এক ব্যক্তিকে জানি, তাকে কোনোদিন কেউ আগে নমস্কার করতে পারত না–কিন্তু তার গোপন জীবন অতি কুৎসিত পাপে পূর্ণ ছিল অথচ নমস্কারের জোরে তিনি জীবনের সর্বস্তরে জয়ী হয়েছেন। এতে মনে হয়েছে, মানুষ মানুষের ভিতরের স্বভাবকে বিশ্লেষণ করে দেখতে যায় না। সে তোষামোদেই মোটের উপর তুষ্ট হয়। সেজন্য অতিরিক্ত নমস্কারে তুষ্ট হওয়া ভালো নয়, অতিরিক্ত নমস্কার করাও যেন ঠিক নয়।
এক যুদ্ধক্ষেত্রে জনৈক শত্রু (বোধ হয় ফরাশি) সেনাপতি ইংরেজের সুসজ্জিত কামান শ্রেণীর ভিতর এসে পড়েন। নিকটেই পাহাড়ের ধারে জঙ্গলের অন্তরালে যে সহস্র বন্দুকধারী সৈন্যদল অপেক্ষা করছে, এ তিনি বুঝতে পারেন নি। ইচ্ছা করলে, তখনই তাকে হত্যা করে ফেলা যেতো। কিন্তু শত্রু সেনাপতি ভদ্রতায় মাত্র একটা বন্দুকের শব্দ করে তার বিপদ সম্বন্ধে সজাগ করে দিলেন। ফরাশি সেনাপতি শত্রুর এই ভদ্রতার প্রত্যুত্তরে তৎক্ষণাৎ একটি অভিবাদন জানিয়ে মৃদু হেসে অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলেন। এই অভিবাদনটি তার পক্ষে তখন খুবই শোভন হয়েছিল।
এক বিচারপতি এক মহানুভব ব্যক্তির উপর অন্যায় করে জেনে-শুনে গুরুতর শাস্তির দণ্ড দিলেন। এই ব্যক্তি রাজাসনকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানিয়ে এই দণ্ড নত মাথায় গ্রহণ করে বিচারালয় ত্যাগ করলেন। এই অভিবাদনের মূল্য অনেক বেশি। বিনয়ে নত হওয়া মানুষের স্বভাব। মানুষ ঈশ্বরজাত–ঐশ্বরিকভাবে তাই সে নত হয়।
ঈশ্বর ছাড়া কোনো মানুষকে নমস্কার, প্রণাম বা অভিবাদন করা ইসলাম ধর্ম বিরুদ্ধ। একমাত্র ঈশ্বরই প্রণামের পাত্র। মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মর্যাদা ইসলাম এইভাবে রক্ষা করেছে। কিন্তু তবু মানুষ মানুষের সামনে মাথা নত করে মানুষকে মানুষ ঈশ্বর জ্ঞান করে। মোগল এবং মুসলমান বাদশাহকে মানুষ কি কুৎসিতভাবে সেজদা। করতো! যে মানুষ এইভাবে সম্মান লাভ করে এবং যে এইভাবে সম্মান করে উভয়েই পাপী। একবার মি. জুসেনকে কলকাতায় জিজ্ঞেস করেছিলাম; মি. জুসেন, আপনি আপনার রাজাকে সম্মান দেখানোর জন্যে তাঁর সামনে জানু পেতে বসে, তাকে নমস্কার করবেন, না তার সামনে করমর্দন করবেন? তিনি বল্লেন; আমি তাঁর সঙ্গে করমর্দন করবো।
প্রণাম–যে সর্বহারা রিক্ত, তার পক্ষে জানা বড় কষ্টকর। যে বড় সেই ছোট হতে পারে। যে ছোট তাঁর ছোট হওয়া শোভা পায় না। প্রণাম, অভিবাদন, নমস্কার এসব মনুষ্যসমাজ থেকে একেবারে তুলে দেওয়া ভালো। এরমধ্যে যেন পৌত্তলিকতা আছে। রাজা-প্রজা, পিতা-পুত্রে, স্বামী-স্ত্রীতে, ভ্রাতায়-ভ্রাতায়, বন্ধুতে-বন্ধুতে প্রতিবেশী প্রতিবেশীতে প্রণতি না হওয়াই ভালো, কারণ এর দ্বারা জগতে অনেক পাপ ঢাকা পড়ে মিথ্যা প্রতিষ্ঠা লাভ করে, মানুষের দাম্ভিকতাকে প্রশ্রয় দেয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের কথা ও ব্যবহারেই জানা যায় সে ভালো কি মন্দ। তার হৃদয়ে প্রেম আছে, না সে নিষ্ঠুর।
ইসলামের শান্তি সম্ভাষণ জিনিসটা খুবই ভালো। এতে কারো স্বাধীনতা নষ্ট হয় না, অথচ পরস্পরে প্রেমের ভাব বর্ধিত হয়। মানুষের জন্যে ঈশ্বরের কাছে কল্যাণ এবং শান্তি কামনা আরবি বাক্য ‘আচ্ছালামো আলায়কুমের অর্থ না বুঝার দরুনই বিদঘুঁটে লাগে। মাতৃভাষায় ওর অনুবাদ”শান্তি লাভ করুন–আপনার মঙ্গল হউক।”
১১-১৫. তপস্যা
১১. তপস্যা
কোনো অজ্ঞাত বিষয়কে জানবার ও পাবার জন্য আত্মার আন্তরিক সাধনার নাম তপস্যা। জগতের সমস্ত সুখ-সুবিধা ও সৃষ্টির পশ্চাতে মানুষের আন্তরিক বহু কালব্যাপী তপস্যা আছে। তপস্যা ছাড়া, সত্য উদ্ধারের সুকঠিন ব্রত ছাড়া, জগতের কোনো কল্যাণ-সাধন। সম্ভব নয়। তপস্যার আন্তরিকতা, তন্ময়তা, আত্মার সুগভীর সুকঠিন বেদনা ব্যাকুলতা চাই। নইলে লক্ষ্যে পৌঁছা যায় না। হয়তো এক জীবনে কিছু হয় না। জীবনের পর জীবনে অসীম ত্যাগ দুঃখ ও সহিষ্ণু অন্বেষণ শেষে জয়যুক্ত হয়। চিকিৎসাশাস্ত্র, ঘরবাড়ি নির্মাণ বিদ্যা, অঙ্কশাস্ত্র, জগতের প্রত্যেক কল্যাণপ্রসূ শাস্ত্র মানুষের বহুযুগের তপস্যার ফল। বিনা তপস্যায় কোনোকিছু লাভ হয় না। বহুঁকাল বিদ্যালাভের চেষ্টা ব্যতীত কেউ বিদ্বান হয় না। কোনো একটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্র তৈরি একদিনে হয় নি! রেলগাড়ি, তার, উড়োজাহাজ, গ্রামোফোন সৃষ্টি, এ-কি দুই একদিনে হয়েছে?
সুখময়, চিন্তাভাবনাহীন, অন্বেষণহীন, ব্যাকুলতা ও চেষ্টাহীন জীবনে কোনো কল্যাণ লাভ হয়? মুসলমানের মধ্যে বর্তমানে কোনো তপস্যা আছে কি? মুসলিম জাতির পক্ষে এশিয়ায় ও ইউরোপে রাজত্ব স্থাপন কি সহজে সম্ভব হয়েছিল? নানা শাস্ত্রে তাদের কৃতিত্ব কি বহু তপস্যার ফল নয়? সে তপস্যা কই আমাদের এখন? আত্মার দিক দিয়ে যেন আমরা মরে গেছি। জীবনের চিহ্ন মাত্র নেই। ধর্ম ব্যাপারটা যা নাকি একেবারেই আত্মার বিষয়, তা তো এখন হয়েছে শরীরের ও ওষ্ঠের ব্যায়াম মাত্র। আল্লাহকে পাবার তপস্যাই-বা আমাদের কই? জীবনের সর্ব পাপ লয় হয়ে ধীরে ধীরে উন্নততর আত্মিক অবস্থায় যাবার চেষ্টা আমাদের কই? মিথ্যা, মাদকতা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, লোভ প্রভৃতি পশু ভাবকে জয় করবার তপস্যা এসব জীবনের বড় কথা–তা তো আমাদের নেই। স্রোতের মুখে কাণ্ডারীহীন ভেলার মতো চলেছি ভেসে।