দীর্ঘদিনের পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং সহিষ্ণুতা ব্যতীত কোনো কাজে সফলতা লাভ হয়। মানুষ ইচ্ছা করে, তাই সম্ভব। চাই একাগ্রতা, বিশ্বাস এবং সাধনা। আন্তরিকতা ব্যতীত কোনো কাজেই সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়। জগতে যে সমস্ত উত্তম উত্তম কাজ দেখতে পাচ্ছ, তা কঠিন পরিশ্রম, ত্যাগ এবং দুঃখের ফল। ইংরেজ জাতিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় এরা বড্ড বাবু; আমরা এত খাঁটি, তার প্রতিদানে পাই এক মুষ্টি ছাতু, আর এরা ছায়ায় বসে এত সুখ ভোগ করে। এরা যে কত দুঃখ করেছে, উন্নতির সাধনায় এরা কত ত্যাগ স্বীকার করেছে, কত প্রাণ দিয়েছে, তার সীমা নাই। তোমরাও এইভাবে ত্যাগ স্বীকার কর, দুঃখ বরণ কর, হৃদয়ের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এবং নিজের ও জাতির কল্যাণ অর্জন করতে হবে।
কাজের ডাকে, কর্তব্যের ডাকে কাজ কর; শুধু অর্থলোভেই কাজে অগ্রসর হয়ো না। শুধু অর্থলোভে মানুষকে শ্রেষ্ঠ এবং পূর্ণ করে না। অর্থের মীমাংসা হলেই অর্থলোভীর সাধনায় জড়তা এবং শৈথিল্য আসে। শুধু অর্থ-লোভ জাতির শক্তিকে খর্ব করে দেয়। সমস্ত কর্ম-প্রেরণার অন্তরালে কর্তব্য বৃদ্ধি এবং জাতির প্রতি প্রেম মানুষকে শক্তিশালী এবং বিজয়ী করে। অর্থ যদি লাভ হয়, তবে তা কাজ করতে করতে ঘটনাক্রমে হয়ে উঠে।
সার জসুয়া রেনল্ডস্ বলেছেন, “যদি কোনো কাজে সফলতা চাও, তা হলে যখন ঘুম থেকে ওঠ, তখন থেকে নিদ্রা যাওয়া পর্যন্ত সেই কাজে সমস্ত চিন্তা, সমস্ত মন ঢেলে দাও।” বাস্তবিক ইহাই সফলতার পথ। কর্মী ও সাধকের কাছে সকাল নাই, দুপুর নাই, সন্ধ্যা নাই, কাজকে সর্বাঙ্গসুন্দর করবার জন্যে তিনি কাজের মধ্যে একেবারে ডুবে যাবেন। সাধনায় সিদ্ধি লাভের ইহা গুপ্ত রহস্য। অভাব, দারিদ্র অসুবিধা মানুষের সাধনার পথে কোনো কালেই বাধা হয় না।
বাধা অনেক সময় সাধকের জীবনকে দুঃখময় করে তোলে বলে দুঃখ করো না, যেহেতু জীবনের প্রতি চিরদিনই এমনি জটিল ও সমস্যাপূর্ণ। তোমাদের দুঃখ ও ত্যাগের ফলে যদি ভবিষ্যৎ মানব-সমাজ দুঃখ, কুসংস্কার, মূর্খতা ও অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পায়, সেই কথা চিন্তা করে মনে মনে আনন্দ কর। আজকাল এই দুঃখ নীরবে আঁখিজলে সয়ে যাও, আল্লাহর দয়ার কথা ভেবে কাজ করতে থাক। যদি সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয়, সেই দিন সমস্ত দুঃখের প্রতিদান পাবে। মানব-সমাজ তোমার কাছে একদিন কৃতজ্ঞ হবেই।
কোনো কাজ একবারে হয় নাই, আবার কর। আবার কর–যতবার না হয়, ততবারই কর। এর শেষে সিদ্ধি। প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিরা হয়তো কোনো কাজ হঠাই করে ফেলেন, কিন্তু পরিশ্রম, চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ সফলতার পথ।
স্বর্ণকার, চিত্রকর, ভাস্কুর এবং ইঞ্জিনিয়ার সেলিনীর জীবন বড়ই চমৎকার। তাঁর পিতা ফ্লোরেন্সের রাজ দরবারে বেতনভুক্ত গায়ক ছিলেন। তার চাকরি গেলে পুত্রকে এক স্বর্ণকারের কাছে কাজ শিখতে পাঠান। অতি অল্পদিনের মধ্যেই বালক অনেক কাজ শিখে ফেলল। বাপের জিদে কিছুদিন তাকে এই সময় আন্তরিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাঁশি বাজানো শিখতে হয়েছিল। এর কিছুদিন পর সেলিনী পোপের অধীনে স্বর্ণকার গায়করূপে চাকরি পান। তার সোনা, রূপা এবং ব্রোঞ্জ ধাতুর কাজ অতি আশ্চর্য। কারো সাধ্য ছিল না, তেমন কাজ করতে পারে। কোনো সুন্দর কারিগরের সংবাদ পেলেই সেলিনী তার কাজ দেখতেন এবং যাবৎ না দক্ষতা গুণে তাকে অতিক্রম করতে পারতেন, তাবৎ তার শান্তি থাকত না, তাঁকে পরাস্ত করা চাই, তার পর অন্য কথা। তাঁর কর্মশক্তি ছিল অসাধারণ।
শিল্পী চাট্র শিল্প-সাধনায় কতদিন মগ্ন থেকে যশের আসন লাভ করেছিলেন, তা পড়লে বিস্মিত হতে হবে। খুব ছোট বেলাতেই তার বাপ মারা যান। মা দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করেন। এই অবস্থায় তাকে গাধার পিঠে শেফিল্ড শহরে দু’বেলা ঘরে ঘরে দুধ যোগান দিতে হতো। তারপর কিছু দিন এক মুদির দোকানে তাঁকে কাজ করতে হয়। একদিন রাস্তার পার্শ্বে তিনি কতকগুলি অতি সুন্দর খোদাই কাঠের কাজ দেখতে পান। এই কাজ শেখবার তাঁর আন্তরিক আগ্রহ হল। বলে-কয়ে কোনোরকমে মুদির কবল হতে রক্ষা পেয়ে সেই মিস্ত্রীর কারখানায় ভর্তি হলেন। সেখানে তিনি সাত বৎসর কাজ করেন। ঐকান্তিক আগ্রহ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, প্রাণঢালা সাধনায় তাঁর কাজের তুলনা নাই। সাত বৎসরে তিনি একজন সুদক্ষ কারিগর হলেন। তাঁর অবসর সময় বিনা কাজে ব্যয় হত না। কাজের পূর্ণতা এবং চারুতার জন্যে কখনও চিত্র আঁকছেন, কখনও মাপজোক নিচ্ছেন–সঙ্গে সঙ্গে আত্মোন্তির জন্যে বইপুস্তক পড়াও কামাই নাই। এর কিছুকাল পরে আরও উন্নত জ্ঞান-লাভের জন্যে তিনি লণ্ডনে রয়েল একাডেমীতে ভর্তি হন। জীবন্ত মানুষের মূর্তি নির্মাণ, চিত্রবিদ্যা প্রভৃতি কার্যে তিনি অতিশয় খ্যাতি অর্জন করেন। সহিষ্ণুতা, সাধনা, অধ্যবসায় এবং কঠিন পরিশ্রম আর তার সঙ্গে তাঁর প্রতিভা তাকে বড় করেছিল। তিনি অতিশয় দানশীল ছিলেন, কিন্তু সে কথা কেউ জানত না।
যে কোনো কাজই কর–বাইরের উপদেশে বিশেষ কিছু লাভ হয় না। মানুষ মানুষকে কিছু শিখাতে পারে না। মানুষ মানুষকে একটু দেখায় মাত্র, নিজের ওস্তাদ নিজেকেই হতে হবে। পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে জগতের কোনো কাজেই কৃতিত্ব লাভ করা যায়। সাধনায় প্রাণ বিশ্বাস এবং আত্মনির্ভরতা কোথা থেকে বুদ্ধি যোগায়, পথ পরিষ্কার হয়ে আসে, তা ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। আল্লাহ মানুষকে এমনি পূর্ণ করে গঠন করেছেন যে, তার পরের কাছে হাত পাতবার আবশ্যকতা খুব অল্পই আছে।