মানুষ দেবতা বলেই সে মানুষের জন্য শোক করে। আত্মা তার স্নেহ-মমতার আধার বলেই বিরহ-বেদনায় কাতর হয়; সমস্ত প্রকৃতির মাঝে আপন চিত্তের শোকধ্বনি শুনতে পায়। পশুর কোনো শোক নাই, তার বিরহ-বেদনা নাই।
মানুষের কী অপরিসীম সাহস! কী তার হৃদয়ের বল! জগতের কোনো ব্যথা, কোনো ভয় তার গতিকে রোধ করতে পারে নি। বজ্র অপেক্ষা সে ভীষণ, বিদ্যুৎ অপেক্ষা সে দীপ্তিশালী। সে মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করেছে, কামানের সম্মুখে নির্ভয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড় ভেঙ্গে ছিন্ন বিচ্ছিন্নরেছে, সমুদ্রকে সে অঞ্জলি আবদ্ধ জলবিন্দু মনে করেছে।
যে মানুষ এত বড়, তার কি কাপুরুষতা, ভীরুতা সাজে! প্রাণভয়ে মৃত্যুর আগেই মরা কি তার শোভা পায়?
মনুষ্য কি নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সংবাদ নিয়েছে? নিঃস্ব পীড়িত আর্ত তার করুণ নয়নের দৃষ্টিলাভ করেছে? সে পশুর মতো পাশ কাটিয়ে স্বার্থ ও লাভের গন্ধে ছুটে নাই। বিশ্বের যেখানে ব্যথা, যেখানে হাহাকার, সেখানে সে তার সর্বস্ব নিয়ে আকুল হয়ে ছুটেছে। এই-ই মানুষের স্বভাব। সে দুঃখী সংসারের সম্মুখে আপন মুখে অন্ন তুলে দিতে পারে নাই, প্রাণ তার প্রেমের বেদনায় কেঁদে উঠেছে। ধন্য মানুষ! তোমায় নমস্কার করি। মনুষ্য যেখানে প্রেমের নামে জাতি-বিচার করে, দুঃখীকে অবিশ্বাসী কুকুর বলে গালি দেয়, তখন তা মানুষের কথার মতো শোনা যায় না।
মানুষে যখন মানুষের উপর অত্যাচার করে, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে, মানুষকে চূর্ণ করে আনন্দলাভ করে, মানুষকে ব্যথা দেয়, মানুষ যখন অপ্রেমিক, নিষ্ঠুর, কাপুরুষ, মিথ্যাবাদী, নীচ, আত্মমর্যাদাজ্ঞানহীন, নিন্দুক এবং বিশ্বাসঘাতক হয়, যখন সে মোনাফেক শয়তান এবং ক্রুর হয়, সে যতই উচ্চাসন লাভ করুক, সে পশু। সে আর তখন মানুষ থাকে না।
মানুষ কি নিজের গৌরব ও মর্যাদা রক্ষা করতে চেষ্টা করবে না? আত্মার গৌরবে কি সে তার জন্ম সার্থক করবে না?
০৬-১০. জীবনের মহত্ত্ব
০৬. জীবনের মহত্ত্ব
প্রায় ৩২ বৎসর আগে খুলনার এক স্টীমার থেকে একজন বুড়ো আর একটি ছোট মেয়ে নামলেন। ঠিক তাদের সঙ্গে একটি যুবক অবতরণ করলেন। যুবকটি খুব সম্ভব বাগেরহাটের উকিল, সবে বারে যোগ দিয়েছেন।
বুড়ো দুর্বল, কুঁজো হয়ে হাঁটছিলেন। একটু পথ হেঁটে আর একখানি স্টীমারে চড়তে হবে, বালির চরায় নদী ভরাট হয়ে গেছে, তাই স্টীমার কোম্পানী দু’ধারে দু’খানা স্টীমারের ব্যবস্থা করেছেন। ৮/৯ বৎসরের ছোট্ট মেয়েটি একটা বৃহৎ বোঝা এক হাত দিয়ে পিঠে তুলে নিচ্ছিল অন্য হাত দিয়ে বুড়োর দুর্বল হাত চেপে ধরেছিল।
বুড়ো সস্নেহে বলছিলেন, “তুই কি অত বড় বোঝা নিতে পারবি, আমায় দে।”
মেয়ে ততোধিক স্নেহে বলছিল, “দাদা, তুমি দুর্বল, হাঁটতে পারছ না, তোমাকে আমি শক্ত করে ধরছি। এ বোঝাটা তুমি নিতে পারবে না, আমিই বেশ পারব।” বোঝার ভারে মেয়েটি কাঁপছিল, কিন্তু স্নেহ প্রদর্শনে তার ক্লান্তি নেই।
এই স্বর্গীয় দৃশ্যটি যুবক চেয়ে দেখলেন, তারপর নিকটে এসে বললেন, “মা লক্ষ্মী, দেখ, আমার গায়ে অনেক বল আমার হাতে ঐ বোঝাটি দাও; আমি বয়ে নিয়ে দেবো, তুমি তোমার দাদার হাতখানি শক্ত করে ধর।”
মেয়েটি যুবকের দিকে সকরুণ নেত্রে চেয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। যুবক তৎক্ষণাৎ ভারী বোঝাটা দৃঢ়-বাহুর একটানে পিঠের উপর ফেলে চলতে লাগলেন। বুড়ো যুবককে প্রাণভরে দোয়া করলেন।
জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজে আমরা যে দয়া ও মহত্ত্বের পরিচয় দিতে পারি, তা একটা সুবর্ণ মুদ্রার মতোই মূল্যবান এবং উজ্জ্বল! তা একেবারে খাঁটি সোনা–আঘাত করলে তার মাঝে একটুখানিও নকল পাওয়া যায় না।
কৃপণ জীবন ভরে এক একটা মুদ্রা প্রাণের রক্তের মতো সঞ্চয় করে। আমরা কি সুন্দর সুন্দর মহৎ কাজ করে, কৃপণের মতো জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজের সুবর্ণ মুদ্রাগুলি সঞ্চয় করতে পারি না? তাতে যে আমাদের জীবনের মূল্য কত বেড়ে যাবে?পার্থিব ধন-সম্পদ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিনষ্ট হবে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহৎ কাজগুলি যেমন আমাদের চিত্তকে প্রসন্ন করে, তেমনি অক্ষয় সুবর্ণরেখার মতো চিরদিন মনুষ্য আত্মাকে সম্পদশালী করে।
পুলিশের নাম শুনলে মানুষ বিরক্ত হয়, থানা-ঘর দেখলেই সেইখান থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষ ঘৃণায় সরে যায়। মানুষ থানা-ঘরের মর্যাদা নষ্ট করছে, কিন্তু যে স্থানে পীড়িত মানুষ নিজের মর্মব্যথা নিবেদন করে, যেখানে অত্যাচারিত দীন-দুঃখী আশ্রয় পায়, সেই স্থান কি সত্যই অপবিত্র? মানুষ নিজের দোষে থানা-ঘরের মর্যাদা নষ্ট করেছে। পবিত্র বিচারস্থানের মূল্য এবং মর্যাদা প্রকৃত খোদাভক্ত এবং ধার্মিক লোকদের কাছে চিরদিনই অক্ষুণ্ণ থাকবে–তারা থানা-ঘরের সংস্রবেই বা বাইরের লোকই হন।
আলী নামক এক পুলিশ কর্মচারী একদা এক রেল স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন, এক অনিন্দ্যসুন্দরী মহিলা স্টেশনে কাউন্টারের কাছে এসে খুব ব্যস্ততার সঙ্গে টিকেট চাইল। স্টেশন মাস্টার বললেন, এখানে অপেক্ষা করুন, রাত্রিকালে গাড়ি আসবে, সেই গাড়িতে যাবেন।
যুবক দেখলেন–মাস্টারের ব্যবহার সন্দেহজনক। মহিলাটি ভদ্রঘরের বলেই মনে হয়; মাস্টারের কথায় সন্দেহ করে মহিলাটি আর বিলম্ব না করে বিনা টিকেটেই গাড়িতে উঠে পড়ল। পুলিশ যুবকটিও তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মহিলাটির উপর রেখে মহিলার গাড়িতেই এক প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন।