কত পাপ, কত অন্যায়, কত প্রকার হীনতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে অপবিত্র করে, আমাদের আত্মাকে কতখানি মলিন করে। দিনের মধ্যে কতবার আমরা মিথ্যা পক্ষ সমর্থন করি। দিনের প্রভাতে উঠে আমরা দেখতে পাই উদার, নীল গগন শী–কী সুন্দর! কী শোভাময়! তারপর পূর্বাকাশের নির্মল প্রভাত ছবি–গাছে গাছে স্বর্গের কী মোহন মাধুরী! বিশ্বময় নির্মলের দেবতাকে একবার প্রণাম কর-তারপর মানুষের মুখের দিকে চেয়ে দেখ।
যত প্রকার পাপ আছে, মানুষের চিত্তে ব্যথা দেওয়াই তার মাঝে বড় পাপ। এ মহাপাপ কেউ করো না! ক্ষমতা এবং বাহুর গর্বে, জনবলের গর্বে মানুষের মুখের দিকে চেয়ে কঠিন কথা বলো না। সরে এস, ভীত হও।
এমন সুন্দর আলো-বাতাস প্রবাহে, এমন সুন্দর বিধাতার আশীর্বাদ ঐশ্বর্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে, হে মানুষ–সর্ব পাপমুক্ত হবার দুর্জয় প্রতিজ্ঞা কর। বিধাতার জড়সৃষ্টির মত তুমি নির্মল হও।
প্রভাতে উঠেই কী ভাবছ?–হিংসা প্রতিশোধের বিষ তোমার নির্মল আত্মাকে বিষাক্ত, অপবিত্র করে দিচ্ছে? সতর্ক হও, কী চিন্তা করছ? কার ক্ষতির চিন্তা মনে জেগেছে? কার পানে মন তোমার নিষ্ঠুর বিরূপতায় বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে? ক্ষান্ত হও! মানুষকে প্রেম করতে শেখ।
ঘর হতে বের হয়ে যাও। পথে পথে মানুষের সুন্দর, শুভ মুখ দেখে জীবন সার্থক কর–মনুষ্যকে আলিঙ্গন কর।
মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করো না-এই মহাপাপ হতে সরে এস, মানুষের সঙ্গে শঠতা করো না, মনুষ্যকে গালি দিও না। সর্ব প্রকারেই জীবনকে সফল ও সুন্দর করে তুলতে চেষ্টা কর। মানুষকে চিনি না এ কথা কাউকে বলো না।
তোমার আত্মসর্বস্ব জীবনের কথা ভেবে তুমি লজ্জিত হও। মানুষ নিজের জন্য বেঁচে নেই। অনেক টাকা-কড়ি উপায় করছ, আরও টাকার জন্য ব্যস্ত হয়েছ? এই টাকা-কড়ি আহরণ করার অন্তরালে কী উদ্দেশ্য তোমার আছে! তোমার সমস্ত জীবন-স্পন্দনের মাঝে দাঁড়িয়ে যে সমস্ত মহাপুরুষ অদৃশ্যভাবে তোমার জীবনকে পরিচালিত করেছেন, তাঁরা মানবজীবন সম্বন্ধে কী বলেছেন? মানুষ কি বেঁচে আছে নিজের জন্যে?–মানুষের নিজের অভাব কতটুকু? আর জগতে রাজা হয়েই বা কী লাভ?–অপরিসীম প্রতিপত্তি লাভ করেই বা কী এমন লাভ আছে, যদি না দুর্বলের পার্শ্বে যেয়ে দাঁড়াও? যদি না মানব-দুঃখ তোমাকে ব্যথিত করে?–মানব সেবার জন্যে যদি না তুমি তোমার সমস্ত ধন-সম্পদ, সমস্ত জ্ঞান ও শক্তি নিয়ে অগ্রসর হও? কী লাভ হবে বড়লোক হয়ে?–কতদিন মানুষ তোমার নাম করবে? তোমার চাইতে অনেক শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী মানুষ মাটির ধূলার সঙ্গে মিশে গেছে। তুমি কোন ছার!
মন যার পাষাণ, মানুষকে শুধু উপদেশ দিয়েই যে কর্তব্য শেষ করে, প্রেমে অগ্রসর হয় না, দুর্বল, অপরাধীকে ক্ষমা করে না, সে মানুষ নহে।
এ শিক্ষা মনুষ্য কোনো পুস্তক, কোনো বক্তৃতা হতে পায় নাই, এ শিক্ষা, এ প্রেমের শিক্ষা মানুষ আপনা আত্মা হতেই পেয়েছে। সমস্ত ধন-সম্পদ দিয়ে তোমার আত্মার প্রেমকে সার্থক করতে হবে। পশুর মত আপন বিবরে প্রবেশ করো না–মানুষের কথা ভাব–মানুষের প্রতি তোমার কর্তব্য আছে। এই কর্তব্য উদযাপনের নাম এবাদত, তা শুধু প্রাণহীন আবৃত্তি নয়।
দুঃখের সামনে, ব্যথার সামনে, নিষ্ঠুর পাষাণের মতো স্থির হয়ে থেকো না। মানব দুঃখের সম্মুখে আপন পত্নীর প্রেমে পূর্ণ থেকো না। অবিচারের সম্মুখে আপন পুত্রের মুখে চুম্বন দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করো না।
ধর্মগ্রন্থ তোমায় কী দীক্ষা দিয়েছে? ইঞ্জিল, জব্দুর, তৌরাত, কোরান এবং পবিত্র হাদীস সমষ্টি কী শিক্ষা তোমায় দিয়েছে? তোমাকে স্নেহশীল, প্রেমিক হতে বলে নি? কতবার কতভাবে তোমাকে বলেছে, হে মানুষ, প্রেমিক হও, পাষাণ হয়ো না।
আত্মার প্রেমকে সার্থক করবার জন্যে,–মনুষ্য জীবনের দানকে সার্থক করবার জন্যেই রত্ন সংগ্রহে দিকে দিকে ছুট। মনুষ্যকে পূর্ণ করবার জন্যে নিজের পরিবারের সুখের জন্যে, মানুষের ধনরত্ন কেড়ে এনে বাক্সজাত করো না। মনুষ্য যে তোমার ভাই, এ কথা কি তুমি জান না? এ কথা তো যুগে যুগে আল্লাহর বাণীরূপে তোমরা পেয়েছ, তবুও তা বিশ্বাস করো না? মনুষ্য সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে কি আনন্দ-রসে পূর্ণ হয়ে উঠতে পার না? তাকে কি কাছে বসাতে জান না? মনুষ্য হয়েও কেন মনুষ্যকে এত বিষ নয়নে দেখ? এই তোমার ধর্ম?–যাও, ফিরে যাও। ভালো করে চিন্তা কর, তোমার ধর্ম কী? মিথ্যা করে তাড়াতাড়ি চিন্তা করে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করো না।
মনুষ্যকে প্রেম করাই আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এ ছাড়া মনুষ্যের জন্যে দ্বিতীয় কোনো ধর্ম নাই। মনুষ্যকে প্রেম কর–মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার কর। মনের হৃদয়ে ব্যথা অনুভব কর। পৃথিবীর দুঃখ তোমরা সকল ভাই সমান ভাগ করে নাও। মানব সমাজের জন্য জগৎ স্বর্গে পরিণত হোক–ধর্মের নামে মিথ্যাচরণ করো না।
দরিদ্র সন্তানের সম্মুখে নিজের সন্তানকে সজ্জাভূষিত করো না–এ নিষ্ঠুর কাজ। আবার বলি, মনুষ্যকে আত্মীয়ের চোখে, প্রেমের চোখে দেখ। পরিচিত বেগানার মতো মানুষের দিকে চেয়ে দেখ না। কীসের তোমরা গর্ব কর?–বংশ মর্যাদার? অর্থের? বেশ ভূষার? অট্টালিকার? জমিদারির? তোমরা জান না-মানুষ কীসের গর্ব করতে পারে! তোমরা যে কত নত হয়েছ, সেই গর্ব কর, প্রেমের গর্ব কর, মনুষ্যত্বে পরস্পরের প্রতিযোগিতা কর। সেবার এবং ত্যাগের প্রতিযোগিতা কর। সত্য বলছি, যে নত হতে পেরেছে, সেই তত শ্রেষ্ঠ হতে পেরেছে। মানুষের চোখে সে তত বড় আসন লাভ করেছে।