জীবনহীনতার এই যে লক্ষণ–এ বড় সহজ বিষয় নয়। এই অহিফেন অবসাদ হয়তো তাকে একেবারেই ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। তার আস্ফালন ও গর্বের কোনো মূল্য নেই। জাতি হিসেবে জগতে তার অস্তিত্ব থাকবে না–থাকবে তার স্মৃতি, যেমন অতীতকালের ল্যাটিন ও গ্রিক জাতির কিংবা মুসলমান জাতি হবে জগতে গোলাম ও দাসের জাতি; কিংবা ইহুদিদের মতো–দেশহীন, জাতীয় সংঘবদ্ধতাবর্জিত জাতীয়তাবোধহীন জগতের পৃষ্ঠ হতে বিতাড়িত।
আল্লাহর শক্তি মানুষের ভিতর দিয়েই প্রকাশিত হয়। সেই ভাবময় জীবনময় সর্বশক্তির আধার সর্বকল্যাণের উৎস, আদি শক্তির তপস্যা কী? তার জীবন-মন্দিরে প্রবেশের পথ মুসলমানের জন্য রুদ্ধ হয়েছে। এ খুব নিরাশার কথা, কিন্তু খুব সত্য।
জীবনের কোনো কল্যাণকর বিষয়ে আমাদের তপস্যা নেই-তপস্যা আছে একটি জিনিসের দাসত্বের; পরপদ লেহনের, জাতিকে, সমাজকে, গ্রামকে, মানুষকে ভুলে আত্মসুখসর্বস্ব, পত্নী ও সন্তানসর্বস্ব জীবনের অনন্ত সম্ভাবনা বিস্মৃত চাকুরি জীবনের। ধি আমাদেরকে। বড়লোক হবার ব্যবসায়ে কৃতিত্ব লাভের, জাতির ভিতর মহাকাজ কারবার, পৃথিবী-বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হবার, কবি ও দার্শনিক হবার, বুজর্গ ফকির হবার কোনো তপস্যা আমাদের নেই।
অতৃপ্তির হলাহল আকণ্ঠ পান না করলে কী মনুষ্য জীবনের মঙ্গল যাত্রা শুরু হয়। কোনো অসন্তোষ, কোনো অতৃপ্তি আমাদের নেই। যা আছি ভালোই আছি, আল্লাহ্ ভালোই রেখেছেন, এই হচ্ছে প্রভুর কাছে আমাদের সুতৃপ্তির উপাসনা।
কত নর-নারী… হায়! জীবনে এদের কারো তীর্থযাত্রা নেই। যে যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
.
১২. তীর্থ-মঙ্গল
প্রত্যেক জাতিই চলেছে বিজয়-শখ বাজাতে বাজাতে সম্মুখে-আমরা সবাই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। শুধু স্বর্গের স্বপ্ন দেখছি। প্রত্যেক মঙ্গল অনুষ্ঠানই ঈশ্বরের পূজা। এ নতুন পূজায় আজ যে যোগ না দেবে সে পশ্চাতেই পড়ে রইবে। মানব-জাতির প্রভু আজ নতুন সাজ পরেছেন, তাঁর পূজাও আজ করতে হবে নতুন রকমে। জীবিতদের কাছে কথা বলে লাভ হয়। মৃতের কাছে জীবন-মন্ত্র পাঠ করলে কী লাভ?
মুসলমানকে তপস্যা করতে হবে। জীবনের সংকীর্ণ চিন্তা কর, মানুষ হও, যথার্থ মুসলিম জীবনের পরিচয় দাও। নিজেকে অমন করে অবমানিত করে ফেলো না। যৌবনের ঐ দানকে, রক্তচক্ষু বিস্তার করে, মানুষকে চূর্ণ করে, সুপ্তির সুখময় আবেশে, অবসাদে, আলস্যে, হাসি-তামাসায় দায়িত্বহীন গানে, বাদ্যে, আত্মকলহে, ক্ষুদ্র পরিবারে, সংকীর্ণচিত্ততায়, গ্রামবাসীর সঙ্গে বিবাদ করে, জমিদারির স্বপ্নে, গর্বে, মিথ্যায়, মানুষকে ফাঁকি দিয়ে ব্যর্থ করে দিও না। দোহাই তোমাদের। জীবনের এবং যৌবনের মহাসার্থকতা আছে। যৌবনের সুউচ্চ এবং সুউন্নত ব্যবহার কর–প্রভুর কাজে, প্রভুর পথে যৌবনের সমস্ত শক্তি উৎসর্গ কর। এই তো মুসলিম যুবকের কাজ।
কোন্ মা, কোন্ প্রভাতে জন্ম দিয়েছিলেন এক শিশুকে। সেদিন সমস্ত প্রকৃতি সেই শিশুর আগমন গানে পুলকিত হয়ে উঠেছিল। বাতাস সেই শিশুর জয়গানে আকাশ-পাতাল মুখরিত করেছিল। সেই দেবতার আশাবাদ একদিন বড় হয়ে জাতির মহামঙ্গল করবে। তার মহাজীবনের আশীর্বাদে জাতির মুক্তি এবং কল্যাণ হবে। তার মহাতপস্যা মহাব্রত উদ্যাপন না করে কখনও ভাঙ্গবে না। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সেই শিশু অনাগত মহাভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হবে, তার পর একদিন সে তার সাধনা নিয়ে মঙ্গলযাত্রা করবে। জীবনে তার কঠিন তপস্যা আরম্ভ হবে। শৈশবের সুমিষ্ট সরল হাসি খেলাধুলা ভুলে মহাচিন্তায় সে গভীর ও তন্ময় হয়ে উঠবে? সে তার জীবনের রক্ত দিয়ে জাতির জীবন সৌধ গড়ে তুলবে। তার হৃদয় হবে বিশাল, বাহু হবে গগন-বিস্তারী, বক্ষ হবে সাগরশোষী। ধন্য সেই শিশু আর ধন্য তার মা।
তপস্যা কঠিন বিষয়। কোনো জিনিসকে পাবার জন্য জীবনের নিরবচ্ছিন্ন সাধনার নাম তপস্যা। তপস্যা ব্যতীত মানব জীবনের কোনো মঙ্গল সাধিত হয়? তপস্বীর তপস্যার ফলে জগতের নরনারী অফুরন্ত কল্যাণ লাভ করে। তপস্যা মানবজীবনের ঈশ্বরের মহাস্থান।
পণ্ডিতেরা বলে থাকেন, চেষ্টার দ্বারা জগতের সমস্ত কাজই সম্ভব, শুধু কবি হওয়া সম্ভব নয়। ডিমসথেনিস নামক এক জগৎ-বিখ্যাত বাগ্মী গ্রিস দেশে এথেন্স নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার কণ্ঠস্বর সুপরিষ্কৃত এবং উচ্চ ছিল না–অতীতে এবং ভবিষ্যতে জগতে এরূপ দ্বিতীয় মহাবাগীর আবির্ভাব আর হয়তো হবে না। তিনি কঠোর তপস্যার দ্বারা, বহু বৎসর প্রান্তরে, নিবিড় অরণ্যে, সমুদ্র সৈকতে বক্তৃতা অভ্যাস করেন। তাঁর বাকশক্তি জগৎ সম্মুখে এক মহাবিস্ময়কর ব্যাপার।
তপস্যা অর্থ সাধারণ মানুষ মনে করে–নির্জন বাস এবং ঈশ্বর আরাধনা। মানব জীবনের যে কোনো গভীর, গূঢ় সত্য উদ্ধারের চেষ্টার নামই তপস্যা।
.
১৩. আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
যাদের হৃদয় অনুন্নত, তারা কি পথের ভিখারী রাণাপ্রতাপ এবং সর্বহারা ইমাম হোসেনের জীবনের মূল্য বুঝতে পারে? আজ তেরশত বৎসর ধরে মুসলিম জগতে কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধ মহররম উৎসব নামে সুসম্পন্ন হচ্ছে। বাঙালি মুসলমান সমাজ সেই মুসলিম জগতের একটি অংশ। তারা সবাই নবীর ভক্ত–নবীর নামে দরুদ পড়েন, ইমাম হোসেনের জন্য শোকাশ্রু ফেলেন, মহররমের রোজা করেন–কিন্তু সত্যি কি তারা মহামান্য প্রিয়তম ইমাম হোসেনের জীবনের মূল্য অনুভব করেছেন? কিছু না, কিছু না। যদি করতেন, তা হলে তারা স্বাধীনতার মূল্য বুঝতেন। রাণাপ্রতাপের ভাই মণিসিংহ সম্রাট আকবরের মন্ত্রী হয়ে কত সুখেই না জীবন কাটাচ্ছিলেন। অন্যদিকে মহাপ্রাণ প্রতাপ পাহাড়ে পাহাড়ে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঘাসের রুটি খেয়ে স্বাধীনতার গৌরব রক্ষা করেছেন। এই মহাপুরুষদ্বয়ের জীবনের মূল্য মুসলমান বোঝেন কি? বাঙালি মুসলমানের কাছে একটা সাব-ডেপুটির পদ কত আকাঙিক্ষত বস্তু। একটা দারোগার কাজ পাওয়া তার পক্ষে কতবড় ভাগ্যের কথা–মন্ত্রীত্ব পাওয়া তো দূরের কথা।