একদা কানাডা শহরে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি সমস্ত বোঝা তার দুর্বল পত্নীর ঘাড়ে চাপিয়ে গর্বিতের ন্যায় যাচ্ছিলেন। স্যার এডওয়ার্ড তাড়াতাড়ি সেই নারীর বোঝাটি নিজের পিঠে নিয়ে তাঁকে ভারমুক্ত করলেন। বস্তুত উত্তম স্বভাবের মানুষ দুর্বল এবং শক্তিহীনের উপর কষ্টের ভার চাপিয়ে নিজে সুখ পান না। নিজে শুয়ে বসে দুর্বল নারীকে দিয়ে সংসারের যাবতীয় কাজ করিয়ে নেওয়া হৃদয়হীনতার পরিচায়ক।
মানুষের মধ্যে ছোটলোক এবং ভদ্রলোক বলে কোনো কথা নাই। স্বভাব যার উত্তম, সেই ভদ্রলোক। নীচ বংশে জন্মেও যদি মানুষ স্বভাবে উত্তম এবং উন্নত হয়, সে মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। যে নমস্কার করে, মাটির আসনে বসে আছে, সে হয়তো অনেক সময় যে উচ্চাসনে বসে আছে তার চাইতে শ্রেষ্ঠ এবং উত্তম।
.
০৮. জীবন সাধনা
জাগতিক অভাব মানুষের বেদনা উপহাসের জিনিস নয়। জাগতিক দুঃখ ও দৈহিক অভাবের ভিতর দিয়েই আল্লাহ্ তার মহিমা এবং গুপ্ত ভাব প্রকাশ করেন। সুতরাং দেহের অভাবকে উপহাস করলে চলবে না, দেহের কথা ভাবতে হবে।
এই দেহের অভাবের জন্য মানব-সংসারে কত পাপই না অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আল্লাহ্ যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, সে প্রতিজ্ঞায় মনুষ্য বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে নাই। হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন, ক্ষেতের পুষ্প কেমন সুন্দর, পক্ষীরা আহারের চিন্তায় ব্যস্ত হয় না অথচ গলা ভর্তি করে সন্ধ্যাকালে তারা কুলায় ফিরে আসে। আল্লাহ্ মানুষের কথা কি ভুলে যাবেন? মানুষকে তিনি আরও বেশি ভালোবাসেন, মানুষকে কি তিনি আরও বেশি সুশোভিত করবেন না?
আল্লাহ্ আর এক জায়গায় বলেছেন, আমার বান্দার কাছে মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করি নাই।
তবু মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করে নাই। অবৈধ মিথ্যা পথে সে অন্ন এবং বস্ত্রের সন্ধানে ফিরেছে। অন্ন এবং বস্ত্রের জন্যে মানুষ কী পাপই না করেছে, তা ভাবতেও মন। অস্থির এবং ভীত হয়ে ওঠে। আত্মাকে বিনষ্ট করে সে বেশ্যা নারীর শুভ্র পোশাকে দেহকে সমিতো করেছে, অবৈধ অন্ন মুখে তুলে দিয়েছে।
কেন জীবনের পথ এত জটিল করে নিলে তোমরা? কে তোমাদের এই সর্বনেশে শিক্ষা দিয়েছে? আত্মাকে অপবিত্র করে, প্রাণঘাতী দারিদ্র্য-দুঃখকে বরণ করে জীবনকে ব্যর্থ করে দেবে? এরই নাম কি দ্ৰতা? এ ভদ্রতা কে শিখিয়েছে তোমাদের? পরিশ্রম করতে লজ্জাবোধ কর? শ্রমকে তোমরা সম্মান করতে জান না? চৌর্য, হীন দাসত্ব, কাপুরুষতা, আত্মার দীনতা ও মিথ্যার পোশাক তোমাদের কাছে ভদ্রতা? ৬০ টাকা বেতনে চাকরি করে অসৎ উপায়ে মাসিক ২০০ টাকা আয় করতে তোমাদের মনুষ্যত্ব লমিতো হয় না? আর এই চুরি করার সৌভাগ্য কয়জনের হবে? এ যে বিনষ্ট হবার পথ।
পরিশ্রমকে তোমরা সম্মান করলে বুঝতে পারবে, কয়লার মধ্যে, কল-কারখানার ধুলা বালির মাঝে, মাঠের কাদায়, কামার ঘরে অগ্নিস্ফুলিঙ্গে তোমাদের মনুষ্যত্ব ও শক্তি লুকিয়ে আছে। দুর্বল, কাপুরুষ, শক্তিহীন, ধর্মহীন, দুঃখী হয়ে তোমরা মরো না। চাকরি ক’টি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে? চাকরির নেশা ত্যাগ করে তোমরা দিকে দিকে ছুটে পড়। পাশ্চাত্য দেশে মানুষ শিল্প ও দৈহিক পরিশ্রমকে সম্মান করতে শিখেছে–কত প্রতিভা কত স্থানে আপন আপন জীবনকে সার্থক করেছে। তারা মানুষ, তাদের শক্তিতে সমস্ত জাতির দেহে অফুরন্ত শক্তি সঞ্চিত হয়েছে, তারাই জাতির মেরুদণ্ড এবং প্রাণ। কয়েকজন কেরানি ইংরেজ জাতিকে গিরি লঙ্ঘন করতে, আকাশে উড়তে, সমুদ্র অতিক্রম করতে শিক্ষা দেয় . নাই। কী অফুরন্ত বিরাট শক্তি সমস্ত জাতির দেহে রক্ত প্রবাহের কর্ম প্রেরণা ঢেলে দিয়েছে।
জাহাজ-নির্মাণ, কামান-বন্দুক তৈরি, অসংখ্য কলকজা, তালা-চাবি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, ছাপাখানা, কৃষি, অস্ত্র-সরঞ্জাম, স্থপতি শিল্প, ভূ-তত্ত্ব, খনি, চারুশিল্প, বস্ত্র তৈরি, সুঁই, সূতা, বাদ্যযন্ত্র, শিশি-বোতল, ধাতুর পাত্র, বাসন ও কাঁচ নির্মাণ প্রভৃতি লক্ষ্য করার কাজে নিজেদের প্রতিভা তাঁরা নিয়োগ করেছেন–শুধু চাকরির সন্ধানে তাঁরা তাঁদের জীবন। ব্যর্থ করে দেন নাই। জাতির অভাব চাকরিতে পূরণ হবে না। এর ফলে দেশে পরস্পর বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ বেড়েই উঠবে অভাবে দেশের মানুষের মনুষ্যত্ব থাকবে না।
জ্ঞান ও বিদ্যালোচনা চাকরির জন্য নয়। জ্ঞান মানুষের জীবনকে অসংখ্য প্রকারে সফল করবার সুযোগ ও সুবিধা করে দেয়। জ্ঞানকে দাসত্বের কাজে নিয়োগ করে জ্ঞানের মর্যাদা নষ্ট করো না। জীবনে ঘুমন্ত শক্তি, মস্তিষ্কের সহস্র লুকান ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলবার অমোঘ উপায় হচ্ছে জ্ঞান।
এ দেশে কি শিল্প চর্চা ছিল না? দেশের মানুষ কি কোনো কালে শিল্প প্রতিভার পরিচয় দেয় নাই? আল্লাহর সৃষ্টি এদেশে মানুষের সঙ্গে ইউরোপের মানুষের কি কোনো পার্থক্য আছে? যদি জাতি চাকরির নেশা ত্যাগ করে তার সমস্ত শক্তি বিবিধ পথে নিয়োগ না করে, তা হলে আবার বলি, জাতির দুঃখ বেড়েই যাবে। অভাব ও দুঃখের অন্ত থাকবে না। যে জাতি অভাব ও দুঃখ ভোগ করে, জগতে তাদের অস্তিত্ব থাকে না। পরিশ্রমকে অশ্রদ্ধা করো না। এম,এ, পাস করে তোমরা কখনো বাবুটি হয়ো না, এই হচ্ছে সর্বনাশের কথা। হাতের ক্ষমতোকে অবহেলা করো না। কুলির মতো সর্বত্র কাজ কর, কাজই জগতের প্রাণ। জগৎ বাবু হওয়ার, বসে বসে শুধুই চিন্তা করবার ক্ষেত্র নয়। জগৎ চায় কাজ। এই যে দেশে কৃষক, কামার, তাঁতী, জেলে, স্বর্ণকার, কাঠের মিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রী, মালী, চিত্রকর, শিল্পী, ভাস্কর–এরা কি অশ্রদ্ধার পাত্র? লেখাপড়া জানে না বলেই এরা মানুষের অশ্রদ্ধা ভোগ করছে। জাতির বাচবার যন্ত্রপাতি এদেরই হাতে। যেদিন এরা লেখাপড়া শিখবে, সেদিন জাতির পরিচালক হবে এরাই। এদের ইচ্ছায় জাতি উঠা-বসা করবে। যদি বাঁচতে চাও দেশের যুবক সম্প্রদায়কে বলি, লেখাপড়া শিখে সর্বপ্রকার হীনতাকে উপহাস করে তোমরা তোমাদের দুইখানি হাতকে নমস্কার করে নাও। তোমাদের ভিতর যে শক্তি আছে, সে শক্তিকে ভাড়া না দিয়ে স্বাধীনভাবে নিজের এবং জাতির মঙ্গলের পথে নিযুক্ত কর, সকল দেশের সকল জাতির মুক্তির পথই এই। প্রাচীন এবং বর্তমান সমস্ত উন্নত জাতির পানে তাকাও–দেখতে পাবে, তারা কখনও পরিশ্রমকে অশ্রদ্ধা করে নাই।