মীলানে ভয়াবহ প্লেগ আরম্ভ হয়েছে, বরোমী (Barromes) নামে এক জন সাধু বললেন—”আমাকে এইখানে যেতে হবে।” বন্ধুরা শঙ্কিত হয়ে বললেন, “আপনি কি প্রাণ দিতে যাচ্ছেন? আপনি কি মরণকে ভয় করেন না?” বরোমী বললেন–”আমার জীবনের চাইতে দুঃখীর ব্যথার মূল্য বেশি। আমাকে যেতেই হবে। সাধু ও মারফতপন্থী বুজর্গ বললে আমরা বুঝি তিনি দিবারাত্র ঘরের মধ্যে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেন। দোয়া পড়ে রোগীকে রোগমুক্ত করেন। বুজর্গের ইহাই ভাব নয়। ইহা ধর্মহীন লোকের চালাকি। বুজর্গ ও সাধুর প্রধান ধর্ম সেবা, প্রেম এবং ত্যাগ, দুঃখীর প্রতি অফুরন্ত সহানুভূতি, জীবন দিয়ে সয়ে আল্লাহর এবাদত করা; আরামে কম্বলের মধ্যে বসে পরের পয়সায় উদরপুষ্ট করা নয়। সাধু মৃত্যুকে ভয় করেন না–তিনি ফুঁ দিয়ে কাজ করেন না। তিনি পীড়িতের মধ্যে যান, দরিদ্রের সেবা করেন, দুঃখীদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন এবং হযরত মোহাম্মদের ন্যায় আপন হস্তে মলমূত্র পরিষ্কার করেন। সেবক শুধু দরূদ পড়েন না, সেবাকার্যের প্রয়োজন হলে প্রাণ দেন। সেবায় তাঁর কোনো অহঙ্কার নাই।
মীলান শহরের প্লেগ চার মাস কাল থাকে। সাধু বরোমী ঔষুধ ও পথ্য হস্তে সর্বত্র যেতেন, দুঃখীর সংবাদ নিতেন, ওষুধ বিতরণ করতেন। রাত্রিকালে দুঃখীর জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন, মরণোন্মুখ রোগীর পার্শ্বে বসে বন্ধুর মতো, মায়ের মতো তাকে আল্লাহর অনন্ত প্রেমের কথা শুনাতেন। এই সাধু সেবা ও প্রেমকে অনুসরণ করে আরও অনেক গুণমুগ্ধ ব্যক্তি তাকে অনুসরণ করলেন এবং যতদিন না ব্যাধি সম্পূর্ণভাবে শেষ হল, তাবৎ তারা ভয়ে সেবার ক্ষেত্র ত্যাগ করলেন না।
বরোমী কিছুদিন পর দেখলেন, তাঁর নগরের নৈতিক অধঃপতন, অপবিত্র পাপীজীবন; মনুষ্য পশুর মতো পাপাচারে উল্লাস করে, অভিশপ্ত, ঘৃণিত, জীবনের গৌরবে মত্ত থাকে। তিনি সর্বত্র লোক শিক্ষার জন্যে প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করতে লাগলেন, সাধারণের মাঝে প্রচার করতে লাগলেন। এর ফল কী হল, সাধু নামধারী কতকগুলি ভণ্ড বললেন,–বরোমী কাফের। একে খুন করো। যে কথা সেই কাজ। বলরামী একদিন যখন ইতর লোকদের মাঝে আল্লাহর বাণী প্রচার করছিলেন, সেই সময় এক ভাড়াটে নরহন্তা তাকে লক্ষ্য করে। গুলী ছোঁড়ে। ভক্তের প্রতি আল্লাহর কী দয়া। তিনি আপন ভক্তকে, সাগরবক্ষ; অগ্নিসমুদ্র, ঝড়ঝঞ্ঝা হতে আশ্চর্যভাবে রক্ষা করেন। গুলী বলরামীর বস্ত্র ভেদ করে তার শরীরে প্রবেশ করতে পারল না। তিনি হাস্যমুখে তার শত্রুদের আশীর্বাদ করলেন, তাদের জন্যে আল্লাহর দয়া ভিক্ষা করলেন। এই কাজ,–এই সেবা এবং সাহস, আর এই অপরিসীম প্রেম ও শত্রুর প্রতি স্নেহভাবই সাধু জীবনের পুণ্য সত্য চিত্র এবং সে চিত্র স্বর্গীয়, মহৎ, পবিত্র পাপীর পথ-প্রদর্শক। চন্দ্রে কলঙ্ক আছে, এ স্বর্গীয় চিত্তে কলঙ্ক নাই।
.
১৪. এবাদত
মানব-জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ এ যাবৎ যত প্রকার বিশ্লেষণ করেছে, তার মধ্যে মানুষ সর্বতোভাবে নিজেকে খোদার এবাদতে নিযুক্ত করবে, ইহাই মানব-জীবনের মূল উদ্দেশ্য। খোদা বলেছেন, “নিশ্চয়, আমি জ্বীন ও মানবকে কেবলমাত্র আমার এবাতের জন্য সৃষ্টি করিয়াছি।” মানুষ খোদার এই এবাদতের অর্থ বুঝতে অনেক সময় ভুল করেছে, যতদিন কোনো মানব খোদার এই এবাদতের অর্থ ঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতেন না পারে, ততদিন তার জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণতায় পরিণত হবে না। এবাদতের অর্থ ঠিক বুঝতে না পেরে কেহ-বা ধর্মের কতিপয় বিধির ব্যবস্থাকে মৌখিক স্বীকার করে নেওয়াকে এবাদতের সারমর্ম মনে করেছে। কোরান শরীফে এবাদতের বিশদ ব্যাখ্যা না থাকলেও যে বর্ণনা দেওয়া আছে তাতেই এবাদতের অর্থ স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। কোরানের এই আলোকের সাহায্যে মানুষকে এর প্রকৃত অর্থ বুঝতে চেষ্টা করতে হবে, এবং সেইভাবে জীবনের উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে, তা নাহলে এ সুন্দর মানব-জীবন বিফলে যাবে। এ জীবন-যৌবন একবার গেলে আর ফিরে আসবে না। যে দিন বিতাড়িত শয়তান খোদাকে বলেছিল, “নিশ্চয় তুমি খুব কম লোকই দেখতে পাবে, তোমার প্রশংসাকারী, যেহেতু তাদের বেশিরভাগকেই আমি পথভ্রষ্ট করতে থাকবো।” শয়তানের কথায় উত্তরে খোদা জোর দিয়েই বলেছিলেন, “আমার আবেদের উপর তোমার কোনোই আধিপত্য চলবে না।” (সুরা হিজর, আঃ ৪২)। আরবিতে এবাদতকারীকেই আবেদ (সেবক) বলা হয়। তাই এর দ্বারা এই প্রমাণিত হচ্ছে যে, খোদার এবাদতই মানব জীবনের প্রকৃত পথ। যে পথের উপর দণ্ডায়মান থাকলে শয়তান ভয়ে কম্পিত হবে, হতাশায় দূরে সরে যাবে। আবার অন্য স্থানে খোদা তার আবেদের সম্বন্ধে বলেছেন, “এবং তাহারই সেই রহমানের আবেদ (সেবকবৃন্দ) যাহারা পৃথিবীর উপর বিনীতভাবে চলাফেরা। করে এবং যখন সাধারণ অজ্ঞ লোকেরা তাহাদিগকে সম্বোধন করে, তখন তাহারা বলে–শান্তি এবং তাহারা স্বীয় প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সেজদায়ও দাঁড়ান অবস্থায় অতিবাহিত করে এবং তাহারাই বলে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের হইতে দোজখের শাস্তি নিবারণ কর। নিশ্চয় উহার শাস্তি অনিবার্য। নিশ্চয় উহা নিকৃষ্টতর বিশ্রামাগার ও বাসস্থান এবং যখন তাহারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় অথবা কার্পণ্য করে না এবং উহার অন্তর্গত মধ্যপথ অবলম্বন করে। তাহারা আল্লাহর সহিত অন্য উপাস্য গ্রহণ করে না, ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যতীত এইরূপ করে, সে পাপের প্রতিফল পাবে। উত্থান দিবসে তাহার জন্য শাস্তি দ্বিগুণ হইবে এবং তম্মধ্যে সে ঘৃণিত অবস্থায় পড়িয়া থাকিবে কিন্তু যে অনুতাপ করে ও বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকার্য করে, তবে আল্লাহ্ উহাদের অকল্যাণ কল্যাণে পরিবর্তন করিয়ে দেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়, যে অনুতাপ করে ও সৎকার্য করে, তবে নিশ্চয় সে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবতিত হয়।