমিও তার পেছনে পেছনে চলোম–লোকটি কী বলে, আর ভদ্রলোকই বা কী বলেন, তাই শোনার জন্যে।
অনেক দূর দৌড়িয়ে গিয়ে ভদ্রলোকটির সম্মুখে দাঁড়ালাম। অপরাধী পথিকটি তখনও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করছিল। আমি দেখলাম সেই ভদ্রলোকের মুখে খোদার জ্যোতি। খোদাকে চোখে দেখি নাই, কিন্তু মানুষের মুখে তার ছায়া দেখলাম।
নিম্নস্তরের লোক, যাদের কৃষক বলে অবজ্ঞা করি, তাদের ভিতর খোদায়ি (Divine) ভাব কেমনভাবে ফুটে উঠে, তা নিম্নলিখিত আর একটি ঘটনায় বেশ জানা যাবে।
অনেক বছর আগে একদা চুয়াডাঙ্গা হতে ঝিনাইদহ মহকুমা পর্যন্ত যে রাস্তা এসেছে, ঐ রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলাম। তখন হেঁটে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। রাস্তা দীর্ঘ ৪০ মাইল। পথের মাঝখানে একটা পুকুরের ধারে বসে এক কৃষককে বিড়ি খেতে দিয়েছিলাম। তখন আমার বাল্যকালের ধূমপানের কুঅভ্যাসটি ছিল।
এক দু’বছর পর আর একদিন আমি চুয়াডাঙ্গা হতে রওয়ানা হই। রাস্তা অতিশয় বিপজ্জনক–দুই ধারে বিরাট মাঠ। ১৬ মাইল আসার পর সন্ধ্যা হয়ে গেল, পাগুলিও অবশ হয়ে এসেছিল; কোথাও আশ্রয় চাইবার অভ্যাস আমার ছিল না। এদিকে ওদিকে না চেয়ে অতিকষ্টে অগ্রসর হতে লাগলাম। ক্রমে রাত্রি অনেক হল, আমিও আর পথ চলতে পারি না। যতই অগ্রসর হই পথ ততই দীর্ঘ বলে মনে হতে লাগল। ঝিনাইদহের প্রায় ৬ মাইল দূরে যখন এসে পৌঁছলাম, তখন দুই ধারে বিরাট দৈত্যাকার গাছের সারি–মনে হতে লাগলো, গাছের ডালে ডালে ভূতেরা সব হেসে বেড়াচ্ছে, জনমানবশূন্য রাস্তা। চাঁদের আলো ঘনসন্নিবিষ্ট গাছের ভিতর দিয়ে অস্পষ্টভাবে এখানে-ওখানে উঁকি মারছিল।