বুঝুক, আমি বুঝেছি। তুমি পাপ, মিথ্যা অন্ধকার নও। তুমি আনন্দ, শান্তি সত্যময়, নির্মল নিপ সত্তা। তুমি মানুষকে তার স্বরচিত অসীম দুঃখ হতে রক্ষা করতে চাও। তোমার রাজ্যে দুঃখ নেই, তাপ নেই, জ্বালা নেই, কুৎসিত নেই। তুমি মানব-সন্তানকে প্রেমের আহ্বান জানিয়েছ। মানুষ তোমার কাছে না এসে অনন্ত দুঃখ ও জ্বালার পথে ছুটেছে। মানুষের দুর্গতিতে, হে প্রভু, তুমি পথে পথে কেঁদেছ–আকাশের বারিধারায় তোমার হৃদয়ে বেদনা উছলে উঠেছে। সারা রাতের শিশিরপাতে তোমার বেদনা অশ্রু ঝরেছে। হায়! বাঁশি বেজেছে তোমারই প্রেম ও মমতার গান গেয়ে। ওগো জননী! নরনারী যখন তোমাকে ভুলে বিপথে ছুটে চলল, যখন মানুষ তোমার মেঘে মেঘে ঝঞ্ঝা-ব্যাকুল সমুদ্রতরঙ্গের ভৈরব শাসন-গর্জনকে উপেক্ষা করে পাপ করল, হায় হায় দুঃখে তখন তুমি কাঁদলে। সে কাঁদন অনন্ত কালেও শেষ হবে না। ওরে মানুষ ওরে অবোধ প্রভুর ভুবন ভোলানো প্রেমের আহ্বান আসছে চিত্তে। জাগ, ওরে মন জাগ। ডাক এসেছে, বিলম্ব করো না। শয়তানের ছলনায় পড়ে পথহারা হয়ো না। প্রভুর পথ ভুলো না। ধন্য সেই, যে তোমাতে মহিমান্বিত হয়। ধন্য সেই–যে তোমার গৌরবে গৌরব বোধ করে, যে দিবাকর প্রতি কাজে তোমার গৌরব রক্ষা করে, তোমার ইচ্ছা পালন করে, যে মানুষকে কোনো রকমে তুচ্ছ ও রূঢ় ব্যবহারে বেদনা, দেয় না, যে তোমার পতাকা ধারণ করে, যে তোমাতে মহৎ ও মহিমান্বিত।
কোন্ পাগল তোমাকে বর্জন করে নিজের বলে অর্থ ও জগতের প্রতাপে জীবনে মহিমার অন্বেষণ করছে?
যে মাথা তোমার কাছে নত করেছি, তা যেন মিথ্যা ও অন্যায়ের কাছে নত না হয়। আমার রক্ত-মাংসের মাথা নয়, আমার মাংসের শরীর নয়, আমার হৃদয় তোমাকে দিয়েছি। যে হৃদয় তোমার আসন হল, তাতে শয়তান কী প্রকারে কর্তৃত্ব করবে? অসত্য, অন্ধকার ও অন্যায়ের সাথে মুসলমানদের চিরজীবনের যুদ্ধ। আমি কি তোমাকে ভুলে জীবিকার জন্য মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করব? শয়তানি ও নিষিদ্ধ (হারামি) পথের পথিক হব? তবে আর কী নামাজ পড়লাম? জীবনভরই কি তোমার সাথে আমার প্রতারণা চলবে? আমার ভূমিষ্ঠ হবার কালে যে মহাগান তোমার ভক্তেরা আমায় শুনিয়েছে–সেই মহা আল্লাহে আকবার ধ্বনি (আল্লাই শ্রেষ্ঠ সত্য ও ন্যায়ই শ্রেষ্ঠ) আমি ভুলি নি। আমি তোমাকে জীবন ভরে সেজদা করলাম। যেন জীবনে, প্রতিদিনকার জীবনে, কার্যক্ষেত্রে মানুষের সাথে ব্যবহারে শয়তানের কাছে মাথা নত না করি।
হায় পৃথিবীতে কত মানুষ পথহারা হয়েছে। তাদের উদ্ধারের জন্য আমি কী করেছি? তোমার সমাচার আমি কারো কাছে বহন করি নি-ব্যর্থ আমার জীবন। শুধু নিজের মুক্তির জন্যই কেঁদেছি। কত পৌত্তলিক, কত পাপী, কত মানুষ মহাপাপে বিনাশের পথে চলেছে, তাদের জন্য আমি কিছুই করলাম না। শুধু আত্মসুখেই তৃপ্ত রইলাম, শুধু নিজেকে বাঁচাবার জন্যই ব্যস্ত রইলাম। প্রভু, আমাকে জ্ঞান দাও, শক্তি দাও, স্বাস্থ্য দাও, যৌবন দাও, রূপ দাও, ঐশ্বর্য দাও, যেন তোমার পথে যুদ্ধ করবার যোগ্য হই। আমাকে সিংহের বিক্রম দাও, যেন তোমার শত্রু যারা, তাদের হৃদয়ের রক্তপান করতে পারি। আমায় ঘৃণা দাও, যেন অধৰ্মচারী দুবৃত্তদেরকে আন্তরিক ঘৃণা করতে পারি, আমায় লজ্জা দাও, যেন পাপের পথে লজ্জা বোধ করি, আমায় আত্মমর্যাদা জ্ঞান দাও, যেন কোনোরূপে জীবনের অগৌরব না করি, আমায় সংযম দাও, যেন লোভে পড়ে পাপের পথে না হাঁটি। মিথ্যা সেবার জন্য কোমরে সোনা ও রূপা ধারণ করে আমি অপেক্ষায় দাঁড়াব না, স্বাধীন কৃষক হয়ে আমি বৈধ অন্ন খাব, পর্ণকুটিরে বাস করব, নিজ হস্তে বস্ত্র বয়ন করব, তথাপি চাকচিক্যময় পাপেভরা জীবনে মিথ্যা পদলেহন করব না। আমার ও আমার মুসলিম ভ্রাতার প্রাণে প্রেম দাও, যেন আমরা পরস্পরকে রোগে-শোকে, দুঃখে-বেদনায়, অভাব-দৈন্যে প্রেম ও সেবা করতে পারি। আমাদেরকে ঐশ্বর্য দাও, মুসলমানকে হতভাগ্য গরিব করো না, যেন দরিদ্র ভ্রাতার সেবার জন্য প্রচুর দান করতে পারি। ধিক, ধিক সেই জীবনে, যে জীবন তোমার গৌরব আকাক্ষা করে না, যে জীবনের একটি দিনও তোমাকে বর্জন করে চলে, তোমাকে ভুলে থাকে, অত্যাচারীকে আন্তরিকভাবে ঘৃণা কর, সেখানে মিথ্যা ও অত্যাচার সম্মানিত হয়, ওরে অবোধ উপাসকের দল, তোমরা কী জান, সেখানে তোমাদের নামাজ সিদ্ধ হয় না। বন্ধুদের সাথে মিশে সারাদিন হেসে-খেলে সারাটা দিনই চলে গেল, একটিবারও প্রভুর কথা তোমার মনে হল না। নিজের ক্ষমতার বড়াই তোমার মনে খুব বেশি। যে মানুষের জীবন, যে জাতির জীবন ঈশ্বরবর্জিত, তারা জগতে কোন্ কাজ করতে সক্ষম? তারা জগতে কখনও শক্তির উত্তরাধিকারি হবে না, কখনও তারা মহিমান্বিত হবে না।
জীবনে ঈশ্বরের বশ্যতা চাই–ঈশ্বরের বশ্যতার অর্থ সত্য, ন্যায়, জ্ঞানের বশ্যতা। এজন্য আলখেল্লা ধারণ করবার দরকার নেই। তিলক কেটে সন্ন্যাসী সাজবারও প্রয়োজন নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়ানো মুসলমান ধর্মের আদর্শ নয়।
সংসারে সংসারী সাজ কর নিত্য নিজ কাজ
ভবের উন্নতি যাতে হয়।
এই হচ্ছে ইসলামের আদর্শ।
মহিমান্বিত জীবনের আদর্শ কী–তার নমুনা দুই-একটি মাত্র এখানে দিচ্ছি। মানুষ নিজ থেকেই বুঝতে পারে অমানুষের স্বরূপ কী, জীবনে অপবিত্রতা কী, কদর্য জীবন কী? জেনেশুনেও মানুষ জীবনে মন্দ হয়। হয়তো সমস্ত সমাজের মন অপবিত্র ও পতিত, তাই মানুষ কদর্য জীবন বরণ করতে লজ্জাবোধ করে না। ঈশ্বরের কাছে কিন্তু মানুষের পাগ সমানভাবে সমাজকে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। কারণ মানুষ তাদের পাপের জন্য শুধু নিজেই দায়ী নয়। বেশ্যাকে যদি মানব সমাজ না চাইত, তবে কি নারী এই মহাপাপের পথে হাঁটত? নারী দেখে এই পথে ধিক্কার নেই, অভাব নেই, লজ্জা নেই, মানুষ তাকে এইভাবে চায়। তা হলে তার আর একার দোষ কী? বেশ্যা জীবনের লজ্জা তাকে অন্তজ্বালা দেবে কেন? সে তত বেশ থাকে!