যে দরিদ্রকে কৌশলে ফেলে তার কাছ থেকে অর্থ কেড়ে নেয়, যে ডাক্তার হাসপাতালের গরিব রোগীর কাছ থেকে টাকা না পেলে তাকে ভালো করে চিকিৎসা করে না, যে উকিল বা আমলা বিচারপ্রার্থী মানুষের অর্থ ছলনা করে গ্রাস করে, যে নিত্য মানুষের অমঙ্গল ইচ্ছা করে, যে স্বার্থের জন্য মানুষকে নমস্কার করে, যে আপনার ক্ষমতার দাবিতে দরিদ্রের নমস্কার কামনা করে, ধিক তাকে!
আমি বলি তার কোনো ধর্ম নেই। সে দাড়ি ফেলুক আর না-ই ফেলুক তাতে কী আসে যায়! সে বাঙালি বা আরবি নাম রাখুক তাতেই-বা কী আসে যায়! তার কোনো ধর্ম নেই। তার কোনো ঈশ্বর নেই। তার রোজা-নামাজ দেখে আমি ভুলি না, তার পূজা-অর্চনা, তার বর্বর যুগের ধর্মশালা দেখে আমি সুখী হই না।
মানুষ নিজেকে কতটুকু ঈশ্বরের করতে পেরেছে–প্রতিদিন কার জীবনে, মানুষের সঙ্গে প্রতি কাজে ও ব্যবহারে ঈশ্বরের কতটুকু ইচ্ছা সে পালন করতে পেরেছে–আমি তাই জানতে চাই।
তোমরা কাফের আর কাফেরের মুখ দেখেছ কি? তোমরা মানুষের চোখে-মুখে তার প্রাণের ছবি দেখেছ কি? আমি দেখেছি। ও সেই দুরাত্মার, দানবের সৃষ্টি আমার বুকে ঘৃণার আগুন জ্বলেছে–আমি নিত্য প্রভাতে তার ধ্বংস কামনা করেছি। সেই চির-আবুজেহেল কোন দাবিতে জগতে বেঁচে আছে?
সেই দুৰ্বত্তের জীবনে সত্যের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই। সেই দুবৃত্ত কাফেরের স্পর্শিত পানি খেলেই মানুষের জাত যায়। সে মানুষের পাকঘরে উপস্থিত হলে গৃহস্থের সমস্ত খাদ্য নষ্ট হয়।
সেই কাফের মিথ্যা কথা বলতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করে না। তার চোখে দানবের ভীষণতা সদাই লেগে থাকে। তার দাড়িভরা মুখে পিশাচের কলঙ্ক কালিমা সদাই প্রতিভাত হতে থাকে।
সেই শয়তানের বুকে কখনও অনুতাপ জাগে না। পাষাণ গলে, তার হৃদয় গলে না। আল্লাহর মন্দিরে প্রবেশ করলে আল্লাহর ঘর তাকে দেখে ভয়ে শিউরে ওঠে।
.
০২. মহিমান্বিত জীবন
এই বিশ্বের যারা কল্যাণ কামনা করে, ঈশ্বরের রাজ্য ও মহিমা বিস্তারের জন্যে নিজের যাবতীয় শক্তি, অর্থ ও জ্ঞান উৎসর্গ করে–তাদেরই জীবন মহিমান্বিত। জেলখানায় দেখতে পাই, অপরাধী দুবৃত্তের প্রতি মানুষ কত হিংসা পোষণ করে। মধ্যযুগে ইউরোপে কয়েদিদের ওপর যে ভীষণ অত্যাচার হতো, তা চিন্তা করতে আমরা ভয় পাই। যে খ্রিস্টান জগতে প্রেমের ধর্ম প্রচার করে, তাদের ভিতর মানুষের প্রতি মানুষের এই নির্মম ব্যবহার। নিতান্তই আশ্চর্য বলে মনে হয়।
মানুষ কি এখনও বোঝে নি, মানুষের ধর্ম কী? মানুষের ঈশ্বর মানুষের কাছে কী চান? স্বার্থান্ধের স্বার্থ-বাসনা জড়িত উপাসনা ও তোষামোদ ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন নেই। মানব সংসারের কল্যাণ কামনা ত্যাগ করে যারা নিরন্তর ঈশ্বর উপাসনায় ব্যস্ত থাকে, তারা। নিকৃষ্ট শ্রেণীর জীব। হৃদয়কে প্রেম উদ্বুদ্ধ করবার জন্যেই, আত্মার মহাজ্ঞানের আশীর্বাদ লাভ করবার জন্যেই মানুষ ঈশ্বরের উপাসনা করবে। উপাসনার আর কোনো বড় সার্থকতা। নেই। জগতে জীবনের উন্নততর, মহিমান্বিত প্রেমের ব্যবহার ত্যাগ করে নিরন্তর উপাসনার। কোনো মূল্য নেই।
মানুষের প্রতি হিংসা বর্জন কর। মানুষকে ঈশ্বরের পথে, মঙ্গল ও কল্যাণের পথে, সুখ ও শান্তির জীবনে আহ্বান কর। গায়ের বল, অর্থসম্পদ, উচ্চ রাজপদের গর্ব ত্যাগ কর। তুমি কি জান না, ঈশ্বরের শান্তি মুহূর্তের মধ্যে তোমাকে দুর্বল ও শক্তিহীন করতে পারে?
জীবনে সুখ-সম্পদে, বলে-গৌরবে প্রতিষ্ঠিত হবার আকাঙ্ক্ষা তুমি কর?–যদি তোমার চিন্তায় মনুষ্য সমাজ, এই পৃথিবীর মঙ্গল তোমার গৌরব প্রতিষ্ঠার কোনো মূল্য নেই। তুমি কি পশুদের রাজা সিংহের প্রতাপ লাভ করতে চাও? তুমি কি উচ্চতরের পশু হতে চাও?
না–না–ঈশ্বর তোমার কাছে সে আশা করেন না। তিনি গভীর রাতে, পীড়িতের আর্তকণ্ঠে তোমাকে ডেকেছেন পৃথিবীর সেবায়, ব্যাধিগ্রস্ত পীড়িত মৃতকল্প মানব সেবার কার্যে, পাপী, পতিত, দুঃখী নরনারীর উদ্ধারের জন্য।
জীবনের দান পেয়েছো কী জন্য? এর সার্থকতা কী? ঈশ্বরে তুমি মহিমান্বিত হও। ঈশ্বরকে বর্জন করে, সুখ-লালিত বিরাট বপুতে, সমুদ্রের গভীর রত্নভাণ্ডারে, চামচিৎকার অট্টালিকা বাসে, কুকুরের তৃপ্তিতে তুমি আত্মতৃপ্তি অনুসন্ধান করছো! মানুষের জীবনে ওতে তৃপ্তি নেই। মানুষ ঈশ্বরের অংশ–যে বেদনা ও অশ্রুর সৃষ্টি, সে দেবতা। সে পশু নয়, রক্তপিপাসু সিংহ নয়, জীবনহীন রত্নময় সমুদ্রগর্ভ নয়, তুচ্ছ চামচিকাও নয়, নিকৃষ্ট কুকুরও নয়। তার প্রার্থনা অতি মহান–সে তার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করে–ওগো মহারাজ! মানুষের জন্যে আমায় কাঁদতে দাও। মানব কল্যাণে আমায় চিন্তা করতে দাও। বিশ্বের পাপ ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে আমায় যুদ্ধ করতে দাও। তোমার রাজ্যে যেন অসত্য ও মিথ্যা জয়যুক্ত
হয়। যারা জগতে অশ্রু সৃষ্টি করে, যারা জগতে অন্ধকারের সংবর্ধনা করে, যারা সত্যের অপমানে লজ্জিত হয় না, তাদেরকে তুমি লজ্জিত কর। প্রভু আমার জাতিকে কাঙ্গাল করিও, তোমার বর্ণ ও গন্ধে আমাদের জীবন মহিমান্বিত কর। অত্যাচারীর বজ্ৰসৃষ্টিতে, অবিচারের নির্মম দণ্ডে, উদ্ধতের নির্লজ্জ দাম্ভিকতায়, মানুষের অবহেলায় যারা দগ্ধ হয়েছে, যারা অকালে শুকিয়ে গেছে তাদেরকে তুমি আশীর্বাদ কর। প্রভু! তুমি চিরকাল আছ, তোমার ধর্মও চিরকাল আছে। মানুষ যে নামেই তাকে অভিহিত করুক। তোমার ধর্ম কী? তা মানুষ