আল্লাহ চান না তোমরা শুধু ইসলামের মহিমা কীর্তন কর, তিনি চান তোমরা মুসলমান হও, নিজ নিজ স্বভাব খোদায়ি ভাবে গঠন কর।
হযরত মোহাম্মদ (দঃ) সম্বন্ধে বলা হয়েছে–”নিশ্চয়ই তোমার স্বভাব উত্তম।” যে নিজ স্বভাবকে উত্তমরূপে গঠন করেছে, সেই প্রকৃত নবীভক্ত; যে শুধু মুখে চিৎকার করে দরূদ পাঠ করে, সে নবী-ভক্ত নয়।
হযরত মোহাম্মদ (দঃ) বলেছেন–”আমি নীতিশাস্ত্রকে পূর্ণ করতে এসেছি।” ইসলাম নীতিময় জীবন।
মানুষের সুন্দর মুখ দেখে আনন্দ্রিত হয়ো না। স্বভাবে যে সুন্দর নয় দেখতে সুন্দর হলেও তার স্বভাব, তার স্পর্শ তার রীতি-নীতিকে মানুষ ঘৃণা করে। দুঃস্বভাবে মানুষ মানুষের হৃদয়ে জ্বালা এবং বেদনা দেয়, তার সুন্দর মুখে মনুষ্য তৃপ্তি পায় না। অবোধ লোকেরাই মানুষের রূপ দেখে মুগ্ধ হয় এবং তার ফল তারা ভোগ করে।
যার স্বভাব মন্দ, সে নিজেও দুষ্ক্রীয়াশীল মিথ্যাবাদী দুর্মতিকে ঘৃণা করে। মানুষ নিজে স্বভাবে সুন্দর না হলেও সে স্বভাবের সৌন্দর্যকে ভালোবাসে।
স্বভাব-গঠনে কঠিন পরিশ্রম ও সাধনা চাই, নইলে শয়তানকে পরাজিত করা সম্ভব নয়।
যে স্বভাব-গঠনে চেষ্টা করে, চিন্তা করে, সে এবাদত করে।
মানুষের পক্ষে একদিনে ফেরেস্তা হওয়া সম্ভব নয়। ধীরে, অতি ধীরে, বহু বৎসরের সাধনায় এমন কি সমস্ত জীবন ধরে নিজেকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে হবে। মন্দের সঙ্গে আমাদের জীবন এমনিভাবে জড়িত আছে যে, একে ত্যাগ করে আপন স্বভাবকে বিশুদ্ধ করা এক মহাকঠিন সাধনা। দিনের প্রতি কাজে, বাক্যে আমরা পতিত হই। প্রতিদিনকার রহস্য এবং আলাপে আমরা গোপনে গোপনে হীন এবং মূঢ় হই। কে আমাদের জীবনের এই শত গোপন কলঙ্ক হতে রক্ষা করবে?
জীবন গঠন করবার জন্যে ধীরে ধীরে চেষ্টা কর, কখনও ভীত হয়ে পশ্চাদপদ হয়ে না। সংসারে যারা কাপুরুষ তারাই স্বভাব গঠনের কঠিন কর্তব্য শক্তিহীনের শৈথিল্যে ত্যাগ করে পলায়ন করে। বীরের মতো সাহসী হয়ে সম্মুখে দাঁড়াও। ভয় পেয়ো না–পালিও না। পালালেই সর্বনাশের গভীর কূপে পতিত হবে। চিরদিনের জন্যে জীবনের অফুরন্ত গৌরব রাজ্য হয়ে ফিরে আসবে। দুর্গ জয় করতেই হবে, মানব জীবনের সুমহান সাধনা ত্যাগ করে পশুদের একজন হয়ো না।
এখানেই মানুষের সমস্ত শক্তি, সমস্ত জ্ঞানের পরীক্ষা হয়–কে কতখানি নিজকে গঠন করতে পেরেছে।–মিথ্যা, লোভ, দ্বেষ, হিংসা, দুর্বলতা কে কতখানি জয় করতে শিখেছে। তুমি কি মিথ্যা বলে থাক? তা হলে চেষ্টা কর–পুনঃ পুনঃ চেষ্টা কর–মিথ্যাকে পরিহার করে চলবার জন্যে। তুমি কি অন্তরে মিথ্যা গোপন করে মানুষের সঙ্গে কথা বল? তা হলে সাবধান হও। গোপনে আপন মনে লমিতো হও–শতবার লমিলতা হও। জীবনের গৌরব রক্ষা করবার জন্যে সর্বদাই চেষ্টা কর; মনুষ্য তোমায় বুঝতে পারুক আর না পারুক।
তোমার প্রবৃত্তি কি নীচ? তা হলে সাবধান হও–চিন্তা কর, নিজেকে সংশোধন কর, কারণ পশুর স্বভাব মনুষ্যের পক্ষে ইহা লজ্জাজনক।
যৌবনের উষ্ণ রক্তে তুমি কি মানুষের উপর হঠাৎ তোমার বজ্রমুষ্টি উত্তোলন কর? ক্ষান্ত হও, সহিষ্ণু হয়ে আপন কাজের তুমি সমালোচনা কর। শীঘ্রই মানুষের রক্ত নিস্তেজ হয়ে যায়, বার্ধক্যে শরীরের পেশীসমূহ দুর্বল হয়ে পড়ে। তুমি যাকে আঘাত করতে যাচ্ছ সেও এক সময় তোমারই মতো শক্তিশালী ছিল।
তুমি কি টাকার গর্বে মানুষের সঙ্গে উপহাসের সঙ্গে কথা বল? তা হলে সাবধান হও। কারণ তোমার চাইতে বড় মানুষ এ জগতে বহু এসেছিল–তারা ধুলায় মিশেছে।
তুমি কি নিষ্ঠুর? ইহা পশুর স্বভাব। মনুষ্য হয়ে কেমন করে তুমি নিষ্ঠুর হবে? তুমি আপন নিষ্ঠুর স্বভাবের জন্য লমিতো হও।
বয়য়াজ্যেষ্ঠ ও প্রবীণ ব্যক্তিকে সম্মান করতে কি তোমার লজ্জা হয়? গর্বে তোমার সমস্ত মানুষকেই অবজ্ঞা করতে ইচ্ছা হয়? তা হলে অনুতপ্ত হও–কারণ বিনয়ই মানুষের ভূষণ।
গর্বিত শয়তান চিরদিনই আল্লাহ্ এবং মনুষ্যের ঘৃণার পাত্র। মনুষ্যের গর্ব করবার কিছুই নাই। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বিনয়ই গৌরব করেন, গর্বে তাঁরা মর্যাদাশীল নন।
তোমার কি অনবরত পরের নিন্দা করতে ইচ্ছা হয়? নিন্দুককে সমস্ত জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিই ঘৃণা করেন। নিন্দুক সমস্ত মানুষের শত্রু-নিন্দাই তার ব্যবসা। সে মানুষের গুণকে শ্রদ্ধা করে না, মানুষের মূল্য তার কাছে কিছুই নয়।
মনুষ্য রাজাকে ভক্তি করে না। কিন্তু উত্তম স্বভাবকে সে আন্তরিক ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে। মানুষের কাছে যদি লমিলতা ও নিন্দিত হয়ে বেঁচে থাকতে হয়, তার চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?
উত্তম স্বভাবের অর্থ–অন্যায়কে সমর্থন করা নয়, শুধু মানুষের প্রশংসা লাভের সাধনাও নয়। কারণ, যে সবাইকে তুষ্ট করতে চায়, সে কাউকেও সন্তুষ্ট করতে পারে না।
স্বভাব যার উত্তম, সে সর্বদাই নীতিবান, মিথ্যাকে সে আন্তরিক ঘৃণা করে, প্রাণ গেলেও সে মানুষকে তুষ্ট করবার জন্যে অন্যায় ও মিথ্যাকে স র্থন করে না। সে মিথ্যাকে সাক্ষ্য দেয় না। অন্তরে পাপ, মুখে তার মধু নয়। সে বিনয়ী, ভদ্র এবং সহিষ্ণু। সে মানুষের দাবীকে নষ্ট করে না, সে কখনও অভদ্রের মতো কথা বলে না। মানুষকে ইতর ছোটলোক বলে উপহাস করে চলা তার স্বভাব নয়। সে জ্ঞানবান, কারণ জ্ঞানী ব্যতীত সূক্ষ্মভাবে জীবনের অন্যায় এবং ন্যায় কোনোমতে অনুভব করা যায় না। সকলের প্রতিই তার সহানুভূতি আছে। সে আত্মসর্বস্ব নয়। শুধু নিজের সুখের চিন্তাতে সে ব্যস্ত থাকে না। মানুষ তার যতটুকু দেখে, সে ততটুকুতেই শুদ্ধ এবং সুন্দর নয়। নিজের চোখে সে আপনাকে যতটুকু দেখে, ততটুকুতেই সে সুন্দর। সে যেমন নিজের সম্মান বোঝে, অন্যের সম্মানও সে। তেমনি বোঝে। তার দৃষ্টি অতিশয় তীক্ষ্ণ, সে হৃদয়তা প্রদর্শনে কোনো সঙ্কোচ করে না।