.
০৩. শয়তান
প্রভু! বীভৎস ঘৃণিত কুৎসিত মুখ আমি দেখতে চাই। আমার হাত তুমি ধর, আমি শয়তানের মুখ দেখবো–খুব ভালো করে তাকে দেখবো। শয়তান কেমন করে আমাকে মুগ্ধ করে, আমার শিরায় শিরায় প্রবেশ করে, আমাকে উদভ্রান্ত করে, আমাকে তোমার স্নেহ-মধুর পূত-নির্মল সহবাস হতে ইঙ্গিতে বিভ্রান্ত করে।
সমস্ত অন্তর দিয়ে তাকে ঘৃণা করতে চাই। তাকে দেখি নাই বললে চলবে না। তার ঘৃণিত, পৈশাচিক মুখ আমায় দেখাও, আমার দেহের অনুপরমাণু ঘৃণায় বিদ্রোহী হয়ে উঠুক, সমস্ত অন্তর দিয়ে আমি শয়তানকে ঘৃণা করতে চাই।
আমি অনেক সাধনা করেছি, অনেক রাত্রি তোমার ধ্যানে কাটিয়েছি আমার সমস্ত শরীর তোমার পরশ-পুলকে অবশ হয়ে উঠেছে; আমাতে আমি নাই–আমার নয়ন দিয়ে তোমার প্রেমের অশ্রু ঝরছে। পৃথিবীর সমস্ত আবিলতা মুক্ত হয়ে তোমার প্রেমে ধন্য হয়েছি; অকস্মাৎ চোখের নিমিষে শয়তান এসে আমার সর্বনাশ করে গেল,–আমাকে এক মুহূর্তে, পাতালের গভীরতম কূপে ফেলে গেল, ক্ষণিকের লোভে মানুষের মাথায় বজ্রাঘাত করলাম, অন্ধকার নিশীথে পশুর নেশায় বারবণিতার সৌন্দর্যশ্রীতে ডুবে মরলাম, গোপনে লোকচক্ষুর অগোচরে কুকার্যে আসক্ত হলাম, মানুষের বৃদ্ধি-অনুভূতির অন্তরালে প্রতারণায় আত্মনিয়োগ করলাম। প্রভু, কে আমায় রক্ষা করবে? মানুষ আমার পাপ দেখে নাই, আমি একাকী দেখেছি, আমাকে শয়তান আমার সর্বনাশ করেছে। প্রভু,মানুষের অগোচরে আমায় দুর্জয় কর; শয়তানের কুৎসিত মুখশ্রী আমায় দেখাও।
পৃথিবীর যত পাপ–পৃথিবীর যত প্রতারণা, নীচাশয়তা, হীনতা, কাপুরুষতা তাই তো শয়তানের মুখ। সাধু সঙ্গ ত্যাগ করে শয়তানের মুখ ভালো করে দেখবার জন্য, পৃথিবীর সমস্ত কাপুরুষতা, সমস্ত মূঢ়তা, গোপন পাপ, নারী ব্যভিচার আজ আমি ভালো করে দেখতে চাই।
একটা দরিদ্র লোক জীবনভর কিছু টাকা উপায় করেছিল। একদিন এক নামাজিকে তার বাড়িতে গিয়ে গভীর রাত্রে পঞ্চাশটি টাকা হাওলাত করে আনতে দেখেছিলাম। নামাজি বিয়ে করতে যাচ্ছিল, খুব বিপদে পড়েই তাকে সেখানে টাকার জন্য যেতে হয়েছিল। পঞ্চাশটি টাকা সে চাওয়া মাত্র পেয়েছিল–কোনো সাক্ষী ছিল না, কোনো লেখা-পড়া দলিলপত্র হয় নাই। এই ঘটনা দেখেছিলেন শুধু আল্লাহ্ আর নামাজির অন্তর মানুষ। তারপর দশ বৎসর অতীত হয়ে গেছে। লোকটি মারা গেছে। তার বিধবা পত্নী নামাজির বাড়িতে হেঁটে হেঁটে হয়রান হয়ে এখন আর হাঁটে না। এই ব্যক্তিকে লোকে মুসলমান বলে, মানুষ তাকে ঘৃণা করে। তাকে অমানুষ বলে ধরবার কোনো পথ নাই। সে পাঁচটি ফরজই আদায় করেছে। কে তাকে কাফের বলবে? কিন্তু আমি দেখেছি তার মুখে শয়তানের বিশ্রী মুখ।
একজন কেরানি তার পত্নীকে খুব ভালোবাসতো। সারাদিন সে পোস্ট অফিসে গাধার খাটুনি খাটতো, আর তার মাঝে তার পত্নীর মুখোনি বুকে জেগে উঠতো। মাতাল যেমন মদ খেয়ে দুর্বল দেহটিকে সবল করে নেয়, সেও তার দুর্বল দেহটাকে পত্নীর মুখোনির কথা মনে করে সবল শক্ত করে নিত। পোস্ট অফিসের ভারী ব্যাগগুলি ধাক্কা মেরে সে দশ হাত দূরে ফেলে দিত।
সে যখন বাসায় ফিরতো বাজার থেকে এক গোছা গলদা চিংড়ি মাছ কিনে শিস দিতে দিতে বাড়ি আসত, পত্নীর হাতে সেগুলি দিয়ে প্রেমে তার মুখের পানে চেয়ে থাকত।
এক ছোঁকরা ঐ বাড়িতে আসত। কেরানি তাকে পুত্রের মতো স্নেহ করতো। তার বয়স আঠার বৎসর হবে। একদিন ছোঁকরার সঙ্গে ঘরখানি খালি করে পত্নীটি চলে এসেছিল–সে এখন পতিতা। রাস্তার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে হাসে। একদিন ঝগড়া করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। হঠাৎ দেখলাম–সেই পতিতার উজ্জ্বল দীপ্ত লোহিত মুখ। সেই মুখে দেখেছিলাম শয়তানের কুৎসিত মুখ-বীভৎস দৃষ্টি। হৃদপিণ্ডে আগুন জ্বলে উঠেছিল, আন্তরিক ঘৃণায় সেই স্থান ত্যাগ করলাম। আমার পাপচিত্ত ক্রুদ্ধ ঘৃণায় জ্বলে উঠেছিল। মহাপাপের মুখ দেখে আমি শিউরে উঠেছিলাম।
শয়তান! আমি তোমার মুখ আরও ভালো করে দেখতে চাই–প্রভুকে যেমন করে দেখছি, তোমাকেও তেমন করে দেখতে চাই–অনন্তভাবে আমি তোমার ঘৃণিত কুৎসিত নগ্ন ছবি দেখতে চাই। আমি সমস্ত প্রাণ দিয়ে তোমাকে ঘৃণা করতে চাই। ভালো করে তোমার মুখ আমায় দেখাও, আমি দুই হাত দিয়ে ভালো করে স্পর্শ করে তোমায় দেখতে চাই।
শমসের এবং হাসান দুই ব্যক্তি কথা বলছিলেন। শমসের বললেন–আপনি মহামানুষ, দেশসেবক, আপনার কাছে আমি চিরঋণী।, হাসান–জনাব, জীবন অনিত্য, কোনো সময় যাই, তার ঠিক নাই, আমার কাছে কৃতজ্ঞ হবার দরকার নাই।
শমসের বললেন–আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ, আপনি মহামানুষ।
অতঃপর হাসান সে স্থান থেকে চলে গেলেন। তার স্থান ত্যাগ করা মাত্র শমসের বললেন–এই ব্যক্তিকে আমি চিনিভারি শয়তান’। শমসেরের মুখে দেখলাম, কাপুরুষ নিন্দাকারী শয়তানের বীভৎস ছবি। শয়তানের হাত থেকে রক্ষা চাই। আমাদের এই সুপবিত্র মুখশ্রীতে শয়তানের মুখ ফুটে না উঠুক।
একটি বন্ধু আর একটি বন্ধুকে ভালোবাসতো। প্রথম বন্ধুটির গৃহে দ্বিতীয় বন্ধুটি প্রায়ই যেত। প্রথম বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুকে বিশ্বাস করতো, ভালোবাসতো। একদিন দেখলাম দ্বিতীয় বন্ধু প্রথম বন্ধুর অনুপস্থিতিতে প্রথম বন্ধুর পত্নীর সঙ্গে অবৈধ প্রেমালাপে মত্ত। শয়তানের মুখ দেখতে বাকি রইল না। শয়তানকে ভালো করেই চোখের সামনে দেখলুম।