হে ভণ্ডেরা, মোহাম্মদ (সঃ) তোমার কাছে দরুদ চান নাই। আবার বলছি, তোমরা অযথা দরুদ পাঠ করো না। মোহাম্মদ (সঃ) দেখতে চেয়েছেন যারা তাকে প্রেম করে, তারা মানব-প্রেমিক কিনা, তারা সর্বপ্রকার অহঙ্কার বর্জন করেছে কিনা, দিকে দিকে আল্লাহর বাক্য তারা বহন করেছে কিনা। হাত-পায়ে সাবান লাগাবার মসলা (ব্যবস্থা) তোমরা প্রচার করো না, এতে তিনি সত্যিই লজ্জিত হন। ইসলাম মানে এ নয়।
সত্য বলতে কী, সমস্ত মানব জাতির জন্য মাত্র একটি ধর্ম আছে, সমস্ত মানুষই মুসলমান হবার জন্য, পরম শান্তির জন্যে লালায়িত। মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনো বিরোধ নেই, বিরোধ আছে শুধু শয়তানের এবং আল্লাহর। আমরা সবাই আল্লাহকে চাই,পরম শান্তি চাই, ইহাই ইসলাম, পরম শান্তি। সব ধর্মেরই সমস্ত মানব-চিত্তের ইহা অপেক্ষা পরম লাভ আর কি আছে? শুধু শয়তানের সঙ্গে বিরোধ কর। সকল জাতির মানুষ সমস্ত হানাহানি ত্যাগ কর, সর্ববিধ পাপ বর্জন কর। আত্মার পক্ষে যাহা কিছু অসম্মানজনক, তাহা ত্যাগ কর। এটাই পরম শান্তির পথ। মনুষ্যকে এই পরম শান্তির পথে আকর্ষণ কর, মানুষকে বিনষ্ট হতে দিও না। জীবনের সমস্ত সাধনা, শক্তি, ধন-সম্পদ এরই জন্যে, জীবনের আর কোনো সার্থকতা নাই।
.
০৫. সংস্কার মানুষের অন্তরে
অভাবে মানুষের দুঃখ হয় না, রোগ-শোকের যাতনা মানুষ ভুলতে পারে, কিন্তু মানুষের নীচতা দেখে যে দুঃখ হয়, তার তুলনা নাই।
মানুষের প্রবৃত্তি যদি পশুর মতোই হবে, যদি তার হীনতায় সে লজ্জিত না হয়, তবে কেন সে পশুর আকার ধারণ করে নাই? কেন সে আপন দেহ পোশাকে ও লজ্জায় ভূষিত করে? যদি রাজ্য হারিয়ে থাক, দুঃখ করো না, যদি তোমার পরম আত্মীয়েরা ত্যাগ করে গিয়ে থাকে তবুও দুঃখ করো না, যদি তোমার প্রবৃত্তি নীচ হয়, যদি ইতর পশুর আত্মার স্বভাবে তোমার আত্মার অবনতি ঘটে থাকে, তাহলেই লজ্জিত হও। তোমার চশমা, তোমার ঢেউ-তোলা চুল, সুবাসিত গন্ধ তেল, তোমার শার্ট, কোচান ধুতি তোমার গৌরব বর্ধন করবে না।
কোনো দুঃস্বভাবে লজ্জিত হও না?–অপরের দোষ দেখে আঘাত কর, নিজের দোষের পানে একটু তাকাও না? একটু লজ্জিত হও না? মানুষের দোষ-ক্রটি অম্লান বদনে সমালোচনা কর, নিজের দোষ-ত্রুটির বিষয় একটুও ভাবো না! পরের চোখে একটা কাল দাগ দেখে লাফিয়ে উঠেছ, নিজের চোখে সরষে ঢুকছে, তা দেখ না? কেন আপন স্বভাবকে সমর্থন করার জন্যে মানুষের সঙ্গে তর্ক কর? অন্ধকারে নিজের মনের দিকে চেয়ে দেখ–কত কালি, কত মিথ্যা, কত প্রতারণা, কত শঠতা সেখানে রয়েছে। নিজের অপরাধের কথা ভেবে লজ্জা লাগে না? কেবলই পরের কথা ভাব? মানুষ তোমাকে চুরি করতে দেখে নি, তা বলে তুমি চোর নও? অন্তরের পাপ মুখোনি একবার ভালো করে দেখে নাও! তুমি কি অন্যায় করে কারো মনে আঘাত দিয়েছ? তাহলে গোপনে ক্রন্দন কর। তার কাছে ক্ষমা চাইবার আগে মসজিদ ঘরে যেয়ো না। তোমার ভাই বা পিতাকে ফাঁকি দেবার জন্যে কোনো মিথ্যা কথা বলেছ কী? তাহলে লোক চক্ষুর আগে চেয়ে আপন মনে লজ্জিত হও। কাউকে বঞ্চনা করেছ কি? তুমি কি অকৃতজ্ঞ? তুমি কি মিথ্যাবাদী? তাহলে লজ্জিত হও। মনুষ্য সমাজে বের হয়ো না।
হাইরোক্লিস বলেছেন, সংস্কার নিজের অন্তর থেকেই হবে। আপন আত্মার দিকে প্রথমেই ফিরে তাকাও। তারপর পরের কথা ভেবো। নিজেকেই প্রথমে প্রেম করো। নিজের জাহাজ ভেঙ্গেছে, সেই কথা আজ ভাব, নিজেকে বাদ দিয়ে মানুষকে সত্যপ্রিয় হতে বলো। নিজের নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ করে, অপর মানুষকে মধুর কথা বলতে অনুরোধ করো। নিজের কথাই আগে ভাবতে হবে। নিজের কর্তব্য আগে পালন কর, তারপর অন্যকে উপদেশ দিও, অপরকে তার কর্তব্য পালন করতে অনুরোধ করো।
যে নিজে নীচাশয়, সে অন্যকে কেন নীচ বলে গালি দেয়? যে নিজে ভুলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, সে কেন অন্যের ভুল ধরে? জীবনের কোনো কিছুতেই আনন্দবোধ করো না–যদি না নিজেকে পশুর স্তর থেকে মানুষের আসনে উন্নীত করতে পার। তুমি কি ধনশালী হয়েছ? ব্যাংকে কি লক্ষ টাকা জমাতে পেরেছ? তাহলে এমন কি আনন্দের বিষয় আছে–সমুদ্রগর্ভে কি অপরিমিত মণিরহ থাকে না? পর্বতের অন্ধকার গুহায় কি বহুমূল্য প্রস্তর নাই?
তোমার পোশাকের গর্ব কর। ক্ষেতের পুষ্প কি তোমাদের চাইতে অধিক সুন্দর নয়। মনুষ্য তোমাদের অর্থ এবং মূল্যবান পরিচ্ছদকে নমস্কার করে না–তোমাদের দংশনকে, তোমাদের আঘাতকে তারা ভয় করে; তাই তোমাদের শক্তি, অর্থ ও গর্বের সম্মুখে মাথা নত করে। বস্তুত অর্থের গৌরবে মনুষ্যের শ্রদ্ধালাভ করতে যেয়ো না–জমিদারির শক্তিতে মনুষ্যকে ঘৃণা করো না। এ দাবি কোনো দাবিই নয়।
তুমি কি মনুষ্যকে প্রেম কর? তুমি কি সহৃদয়? মনুষ্য তোমাকে দেখে কি আনন্দিত হয়? তুমি মানব-মঙ্গল চাও? তোমার জীবনে কি পৃথিবীর এবং মানব সমাজের কোনো কল্যাণ হচ্ছে? তুমি কি মনুষ্যকে আল্লাহর পথে আকর্ষণ করে থাক? তুমি কি মনুষ্যকে সত্যময় হতে উপদেশ দিয়ে থাকো? তাহলে মনুষ্যের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার দাবি তুমি করতে পার।
মন পরিবর্তন কর। মনের গোপন পাপ ধুয়ে ফেল। যতই কেন ধার্মিকের বেশ ধারণ কর না, অন্তরের গ্লানি ধুয়ে না ফেললে তোমাকে যথার্থ ধার্মিক বলা হবে না। মানুষ শরীরের গৌরবে বড় নয়। আত্মার গৌরবে যে বড় হতে চায় না, সে মানুষের জন্য নয়। সে পশু জাতীয়।