হযরত মোহাম্মদ (দঃ) বলেছেন, যিনি আপন পরিবারের মধ্যে উত্তম, তিনি আল্লাহর কাছে উত্তম। যথেচ্ছাচারী রাজার মতো পরিবারের যথেচ্ছাচারী কর্তা মনুষ্য জীবনকে বিষময় করে তোলে। তার প্রতাপে গৃহের সমস্ত মানুষ অন্তরে দগ্ধ হতে থাকে, ফলে তার বিপদে, দুঃখে পরিবারের কারো কোনো আন্তরিক সহানুভূতি থাকে না।
বাইরে মানব-সমাজে, মুক পশুর কাছে, প্রেমের যেমন প্রভাব, অধীনস্থ আত্মীয়দের উপরেও প্রেম তেমনি কাজ করে। বালক-বালিকা আশ্রিতদের দুঃখের সহানুভূতি, তাদের প্রতি সহৃদয় ব্যবহার পরিবারের সবাইকে যেমন গভীর প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ করে, তেমনি গৃহের সুখ শতগুণে বর্ধিত করে দেয়। প্রেমের নামে, মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়ের নামে মানুষ দুর্বল, শক্তিহীন। মুখাপেক্ষী অধীনস্থদের প্রতি যে অত্যাচার করে, তার তুলনা নাই।
লোকে শিক্ষার নামে কোমলমতি বালক-বালিকাঁদের অত্যাচারীর (কহরটর্ভ) মতো দণ্ড দেয়। প্রেমের অভাবেই এমন হয়! মনুষ্য সন্তানকে মনুষ্য আল্লাহর আর্শীবাদ মনে করে না–যেন বিপন্ন হয়েই পুত্র বলতে বাধ্য হয় ঘটনাক্রমে পিতা মনুষ্য দুর্ব্যবহারের দ্বারা নিজেদের জীবনে অনুতাপ প্রকাশ করে।
সন্তান আল্লাহর কাজ করবে, এই উদ্দেশ্যে পুত্র কামনা কর, তা হলে পুত্রের মুখ দেখে। যে আনন্দ হবে সে আনন্দ স্বর্গীয় হবে। পাপ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে, নিজের দুরাশার ইন্ধনরূপে মানব সন্তানকে ব্যবহার করতে যেও না। শিশু ভূমিষ্ট হওয়া মাত্র বল, আল্লাহ আকবার আল্লাহ শ্রেষ্ঠ সত্যের জয়’–’প্রেম ও সত্যের জয়। মানব শিশুর জন্য ইহাই প্রথম মন্ত্র। সমস্ত জীবন তার সত্য প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত হোক। জীবন তার মহত্বে-মানব কল্যাণে যাহা কিছু সুন্দর, পবিত্র, তাতেই উৎকৃষ্ট হোক। নিষ্ঠুর কঠিন মুখ শয়তানের। প্রেম ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা কখনও নিষ্ঠুর বাক্যে হবে না। হয়েছে বলে যা মনে হবে–তা হয় নাই। কঠিন ব্যবহারের রূঢ়তায় মানবাত্মার অধঃপতন হয়। সাফল্য কিছু লাভ হলেও আত্মা যে দরিদ্র হতে থাকে সুযোগ পেলেই সে আপন পশু স্বভাবের পরিচয় দেয়।
ইসলাম মানে শুধু উপাসনা নয়। বাইরে, রাস্তায়, ঘরে, বিপণীতে দিনের সমস্ত কাজে সে সর্বাঙ্গ সুন্দর হবে। যে পরিবারে কর্তা ছোটদের সঙ্গে কদর্য ব্যবহার করে, সে পরিবারের প্রত্যেকের স্বভাব অতিশয় মন্দ হতে থাকে। শিশুর জন্য এ একটা নিষ্ঠুর কথা, একটা মায়াহীন ব্যবহার–তার মনুষ্যত্বকে অনেকখানি করে কমাতে থাকে। অতএব শিশুকে নিষ্ঠুর কথা বলে, তার সঙ্গে প্রেমহীন ব্যবহার করে, তার সর্বনাশ করো না। একটা মধুর ব্যবহার অনেকখানি রক্তের মতো শিশুর মনুষ্যত্বকে সঞ্জীবিত করে। পরিবারের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতির জন্যে সকলেরই চেষ্টা করা উচিত। ইহাই পরিবারের প্রতি প্রেম। নিজের সমস্ত কাজই চলেছে, কিন্তু পরিবারের লোকগুলি যে ধীরে ধীরে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তার উদ্ধারের কোনো আয়োজন নেই। আত্মাকে জীবনের পথে আলোকের পথে নিতে হলে তাকে যা দিতে হবে–পরিবারের কল্যাণেচ্ছুদের ইহাই শ্রেষ্ঠ কাজ। শুধু বোধহীন আবৃত্তিতে আত্মা সচেতন, জাগ্রত, ব্যাকুল এবং সত্যের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে না। আল্লাহর কালাম অনুভব করা চাই, নইলে বিশেষ কোনো ফল হবে না।
অর্থ লোভে দিবারাত্র ছেলেদের দিয়ে বই মুখস্থ করান বড় কথা নহে–পরিবারের ছেলেদের ভিতর যাতে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়, তার চেষ্টা করা উচিত। পশু জাতীয় বড় লোক বা স্বার্থপর বা আত্মসুখ সর্বস্ব শিক্ষিত পণ্ডিত হয়ে লাভ কি? পরিবারের সবাই যাতে উদার হৃদয় সত্যবান মানুষ হয়ে ওঠে, তার চেষ্টা কর।
নির্ভরশীলদের বিশ্বাস কর, তাদের মনুষ্যত্বের আত্মমর্যাদাজ্ঞান জাগ্রত হবে। তাদের অবিশ্বাস করো না, তাদের আত্মমর্যাদাজ্ঞানে আঘাত দিও না, তাদের লজ্জা দিও না–তাদের মনের কোণে গোপনে ঘৃণা ও বিদ্বেষ জাগবে। যদি বিশ্বাস করে প্রতারিত হও, তবুও বিশ্বাস কর।
ছোট হোক বড় হোক পরিবারের কাউকে কখনোও খারাপ কথায় আঘাত দিও না। এতে মানুষের মন অতিশয় ব্যথিত হয়; সে পীড়া দাতাকে ঘৃণা করে; মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাস ব্যতীত মানুষকে লাভ করা যায় না।
বিশ্বাস কর, অন্তর্নিহিত সুবুদ্ধির কাছে নিবেদন কর, ভক্তি, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা অর্জন করবে। পরিবারের প্রতি সহানুভূতিই পরিবারের প্রাণ। এই ভাবটি যাতে বেড়ে ওঠে, তার চেষ্টা চাই। যে পরিবারে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি নেই, সে পরিবারে কোনো উন্নতি সম্ভব নয়।
.
১২. প্রেম
খ্রিষ্টান ধর্ম আজ এত সমুজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছে ইসলাম ধর্মের প্রভাবের ফলে। আল্লাহর মঙ্গলবাণী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে প্রচার করেছিলেন, তারপর ইঞ্জিল কেতাবের দীপ্তি ইউরোপবাসীর চোখে সমুজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হয়েছে।
আতুর, কয়েদি, পাগল, দাস, কুষ্ঠরোগীকে ইউরোপ কুকুরের মতো, বন্য পশুর মতো ঘৃণা করতো। পিসা (টে) শহরে জীবন্ত মানুষের শরীরে এনাটমি শিখবার জন্যে ডাক্তারেরা স্কালপোল (ছুরি) ব্যবহার করতো। মানুষের উপরে এই অত্যাচারের কাহিনী পড়ে আমরা ভীত হই। আত্মা ব্যাকুল হয়ে উঠে।
মানব জাতির জন্যে আর্শীবাদ হয়েই ইসলাম যথাসময়ে পৃথিবীতে এসে ছিল। ছোট নাই, বড় নাই, ধনী নাই, দরিদ্র নাই, পীড়িত, লাঞ্ছিত, দাস গোলাম, রোগী সবই ভাই’!৩