এজিদ বল্লেন–হোসেন একটুখানি বশ্যতা স্বীকার করলেই আমি তাকে মহাসম্মানে, সুখ ও সম্পদের আসনে বসাব। একটুখানি সে নত হোক।
ইমাম; নবী–দৌহিত্র ইমাম হোসেন সত্য ও ন্যায়ের মর্যাদা অস্বীকার করে জীবন, সম্পদ ও সম্মান চান নি। আপন জীবনের, আপন বংশের এবং আপন ভক্ত আত্মীয় বন্ধুগণের হৃদয়-রক্ত দিয়ে মরুভূমির প্রতি বালুকণাকে স্বর্গের পুষ্পগন্ধে সুরভিত করে তুলেছিলেন–জেনে-শুনে মৃত্যুর হলাহল অমৃত বোধে আকণ্ঠ পান করলেন। এই জীবন বলি, এই কোরবানিই তাঁর কাছে গৌরবের মৃত্যু। হায় মুসলমান জাতি তোমরা কারবালার মহামৃত্যুর মূল্য বুঝবে কি? কারবালার যুদ্ধে শুধু পুরুষ নয়–নারীও আপন হৃদয়-রক্ত দিয়ে ইমামের স্বাধীনতা বোধের পূজা করেছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শোণিতপণ অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পূজা শুধু পুরুষকে দিয়ে হবে না নারীও চাই। পতনের সুগভীর গুহায় পড়ে মুসলিম নারী সমাজের শক্তি না হয়ে তাকে টেনে অন্ধকারের অতল তলে নামাচ্ছে। স্বাধীনতার মহাপূজারী মহাবীর রাণার পরী স্বামীর পশ্চাৎ পথে পথে ঘুরেছেন। মহাজীবনের পরম ভক্ত এই মহিষী নারীর সম্মান জগতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দেবশিশুগুলো ঘাসের রুটি খেয়ে স্বাধীনতার উপাসক পিতার পশ্চাৎ পশ্চাৎ হাসি মুখে ছুটেছেন। এসব জীবনের গৌরব সাধারণ মানুষ কি আত্মায় অনুভব করতে পারে? ঈশ্বরের চরম স্পর্শ যারা আত্মার বেদিতে পেয়েছে তারাই জানেন স্বাধীনতার পূজা কেমন করে করতে হয়–ঈশ্বরের প্রকৃত কোরবানি কাকে বলে? বছর বছর মাংসের কাবাব খাওয়ার নাম কোরবানি নয়। জীবনের প্রতি কাজে প্রতিদিন প্রতিমূহুর্তে সর্বদুঃখ জয় করে সত্যের পূজা করে। এটাই মহামানুষের জীবনের চরম ও পরম উপাসনা।
রাণাকে এবং ইমামকে সে সময় অনেকেই বাতুল বলে উপহাস করেছিলেন আল্লাহর মহাদরবারে কিন্তু তাদের নাম সর্বোচ্চ স্তরে লিখিত হচ্ছিল। তাদের জীবনের দুঃখ বরণের এবং ত্যাগ স্বীকারের মূল্য প্রকৃত মানুষ ছাড়া কে আত্মায় অনুভব করতে পারে। উত্তর–কেউই না!
হোসেন মরণ বরণ করতেও সর্বত্র পূজিত। পৃথিবীর কোনো জাতির মধ্যে ইতিহাসের কোনো পৃষ্ঠায় অতীতে এবং বর্তমানে সত্য ও ন্যায়ের জন্য এমন স্বর্গীয় মরণ বরণের মহাদৃষ্টান্ত দেখা যায় না। আমরা কী এই মহাজনের অনুরাগী? রাণাপ্রতাপ পরাজিত হয়েও অনেক বিজয়ী সেনাপতির চাইতে শ্রেষ্ঠ, প্রতাপের মহাত্যাগের দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত বিরল। স্বাধীনতার পূজারী জগতের আর কে? যে জাতির মধ্যে এমন মানুষ জন্মেছেন, সে জাতি মানুষের সম্মান ও আত্মীয়তার যোগ্য।
.
১৪. মনুষ্য পূজা
মানুষ মানুষকে কত প্রেম করে ভাবতে গেলে আশ্চর্য হতে হয়। মহাজীবনের পশ্চাতে কতকগুলো ভক্ত-প্রাণ থাকে, যারা সর্ব অবস্থায় আপন ভক্তির দেবতাকে প্রেম করে ধন্য হন। হয়তো মহাজীবনের চাইতে এইসব ভক্তের মূল্য বেশি। এরাই আপন আপন শক্তি ও প্রেমের বলে মহাজীবনকে জয়যুক্ত করেন–যদিও জগৎ তাদের একজনকেও জানে না।
নেপোলিয়ন আপন সৈন্যদলের সম্মুখে বের হলে তাদের হৃদয় যেন এক প্রচণ্ড বিদ্যুৎ শিহরণে জেগে উঠত। প্রভুর পদশব্দের তালে তালে তাদের হৃদয়-রক্ত তরঙ্গিত হতো। তারা অন্ধআবেগে, আপন প্রভুর জন্যে প্রেমের মাদকতায় চেতনাশূন্য হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন দিত। এই অন্ধভক্তির প্রভাবে নেপোলিয়ান সারা ইউরোপের রাজা হয়েছিলেন। হুমায়ুন পথের ফকির হলেন–সিংহাসনচ্যুত নিঃস্বার্থ পথের ভিখারি ভারতের সম্রাট হুমায়ুনের পশ্চাতে তাঁর কতিপয় বিশ্বস্ত প্রেমিকভক্ত ছাড়া আর কেউ ছিল না। এই ভক্তের দল তাকে জয়যুক্ত করেছিল–বিপদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, নিরাশার বুকে আশা দিয়েছিল। যখন আরবের পৌত্তলিকেরা প্রভু মহাম্মদকে হত্যা করবার জন্যে তরবারি হস্তে পশ্চাতে পশ্চাতে ছুটেছিল, তখন তার সঙ্গে ছিল দুই ভক্ত, তাঁরা হলেন আলী ও আবুবকর। রসুলকে বাঁচান ছিল যাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ চিন্তা। নিজেদের জীবনের মায়া যাঁদের ছিল না। হলদী ঘাটের মহাযুদ্ধে রাণাপ্রতাপ মোগল হস্তে সাতটি আঘাত পেয়েছেন–তথাপি উন্নত অধীর আবেগে সমর উত্তেজনায় সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছেন। তার একান্ত ভক্তজনেরা তাকে অনেকবার শত্ৰুচক্রের ভিতর হতে পশ্চাতে টেনে এনেছেন। তথাপি তিনি শত্রু নিধনে জ্ঞানশূন্য। শেষবারে ঝাঁসীয়া রাজ আপন প্রাণ দিয়ে তাঁকে পতন হতে রক্ষা করলেন। ভক্তের এই জীবনদানের ফলে সেদিন প্রতাপ রক্ষা পেয়েছিলেন নইলে কিছুতেই রক্ষা পেতেন না।
পূজিত বীরের চাইতে তাঁর রক্তদানের জীবনের মূল্য কোনো অংশে কম নয়।
বীরকে জানা এবং তাঁকে সর্বপ্রকার প্রেম করা মহাজীবনের প্রকৃতি। ”মহামানুষ” ছাড়া মহাজীবন’ কে অনুভব করতে পারে।
.
১৫. মন্দতাকে ঘৃণা
যে যাবৎ না তোমাদের দেহের প্রতি শোণিতবিন্দু পাপকে ঘৃণা করতে শিখেছে, পাপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়েছে,… তাবৎ তোমাদিগকে ঈশ্বর পথের পথিক বলা যায় না। পাপ ও কুৎসিত যা, যা মন্দ তাকে ঘৃণা কর, আন্তরিকভাবে ঘৃণা কর। মন্দ জীবন যেন কখনও তোমাদের কাছে সম্মানিত না হয়। যারা স্বাধীনতার উপাসক নয় যারা দায়িত্বহীন শাসনতন্ত্রের চাকর, সত্যের উপাসক যারা নয় স্বাধীন জীবনকে যারা সম্মানের চোখে দেখে না–তাদেরকে সম্মান করো না–তাদের গৃহে যেয়ো না–তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা না।