বড়ই দুঃখের বিষয়, ভারি বেদনার কথা, যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে, মানব কল্যাণের নামে অস্ত্র ধারণ করেছে–তারা যদি ঘুষ খায়, চরিত্রহীন হয়, দুর্বল, নিরপরাধীর উপর অত্যাচার করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে। দেশের অনেক কর্মচারী সম্বন্ধে সাধারণের মধ্যে নানা অপবাদ শোনা যায়। যারা জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার পবিত্র নামে আপন কার্যের অবমাননা করে তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। তাদের মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই। যারা হবে বেশি ভালো, তারাই যদি হয় অধিক মন্দ, তবে আর সে অবস্থায় মীমাংসা কী? ফরাসি সেনাপতি বেয়ার্ড আদর্শ সেনাপতি ছিলেন। তিনি মহাপ্রাণ, নিষ্পাপ এবং মহামানুষ ছিলেন। তিনি নির্ভীক, দোষশূন্য ছিলেন। অবিচার তাঁর কাছে ছিল না। যোদ্ধা হলেও তাঁর হৃদয় ছিল দয়ার আঁধার। তিনি সত্য ছাড়া মিথ্যা জানতেন না। দুঃখ-বিপদ যত হত, তার সাহসও তত বেশি বাড়ত। বড়লোককে তিনি ঘৃণা করতেন, যদি তারা সজ্জন না হতেন। তিনি সমস্ত অর্থ দরিদ্রদের মধ্যে দান করে দিতেন। তিনি সর্বদা গোপনে এবং নিরহঙ্কারচিত্তে প্রতিবেশীদেরকে সাহায্য করতেন। তিনি শত শত নিঃসহায় বালিকাকে মাসিক বৃত্তিদান করতেন। বিধবারা কখনও তাঁর সাহায্য হতে বঞ্চিত হত না।
কত সাদা কাপড়পরা ভদ্রলোক নির্মমভাবে দরিদ্রের অভাব দেখলে সেখান থেকে সরে যান, বেয়ার্ড তাদেরকে সাহায্য করা কর্তব্য বলে মনে করতেন। তিনি অধীনস্থদেরকে অতিশয় স্নেহের চোখে দেখতেন। বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া, পীড়িতকে ঔষধ দেওয়া, ঋণীর ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া ছিল তার স্বভাব। তিনি প্রশংসা তোষামোদ ঘৃণা করতেন। বাল্যকালে যে-সব মহৎ গুণ তার চরিত্রে প্রকাশ পেয়েছিল, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো আরও বেড়েছিল। অনেক সময় দেখা যায়, যুবক বয়সে মহৎ ও সাধু থাকে, শেষে তারাই নিষ্ঠুর এবং অসাধু হয়ে উঠে। ডিউক অব ওয়েলিংটনও আদর্শ সেনাপতি ছিলেন। তিনি পরাজিত দেশবাসীর প্রতি অতিশয় দয়াপূর্ণ ব্যবহার করতেন। একবার তার সৈন্যগণ কতকগুলো কাঠ তার গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলো। সেনাপতির কাছে অভিযোগ করা মাত্র তিনি কড়ায় গণ্ডায় তাদের প্রাপ্ত দাম বুঝে দেন। তিনি অত্যাচারকে আন্তরিক ভাবে ঘৃণা করতেন। তিনি ঘুষ গ্রহণ করা অতিশয় হীন কাজ বলে মনে করতেন। তার হৃদয় দয়ার সাগর ছিল। একবার যুদ্ধে যখন তাঁকে মৃতের সংখ্যার তালিকা দেওয়া হয়, তখন তিনি বালকের ন্যায় শোকে ক্রন্দন করেন। এই দয়ার সাগর সেনাপতি ক্ষমা করতে পারলে কখনও শাস্তি দিতেন না। নিম্নপদস্থদের সঙ্গে অতিশয় ভদ্র ও মধুর ব্যবহার করতেন। যুদ্ধে লুণ্ঠন-কার্যকে তিনি অতিশয় ঘৃণা করতেন! আহত সৈন্যদের রক্ষার জন্য তাঁর আন্তরিকতা ছিল অসীম-স্বজাতি, বিদেশী যেই সে হোক।
অন্যেরা যাকে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে এসেছে তিনি তাকে কুড়িয়ে এনেছেন। নেপোলিয়নের মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদ করতে যেয়ে তিনি বলেন–সেনাপতি জল্লাদ নয়। নেপোলিয়ন কিন্তু মৃত্যুকালে, ডিউককে যে ব্যক্তি হত্যা করতে চেষ্টা করেছিল, তাকে দশহাজার ফ্রাঙ্ক পুরস্কার দিয়ে যান। এই ব্যক্তিও সৈনিক, কিন্তু দুজনের মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল ব্যবধান। প্রাচীনকালে বর্বর গথ এবং জার্মানের হন জাতি.ল্যাটিন সভ্যতা ধ্বংস করেছিল–আগুন, রক্ত, ধূম, হাহাকার ক্রন্দন তাদের গমন পথকে কলঙ্কিত করেছিল। এরা হচ্ছে আল্লাহর গজব। আল্লাহর অভিশাপ হয়ে এরা জগতে রক্তস্নাত করেছে।
আলেকজান্ডার প্রাচীন সিনিসিয়ার রাজধানী টায়ার ধ্বংস করতে গিয়ে রাজপথসমূহে রক্তের নদী সৃষ্টি করেছিলেন। আলেকজান্ডার, চেঙ্গীস খ, হালাকু খাঁ, সুলতান মাহমুদ, নাদিরশাহ্ পবিত্র তরবারির অপমান করেছেন। অনন্ত মানুষের বুকে আগুন জ্বেলে এরা। জগতে রক্তনদী সৃষ্টি করে আনন্দ পেয়েছে। এরা সেনাপতি, না দস্যু?
তরবারি ধারণ করবার যোগ্যতা কার আছে?–যিনি মহাজন, যিনি প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ, যিনি মানুষের রক্ষাকর্তা–বন্ধু, যিনি দুর্বলের বল, মানব জাতির পরম হিতাকাক্ষী, সহায়।
.
০৫. স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
রোমান সেনাপতি সিন-সি-নিটাস সমস্ত জগতের কাছে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান জাতির কাছে আদর্শ মহাপুরুষের স্মৃতি হয়ে মানব ইতিহাসে বেঁচে আছে।
চাকরি ছাড়া মানুষের জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়–এ ধারণা বাঙালি মুসলমান ছাড়া আর · কারো নেই। ইসলাম ধর্মের প্রথম বিশ্বাস মন্ত্র (কলেমা শাহাদাত) মানুষের জীবনে কতখানি স্বাধীনতার ভক্ত করেছে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। অথচ বাঙালি মুসলমান জীবনের স্বাধীনতাকে কতখানি অমর্যাদা করে, তা বলা যায় না। আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ মানুষের নমস্য ও ভক্তির যোগ্য নয়–এই হচ্ছে মুসলমানের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ ধর্মবিশ্বাস। সত্য জীবনযাপনেই যে মানুষের গৌরব বেশি, মুসলমানের সে মহাচিন্তাধারা প্রাণে আজ জাগে না, তার কারণ সে প্রকৃত মুসলমান নয়। সে নিজের ধর্মের ভাব ও রস গ্রহণ করতে পারে। না। না বুঝে সে কোরান পড়ে এবং স্বর্গের আশা করে। তার জীবনের মহৎ ভাব, গৌরবের ধারণা কোনোমতে আসে না। গ্রামের দারোগা ফকু মিয়া ছুটি নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি আসেন, সাধারণকে ধরে এনে গালি দেন, অপমান করেন–তা দেখে অশিক্ষিত প্রতিবেশী মুসলমান মনে করে এই উচ্ছল প্রতাপের জীবনই হচ্ছে গৌরবের জীবন। অনেক বছর আগে কলকাতার কোনো ছাত্রাবাসে যশোহরের কোনো জাম্বিল-পরা কাজী সাহেব একদিন গল্প করছিলেন আমার বাপ-দাদা গ্রামের কৃষকদের বাড়িতে ধরে এনে জুতা মারেন, এমনই সম্ভ্রান্ত আমরা। আমরা মাঠে গরু-ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে শস্য নষ্ট করলে কারো সাহস হয় না প্রতিবাদ করে। জীবনের গৌরব সম্বন্ধে বাঙালি মুসলমানের ধারণা কত ছোট, তারই নমুনা মাত্র এই একটি।