মহামানুষ কারা? যারা ঈশ্বরের বাণী লাভ করে জগতের মেষদলকে ঈশ্বরের বাণী শুনিয়েছেন। সত্যের জন্য বলি হয়েছেন, দুঃখ সয়েছেন, তারাই মহামানুষ। এতদ্ভিন্ন আর কে মহামানুষ। আর কে মহামানুষ হতে পারে? এরূপ আকাক্ষা করাও পাপ। কারণ জীবনে নামের জন্য, যশের জন্য মানুষের কোনো সাধনা সিদ্ধ নয়। মানুষ কর্তব্য করবে, ঈশ্বরের আদেশ শিরে বয়ে জীবনের পথে চলবে–তাতে তার জীবনের আসন যেখানে হয় হোক, বড় এবং ছোট হওয়ায় তার কী আসে যায়! আমরা ক্ষুদ্র, সামান্য মাটির মানুষ। জীবনের দিনগুলো সাধুকার্যে যদি রঙিন করে তুলতে পারি যদি বাতুলের ন্যায় মানুষের সঙ্গে আলাপে প্রলাপ বকে সময় নষ্ট না করি, সামান্য কিছু অর্থলাভ করেই দাম্ভিক সেজে না বসি–তাই-ই আমাদের পক্ষে মহাজীবন। দোকান ঘরে অংশীদার বন্ধুর আগোচরে যদি একটি পয়সাও না লই, লজ্জা ত্যাগ করে সেবা ও সত্যের জন্য যদি পথের মজুর সাজতে কুণ্ঠাবোধ না করি, বৃদ্ধ, রুগ্ন পিতা-মাতার জীবনে যদি আনন্দ দিতে পারি, তাই আমাদের পক্ষে মহাজীবন। যদি চাকরি করে প্রত্যহ ঘুষের লোভ সংবরণ করতে পারি, প্রতিবেশীর দুঃখ বেদনায়, তাকে যথাসম্ভব সাহায্য করি, জীবনে অশিক্ষিত ও মূঢ় চিত্ত থাকতে লজ্জাবোধ করি–তাই-ই আমার পক্ষে যথেষ্ট গৌরবের জীবন। পৃথিবীকে ওলট-পালট করবার সাধনা আমার না, নোবেল পুরস্কার পাবার আশাও আমি করি না; যৌবনগর্বে যদি জিহ্বাকে সংযত রেখে মূল্যহীন-কুতর্ক হতে রক্ষা করতে পারি, দরিদ্র ইতর লোকদের সন্তানগণকে আপন অজানিত অবজ্ঞার জীবনে, জীবনের গান শোনাতে পারি, তাদেরকে বছরের পর বছর ধরে শিক্ষার আলো দান করতে পারি–সেটাই আমার পক্ষে মহাজীবন।
আমি মূল্যবান পোশাক চাই না, অট্টালিকা-কোঠাবাড়ি চাই না; শুধু সহজ জীবনে শান্ত নির্বিকার দৈনন্দিন আনন্দে জীবনকে সুরভিত করে তুলতে চাই–দেশের মানুষকে প্রিয়তম জ্ঞান করতে চাই–আপন দেশ ও স্বাধীনতাকে ভালবাসতে চাই–উদ্ধত, গর্বিত, অত্যাচারী, স্বাধীনতা অপহরণকারী দুবৃত্ত শত্রু-গুধারী নামাজিকে পদাঘাত করতে চাই–এটাই আমার জন্য গর্বের জীবন।
নারীর সম্মান যেন আমার জন্য ক্ষুণ্ণ না হয় নারীকে যারা বিপথে নেয় তাদের রক্ত আমি পান করতে চাই। জীবনে মিথ্যা চাই না, প্রতারণা চাই না, প্রবঞ্চনাও ভালবাসি না, প্রতিজ্ঞার মর্যাদা রক্ষা করতে চাই। আমি ধনী হতে চাই নে। যা প্রয়োজন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে চাই। অভাবগ্রস্ত ভদ্রলোক হতে চাই নে, সচ্ছল অবস্থায় কৃষক হতে চাই, এটাই আমার জন্য মহাজীবন। কামুকতা চরিতার্থ করবার জন্য বিবাহ করতে চাই নে, তা তো পশুতেও করে। আমি শুকর, না বৃষ? আমার স্ত্রী আমার মানস-স্বর্গের দেবী হবে। আমার গৃহ ঋষির আশ্রম। আমার পুত্র-কন্যারা হবে দেব-শিশু। আমার স্ত্রী জীবনে কখনও কঠিন কথা বলবে না–সেই হবে আমার পার্থিব জীবনের স্বর্গ। এটাই আমার জন্য মহাজীবন।
যে মাথা মহাসত্যকে পূজা করেছে, প্রণাম করেছে, তা দাসের হীন স্বার্থে অন্য কাউকেও শ্রদ্ধা জানাবে না, অথচ সেবায় আমি মাটি অপেক্ষা ছোট হবো, -,নুষের পদধূলি মাথায় নিয়ে ধন্য হবো, এটাই আমার মহাজীবনের ধারণা। আমি দরিদ্রকে উপেক্ষা করে ডেপুটি বাবুর সঙ্গে হেসে মিশে জীবনের মান বাড়াতে চাই নে। আমি আকাশে উঠতে চাইনে, বাতাসে উড়তে চাই নে। সাগর সেচতেও চাই নে। গিরিশীর্ষ ধরে আছাড় মারতেও চাই নে–অতবড় কাজ আমার দ্বারা হবে না! আমি নিজ জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষেত্রে আমার দীন জীবনের শান্ত আলো ছড়াতে চাই। তাই আমার জন্যে মহাজীবন।
.
০৪. যুদ্ধ
সর্বনাশ! এভাবে মানুষকে মানুষ হত্যা করতে কে শিক্ষা দিয়েছে? আমি ভাববাদী নই, মহামানুষও নই–তথাপি প্রাণ আমার কেঁদে জিজ্ঞেস করেছে–মানুষ এত নিষ্ঠুর হল কী প্রকারে? তোমরা জীবনে কোনো না কোনো ধর্ম মান নিশ্চয়ই। এই কী তার পরিচয়? আমি বলি, তোমাদের কোনো ধর্ম নেই। সবই যেন তোমাদের পাগলের খেলা। জাত এ কি ঈশ্বরের ব্যবস্থা? হায়, হয়তো ছোঁয়াছুঁয়ি তোমাদের ধর্ম। প্রেম তোমাদের জন্য নেই। পোশাক, গীর্জা ও মসজিদই তোমাদের ধর্ম। প্রেম তোমাদের ধর্ম নয়। হায়, তোমাদের প্রাণে দরদ কই, মানুষের জন্য মমতা কই?
দিনের মধ্যে শতবার অজু করছ যাতে শুদ্ধ ও পবিত্র হতে পার। স্নান করছ, যাতে পাপ ধৌত হয়। কতবার ভগবান-ভগবান, (Lord-Lord) আল্লা-আল্লা করছ, এতেই কী ঈশ্বর তুষ্ট হন? আলখেল্লা পরা ধার্মিকগণ! সারা রাত উপাসনা করছ–প্রাণে কিন্তু দরদ নেই, সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠা নেই। বাঃ বেশ তোমাদের ধর্ম! সন্ধ্যায় কুকুরের মতো ক্রোধে মানুষের বুকের মাংস খেতে উদ্যত হচ্ছ! তোমরা সত্যই ধার্মিক। হায়! দরদহীন, প্রেমহীন, মমতাহীন ধর্ম!
উত্তেজিত, ক্রুদ্ধ মানুষকে মারাত্মক ভীষণ অস্ত্র ত্যাগ করতে বল্লে কে তা আর শোনে? একটা মানুষকে শান্ত করা যায় না, জগৎকে কী করে বুঝান যাবে? যুদ্ধে সঙ্গীন, বন্দুক, কামান, তীর, গ্যাস, বর্শা এসব ব্যবহার বড়ই নিষ্ঠুরতা। মানুষ এত নিষ্ঠুর, তার প্রাণে দরদের এত অভাব যে তারা উত্তেজিত পশুর মতো অতি নিষ্ঠুরভাবে তার ভ্রাতাকে হত্যা করে।
প্রাচীনকালে মানুষ নিজ নিজ শরীরের শক্তি দ্বারা শত্রুকে পরাজিত করতে চেষ্টা করতো। যুদ্ধে তরবারি এবং মুগ্ধার ছাড়া আর কোনো কিছু ব্যবহার করা মহাপাপ। মানবপ্রাণে দরদই যদি না জাগল, ভ্রাতাকে দুঃখ দিতে যদি তার অন্তরে মমতাই না হল, তবে আর সে জগতে ধর্মের মানে কি আর পালন করে? এরই নাম কি মানব সভ্যতা? কার শরীরে কতখানি শক্তি আছে, সম্মুখ সময়ে তারই পরীক্ষা হোক। তিন ক্রোশ দূর থেকে কামান দেগে মানুষকে হত্যা করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। দূর থেকে মানুষের বুকে তীর ছোঁড়া, সঙ্গীন দিয়ে তার বুক ফেঁড়া, গুলি করে তার হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ করা হয়, কতখানি নির্মমতা! কীসের জন্য মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়? মানুষ জীবনে কদিন বাঁচে। মানুষের মধ্যে শক্তির পরীক্ষা হোক, তার শৌর্য-বীর্যের পরীক্ষা হোক, হাতাহাতি-ধাক্কাধাক্কি লাঠালাঠি হোক। নিষ্ঠুর যুদ্ধ কেন?