মানুষকে পশুর সঙ্গে তুলনা করে কেন? মানুষের প্রবৃত্তি কী, পশুর প্রবৃত্তিই বা কী? পশুরা আপন পত্নীকে খুব ভালোবাসে, কিন্তু খাবার বেলায় দেখতে পাই, সে পত্নীকে ফাঁকি দিয়ে নিজেই খায়, পশু পিতা সন্তান পালন করে না, বরং বাচ্চাগুলো নিকটে এলে পশু পিতা অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়, নিকটে এলে তাড়িয়ে দেয়। সে নিজের ভালো, নিজের লাভই বেশি বোঝে, সে কখনও পরের চিন্তা করে না, সে দুর্বলকে আঘাত করে এবং অপেক্ষাকৃত শক্তিশালীর কাছে সভয়ে মাথা নত করে। তার আপন-পর জ্ঞান নাই, সুযোগ পেলেই পরের জিনিস চুরি করে। নিজের কোনো অন্যায় দেখলে আপত্তি করে না। কেউ বিপদে পড়লে তার উদ্ধারের জন্য অগ্রসর হয় না। কোনো কোনো সময় দেখতে পাওয়া যায়, আপন জাতির কাউকে বিষণ্ণ দেখলে তাকে আরও আঘাত করে, তার লজ্জা নাই, তার কোনো সম্মান-জ্ঞান নাই। আপন আপন স্বামী এবং পরীর কাছে সে বিশ্বস্ত থাকে না। সে শোক করে না–আত্মীয় বিরহে তার কোনো বেদনা বোধ নাই। তার কোনো ধর্ম নাই, সে
অতিশয় ভীরু। যেখানে স্বার্থ দেখে সেখানেই উপস্থিত হয়। . মানুষের স্বভাব এর সম্পূর্ণ বিপরীত, যেখানে মানুষকে পশুর মতো দেখি সেখানে আমরা তাকে পশু বলে ঘৃণা করি। সেখানে মানুষ পশু অপেক্ষা নিকৃষ্ট স্বভাবের পরিচয় দেয়, সেখানে তাকে ঘৃণায় পশ্বাধম বলে গালি দেই।
মানুষে আর পশুতে পার্থক্য আকাশ-পাতাল, মানুষ স্বর্গের দেবতা, তারার মতো সুন্দর,–পশু মর্তের নিকৃষ্ট জীব, রাত্রির মতো মসিমলিন।
মানুষ ভালোবেসে, যা-কিছু আছে সবই দান করে। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে সে সব দিয়ে দেয়, রিক্ত হস্তে দাঁড়িয়ে ধন্য হয়। সে যাকে ভালোবাসে, তাকে সর্বপ্রকার সুখী করতে চায়, নিজে না খেয়ে তাকে খাওয়াতে চায়। মানুষের প্রেমের এটাই স্বভাব। ইহাতেই তার আনন্দ। মানুষ সন্তানকে হৃদয়ের টুকরা মনে করে, স্ত্রী-পুত্রের জন্যে সে বিপদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপদকে সে বিপদ মনে করে না, পরের জন্য দুঃখভোগ করতেই তার আনন্দ। এক একটা পশ্চিমা দারোয়ান বিদেশে ৭/৮ টাকা বেতনে, ছাতু খেয়ে মাটির উপর শুয়ে বৎসরের পর বৎসর কাটিয়ে দেয়; মাসটি গেলে কত আনন্দে সে পত্নীর কাছে টাকা পাঠায়। কীসের জন্যে। সে এত কষ্ট সয়?–না, তার স্ত্রী-পুত্র খাবে। পশ্চিমা ছেলেগুলি মাস অন্তে কত আনন্দে মায়ের কাছে দুই তিনটি টাকা পাঠায়। মানুষ নিজে খেয়েই শুধু সুখী হয় না, আত্ম-সুখের জন্যে সে শুধু দুঃখের সাগর পাড়ি দেয় না। হাজী মোহাম্মদ মহসিন, ডাক্তার পালিত ঘোষ, করটিয়ার –চাঁদমিয়া সর্বস্ব দান করে রিক্ত হস্তে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। এই-ই মনুষ্য দেবতার স্বভাব। পশুর মত চীৎকার করে, সকলকে দংশন করে, নিজের উদর ভর্তি করাকে সে ঘৃণা করে। মানুষ মানুষের দুঃখ-ব্যথার কথা চিন্তা করে, লোকচক্ষুর অগোচরে নানা বেদনায় ফুলে ফুলে কাঁদে। কী প্রেম তার চিত্তে! মানুষ দুর্বলের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, পশুর মতো পীড়িতকে দুঃখে ফেলে সে ত্যাগ করে না। লাঞ্ছিত-অত্যাচারিতকে সে সকলের নিষ্ঠুর আঘাত থেকে রক্ষা করে। সে নিঃসহায়া নারীকে নিজের প্রাণ বিপন্ন করে রক্ষা করে, কারণ সে যে মনুষ্য দেবতা। প্রেম দিয়ে তার চিত্ত গড়া। প্রেম করা, আঁখি জলে কাদা, মানুষের দুঃখে বিগলিত হওয়াই তার স্বভাব। মানুষ যখন পশুর মতো হীন হয়ে আপন সত্য স্বভাবের পরিচয় দেয় না, তখন মানুষের আকৃতি ধারণ করলেও সে সত্যিকার মানুষ থাকে না–সে পশুর স্তরে নেমে যায়। মর্যাদা রক্ষার জন্য মনুষ্য প্রাণ দেয়, তবুও অন্যায় ও মিথ্যার কাছে সে মাথা নত করে না। কারবালা প্রান্তরে পিপাসিত, ক্ষুধার্ত মানব দেবতা চরম দুঃখে নিজের মর্যাদা রক্ষা করেছেন, তবুও দুর্মতির কাছে মাথা নত করেন নাই, তার অনুগ্রহ স্বীকার করেন নাই। ইহাই মানুষের মহত্ত্ব। অন্ধকারে কেহ যেখানে তাকে দেখে নাই, সেইখানে সে নিজের পাপ নিজে দেখেছে এবং শঙ্কিত হয়ে নিজেকে শাসন করেছে–নিজ পাপে সে নিজেই লজ্জিত হয়েছে। মনুষ্য নিজের জাতির জন্য বর্তমান ও অতীতে কত দুঃখই না সয়েছে, ইতিহাস তার প্রমাণ। নিজের রক্ত দিয়ে ধুলার সঙ্গে মিশে যে জাতির ভবিষ্যৎ কল্যাণের পথ প্রস্তুত করেছে, কেউ তাদের সংবাদ রাখে নি। এই-ই মনুষ্য দেবতার স্বভাব। নিজের দেশের মানুষ দেখলে মানুষের প্রাণ আনন্দে নৃত্য করে উঠে, প্রেমে তার কণ্ঠবেষ্টন করে সে যে কত বড় তারই পরিচয় দিয়েছে।
মানুষের জন্যে রাজ-সিংহাসন ত্যাগ করে পথের ভিখারি হয়েছে, ঐশ্বর্য বিলাস অস্বীকার করে সে পথের ফকির হয়েছে।
বেহেস্তের কন্যা নারী আপন সতীত্ব রক্ষার জন্যে দস্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, সে জীবন দিয়েছে, তবু স্বামী ত্যাগ করে পরের অঙ্গশায়িনী হয় নি। যেখানে নারী ব্যভিচারিণী, সেখানে নারী আর নারী নয়–সে পশু।
মানুষের জন্যে মানুষ কী কঠিন শোকই না করেছে। মানুষের জন্যে মানুষের কী অপরিসীম বেদনা! কী অতুলনীয় প্রেমের অনুভূতি তার। সে আপন সন্তানের জন্য, আপন প্রণয়ী ও প্রণয়িনীর জন্য পথে কেঁদে মরেছে। পৃথিবীর কোনো আকর্ষণ তাকে আনন্দ দেয় নাই। চিরজীবন সে হাসে নাই। পথে পথে বনে বনে ঘুরে, পাহাড় ভেঙ্গে, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে তার মহাপ্রেমের পরিচয় দিয়েছে। সে ধন্য।