প্রার্থনা সবসময় স্বরচিত ও মাতৃভাষায় হওয়া উচিত। দু-একটি মাত্র আল্লাহর কালাম সমাজের ঐক্য রক্ষার জন্য প্রার্থনায় ব্যবহার কর, বাকি সমস্তই আপন আত্মার রচিত কথা হওয়া উচিত। আল্লাহর কালাম অর্থাৎ কোরান পুনঃপুনঃ বুঝে পাঠ করলেই আত্মার প্রার্থনাকালে ভাষা আপনা থেকেই আসবে। আল্লাহর গ্রন্থের রস গ্রহণ করে নিজের রক্ত মাংসের অংশ করে ফেল।
Bengal Educational Conference The All Indian Muslim League-এর মতো অবিলম্বে (আমাদের যখন কোনো আমীর নেই তখন জাতিকেই আমীরের আসন গ্রহণ করতে হবে) ধর্ম সম্বন্ধে কী আমাদের কর্তব্য তা নির্ধারণের জন্য পণ্ডিতমণ্ডলীকে নিয়ে একটা (Bengal Religious Conference) নামে সভা গঠিত হওয়া উচিত। দীর্ঘ লম্বা-চওড়া বিশ-তিরিশ রাকাত (দুই প্রণতিতে এক রাকাত) নামাজ বাদ দিয়ে ঈমামের (Priest) ধর্মভাব-উদ্দীপক, প্রেম ও ভক্তিধারবর্ধক দীর্ঘ বক্তৃতা (Sermon) হওয়া অতি আবশ্যক। প্রার্থনায় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হওয়া কোনোমতে অন্যায় নয়। প্রচলিত প্রার্থনার ভাষা গান ছাড়া আর কী? সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর বিশিষ্ট ব্যক্তিকেই ইমাম বলা হয়। .
প্রত্যেক মহাজীবনের অন্তরালে প্রার্থনা আছে। মোস্তফা-কামাল-পাশা নিজের বলে জাতীয় জীবনে একটা পরিবর্তন এনেছেন এরূপ মনে করা বড়ই ভুল, অথচ একটা মূল্যহীন বাঙালি মুসলমান তাকে অধার্মিক বলতে একটু দ্বিধাবোধ করে না। প্রার্থনা প্রত্যেক মহাজীবনের পশ্চাতে থেকে তার জীবনের সমস্ত শক্তির রস গোপনে সরবরাহ করে। বাইরের লোক তা অনুভব না করতে পারলেও একথা মিথ্যা নয়।
শুক্রবারে আমাদের সাপ্তাহিক উপাসনার দিন, প্রত্যেক দিন, প্রত্যেক মসজিদে অধীনস্থ অধিবাসীদের চাদা দ্বারা প্রতিপালিত সুশিক্ষিত একজন গ্রাজুয়েট ইমাম সমবেত ব্যক্তিগণকে যাতে ধর্মভাবে মুগ্ধ এবং প্রতি সপ্তাহে সকলের আত্মাকে উন্নততর করে গড়ে তুলতে পারেন, তার চেষ্টা করা একান্ত আবশ্যক। কেউ যেন উপাসনায় এসে না বলে–”তাড়াতাড়ি সেরে ফেলুন”। তার নাম কি উপাসনা? ছি!
.
১০. নমস্কার
আর নমস্কার করো না, জগতের অত্যাচার মানুষের মাথাকে চরম অপমান করেছে। মানুষকে সে দাবিয়ে রাখতে, ছোট করতে চেষ্টা করেছে। তাকে বুক দিয়ে ভালোবাসে নি–তাকে মাত্র শাসিয়েছে, ভয় দেখিয়েছে–প্রেমে কাছে ডাকে নি। তাকে ভ্রাতৃ সম্বোধন জানায় নি।
মানুষকে প্রেমে বুকের সঙ্গে বরং চেপে ধরতার হস্ত প্রেমে হৃদয়ের উপর রাখ। প্রেমের ছলনা কর না মিথ্যা নমস্কার করে; লজ্জায় ও ভয়ে, ঘৃণায় ও গোপন ক্রোধে। আত্মার সহজ নিঃসারিত শ্রদ্ধার নিবেদনের নাম নমস্কার। এ জিনিসটা বল প্রয়োগের দ্বারা বা অনিচ্ছায় হওয়া ভালো নয়।
মানুষের কাছে নত না হলে, নমস্কার না করলে মানুষ দাম্ভিক এবং বিদ্রোহী বলে সন্দেহ করে। সুতরাং সময় ও পাত্র বুঝে নমস্কার করা উচিত।
নমস্কারের দ্বারা অনেক পাপ ঢাকা পড়ে। কোনো কোনো দুরাচার নমস্কার করে জীবনের পাপ ঢেকে রাখে। তাদের দোষ পদস্থ লোকেরা তাদের তোষামোদ ও নমস্কারের মোহে ভুলে যান। এসব ক্ষেত্রে বুদ্ধিমান লোকদের খুব সাবধান হওয়া উচিত।
পরিবারের গুরুজনদের প্রতি ছোটদের শ্রদ্ধা নিবেদন ভালো। রাত্রিবেলা বিদায়কালে পরস্পরকে অভিবাদন জানিয়ে নেওয়া ভালো, তাতে পরস্পরের মধ্যে সদ্ভাব জাগে।
নমস্কার অর্থ আনুগত্য, বশ্যতা–কোনো অমিল ও বিদ্রোহের ভাব নয়। পুত্র পিতাকে, স্ত্রী স্বামীকে, পুত্রবধূ শাশুড়ী ও শ্বশুরকে, ছোট বড়কে সময় ও শোভনমতো অভিবাদন করা মন্দ নয়। বাড়াবাড়ি জিনিসটা ভালো নয়।
জীবনের পাপ ও অন্যায় ঢাকার জন্য যারা হরদম বিনয় প্রকাশ করে এবং নমস্কার করে, তাদের শ্রদ্ধা নিবেদনে সুখী হবে না, তাদের সম্বন্ধে সতর্ক থাকবে।
হাত উঠিয়ে বা মাথা নাড়া দিয়ে অভিবাদন জানান হয়–তার অর্থ মুখের শব্দ অনেক সময় ভিড়ের মাঝে গোলমালে শোনা যায় না। অভিবাদনের ভাষা বিদেশী হওয়া মোটেই শোভন নয়। ”আচ্ছালামো”–ইত্যাদির পরিবর্তে আপনার মঙ্গল হোক, আপনি শান্তিতে থাকুন বলা ভালো।
ভাষার প্রতি মোহ কিছুই নয়–ভাব ও আত্মার চাইতে দেহ বড় নয়। পদ চুম্বন জিনিসটা সভ্য-জগতের মধ্যে নেই। মানুষের ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতাকে অমর্যাদা করবার অর্থ ঈশ্বরের অপমান। অতি নিকটবর্তী গুরুজন যারা এবং সঙ্গে সঙ্গে সে পদলোভী বাজে লোক ও শুধু “শান্তি সম্ভাষণে” অর্থাৎ “আচ্ছালামো”…ইত্যাদি অভিবাদন বলে মনে করেন। সভ্যজাতির মধ্যে গুরুজন ও ভদ্রলোকদেরকে একই ধারায় সম্মান দেখান হয়–এর নানা রকম ধারা নেই।
সমাজে যা চলে আসছে বা চলছে তার পরিবর্তন সহজে সম্ভব নয়। তবে উচ্চস্তরের লোকেরা যা করেন, সাধারণ লোক তাই অনুসরণ করে।
মোটের ওপর মানুষের কাছে নত হওয়া, মানুষকে অভিবাদন করা, ভদ্রতা দেখান অতীতকালের উচ্চস্তরের লোকদের প্রকৃতি ছিল। দুষ্টের হাতে নমস্কারের অপব্যবহারে এর সার্থকতা সম্বন্ধে বর্তমানে মনে সন্দেহ জাগে।
অন্তরে ভাব নেই–প্রাণে শ্রদ্ধা নেই–বাইরে ভয় ও লজ্জাজনিত এরূপ নমস্কারের অভিনয় কখনও গ্রহণযোগ্য নয়। যোগ্য ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা না জানানোও ভালো নয়। হযরত নবী সম্বন্ধে বলা হয়েছে–তাকে কেউ কোনো দিন আগে নমস্কার করতে পারে নি।