মানুষ মানুষের বুকে কীভাবে সঙ্গীন চালিয়ে দেয়–ও দৃশ্য আমি দেখতে পারি নে, সহ্য করতেও পারি নে, ভাবতেও পারি নে। থাক তোমাদের রাজত্ব আমার জীবনের সঞ্চিত। সমস্ত ধন তুমি নিয়ে যাও, তথাপি তোমার বুকে আমি বর্শা চালাতে পারবো না।
মানুষ হত্যা কী পাপ নয়? আত্মরক্ষার জন্যে মানুষ অস্ত্র ব্যবহার করুক, মানুষের মতো মনে দরদ দিয়ে সে যুদ্ধ করুক। হায়, মানুষ মানুষকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে! এমন জঘন্যভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ হয়!। আমার সঙ্গে কুস্তি কর, দেখি তোমার কেমন শিক্ষা, কেমন তোমার গায়ে বল? দূর থেকে চোরের মতো আমার হৃদয়ে গুলীবিদ্ধ করে তোমার কী আনন্দ? তুমি কি মানুষ? তোমার কি মৃত্যু নেই। তোমার কাজের কি কোনো কৈফিয়ৎ নেই? এই কামান-বন্দুকের ব্যবহার কতদিন থেকে শিখেছ? মহাপুরুষ বুদ্ধদেব তীরবিদ্ধ রক্তাক্ত পাখিকে কোলে করে কেঁদেছিলেন। আর তোমরা মানুষের বুকে গুলি চালিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস পর্যন্ত ফেল না। আমাকে ফাসীকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মার, কুঠার দিয়ে আমার মাথা কেটে ফেল, শুধু নিষ্ঠুর বর্বরের মতো যাতনা দিয়ে, অপরিসীম দুঃখ দিয়ে মের না।
যিশুখ্রিষ্টকে কতবার তোমরা ক্রুশকাষ্ঠে ঝুলাবে? খ্রিষ্টের রক্তাক্ত দেহ, তার যাতনাক্লিষ্ট মুখ দেখে কি তোমাদের মায়া হয় না? ও দৃশ্য কি চোখে দেখা যায়? হায়! ধর্মহীন মানুষ!
যারা এত অধার্মিক, তারাই জগতে কর্তৃত্ব করবে। হাজার হাজার, কোটি কোটি মানুষ! খ্রিষ্টের মৃত্যু তোমরা চোখে দেখে শান্ত হয়ে আছ? তোমাদের ভিতর ক্রোধ জাগে না, অভিমান জাগে না?
আমি বলি তোমরা যুদ্ধনীতি বর্জন কর। সমস্ত বন্দুক, কামান, তীর, বর্শা সাগরজলে ফেলে দাও। যারা শুনবে না পৃথিবীর সমস্ত ঈশ্বরের মানুষ, সর্ব জাতির শান্তিকামী মানুষ মিলিত হয়ে সেই মনুষ্যহন্তা অত্যাচারী মনুষ্য দলের সঙ্গে সত্যাগ্রহ কর। তাদের সঙ্গে কারও কোনো সংশ্রব নেই; এইভাবে আমরা ঈশ্বরের রাজ্য স্থান করি। শয়তানের অনুচরেরা যারা নিষ্ঠুর ঈশ্বরবিদ্রোহী, তারাই কি জগতের ক্ষমতার অধিকারী হবে? কার কথায়, কোন লাভে, কার স্বার্থে, কার আদেশে তোমরা দলে দলে যেয়ে ভ্রাতার বক্ষভেদ কর, নিজের বক্ষ বিদ্ধ হতে দাও? ও পাপের জন্য দায়ী কে? এই মনুষ্য হত্যার জন্য তোমরা জগতে কি রাজত্ব পেয়ে থাক? যারা তোমাদেরকে যুদ্ধ হানাহানি করতে বলে, তারা তো সুখেই ঘরে বসে থাকে। মর তোমরা শুধু। বিভিন্ন দেশের মানুষ আপন ইচ্ছামত যার যেখানে ইচ্ছা, বাস করুক। কেন মারামারি হয়? আর যদি মারামারি হয় তবে কি অমন নির্মম মারামারি! সম্মুখ সমরে প্রবৃত্ত হও। কেন মেঘের ভিতর থেকে মেঘের অন্তরালে লুকিয়ে দশ মাইল দূর থেকে বাণ নিক্ষেপ কর? বাণ যখন শত্রুর দেহ বিদ্ধ করে, তখন তার কত যন্ত্রণা হয়, তা কি একটুও ভাবতে পার না? কীভাবে মানুষকে অত ব্যথা দিয়ে তোমরা বেঁচে থাক? কুঠার দিয়ে কাছে এসে বরং এক আঘাতে তার শির দেহ হতে বিভক্ত করে ফেল।
একজনের দোষে নয়, পরস্পরের দোষে জগতে-যুদ্ধ, নৃশংসতা ও ভীষণতা বেড়ে গেছে। একজন যদি যুদ্ধে নৃশংস বধের পন্থা অবলম্বন করে, আত্মরক্ষার জন্যে আমাকেও তেমনি করতে হয়। এইভাবে মানব সমাজে মহাপাপ আসন পেতে বসেছে। যে ভালো সেও মন্দ ও বর্বর হয়েছে। বরং যথাসম্ভব ক্ষতি স্বীকার করতত্রাচ নৃশংস আচরণ করো না। দেশে দেশে মানুষ সমস্ত ভীষণ যুদ্ধাস্ত্র তৈরি বন্ধ করে দিক, তা হলেই জগতে বর্বরতার অবসান হবে। যুদ্ধে নৃশংস আচরণের শেষ হবে।
দস্যু ও শয়তানের বুকে দানব রাজত্ব করে, যেখানে দয়া-মমতার নাম-গন্ধ নেই। তাদেরকে দমন করতে হলে হত্যা করতে হয়। তারা যেমন অস্ত্র ব্যবহার করে, আমাদেরকেও তার চেয়ে ভীষণ অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়।
এভাবেই জগতে পাপ বেড়েছে। প্রাচীনকালের মানুষ, যাদের কোনো ধর্ম ছিল না, কিংবা পশু দুরাত্মাদের মধ্যে এমন হতে পারে–সত্য মানুষ, যাঁরা যিশু, আব্রাহাম, বুদ্ধ, মুহাম্মদের শিষ্য, তাদের মধ্যেও কি পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধে তেমনি হবে?
আগে বাংলাদেশের নদী-নালা দস্যুতে ভর্তি ছিল। মানুষের জীবন, ধনরত্ন নিরাপদ ছিল না। দস্যুরা নিরীহ পথিকের সর্বস্ব লুণ্ঠন করত। একবার বরিশালের এক নদীতে এক ভদ্রলোক তাঁর পত্নীসহ নৌকায় কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সন্ধ্যার অন্ধকারে একদল দস্যু এসে তাদেরকে আক্রমণ করল। ধনরত্ন তো নিলই, ভদ্রলোকটিকে নদীগর্ভে ফেলে দিল। নারীর ক্রন্দনে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে তার মাথা কুঠার দিয়ে দুভাগ করে ফেল্ল। গহনাগুলো জীবিত অবস্থায় নাক-কান থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিল। হাত-পা’র গহনা খুলতে টানাটানি না করে হাত-পা কেটে ফেল্ল। খুলে দেবার দেরি সহ্য করল না। এমনই নির্মম পিশাচ এরা। এদেরকে দমন করবার জন্যে অস্ত্র আবশ্যক। দুষ্টের দমনের জন্যে অস্ত্রের প্রয়োজন হবেই। চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্তুগীজ দস্যুর অত্যাচার-কাহিনী সর্বজনবিদিত। মুসলমান সেনাপতিরা এদেরকে সমূলে দমন করেন। মানুষকে শান্তি দাও, নিষ্ঠুরের মতো নয়–বর্বরের মতো নয়। যারা জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অস্ত্র ধারণ করেন–তাঁরা মহাপুরুষ। গত জার্মান যুদ্ধে বাঙালি সৈন্যদলের করাচী হতে পল্টনে যোগ দিবার সময় কম্যান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ. এল. ব্যারেট সৈন্যদলের মাঝে বক্তৃতায় বলেছিলেন–সিপাহী লোককা য্যায়সা ইজ্জত হ্যাঁয়, এ্যায়সা আওর কিসিকা নেহি হ্যাঁয়। অর্থাৎ জগতে সৈনিকের যেমন মর্যাদা, এমন আর কারো নয়। একথা সত্যি। লেখক কয়েক বছর আগে ‘মোস্লেম ভারতে’ লিখেছিলেন : সৈনিকের মর্যাদার কথা। দুর্বলকে দানবের অত্যাচার লীলা হতে বাঁচাতে, বিশ্বের কল্যাণ স্থাপনের জন্য যে আপন প্রাণ দেয়, সে কী সহজ? সে নমস্য, সে নমস্য, সে নমস্য। কতকাল আগে অবজ্ঞা, অসম্মানিত অবস্থায় এক সৈনিক আপন বুকের রক্ত দিয়ে মাটি রঞ্জিত করেছিল–আজ তিনশত বছর পরে সেই রক্তধারা ফুল হয়ে আমার বিছানার চারপাশে পড়ে আছে।