শিল্পকে জীবনে অনেক সময় অপরিসীম দুঃখ ভোগ করতে হয়েছে তা, ভেবে সাধক তার কাজ ত্যাগ করেন নাই। কত কর্মী মানুষের অশ্রদ্ধা এবং অবহেলায় প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছেন–তাঁদের সমাপ্ত সাধনায় নতুন নতুন সাধক পূর্ণতা এনে দিয়েছেন।
স্টকিং মেশিন–নির্মাতা রেভারেণ্ড উইলিয়াম লী এক নারীকে ভালোবাসতেন। লী ধর্মপ্রচারক ছিলেন। তিনি প্রায়ই প্রেম-প্রার্থী হয়ে তার প্রিয়তমার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। কিন্তু সেই নারী তাকে ভালোবাসত না, হাতে স্টকিং তৈরি করত, আর তার সহকর্মী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলত। লী প্রিয়তমার এই ব্যবহারে অতিশয় মনঃক্ষুণ্ণ হন। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন এমন এক যন্ত্র তৈরি করতে হবে যাতে আর কেউ হাতে স্টকিং তৈরি করতে না পারে। প্রিয়তমাকে শাস্তি দেবার মানসে তিনি চিন্তা আরম্ভ করলেন। একটা অতি লাভজনক ব্যবসায় এই প্রেমের দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়। লী প্রচারকার্য ত্যাগ করে যন্ত্রের সফলতার দিকে মন দিলেন। ঐকান্তিক সাধনার ফলে তিনি কয়েক বছরেই এই আশ্চর্য কৌশলময় যন্ত্রটি তৈরি করতে সক্ষম হলেন। তার উদ্ভাবিত যন্ত্রটি নিয়ে তিনি প্রদর্শনের জন্য রানী এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করলেন। দরিদ্রের অন্ন মারা যাবে, এই কথা বলে রানী তাকে অশ্রদ্ধা করলেন। লী অতঃপর দুঃখে সে স্থান ত্যাগ করলেন। এই সময় ফ্রান্সের চতুর্থ হেনরী তাকে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি কয়েকজন সহযোগী নিয়ে যন্ত্রপাতিসহ রুয়েন শহরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। রুয়েন একটা প্রধান হস্তশিল্পের কেন্দ্র। সেখানে তিনি বিশেষ সমাদর লাভ করলেন। এখানে তার কাজের আদর হতে লাগল। দুর্ভাগ্যবশত এই সময়। একদল ধর্মান্ধ গোঁড়া সম্প্রদায় সম্রাটকে হত্যা করে। ফলে লীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। তিনি রুয়েন ছেড়ে প্যারিস শহরে গেলেন। সেখানে সবাই তাকে ধর্মহীন এবং বিদেশী বলে অবজ্ঞা করলেন। একটি বিশেষ লাভজনক যন্ত্রশিল্পের উদ্ভাবক অতঃপর বিদেশে মনের কষ্টে, অবহেলায়, রোগে, দুঃখে প্রাণত্যাগ করেন। অতঃপর তার ভাই কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে স্বদেশে পালিয়ে আসেন। এই সময় আল বলে আর একজন সুদক্ষ শিল্পী তার সঙ্গে যোগ দিয়ে যন্ত্রটিকে সর্বাঙ্গ সুন্দর এবং সফল করে তুললেন। ক্রমে দেশের সর্বত্র স্টকিং মেশিনের সমাদর হল।
মানুষের কাজ এইভাবেই সমাদর লাভ করে। মানুষ প্রথম প্রথম কোনো কথা, কোনো সাধনার দিকে ফিরে তাকায় না। মানুষের এ স্বভাব, তা বলে ভাবনা করলে চলবে না।
জগতে এখনও অনেক কিছু নতুন করে তৈরি করবার আছে। জগতের যা কিছু প্রয়োজন তা মানুষের ত্যাগের ফলে তৈরি হয়ে থাকে–তারপর কাজে নেমে পড়লেই হয়। জাতির ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করবার জন্যে, পল্লীর দুঃখ দূর করবার জন্য এখন দেশের মানুষের অগ্রসর হওয়া মাত্র বাকি। হাত-পা গুটিয়ে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা না করে হাত-পা খাঁটিয়ে শক্তি ও মনুষ্যত্বের সদ্ব্যবহার করে নিজের এবং জাতির মঙ্গল চেষ্টা করাই উত্তম। জাতির না হোক, সমাজের না হোক, দেশের ছেলেরা যদি আপন আপন মা-বোনের সেবা করতে পারে, সাধু জীবন-যাপন করে প্রতিবেশীদের স্বার্থে আঘাত না করে, তা হলেই যথেষ্ট।
আর্থার হ্যাঁলাস বলেছেন–”ইংরেজ জাতির ভিতর থেকে শ্রমিক, শিল্পী, মিস্ত্রী ফেলে দাও, সমস্ত জাতিটা অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়বে। সমস্ত জাতির দেহটা তাদের ঘরের মতো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে পড়বে। তাই বলছি কয়েকজন রাজ কর্মচারী এবং দেশের ভদ্রলোক এরাই জাতির শক্তি এবং প্রাণ, এ কথা পাগল ছাড়া আর কেউ মনে করে না। কোনো মানুষের কৃতিত্ব বিশেষত্ব এবং গুণ চাপা থাকবে না–সে ছুতোরই হোক, আর রাজমিস্ত্রী, গায়ক, কামার স্বর্ণকার, শিল্পী যাই হো–মানুষের অন্তনিহিত ক্ষমতো তার কাজের ভিতর দিয়ে তাকে শ্রেষ্ঠত্ব এবং সম্মান দান করবেই।
জর্জ কেম্প একজন সামান্য লোক ছিলেন। তাঁর পিতার সম্পত্তি ছিল কতকগুলি গরু ও ছাগল। প্রথম জীবনে তিনি সামান্য একজন মিস্ত্রীর কাছে শিক্ষানবীশি করেন। স্থাপত্য শিল্পে তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। ভালো উল্লেখযোগ্য নতুন, পুরাতন সুদৃশ্য অট্টালিকা দেখলেই তিনি তার চিত্র গ্রহণ করতেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইউরোপ পরিভ্রমণ করতে মনস্থ করেন। তিনি পায়ে হেঁটে ইউরোপের বৃহৎ বৃহৎ প্রাচীন অট্টালিকা, দুর্গ এবং গীর্জা পরিদর্শন করেন এবং সেগুলির নক্সা হাতে গ্রহণ করেন। এডিনবরা শহরে স্কট মনুমেন্টের নক্সা প্রস্তুত করবার প্রতিযোগিতায় তিনিই প্রথম স্থান অধিকার করেন। তাঁরই নক্সা অনুযায়ী এডিনবরায় এই বিখ্যাত সাহিত্যিক স্মৃতিমন্দির নির্মিত হয়।
অসংখ্য প্রকারে মানুষ নিজ নিজ জীবনকে উল্লেখযোগ্য করে তুলতে পারে। যে দেশের মানুষ এ বুঝে না, সে দেশের লোক দাস ও গোলামের জাতি ছাড়া আর কী? চাকরিকেই সম্মানের মাপকাঠি মনে করা যার পর নাই ভুল। জাতিকে সমৃদ্ধশালী করে তোলবার পথ এ নয়। জাতির শক্তির পশ্চাতে অনন্ত বিচিত্র জীবন ধারা দেশের শিরায় শিরায় খেলে যাচ্ছে। মিশর, পারস্য, ব্ৰহ্মদেশ, এশিয়া মাইনর প্রভৃতি ছোট ছোট দেশেও ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা অর্থাগমের বিবিধ পন্থা আছে। আমাদের দেশেও থাকা চাই। একজন আর একজনের নাড়ী ছিঁড়ে খেলে কয়েকজন লোক ছাড়া বাকি সকল লোকই মারা যাবে। মিথ্যা ও মূর্খতার বিরুদ্ধে যুবক সমাজকেই বিদ্রোহী হতে হবে। অত্যাচারী মরুব্বীর দল যে চাকরিকেই সম্মানের জীবন মনে করে নিষ্ঠুর হস্তে সে মানসিকতাকে ভেঙ্গে না দিলে আর উপায় নাই। পরের গলগ্রহ হয়ে অসাধু পথে দাসত্বের লৌহচাপে, অভাবের অভিশাপে মানুষের জীবনীশক্তি এবং মনুষ্যত্ব দুই-ই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে। শ্রমকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ কর। কালি-ধুলার মাঝে, রৌদ্র-বৃষ্টিতে কাজে নেমে যাও। বাবু হয়ে ছায়ায় পাখার তলে থাকবার কোনো দরকার নাই। এ হচ্ছে মৃত্যুর আয়োজন। কাজের ভিতর কু-বুদ্ধি, কু-মতলব মানবচিত্তে বাসা বাঁধতে পারে না। কাজের শরীরের সামর্থ্য জন্মে, স্বাস্থ্য, শক্তি, আনন্দ, কূর্তি সবই লাভ হয়। মদ খেয়ে আনন্দ করবার কোনো প্রয়োজন হয় না। পরিশ্রমের পর যে অবকাশ লাভ হয়, তা পরম আনন্দের অবকাশ। শুধু চিন্তার দ্বারা জগতের হিত সাধন হয় নাই। মানব জাতির সমস্ত কল্যাণ বাহুর শক্তিতেই সাধন হয়েছে। মানুষের বাহু অত্যাচারিত মনুষ্য, পীড়িত-লাঞ্ছিত মনুষ্যকে উদ্ধার করছে, জগতের জালিমকে বিনষ্ট করেছে; রাক্ষসের মুখ থেকে নির্দোষ দুর্বল মানুষকে বাঁচাচ্ছে। কাপুরুষ ছাড়া মানুষের বাহুকে অন্য কেউ অশ্রদ্ধা করে না।