আমরা কি সত্যই উন্নতির পথে চলেছি? –তা হলে দেখতে হবে, আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হচ্ছে কিনা। সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত সভ্যতা, সকল ধার্মিকতার প্রাণ-প্রেম। প্রেম ব্যতীত জাতির সাধনা ব্যর্থ। প্রেম মনুষ্যত্বকে ত্যাগী করে, তাকে দুঃখ বরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে, মানুষের এবং জাতির জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। প্রেম কখনও মানুষকে অবিবেচক, নিষ্ঠুর, আত্মসর্বস্ব, অবিনয়ী, পরস্বার্থহারী, দাম্ভিক করে না।
দেখতে হবে, আমরা দেশের মানুষকে ভালোবাসি কিনা। দেশের মানুষের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করতে শিখেছি কিনা? তা হলে বুঝবো জাতির সত্যই উন্নতি শুরু হয়েছে।
আমরা কি প্রতিবেশীকে আঘাত করি?–আমরা কি কারও দাবি নষ্ট করি?–জাতির দুঃখে কি আমাদের কোনো সহানুভূতি নাই?–পরস্পরে কি আমরা মিথ্যা ব্যবহার করি? তা হলে বুঝবো কিছুই হয় নাই।
মনুষ্য যতই অপরাধ ও মূঢ় হোক না কেন, তাকে আঘাত করে মানুষের মনে যখন। আনন্দ হয়, তখন বুঝতে হবে, শয়তান আত্মতৃপ্তি লাভ করেছে। সে আঘাত মানুষের নয়। মনুষ্যকে শাস্তি দাও–আঘাত কর কর্তব্যের খাতিরে–পশুর আনন্দ নয়।
.
১৩. সেবা
যে দুঃখী পীড়িতের ব্যথা মর্মে অনুভব করে সেবার কাজে আত্মদান করে, সে মানুষের গৌরব। কোনো কোনো ভ্রাতা বলে থাকেন, “খ্রিস্টান ও হিন্দুরা সেবার দ্বারা মানুষের চিত্ত জয় করে, তাদের প্রতারণা-জাল থেকে সাবধান।”
সেবা ও প্রেমকে অশ্রদ্ধা করা মুমিনের কাজ নয়। যারা সেবা-ধর্মে নিজেদের জীবনকে ধন্য করেছে, তারা বিধর্মী হলেও উদার মুসলমান শ্রদ্ধা করেছে, ভালোবেসেছে।
বিধর্মী ম্রাট নওশেরোয়া বিচার ও ন্যায়নিষ্ঠায় চিরদিন মুসলমানদের শ্রদ্ধা-পুস্পাঞ্জলি পেয়েছেন। যিনি প্রেমিক এবং সেবক, তিনি ন্যায়-বিচারক ও দুঃখীর বন্ধু।
যখন বিধর্মী তায়ী সম্প্রদায় বন্দি হয়ে হযরতের সম্মুখে নীত হল, তখন বন্দিদের মধ্য হতে একজন মহিলা বললেন–”মহানুভব, আমি হাতেমের বংশধর।” হযরত বললেন”এদের মুক্ত করে দাও। বিধর্মী হলেও সেবাধর্মে হাতেম আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছেন। তার কন্যাকে আঘাত করা হবে না, সবাইকে মুক্ত কর।”
হযরত মহিউদ্দীন জিলানী যখন সামান্য ছাত্র, তখন একদিন রাস্তার ধারে পতিত এক পীড়িতকে বুকে করে আপন শয্যায় আশ্রয় দিলেন। তার সেবায় রোগীর রোগমুক্ত হল। সে মহিউদ্দীনকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলো। সেইদিন রাত্রে তিনি স্বপ্নে শুনলেন–”তোমার জীবনের এই প্রেম সার্থক হবে। মানব-কল্যাণের সাধনায় তোমার জীবন ধন্য হবে। আল্লাহ তোমায় মহৎ স্থান দান করেছেন।”
সৈনিক সবুক্তগীন যেদিন হরিণ-মাতার মুখের দিকে চেয়ে করুণা বিগলিত চিত্তে মৃগ শিশুকে ছেড়ে দিলেন, সেইদিন আল্লাহ তাঁকে লোকপালনভার দিয়ে তাঁর প্রেমকে পুরস্কৃত করলেন। প্রেমের পুরস্কার হবেই প্রেমে আল্লাহর আরশ জোরে নড়ে। প্রেম, দয়া ও সেবা ইসলামের অঙ্গ। দুঃখীর জন্য দান (জাকাত) ইসলামে অপরিহার্য বিধান। ইসলামের জাকাতের টাকা থেকে অনেক হাসপাতাল, অনেক সেবা-সঙ্গ চলতে পারে।
জল-প্লাবনে, রোগে, দুর্ভিক্ষে বিভিন্ন দেশে সেবা-সঙ্গের ভিতর দিয়ে মানুষ অর্থ ও অন্নবস্ত্র দান করেছে–যারা জীবন দিয়ে তার সেবা করেছেন, সেবার দুঃখ সয়েছেন–তারা প্রেমিক। মানুষের শ্রদ্ধা সংবাদপত্রের নাম তাঁরা চান নি; বিবেক, মনুষ্যত্ব ও আত্মার ধর্মকে তারা সার্থক করেছেন জগৎ এদের পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে। এদের প্রেম ও অশ্রুর মূল্য রাজার রাজতখতও নয়। মানুষের দুঃখে অশ্রু যারা ফেলেছেন, মানব দুঃখের জন্য যারা সেবাকার্যে অগ্রসর হয়েছেন, তাঁরা আল্লাহর আর্শীবাদ পেয়েছেন। জীবন শেষ হবেই কিন্তু ধন্য হবার এই-ই পথ।
পণ্ডিত হয়ে লাভ কী, যদি না প্রেমে পাণ্ডিত্যকে সার্থক করি? বড়লোক হয়ে লাভ কী, যদি না আপন বিত্ত মহিমা প্রেমে সার্থক করি? অফুরন্ত উপাসনায় আল্লাহর কী প্রয়োজন, যদি না উপাসনা প্রেমে সার্থক হয়। বস্তুত প্রেমহীন জীবন, জ্ঞান এবং ধার্মিকতা কিছু নয়। মানবের সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত সাধনা প্রেম-সাধনায় সার্থক হয়।
পর সেবায় আমরা অনেকে হয়তো জীবন দান করতে পারি কিন্তু যারা আপন প্রাণ সেবার কার্যে উৎসর্গ করেছেন–অর্থ দিয়ে তাদের কাজে সাহায্য কি আমরা করতে পারি না? পীড়িতের জন্যে সাহায্য কিছু দান করাও কি কষ্টকর হবে? কে ব্যাধি দেখে নির্ভয়ে চলেছে? কে শঙ্কা, সন্দেহ, মরণকে উপহাস করে আল্লাহ্ বলে ছুটছে? মুসলিম। কার প্রাণে ভয় নাই? সে মুসলমান। মরণাপন্ন পীড়িতের শয্যাপার্শ্বে মুসলিম যুবককে দেখি না কেন? বিপদ ও মরণ-বিজয়ী মুসলিম তোমাকে তো কোনোদিন কাপুরুষ দেখি নাই? পরকালের পুরস্কারের আশায় হে বিশ্বাসী! তোমাকে দেখেছি তোমার মহাযাত্রাকে সার্থক করতে। মৃত্যুকে তুমি কি ভয় কর? প্রেম ও ত্যাগই যে জীবন।
প্রায় তিন শত বৎসর পূর্বে মীলানে (Milan) প্লেগের আবির্ভাব হয়। প্লেগ অতিশয় ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধি। মনুষ্য প্লেগের ভয়ে দিশাহারা হয়ে পলায়ন করে। অনাহারে, বিনা চিকিৎসায়, মানুষ পথে পড়ে মরে। আত্মীয় আত্মীয়কে ত্যাগ করে, বন্ধু বন্ধুকে ফলে যায়। এই পাপপূর্ণ দুঃখের সংসারে অনেক মানব দেবতাও বাস করেন। তাঁদের স্পর্শ কী শক্তিপূর্ণ। তাদের বাক্য কী প্রেম-মধুর। আল্লাহর ছায়ারূপে পৃথিবীর দুঃখ-দগ্ধ মানবসন্তানকে সান্ত্বনা দিয়ে তারা সংসারকে মধুর করেন।