এক আমলা দরিদ্রের সন্তান–তার এক বিঘা জমি বলতে ছিল না। সে চাকরি পেয়ে জীবনে কঠিন পাপ ও অন্যায়ের সেবা করে বড় মানুষ হয়েছে। সেজন্য মানুষ তাকে প্রশংসাই করে, তার বুদ্ধির প্রশংসা করে–তা হলে তার পাপের জন্য শুধু সেই কি দায়ী?
আমাদের জাতির জীবন এবং মানসিকতা কদর্য হয়েছে। তাই মানুষের ব্যক্তিগত জীবনও কদর্য। জীবনের মহিমা কীসে হয়–একথা কেউ তাকে শোনায় নি। কার্যক্ষেত্রে মানুষের জীবন মন্দ বলে সে জানতেও চায় না।
মহিমান্বিত জীবনের সমস্ত আদর্শের উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়। উচ্চ মহাজীবনের ধারণা মানুষ করতে শিখলে, জাতির চিন্তাধারা বদলাতে জাতির ভিতর মহৎ চরিত্রের আবির্ভাব হবে। মানুষ সবই জানে, সবই বুঝে, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার চাপে সে পশু, মূঢ় ও হীন হয়ে থাকে। কতদিন বাঙালি মুসলমান গৌরবময় জীবন সম্বন্ধে ধারণা করতে শিখবে? সমস্ত অন্তর দিয়ে জীবনে যা কিছু কদর্য ও হীন তাতে লজ্জা বোধ করবে? নিজের
শক্তিকে পশুর মতো নয়, মানুষের মতো ব্যবহার করবে? . জনৈক মূঢ় ভদ্রলোক আপন প্রাচীরবেষ্টিত বাগানে বসে আল্লাহর মহিমা অনুভব করছিলেন। এমন সময় জনৈক খ্রিষ্টান বাইরে থেকে প্রাচীর ডিঙিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। খ্রিষ্টান যুবক নতজানু হয়ে মূঢ় ভদ্রলোকের সম্মুখে পতিত হয়ে নিবেদন করল–মহাশয়, আমি বড়ই বিপদগ্রস্ত। যদিও আমি খ্রিষ্টান তবুও আমি আপনার ন্যায় মূঢ় মুসলমান আমীরের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করতে কিছুমাত্র সন্দেহ পোষণ করছি না। আমি আপনার আশ্রিত। আশ্রিতকে রক্ষা করে মহত্ত্বের পরিচয় দিন। আমি এইমাত্র জনৈক মুসলমান যুবককে হত্যা করেছি। আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে ধরে এখনই শক্তহস্তে অর্পণ করতে পারেন। ইচ্ছা করলে জীবন রক্ষা করতেও পারেন। আমার বাঁচবার কোনো উপায় ছিল না, সে জন্য আপনার এ বাগানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি।
মূঢ় ভদ্রলোক বলেন, তোমার কোনো ভয় নেই। যতক্ষণ আমি জীবিত আছি, ততক্ষণ তোমার শরীরে কেউ সামান্য আঘাতও করতে পারবে না। মুসলমানের দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতা সম্ভব নয়।
যুবক হৃষ্টচিত্তে এক গুপ্তঘরে আবদ্ধ রইল। ইত্যবসরে বাইরে কাঁদের ক্রন্দন ধ্বনি শোনা গেল। যুবককে সেই স্থানে নিরাপদে থাকতে বলে ভদ্রলোক সদর দরজায় এসে দেখলেন, যে যুবককে তিনি এইমাত্র আশ্রয় দিয়েছেন সে তারই একমাত্র যুবক পুত্রকে হত্যা করে এসেছে। ভদ্রলোকের ললাট শোকে মলিন হয়ে গেল, কিন্তু তিনি কাউকেও কিছু বললেন না। গভীর রাত্রিতে সেই জ্বলোক আশ্রিত যুবকের নিকট এসে বল্লেন,-বন্ধু তোমাকে আমি আমার আস্তাবলের সর্বাপেক্ষা বলবান অশ্বটি এবং একখানি তরবারি দিচ্ছি। যে যুবককে তুমি গত সন্ধ্যায় হত্যা করেছ, সে আমারই পুত্র। কী জানি, পিতার মন যদি দুর্বল হয়, এজন্য আত্মরক্ষার্থে তোমাকে অশ্ব ও তরবারি দিলাম। তুমি সত্বর এই স্থান হতে পলায়ন কর।
খ্রিষ্টান যুবক তনুহূর্তে তরবারিখানি নিয়ে সেই অশ্বপৃষ্ঠেই পলায়ন করল। এই মহত্ত্ব–এর কি তুলনা আছে? মানব-সমাজে এর মূল্য কত বেশি! এটা কি মহান আদর্শ! কতবড় মহাপ্রাণ এই মূঢ় ভদ্রলোকের। এই ক্ষমাশীলতা, এই ক্রোধসংযম, এই প্রেম–স্বর্গীয়। শত্রুর প্রতি এতদৃশ্য ব্যবহার কোনো মানুষের দ্বারা সম্ভব হয় কি?
মহিমায় জীবন-জগতে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতায় মানব হৃদয়ে বিস্ময় ও আনন্দ উৎপাদন করে।
একদা জনৈক সেনাপতি তার সৈন্যগণের রসদ সংগ্রহের জন্য এক পল্লীতে এসে এক কৃষকের দরজায় আঘাত করলেন। কৃষক দরজা খুলে দেখল, সেনাপতি তার দুয়ারে দণ্ডায়মান। কৃষক সেনাপতিকে আসন গ্রহণ করতে বলে তার এতদৃশ আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। সেনাপতি বল্লেন–হে কৃষক! আমার সৈন্যদের খাবার ফুরিয়ে গেছে। কোনো ভালো শস্যের ক্ষেত দেখিয়ে দাও আমাকে। ক্ষেতের শস্য আমরা কেটে নেব।
বলাবাহুল্য সৈন্যরা যে সব খাদ্য সংগ্রহ করে, তা জোর করেই নেয়। সেজন্য মালিককে কোনো দাম তারা দেয় না। জাতির মহাবিপদকালে নাকি বিনামূল্যে লুট করে নিলে কোনো দোষ হয় না।
বৃদ্ধ কৃষক বল্লেন–”আসুন আমার সঙ্গে” এই কথা বলে কৃষক সেনাপতি আর তার সৈন্যগণকে নিয়ে এক মাঠের ভিতর দিয়ে চলতে লাগলেন। পথে বহু উত্তম শস্যের ক্ষেত। দেখা গেল কিন্তু কৃষক সেসব ক্ষেত উপেক্ষা করে দূরে একখানি উত্তম শস্যের ক্ষেত দেখিয়ে বল্লেন; এই ক্ষেত থেকে আপনার শস্য সংগ্রহ করুন। সেনাপতি সেই ক্ষেত থেকে সমস্ত ফসল কেটে নিতে আপন সৈন্যগণকে আদেশ দিলেন। তারা কৃষককে জিজ্ঞেস করলেন–এর আগেও কয়েকখানি উত্তম শস্যের ক্ষেত দেখলাম। সেগুলি বাদ দিয়ে তুমি এ পর্যন্ত আমাদিগকে ডেকে আনলে কেন? কৃষক বলেন, সেনাপতি, সেগুলো আমার নিজের ক্ষেত নয়, এইটা আমার নিজের ক্ষেত।
সেনাপতি কৃষকের মনুষ্যত্বে চমৎকৃত হয়ে তাকে প্রেমালিঙ্গন দিলেন। বল্লেন, যে দেশে এমন মহানুভব কৃষক বাস করেন, তাদের পরাজয় কখনও হবে না। মনুষ্য জীবনের এইসব মহত্ত্বপূর্ণ পরিচয় বাস্তবিকই প্রাণকে মুগ্ধ ও আনন্দিত করে। মানুষ সাধারণত নীচ, নিজের কাজের চিন্তায় সে বেশি পাগল। যখন সে পরের কথা ভাবে অপরের সুখের পথে সে আঘাত করে না, তখন সে দেবতা।
আমি আশা করি, মনুষ্যত্ব জয়যুক্ত হোক। মানুষের মনে উন্নত মহাজীবনের প্রতি শ্রদ্ধা জাগুক। সে নিজের এবং পরের হীনতাকে ঘৃণা করতে শিখুক। মানুষ যেন তার নির্মম পেষণে দুঃখ পেয়ে খোদাতালার কাছে ফরিয়াদ না জানায়।