একটি যুবক, সে বক্তৃতা করতো, এক সংবাদ-পত্রিকার সম্পাদক সে। এক বুড়ির বাড়িতে সে যেত। বুড়ি তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত–স্নেহ করতো; এতটুকু অবিশ্বাস করতো না। বুড়ি উচ্চ-হৃদয় যুবককে গৃহে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতো। বুড়ির একটি মাত্র অবলম্বন ছিল তার বার বৎসরের প্রিয় সন্তানটি, দেখতে বেহেশতের পরীবালকের মতো। এই যুবক বালকটিকে ভালোবাসতো; বুড়ি প্রাণ ভরে দেখতো তার পিতৃহীন সন্তানকে যুবক ভালোবাসে, স্নেহ করে। প্রাণভরে সে যুবককে আশীর্বাদ করতো। একদিন যুবক এই শিশুর পবিত্র মুখে গোপনে চুম্বন করলো। সুকুমার স্বর্গের শিশুটি যুবকের মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে শিশুকে যুবক পাপের পথে আকর্ষণ করলো। তার সোনার হৃদয়-কুসুমে পাপের হলাহল ঢেলে দিল। বুড়ির নয়ন-পুত্তলির সর্বনাশ হয়ে গেল। বুড়ি তা জানতে পারলে না। তার সাজান বাগানে যুবক আগুন ধরিয়ে দিল। এখন দেখি বুড়ি অন্ধ, রাস্তায় রাস্তায় সে ভিক্ষা করে। তার সোনার যাদুটি মারা গেছে। শিশুটি ধীরে ধীরে পাপের পথে অগ্রসর হতে থাকে, তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, বিবিধ রোগে সে ভেঙ্গে পড়ে, সে মদ, গাঁজা, ভাঙ্গ খায়, পরে সে জেলে যায়, সেখানেই মরে। সেই সম্পাদক যুবককে কেউ জানে না, তাকে মানুষ নমস্কার করে। নিকটে এলে আসন এগিয়ে দেয়। অনেক টাকা তার। আমি তার মুখ দেখলে ভয় পাই। সম্মুখে সাক্ষাৎ শয়তান দেখে শিউরে উঠি।
এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির গৃহে তার সেয়ানা মেয়েটি থাকতো। মেয়েটির স্বামী বিদেশে থাকে। ভদ্রলোকের বাড়িতে তার এক দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয়ও থাকত। দেখলাম, একদিন সেই আদরের মেয়েটি সেই যুবকটির সঙ্গে গোপনে গোপনে আলাপ করছে। মেয়েটির মা বোনেরা তা জানে, জাতি যাবার ভয়ে কথা বলে না। নির্জন কক্ষে এই দুটি বিশ্বাসঘাতক নর-নারী কথা বলে, এক সঙ্গে খায়।
যুবকটি ভয় করে, অনিচ্ছা প্রকাশ করে; বিবাহিতা অবিশ্বাসিনী যুবতীটি তাকে বলে–কোনো ভয় নাই।
দুই বৎসর পরে দেখলাম, এক জায়গায় এক বাবুর গৃহিণীরূপে এই বালিকাটিকে। বাবু পরম বিশ্বাসে পত্নীর সঙ্গে প্রেমালাপ করছেন, পত্নীও স্বামীর সঙ্গে আনন্দে কথা বলছে।
এই দৃশ্য দেখে শোকে আমার চোখ জলে ভরে উঠলো। শয়তানের এই অভূতপূর্ব কীর্তির ছবি চোখ দিয়ে দেখলাম। অসহ্য দুঃখে ভাবলাম, মানুষের অত্যাচার এবং মূর্খতা-অবিচার আর শয়তানের প্রাণঘাতী কীর্তি!
এক মহাজন এক ব্যক্তিকে বিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। লোকটি একদিন মহাজনের সর্বনাশ করার জন্যে চালাকি করে ঘরে সিঁদ কেটে দুপুর রাতে কাঁদতে আরম্ভ করলো। লোকজন যখন জমা হল, সে কেঁদে বলল, তার সর্বনাশ হয়েছে–চোর তাকে সর্বস্বান্ত করে গেছে, কী করে সে মহাজনকে মুখ দেখাবে?’ প্রাতঃকালে সে মহাজনকে টেলিগ্রাম করল। থানার কর্মচারীর সঙ্গে রাত্রে গোপনে সে দেখা করল। চুরি যে ঠিক হয়েছে এবং সে যে নিঃস্ব হয়ে গেছে, তা প্রমাণ হয়ে গেল। তার মিছে সর্বনাশের কেউ প্রতিবাদ করলো না। করতে কেউ সাহস পেল না।
এই নিমকহারাম বিশ্বাসঘাতক লোকটি সেই টাকা নিয়ে এসে বাটীতে মসজিদ-ঘর তুলো। সেই ঘরে বসে সে বন্দেগী করে। মানুষের মুখে তার প্রশংসা ধরে না; কত মানুষ তার গৌরব করে, কত মৌলবীর মুরুব্বি সে, কত ভদ্রলোকের বন্ধু সে। আমি তার মুখ দেখলেই ভয় পাই, তার মুখে কার বীভৎস মুখ দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠি। ঘৃণায় সে স্থান ত্যাগ করি।
চল্লিশ বৎসর পূর্বে এক ব্যক্তি রেঙ্গুনে গিয়েছিল; সেখানে গিয়ে সে একটি বালিকাকে বিবাহ করেছিল। সেই বালিকাটি এখন যুবতী। যৌবনের রূপ-ঐশ্বর্য দেখে তাকে ভোগ করার লোভ সংবরণ করতে না পেরে, সে প্রতারণা করে তাকে বিয়ে করেছিল। যখন তার পিপাসা মিটে গেল। তখন একদিন আসি’ বলে ঐ যে পালিয়ে এল, আর কোনোদিন সেখানে গেল না। সেই বালিকা যে কত বৎসর ধরে পথের পানে তার প্রিয়তমের আশায় চেয়েছিল, তা কে জানে? এই যুবক একজন ধার্মিক ভদ্রলোক। সমস্ত ধর্ম সাধনাই তার ব্যর্থ হয়েছে। প্রভু আর আমি জেনেছি সে কে!
এক ব্যক্তি মরে গেছে। সে যে বিপুল সম্পত্তি রেখে গেছে তার জন্য তার বংশের মর্যাদা দেশ জোড়া। সে ছিল এক জমিদারের নায়েব। জমিদার বিশ্বাস করে তার সম্পত্তি নায়েবের হাতে দিয়ে আনন্দ করে বেড়াতো। ধীরে ধীরে জমিদারের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় করে বিশ্বাসঘাতক নায়েব নিজেই জমিদার হল। তার এখন কত সম্মান, মানুষ তার নামে দোহাই দেয়, কত ইট পাথর তার বাড়িতে। কত বড় বড় প্রতিমা তার ঘরে উঠে। আমি তার বাড়ির সামনে গেলেই হাসি-শয়তানের ভণ্ডামি দেখে জ্বলে উঠি, শয়তান মানুষকে কত রকমেই না প্রতারণা করে। কে তার মুখ মানুষের মুখে দেখতে সাহস পায়?
সৌরভ, সমস্ত পরিচ্ছদ, সমস্ত সৌন্দর্যের সাধ্য নাই শয়তানের কুৎসিত মুখচ্ছবি ঢাকে। যে তা দেখেছে, সেই ভয় পেয়েছে।
.
০৪. দৈনন্দিন জীবন
জীবনের প্রতিদিন আমরা কত মিথ্যাই না করি, সেজন্যে আমাদের অন্তর মানুষ লজ্জিত হয় না। আল্লাহর কালাম পাঠ করি, কিন্তু সে কালাম আমাদের প্রতারণা, মিথ্যা ও অন্যায় হতে রক্ষা করে না।
পুটার্ক (Plutarch) বলেছেন, যে বড় যুদ্ধে জয় লাভ করে, তার মনুষ্যত্ব সূচিত হয় না। প্রতিদিনের ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ব্যবহার, হাসি-রহস্য একটুখানি সহৃদয়তা, একটা স্নেহের বাক্যে মানুষের মনুষ্যত্ব সূচিত হয়। যে মানুষ জীবনে এক একটা দিন নিষ্ঠুর বাক্য, মানুষের সঙ্গে মিথ্যা ব্যবহার এবং প্রতারণা থেকে মুক্ত করে রাখতে পারবে জীবন শেষে সে দেখতে পারবে, সে তার জীবনকে সার্থক করেছে। প্রতিদিনকার জীবন যার নিষ্ঠুরতা, মিথ্যা ও প্রতারণায় ভরা-তার সমস্ত জীবনটাই একটা ভাঙ্গা ঘরের মতো অন্তঃসারশূন্য। প্রাতঃকালে উঠেই প্রতিজ্ঞা কর, “আজিকার দিনটা সফল ও সার্থক করবো! আমার আজিকার এই দিনের কার্যে যেন মানব সমাজ উপকৃত হয়। যার সঙ্গে কথা বলি, তাকেই যেন আনন্দ দিতে পারি, যেন কোনো কার্যে কাপুরুষ না হই। যেন এর প্রতিমুহূর্ত আমার জীবনে সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায়।”