মানুষকে কোনো রকমে দুঃখ দিও না, জীবনকে মহাগৌরবের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে ইচ্ছা কর। মানুষ তো অনেকেই জগতে জন্মে। যারা হীন কুকুরের জীবন জগতে কাটিয়ে গেল, যারা অত্যাচারে জগতের বুকে হাহাকার ধ্বনি জাগিয়ে গেল, তাদের শেষ মাটি, আর যারা দরিদ্র, অশ্রু পূজাই যাদের জীবনের শেষ পূজা, দরিদ্র, অবহেলিত, অপমানিত–তাদেরও শেষ মাটি।
এই পৃথিবীই আমাদের শেষ নয়। মানুষের জন্য এক মঙ্গলময় ভবিষ্যৎ আছে–যেখানে আমাদের জীবনের অবস্থা আমাদের কৃতকর্মের ফল অনুসারেই হবে।
জেনোয়াতে (Genoa) যখন গণ-শাসনতন্ত্র একটি সামান্য বণিকের সন্তান একটি গৃহস্থ ঘরের যুবকের হাতে এল, তখন জেনোয়ার ধনী ও কুলীন সম্প্রদায় মর্মে মর্মে চটে গেলেন। উবাটো (Uberto) নামক জনৈক যুবক আপন স্বভাবের অমায়িকতা, মহত্ত্ব ও আত্মশক্তিতে দেশের সমস্ত ক্ষমতা অধিকার করলেন। .
কিন্তু এ কর্তৃত্ব বেশি দিন তিনি করতে পারলেন না। দেশের আমীর সম্প্রদায় এই নীচ নিম্নশ্রেণীর লোকটার কর্তৃত্ব সহ্য করতে পারলেন না। তারা সত্বরই সংঘবদ্ধ হয়ে উবার্টো (Uberto)-কে দূরদেশে নির্বাসিত করলেন। তার প্রাণদণ্ডেরই আদেশ হতো, কিন্তু নগরের বিচারক এডর্নো (ইমরভম) দয়া করে তাকে মাত্র নির্বাসন দণ্ড দিলেন।
উবার্টো (Uberto) আপন দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে বিদেশে বহু বৎসর আপন প্রিয়জন বিচ্ছেদ দুঃখের মর্মযাতনায় জীবনযাপন করতে লাগলেন। কিন্তু বিদেশেও আপন মহৎ স্বভাবের গুণে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ ধনী বলে পরিগণিত হলেন। পরিশ্রম, সৎ-সাহস, সততা, মহত্ত্ব এসব গুণই মানব জীবনকে সর্ব অবস্থায় উন্নত করে। উবার্টের অর্থাভাব নেই, কিন্তু স্বদেশের বিরহ যাতনা সদাই তার বুকে লেগে থাকত। একদিন বিদেশে টিউনিস (Tunis) নগরে হঠাৎ তিনি শৃঙ্খলাবদ্ধ এক যুবককে দেখতে পেলেন। যুবককে সদ্বংশজাত বলে মনে হল। কুলির কঠিন জীবন তাকে বহন করতে হচ্ছে। কাছে যেয়ে অনুসন্ধানে জানতে পারলেন–যুবক জেনোয়া শহরের প্রধান বিচারপতি এডর্নোর (Adorno) সন্তান। বন্দি হয়ে দাসরূপে বিক্রিত হয়ে বর্তমানে এই কঠিন দুঃখের জীবন যাপন করছে। এডর্নো!–যিনি পদ ও বংশ মর্যাদার গর্বে দরিদ্র নীচ বংশের উবার্টোকে চিরনির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করেছেন, সেই এডর্নোর পুত্রের এই দুরবস্থা! এই অপমানের জীবন! উবার্টো যুবকের মালিককে বহু মিলিয়ন (Million) ক্রাউন মূল্য দিয়ে যুবককে উদ্ধার করলেন। যুবক এই অপরিচিত ব্যক্তির মহানুভবতায় অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি উবার্টোর পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। উবার্টো বল্লেন, আপনাকে শীঘ্র দেশে পাঠাবো। আপনার পিতার কাছে আমার পরিচয় পাবেন। কিছুদিনের মধ্যে বহু উপঢৌকন সহ উবোটো নিজ জীবনের পরম শত্রু পুত্রকে স্বদেশে পাঠিয়ে দিলেন। এডনো বহুঁকাল পরে অপ্রত্যাশিতভাবে পুত্রকে পেয়ে হাতে স্বর্গ পেলেন। উবার্টোর পরিচয় তিনি পুত্রের কাছে পেয়ে তার গত কৃতকর্মের জন্য বহু অনুশোচনা করলেন। এবং দেশে বহু আন্দোলন করে উবার্টোকে দেশে ফিরিয়ে আনবার পূর্ব আদেশ প্রত্যাহার করলেন। মহিমার কাছে বংশ গৌরবের কোনো মূল্য নেই। বংশ গৌরবের অর্থ দাম্ভিকতা, অত্যাচার, অপ্রেম ও . নিষ্ঠুরতা–তা অহঙ্কারের মতো মানুষের হৃদয়কে তাপিত করে তা কখনও দরিদ্র, পতিত ও মূঢ়কে স্বর্গের আলো দেখাতে সমর্থ নয়। যে আপনাকে ভুলেছে, জীবনের বা বংশের গৌরব-গর্ব যার প্রাণে স্বপ্নেও জাগে না, সেই জগতে আদর্শ মহাপুরুষ হয়ে মানুষের অন্তরকে স্বর্গের অমৃতধারায় অভিষিক্ত করে দুর্বলকে পথ দেখায়, দুঃখীকে সান্ত্বনা দেয়, পতিতকে উন্নত করে, অপরিচিতকে পরম আত্মীয় করে।
মানুষ অহঙ্কারকে ভালবাসে না, যা অগ্নির ন্যায় দূর হতে সুন্দর দেখায় সুশীতল বারির মতো তা তৃষিত, তাপিত মানুষের জীবন ঠাণ্ডা সরস করে না। আমরা চাই দরিদ্রের আদর্শ-মহামহিমার জীবন।
“হে প্রভু, কাফেরদিগের উপর আমাদিগকে কর্তৃত্ব দাও।” (কোরান) যারা কদাচারী, নীচ, ধর্মহীন, বিধর্মী, তাদের কাছে নত হবার মতো লজ্জা আর নেই। যারা জ্ঞানে, দৃষ্টিতে হীন এবং সঙ্কীর্ণ, তাদের কাছে জ্ঞানীর মতো দৃষ্টি মানুষের মনে শোক সৃষ্টি করে। জ্ঞান ও সত্যের স্বাধীনতা চাই, সম্মান চাই। মানুষ কি কখনও অমানুষের জুতা বহন করতে পারে? কখনও না–তার আগে তার মৃত্যুই ভালো।
ক্ষমতা অধিকারের যোগ্য কে? যে জ্ঞানী, যে মানুষ, যে সাধু, যে ঈশ্বরের পতাকা বহন করে। প্রতাপের রাজা কে?–যে ঈশ্বরের পতাকা বহন করে। জগতের ধন-সম্পদের অধিকারী কে হবে? যে ঈশ্বরের শক্তিতে বলবান, সেই। হিন্দু-চিন্তার সর্বশ্রেষ্ঠ নমস্য চিত্র মা আদ্যাশক্তির দুই কন্যা-লক্ষ্মী (ধনৈশ্বর্য) আর সরস্বতী (জ্ঞান)।
সর্ব দুঃখ সয়ে যাও, প্রভুর পতাকাই ধরে থাক; তথাপি অসত্যের কাছে, মিথ্যার কাছে। ভয় পেয়ে ধৈর্যহীন হয়ে পতাকা ফেলে দিয়ে পালিও না। সব দুঃখ সহ্য করে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা কর। জয়ের দিন আসবে। মহাজীবনের মহিমা জাগবে। এইভাবে তো মহিমার। জয় হয়।
.
০৩. মহামানুষ
নিজে মহামানুষ হতে ইচ্ছা করি নে। সে তো দুরাশা। এ যুগের মুসলমান সমাজের কাউকেও মহামানুষ হতে বলি না। কারণ তা অসম্ভব। শুধু মহাজীবনের অনুভূতিকে, মহাজীবনের হৃদয়তলে কোন চিন্তাধারা সদা জাগ্রত থাকে, মহাজীবনের স্বাদ কী, সেটুকু জানাতে ও জানতে চাই। যদি কোনোদিন কোনো যুবকের মনের সম্মুখে মহাজীবনের স্বর্গ দ্বার খুলে যায়, সেই দিন সে অজানিতের প্রেরণায় জাগবে, নামের জন্য নয়, কর্তব্যের আহ্বানে মহাচেতনা লাভ করে মহাকাজের আহ্বানে সে ছুটে চলবে। সে তো নিজের শক্তিতে হবে না, নিজের ইচ্ছাতেও না।